যে বাড়িটি নেচে যায় প্রাগ শহরেতে

নিরুপম চক্রবর্তী

 

বহুবার ভাবিয়াছি, হে পাঠক! রচিব কবিতা এক নৃত্যপটীয়সী এই অত্যাশ্চর্য গৃহটিকে ঘিরে। প্রাগ শহরেতে আমি বিচরণ করিতেছি আহা, তাহা বহুমাস ধরে। কতবার গেছি আমি কার্লোভো নমেস্তি নামে পরিচিত এক মেট্রো স্টপে। পাতালের গোলোকধাম রহস্যের লক্ষ্যভেদ শেষে অবশেষে আসিয়াছি এস্কালেটার লয়ে মুক্ত রাজপথে। সম্মুখে ভাল্তভা নদী। তীরে তার সেতু এক, আর তারই সন্নিকটে নাচিতেছে প্রাগ শহরের এই সুলক্ষণা ডান্সিং হাউস। হে পাঠক! গ্লোবাল ট্যুরিস্ট তুমি, কখনও কি তোমাকেও দেখিয়াছি আমি ওই স্থানে? তুমি কি আমারই মতো লিপ্ত ছিলে সে নৃত্যের অবরুদ্ধ রহস্যের শিকড় সন্ধানে? সেখানে কবিতা জাগে। জীবনানন্দিত মগ্ন স্বরে তোমাকে কি বলিয়াছে পথযাত্রী কেহ এক ‘নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের’? আত্মমগ্ন তুমি বুঝি ভাবিয়াছ ভাল্তভা নদীতে আজি সে বুঝি ভাসায়ে ভেলা, ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো’ আসিয়াছে নেচে যেতে প্রাগ নগরীতে, অজানিত ইন্দ্রের সভায়। তার নাম বেহুলা কি? এ কথা কদাপি তাকে জিজ্ঞাসা কি করিয়াছ, হে পাঠক! ভ্রমণপিপাসু ওহে প্রমত্ত পাঠক?

আমাকে সে বলে নাই কিছু। প্রত্যুত্তরে নেচে গেছে শুধু নিরবধি। সূর্যোদয় থেকে বুঝি সূর্যাস্তের দিকে উড়ে যেতে বিপন্ন মক্ষিকা এক নিয়াছে আশ্রয় আজ তার নষ্টনীড়ে। এ দিবসে তাকে দেখি মৃত।

এসকলই দেখিয়াছ দিবালোকে, চর্মচক্ষে, হে পাঠক! হে আমার তন্নিষ্ঠ ট্যুরিস্ট। দিন অবসানে গেছ বিশ্রামের লাগি— দিবসের দৃশ্যাবলি ঘিরিয়াছে মসীকৃষ্ণ নিশি। উৎকীর্ণ পাঠক তুমি ক্রন্দনের মৃদুধ্বনি শুনিতে কি পাও? ঘুঙুর ছড়ায়ে আছে, নৃত্য বন্ধ, গৃহটি ক্রন্দন করে: বিহ্বল, ব্যাকুল। মৃত মক্ষী জেগে উঠে— প্রবল হিংস্রতা লয়ে দংশন করিতে থাকে গৃহটিকে বারংবার। হে পাঠক! আজি এই পৈশাচিক রাতে মক্ষীটি উড়িতে থাকে, বোমারু বিমান যথা: দ্যাখো তার অভিক্ষেপে ফিরিয়া আসিছে ওই বিশ্বযুদ্ধকাল বুঝি— ১৯৪৫ সালে এই গৃহ ধ্বংস হয়: বর্ষিত মার্কিন বোমা, অন্তরীক্ষে বোমারু বিমান, বায়ুসেনা ফিরিয়া যাইবে আজ এর ধ্বংস শেষে। হে পাঠক! কোনও এক কালরাত্রি জুড়ি নৃত্যপরা গৃহটির কান্না আমি শুনিয়াছি। তুমি শুনো নাই? আর কেহ শুনে নাই বুঝি?

আহা, দেখি রাত্রি শেষ। ট্রামের আওয়াজ শুনি। সুসজ্জিত মানুষেরা অফিসের পথে। ওই দ্যাখো, গৃহটি আবার নাচিতেছে! হে পাঠক! এইস্থানে, দিনেমানে এবার নিশ্চিন্তে চলে এসো।

 

গ্রীষ্মের সেস্টিনা প্রাগে

দীর্ঘদিন দ্যাখা নেই, কোনখানে ছিলে ত্রুবাদুর? কেন এলে এতদিন পরে?
দেখেছ কেমন যত্নে সাজিয়ে চলেছি আমি প্রাগ পঙক্তিমালা, আনন্দ সেস্টিনা
যাতে, এ গ্রীষ্মের প্রতিপল বেজে যায়, মুখরিত রাজপথগুলি, শহরেতে
মেতে ওঠে উচ্ছ্বল আনন্দনৃত্যে প্রজাপতিসম শিশুগুলি, ঘাসের সবুজে
মগ্ন এক যুবতীর গ্রীষ্ম-বাসে বিচ্ছুরিত কবিতার আলো, চূর্ণ কুন্তলেতে বয়
নিদাঘে কবোষ্ণ বায়ু; কিছুটা সে আনমনা, কে জানে নিজস্ব কোন স্বপ্নে স্থিত

