বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাস ও রাজনীতি

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাস ও রাজনীতি | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: উপন্যাসের পাঠঅভিজ্ঞতা

‘যে নাটকের রাজনীতি ভুল, তার সবটাই ভুল’ সম্ভবত উৎপল দত্তের নামে প্রচার আছে এমন সোজাসাপটা মন্তব্যের। আমরা ঠিক ততটা তীক্ষ্ম বাক্য প্রয়োগ না করলেও নির্দ্বিধায় বলতে চাই রাজনীতি-বিযুক্ত সাহিত্যের এক্সপায়ারি ডেট ছাড়া অন্য কোনও মূল্য নেই। অথচ, বাংলা উপন্যাস রচনার সময় বহু প্রথিতযশ ঔপ্যনাসিক রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে নির্মাণ করেছেন। সংখ্যায় তাঁরাই এখন অধিক। এই অসুখ শুরুতে ছিল না। প্যারীচাঁদ মিত্র বা কালীপ্রসন্ন সিংহ যে তাঁদের সমকালীন রাজনীতিকে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে ভাষা দিয়েছেন তা আমরা তাঁদের লেখায় স্পষ্ট দেখেছি। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিটি উপন্যাসই আক্ষরিক অর্থে রাজনৈতিক আখ্যান। রবীন্দ্রনাথের গোরা কিংবা ঘরে-বাইরে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত সার্থক উপন্যাসের নমুনা। শরৎচন্দ্রকে রাজনৈতিক উপন্যাস লেখার জন্য যে রাষ্ট্রীয় পীড়নের মধ্যে পড়তে হয়েছিল আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কোনও সাহিত্যিকের কপালে তা জোটেনি। তারাশঙ্কর কিংবা সতীনাথের রাজনীতি কারও কাছে অস্পষ্ট ছিল না। তাঁরা জাগরী কিংবা গণদেবতা রচনার সময় তাঁদের রাজনৈতিক বীক্ষাকে গোপন করেননি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের সময় মানিকবাবুকে টালিগঞ্জ রেল স্টেশনের কাছে কয়েকজন দাঙ্গাবাজ ‘কমিউনিস্ট’ বলে মারধর করে। পরবর্তীকালে ‘কংগ্রেসি’ বলে তারাশঙ্করের কপালেও এমন দুর্ভোগ জুটেছিল। কিন্তু তাঁরা তাঁদের মত বা পথ থেকে বিচ্যূত হননি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে দ্ব্যর্থহীন জানিয়ে ছিলেন:

মার্কসবাদই যখন মানবতাকে প্রকৃত অগ্রগতির সঠিক পথ বাতলাতে পারে, অতীত কী ছিল, বর্তমান কী হয়েছে এবং কীভাবে কোন‌্‌ ভবিষ্যত আসবে জানিয়ে দিতে পারে তখন মার্কসবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে সাহিত্য করতে গেলে এলোমেলো উল্টোপাল্টা অনেক কিছু তো ঘটবেই।[1]

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই স্পষ্ট করে সেদিন যারা মার্কসবাদকে তাঁদের উপন্যাসে উপজীব্য করেছিলেন, সেই গোপাল হালদার বা তাঁর পরিচয় পত্রিকার স্বজনেরা তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বিব্রত বোধ করেননি। তাঁদেরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অসীম রায় থেকে শৈবাল মিত্র, নবারুণ ভট্টাচার্য মার্কসবাদে আস্থা রেখে আজীবন সাহিত্যসেবা করেছেন। যদিও ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে ভারতের মার্কসবাদী দল তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল। সংশোধনবাদের তকমা তাঁদের পিঠে পড়েছিল। কিন্তু কৌতূহলের ব্যাপার হল, তাঁদের সাহিত্য কোনওদিন পার্টির ক্ষুদ্র মতার্দশে আটকে থাকেনি। দেবেশ রায় যেমন বিপ্লবের অসময়ে এমন ঘটে থাকে-র মতো রাজবন্দি নকশাল নেতাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ঠিক তেমন নকশালবাড়ি রাজনীতির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন অসীম রায়। আবার ওই একই ঋতুতে ময়দানে মনুমেন্টের নীচে জনসভায় দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জরুরি অবস্থার পক্ষে তাঁর বক্তব্য রেখে যথেষ্ট সমলোচিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির এই সংযোগ যেমন ছিল স্বাভাবিক, ঠিক তেমনই ঔপ্যনাসিকেরা তাঁদের রাজনৈতিক মত তাঁদের লেখায় স্পষ্ট করতে কুন্ঠিত ছিলেন না। সেই স্পেস ক্রমে-ক্রমে বাংলা উপন্যাস থেকে চলে গেল। বাংলা উপন্যাস হয়ে গেল রাজনীতিবিযুক্ত এক হাঁসজারু। কিন্তু কেন এমন হল?

নকশালবাড়ি রাজনীতির তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় পশ্চিমবংলার যেমন বহু প্রাচীন ঔপনিবেশিক স্বভাবধর্ম পালটে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই পার্টিজান রাজনীতির সূত্রপাত নকশালবাড়ি রাজনীতির সূত্রেই আমাদের পাওয়া। ১৯৭০ সালের শেষদিক থেকে যাঁরা প্রশ্ন ওঠাতেন, তাঁদেরকে ‘সংশোধনবাদী’ তকমা দিয়ে দেওয়া, শ্রেণিসংগ্রামের নামে ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির আমদানি এসব নকশাল রাজনীতির বিরাট বিচ্যূতি এ কথা বলা ভাল। আর এই খুনোখুনির রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কসবাদী দলগুলোই। ১৯৬২ সালের আগে যাঁরা একসঙ্গে জেল খেটেছেন, এক দশকের মধ্যে তাঁরাই হয়ে গেলেন পরস্পর পরস্পরের টার্গেট। এই অবিমৃষ্যকারিতার ফল ভোগ করতে হয়েছে পরবর্তী সময়ের বাংলা উপন্যাসকে।

১৯৭৭ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে বহুদলীয় নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় আসে। তাঁরা মুখে মার্কসবাদের চর্চা করলেও তাঁদের চর্যা ছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মতো। সংসদীয় গণতন্ত্রের অর্জুন–নিশানা ‘ক্ষমতা দখল’ ছিল তাঁদের একমাত্র বিপ্লব। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। ফলে গণিতের নিয়ম মেনে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে প্রায় বিরোধীশূন্য এক রাজনীতি কায়েম করেছিলেন সেদিনের পার্টিনেতৃত্ব। তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সব ক্ষেত্রে দলদাস তৈরি করে নিয়েছিলেন। বাংলা উপন্যাস তার থেকে আর আলাদা থাকে কী করে? সেদিন যাঁরা ‘চোখের মণির মতো বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করতে হবে’ স্লোগান তুলেছিলেন, তাঁরাই কৌশলে রাজনীতিহীন অন্তরসারশূন্য উপন্যাস রচনায় প্ররোচিত করেছেন তরুণ ও মেধাবী ঔপ্যনাসিকদের। কারণ তাঁরা চোখের ওপর দেখেছেন পার্টিতে প্রশ্ন করার অর্থ পার্টি থেকে বিতাড়ন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন রাজনৈতিকমনস্কতা মানে কি কোনও একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে ঝান্ডা ধরা? তার পক্ষে দাঁড়িয়ে উপন্যাসের নামে প্রোপাগান্ডা করা? দলদাস না হয়েও রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে যে উৎকৃষ্ট উপন্যাস রচনা করা যায় তার উদাহরণ খোদ রাশিয়ায় বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে হয়েছে। যারা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেসব সারস্বতসেবীরা পরবর্তীকালে এমন কী ঘটল যে দলদাসে পরিণত হলেন? প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর হয়তো আমাদের অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।

এখন এই সাধারণ অথচ জটিল প্রশ্নটার উত্তর আমরা সরাসরি খুঁজে নিতে চাইছি। ফলে আমাদের নোম চমস্কির The Responsibility of Intellectuals প্রবন্ধটির ক্ষুদ্রতম প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরতে হবে।