রৌদ্রময় দীর্ঘ উষ্ণ দিনে। বুঝি সেই স্বপ্নটুকু কুড়িয়ে নিয়েই আজ স্থিত
ত্রুবাদুর এ শহরে তুমি। অবারিত সূর্যালোকে গেয়েছ সেস্টিনা তারপরে
ভরিয়েছ তীব্র বিষণ্ণতা, অথচ ভাল্তভা নদী কলস্রোতা, আনন্দেতে বয়
প্রাগ শহরেতে। তার আছে আঠারোটি সেতু, আর জলস্রোতে বেজেছে সেস্টিনা
সম্ভ্রান্ত রণনে আজ। অলৌকিক সবুজ মানুষ মিশে যায় অরণ্য সবুজে
অতঃপর। আর জীবন বন্দনা জাগে সূর্যালোকে অঙ্কুরিত প্রাগ শহরেতে

ত্রুবাদুর। দৃষ্টি পায় অন্ধ গায়কেরা, তোমার সেস্টিনা গায় প্রাগ শহরেতে
তারা, তোমার গানের সুরে আকাশ দেখেছে, তোমার সুরেতে যারা আজ স্থিত
এই অপার্থিব দিনে। জেগে ওঠে মৃত কবি, শহুরে টিলার দুরন্ত সবুজে
লিখে যায় এ সেস্টিনা বর্ণমালাহীন এক অচেনা ভাষায়। আর তার পরে
আনত মানুষ এক শুয়ে ছিল রাজপথে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে: তোমার সেস্টিনা
রাজার উষ্ণীষ এনে পরিয়েছে তাকে। প্রাগে আজ রাজদুর্গে উষ্ণ হওয়া বয়

সারাদিন। হতবাক রাজা চার্লস চেয়ে থাকে জনতার ভিড়ে, আজ হওয়া বয়
সেতুটিতে। হতবাক ক্রুশবিদ্ধ যীশু: এ কোন বিচিত্র গ্রীষ্ম প্রাগ শহরেতে
হে প্রভু আমার! ইহুদি কবর থেকে উঠে এসে কঙ্কালেরা শুনছে সেস্টিনা
আর তাদের কাঁধেতে চড়ে নাচে যীশু, এইদিন গ্রীষ্মের ম্যাজিকে বুঝি স্থিত
ছিলে, তুমি ত্রুবাদুর। কেন তুমি গান গাও মেঘমন্দ্র স্বরে, আর তার পরে
মিরাকল! মিরাকল! বলে পাদ্রী য়োসেফ তুফার: তার রক্ত ঘাসের সবুজে

ভেসে যায়। কম্যুনিস্ট পার্টি ভাঙে অতিকায় স্ট্যালিনের স্ট্যাচু, এখানে সবুজে
বিস্ফোরণ। লেট্না পার্কে মেট্রোনোম বাজে, বলে পাল্টেছে সময়, অন্য হওয়া বয়
এই দেশে। কোন গান গাই বলো, ত্রুবাদুর? সমুদ্রের স্বর যেন তার পরে
বাজে এই সিন্ধুহীন দেশে। নাবিকের বেশে ডাকে গ্রীষ্মমগ্ন এই শহরেতে
কৃষ্ণাঙ্গ যুবক এক। ক্রুসবোটে ট্যুরিস্টের ভিড়, নদীতে জাহাজগুলি স্থিত,
ভাসমান রেস্ট্যুরান্ট অথবা হোটেল বুঝি ভাল্তভা নদীতে। গাইব সেস্টিনা

ত্রুবাদুর তুমি, আমি, জগতের সবটুকু ভালবাসা নিয়ে গাইব সেস্টিনা
আজ এই নদীনীরে। সুবিশাল রামধনু নীলাকাশ থেকে, ঘাসের সবুজে
এসে মেশে। তোমার সেস্টিনা তাকে জাগ্রত করেছে ত্রুবাদুর। এ আনন্দে স্থিত
গানগুলি গেয়ে যাও, গেয়ে যাও তুমি। সমাহিত এই গ্রীষ্মে আনন্দ নগরে বয়
অলৌকিক বায়ু। উদ্ভাসিত মুখগুলি বাসে, ট্রামে, মেট্রো রেলে প্রাগ শহরেতে
গেয়ে যাও ত্রুবাদুর, এইসব মগ্নসুর। সেস্টিনা ফিরেছে সমে এর পরে।

গ্রীষ্মের আলেখ্য শেষ, রহস্যের স্বরে স্থিত তুমি, প্রজ্ঞাদীপ্ত সেস্টিনা গায়ক
ত্রুবাদুর। এরপরে কোন দেশে অন্যএক নিরালা সবুজে গেয়ে যাবে তুমি?
কোন হাওয়া বয় সেই দেশে, শেষ হলে শহরেতে নিরুপম প্রাগ শব্দাবলি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...