Intellectuals are in a position to expose the lies of governments, to analyze actions according to their causes and motives and often hidden intentions…. Western democracy provides the leisure, the facilities, and the training to seek the truth lying hidden behind the veil of distortion and misrepresentation, ideology, and class interest through which the events of current history are presented to us… It is the responsibility of intellectuals to speak the truth and to express the lie.[2]

চমস্কি পশ্চিমের মেধাজীবীদের কথা বলেছেন, কারণ তাঁর অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ। তবে কথাটা পৃথিবীর সব দেশের সব মেধাজীবীর ক্ষেত্রে খাটে। এখন উৎসাহের বিষয় হল চমস্কি এই প্রবন্ধে একটিবারের জন্যও কোনও রাজনৈতিক দল বা দর্শনের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচক হতে হলে কোনও দলের দাস হওয়া কিংবা কোনও ইজমের অনুবর্তী থাকার প্রয়োজন নেই। সামান্য রাজনৈতিক বীক্ষাটুকু থাকলেই হবে। অথচ, আমাদের বাংলা উপন্যাসের কারিগরদের চালু স্লোগান ‘রাজনীতি আমার বিষয় নয়’। এই স্লোগান প্রকৃত প্রস্তাবে শাসকের হাত শক্ত করে। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ঔপ্যনাসিকেরা সমাজের প্রিভিলেজড‌্‌ ক্লাশ। ফলে শাসকের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ বা বিচার করার ঝুঁকি তাঁরা নিতে চাইবেন কেন? যখন তাঁরা স্থির জানেন শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার অর্থ হাতের সামনে পাওয়া পুরস্কার হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া। বাণিজ্যিক পত্রিকার মালিক কিংবা মিডিয়ার সমবেত বয়কট। এসব ছাড়া পচা খালের, ঘোলা জলের মেছোরা বাঁচবেন কী করে? কিন্তু যাঁরা এইসব আপাত ধান্দাবাজির উলটো ফুটপাতে থাকতে চান তাঁদের জন্য কিছু সুখবর দেওয়া এখন আমাদের কর্তব্য।

আমরা এতদিন জেনে এসেছি চর্যাপদ হল বাংলাভাষার প্রথম লিখিত সাহিত্য। ভারতে ইসলামধর্ম প্রতিষ্ঠার আগে চর্যাপদগুলো লেখা হয়েছে। তখনও পূর্বভারতের রাজনৈতিক ভূগোল আধুনিক আকার পায়নি। চর্যাপদে ভাষার যে ব্যবহার আমরা দেখি, তার মধ্যে যেমন বাংলাভাষার আদিম নমুনা পাওয়া যায়, তেমনই অসমিয়া, ওড়িয়া এমনকী মগধের পূর্বদিকের হিন্দিভাষার প্রচুর নমুনা রয়েছে। চর্যাপদের পদকর্তারা সকলেই ছিলেন সহজযানি ধর্মগোষ্ঠীর মানুষ। তখন পূর্বভারতের রাজধর্ম হিন্দু। যাঁরা বহুকাল এই প্রদেশে বৌদ্ধদের কাছে ছিলেন সংখ্যালঘু। সেদিনের হিন্দু রাজারা তাঁদের রাজধর্ম অক্ষত রাখতে সমাজে প্রচলন করেছিলেন কৌলীন্য প্রথা। রাজা স্বয়ং তাঁর পরলোকের পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য দেব–দ্বিজের জন্য অপরিমিত অর্থ ব্যয় করেছেন। অন্যদিকে রাজার শাসনে দিশেহারা বৌদ্ধ ধর্মসংঘ, বিশেষত সহজযানি শিবির। এমন এক সঙ্কটের সময় চর্যাপদের রচনা যা গুপ্ত-সমিতির আদলে গড়ে ওঠে। শাসকের সাহিত্য, সংস্কৃত সাহিত্যের পাল্টা এক প্রতিরোধ। ইতিহাসের এই টুকরো অংশটার দিকে আমরা একবার মুখ ফেরালাম এই কথা বলার জন্য যে, শাসকের বিরুদ্ধে তর্জনী তোলার সাহস না থাকলে সাহিত্যের কোনও মর্যাদা থাকে না। ঠোঙা হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের চেয়েও নিম্নশ্রেণির আবর্জনা হিসাবে আগামী প্রজন্মের কাছে তা ত্যাজ্যবস্তু হিসাবে পরিণত হয়। আর যদি রাজনৈতিক বীক্ষা থাকে, তাহলে শাসকের শত চেষ্টাতেও তাকে নিঃশেষিত করা যায় না। কোথাও-না-কোথাও তার অবশেষ থেকে যায়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভ্রান্তির জন্য আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের কোনও ঐক্য তৈরি হয় না। আমরা যখন কোনও সমস্যার সমাধান করতে চাই, তখন কোনও একক রাজনৈতিক দর্শন আমাদের মধ্যে কাজ করে না। বরং জিনিসটার সমাধানের জন্য আমরা আমাদের সমর্থিত রাজনৈতিক দল কিংবা তার কোনও বিশিষ্ট নেতার বক্তব্য ধার করি। আবার কৌতুকের ব্যাপার এই যে, রাজনৈতিক সমর্থনও গড়ে ওঠে আমাদের পরিবার থেকে। আমরা পিতৃপুরুষের কাছ থেকে আর কিছু অর্জন করি কিংবা না করি, আমাদের রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সর্মথন গড়ে ওঠে আমাদের বাবাদের কাছ থেকে। অথচ, রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে আমাদের রাজনৈতিক দর্শন গড়ে উঠতে পারে। তার জন্য সব সময় ঝান্ডার দরকার হয় না। বিষয়টা একটু খোলসা করে বলা যাক।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেতেস যখন তাঁর কোনও দার্শনিক মত কিংবা বক্তব্য রাখতেন তখন তিনি প্রশ্ন আর প্রতিপ্রশ্নের মধ্যে দিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে এগোতেন। যখন তিনি তাঁর ছাত্র কিংবা সহযোগীদের কোনও আপাত নিরীহ প্রশ্ন করতেন, তখন সেই প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর হ্যাঁ-বাচক কিংবা না-বাচক কোনও একটা হত। সক্রেতেস সেই উত্তরটাকে সামনে রেখে আর একটা প্রশ্ন (এক্ষেত্রে প্রতিপ্রশ্ন) রাখতেন। তখন উত্তরদাতা যে উত্তর দিতেন সেটা স্বভাবতই প্রথম উত্তরের ঠিক উলটো হয়ে যেত। এটা সক্রেতেস ইচ্ছে করেই যে করতেন তা বলা বাহুল্য। আসলে তিনি কোনও সমস্যাকে একরৈখিক দৃষ্টিতে দেখতে চাইতেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল সমস্যাকে বহুকৌণিক দিক থেকে বিচার না করলে তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। সক্রেতেস এইসব আলোচনা করতেন সংলাপের মধ্যে দিয়ে। তেমনই একটি সংলাপনির্ভর সোক্রাতেস ডকট্রিন আমরা একটু দেখে নিতে চাই।

সোক্রাতেস সেফুলাসকে প্রশ্ন করছেন, What is justice? তার উত্তরে সেফুলাস বলছেন, Speaking the truth and paying the debts is justice. সেফুলাসের এমন বিচক্ষণ উত্তরের প্রতিপ্রশ্নে সোক্রাতেস বললেন:

Suppose that a friend when in his right mind has deposited arms with me and he asks for them when he is not in his right mind, ought I to give them back to him? No one would say that I ought or that I should be right in doing so, any more than they would say that I ought always to speak the truth to one who is in his condition.[3]

সেফুলাস উত্তর দিলেন, ‘You are quite right.’ তখন সোক্রাতেসীয় মোক্ষম উত্তর: ‘Speaking the truth and paying your debts is not correct definition of justice.’ পাঠক নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছেন আলোচনা এখানেই থেমে যাচ্ছে না। ‘জাস্টিস’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণে সোক্রাতেস ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখা অবধি চলে যাচ্ছেন। আর এভাবেই পেঁয়াজের খোসার মতো প্রশ্নের পরতে-পরতে যে সংঘাত লুকিয়ে থাকছে, তাকে টেনে বের করে সোক্রাতেস ‘জাস্টিস’ এই শব্দটার দার্শনিক উত্তরের কাছাকাছি পৌঁছাবেন।

আজকের যে গণরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশে চর্চিত হয়, এর আদিম রূপ ছিল সোক্রাতেসের সময়কার এথেন্স নগরে। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল অসুখটা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। সেই অসুখ বা গলদ এখনও ব্যবস্থাটার মধ্যে কেবল রয়ে যায়নি, বরং বিবর্তনবাদ মেনে আরও জটিলতা এসেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আমরা জানি সোক্রাতেসকে শাসকেরা বাগে আনতে পারেননি। তাই তাঁকে হেমলক বিষ পান করতে হয়। সোক্রাতেস নিজে কিছু লিখে রেখে যাননি। তাঁর কাজ ছিল ডানহাতের তর্জনী তুলে শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা। জানতে চাওয়া What is justice? পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য ছাত্ররা তাঁর দার্শনিক তত্ত্ব লিখিতভাবে ভাবী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন।

আমাদের সৃজনশীলতার গতি যেন স্লোগান কিংবা দার্শনিক কচকচানিতে রুদ্ধ না হয়ে যায়, সেদিকে আমাদের নজর থাকবে। আমরা জানি পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের আখ্যান যেমন কুবের মাঝির কখনও পড়া কিংবা জানার সৌভাগ্য হয়নি, ঠিক তেমন বোওকা বাবা কিংবা ফ্যাতাড়ুরা কোনওদিন খবর পায়নি তাদের নিয়েও কাহিনি রচিত হয়েছে। আমাদের উপন্যাসের পাঠক নিছক মধ্যবিত্তশ্রেণি। যারা কোনওদিন বিপ্লবে কিংবা বিক্ষোভে অংশ নেবে না। খুব বড়জোর এইসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু নির্বিষ প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে প্রতিবাদের ফুলকি ছেটানো মূলত এক ধরনের ধূর্ততা। এক ধরনের ফ্যাশন। রাষ্ট্রকর্তারা খুব জানেন এইসব চালিয়াতি। তাই তাঁরা ডোন্টকেয়ার ভাব দেখান। দেখাতে সাহস পান। সেই সাহসটা যে আমি-আপনি সরবরাহ করে থাকি সেই সমীকরণ আমাদের খেয়াল থাকে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের চেয়ে আলসেমির আর কীইবা থাকতে পারে? একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর দুই বা ততোধিক খারাপ মানুষের মধ্যে থেকে কোনও একজনকে বেছে নেওয়া। যাঁরা নির্বাচিত হন তাঁরা যেমন এই বাস্তবটা জানেন, যারা নির্বাচন করেন তাঁরাও জানেন। ফলে বাকি সময় নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটারদের আর কিস্যু করার থাকে না। একজন সৎ ঔপ্যনাসিকের দায়বদ্ধতা ঠিক এখানেই। এখানেই এসে পড়ে সাহিত্যের রাজনীতি। ইতিহাস সাক্ষী সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের মধ্যেই লেখা হয়ে থাকে দুনিয়ার কালজয়ী উপন্যাস। দুই বিশ্বযুদ্ধে মানবতার যত ক্ষতি হয়েছে, তার সাক্ষীসবুদ রয়েছে সেই সময় কিংবা অনুবর্তে লেখা উপন্যাসে।

সিভিলাইজেশনের প্রথম যুগে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা সবে তৈরি হল, তখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পৃথিবীর বুকে কেটে গেছে। রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র এমন বহু রাষ্ট্রব্যবস্থা পৃথিবীতে এই পাঁচ হাজার বছর ধরে টিকে আছে। আজ কোনও একটি ব্যবস্থা সেরা এমনটা কি বলা যায়? আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা জানি উত্তরটা সকল দেশের, সকল কালের, সব ব্যবস্থার জন্য এক। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থা মূলত এক। মুষ্টিমেয়র হাতে সংখ্যাগুরুর নিপীড়ন। বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র যে আসলে ছদ্ম একনায়কতন্ত্র, তার উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। ততটা ভয়াবহ না হলেও ‘জরুরি অবস্থা’র নামে প্রতিবাদী কণ্ঠকে এসমা, নাসা কালাকানুনের জোরে জেলে পুরে দেওয়া যায়। দিনের আলোয় বাকি দুনিয়াকে সাক্ষী রেখে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে মাটিতে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া যায়। বরানগর-কাশীপুরে গণহত্যা ঘটানো যায়। ক্যাডার বাহিনির হাতে পুলিশি রাইফেল তুলে ‘নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়’ ঘটানো যায়। ফলে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক মতবাদকে ফ্যাসিবাদের তকমা এঁটে দিলে তা একজন সৎ ঔপন্যাসিকের পক্ষে মারাত্মক ভ্রম হয়ে উঠবে। যতই শক্তশালী তাঁর কলমের জোর হোক না কেন, কালক্রমে তিনি কিংবা তাঁর সাহিত্য আর্বজনা ছাড়া আর কিছু মনে হবে না ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। ফলে ঔপন্যাসিককে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। গণতন্ত্রের ভেতরে বাস করে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েতব্যবস্থায় যে একনায়কতন্ত্র জেগে উঠেছে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। আর সেটা তাঁর সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়েই করতে হবে। আমাদের হাতের সামনে এমন বহু সার্থক উপন্যাস আছে যা রাজনীতির কথা বলে। রাজনৈতিক দর্শনের কথা বলে।

বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের বীজ লুকিয়ে ছিল জঁ জ্যাক রুশোর দর্শনতত্ত্বে। রাশিয়ায় বলশোভিক বিপ্লবের মূল উদ‌্‌গাতা কার্ল মার্কসের দর্শনসূত্র। একজন ঔপ্যনাসিকের কাজ সমাজকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বিশ্লেষণ করা। ভলতেয়রের সাহিত্য থেকে যেমন ফরাসি বিপ্লব গড়ে ওঠেনি। তেমনই তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কির লেখায় প্ররোচিত হয়ে বলশোভিক বিপ্লব ঘটেনি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বোমা-পিস্তলের ব্যবহারের জন্য, বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ পথ দেখায়নি। সেই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কেবল উদ্বুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের। সাহিত্যের সীমারেখা ঠিক এই পর্যন্ত। সমস্যার সমাধানে দায় কোনও ঔপ্যনাসিকের নয়। তিনি প্রশ্ন তুলবেন। রাজনৈতিক প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন যা অবহেলা করতে পারবেন না রাষ্ট্রনায়কেরা। অগ্রাহ্য করতে পারবেন না শাসকেরা। তাঁরা ফ্যাতাড়ুদের ভয় পাবেন। তাদের নিয়ে তৈরি সিনেমা সরকার পরিচালিত সিনেমা হলে দেখাতে দেবেন না। সেনসর করে দেবেন ‘ভবিষ্যতের ভূত’কে। কিন্তু শিল্পীকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। আজ পরিতাপের বিষয় সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা মেধাজীবীরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছেন শাসকের কাছে। তাই আজ আর শাসক তাদের নূন্যতম সম্মানটুকু দেন না। বাংলার সাম্প্রতিককালের বিকল্পধারা উপন্যাসে সংখ্যায় কম হলেও এমন দায় ও দায়িত্ব নিয়ে উঠে আসা ঔপন্যাসিকেরা খুব ব্যতিক্রমী নয়।

আজ যখন বিকল্পধারার কোনও ঔপ্যনাসিক ইতিহাসকে বিষয়বস্তু করে তাঁর উপন্যাস রচনা করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি কোনও রোমান্টিসিজমের জায়গা থেকে তাঁর বিষয়কে ভাবেননি। বরং ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণকে ব্যবহার করে তাঁর সমকালকে তিনি চিহ্নিত করতে চান। তাঁর পাঠককে সজাগ করতে চান। শ্রীচৈতন্যের সময়কাল কিংবা লক্ষ্মণসেনের শেষ সময় নির্বাচনে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার ছবি। যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাহিত্যিকদের স্পষ্ট ভূমিকা নিতে হয়। আজ হঠাৎ করে চারপাশে ফ্যাসিবাদের কথা বলা হচ্ছে। কোনও একটি দল কিংবা তার মতাদর্শে চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে যে এমন কথা বলা হচ্ছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ফ্যাসিজম কি এভাবে চিহ্নিত হয়? চিহ্নিত করা যায়? ফ্যাসিবাদের সুলুকসন্ধান খুঁজতে গেলে আরও গভীর সামাজিক দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখতে হবে। ফ্যাসিজম এক সংক্রামক রাজনৈতিক ব্যধি। যা আমারা প্রত্যেকে অবচেতনে বয়ে চলি। তা কখনও পরিবারের কর্তা হিসাবে। কখনও আবার অফিস বস‌্‌ হিসাবে। বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের সঙ্গে বাড়ির কর্ত্রীর যে সমীকরণ, রিকশাওলার সঙ্গে তার আরোহীর বচসার মধ্যে যে সমীকরণ, নামী আবাসনের সিকিউরিটি গার্ড কিংবা লিফট‌্‌ম্যানের সঙ্গে আবাসিকের যে সমীকরণ, তা অনেক সময় আমাদের অজান্তে ফ্যাসিস্ট হয়ে যায়। আমরা টের পাই না।

আমরা অনেক সময়ই সকলের করা কাজটাকে বলতে শুরু করি ‘আমার কাজ’। ব্যক্তিগত স্তর থেকে সামাজিক রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত এই ‘আমি’ তখন হয়ে ওঠে এক ঘোষণা-শব্দ, চিৎকার-শব্দ, যার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে অবারণ একটা জোর দিয়ে বলবার প্রতাপভঙ্গি। আর সেই চোরাপথে এগিয়ে আসে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।[4]

এমন সাবধানবাণী আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। যিনি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তাঁর ছিল না কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত। ‘সেটা ছিল বোধহয় ১৯৫৪ সালের এক ডিসেম্বর-সন্ধ্যা।’ যুব উৎসবে উপস্থিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আড়ালে সরে এসে শঙ্খ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শুনলাম তুমি পার্টি মেম্বারশিপ নেওয়ার কথা ভাবছ?’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই জিজ্ঞাসার পেছনে ছিল সাময়িক এক জনরব। সেদিনের তরুণ শঙ্খ ঘোষ স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, ‘না, কথাটা ঠিক সত্যি নয়। ও-রকম কোনও ভাবনা আমার নেই। ওটা আমি পেরে উঠব না।’ ফলত ১৯৫০ দশকে রাজনৈতিক দলের সাহচর্য থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারার মধ্যেই ছিল পরবর্তীকালে ‘তিমির বিষয়ে দু–টুকরো’র মতো বহু কবিতা।

তাঁর সেই কথার জের টেনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সেদিন শুধু সর্মথন করেননি। বরং নিজের দূরাবস্থার কথা (মনে রাখতে হবে ঘটনাটা ১৯৫০ দশকের, তখনও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না) বলে বলেছিলেন, পার্টির বাইরে থেকেই পার্টির হয়ে সবচেয়ে ভাল কাজ করা সম্ভব। এমন সিদ্ধান্ত যে শঙ্খ ঘোষ প্রথম নিয়েছিলেন তেমন তো নয়? সমর সেন প্রথম যৌবনেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে চাননি। অথচ মানুষটা নিঃসীম দারিদ্র্য নিয়েও ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার’-এর মতো আপাদমস্তক রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা চালিয়ে গেছেন। একদা কবি ও সংবাদিক পরবর্তীকালে নকশালবাড়ি রাজনীতির অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্ত তাঁর পার্টিকর্মীদের সমর সেনের দ্য ফ্রন্টিয়ার পড়তে মানা করে দিয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল এক বির্তকিত রাজনৈতিক ইতিহাস।

১৯৩৮ সালে কলকাতার আশুতোষ কলেজে প্রগতি লেখক সংঘ-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বুদ্ধদেব বসু মতামত রাখেন। সেখানে তিনি সাহিত্যের অবক্ষয় নিয়ে মূলত আলোচনা করেন। বুদ্ধদেবের ভাষণের প্রতিবাদে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে ‘অগ্রণী’ পত্রিকার প্রথম বছরের দ্বিতীয় সংখ্যায় সরোজ দত্ত ছিন্ন করো ছদ্মবেশ নামের একটি কড়া প্রবন্ধ লেখেন। সরোজ দত্তের এই আক্রমণের প্রতি-আক্রমণ ঘটল সমর সেনের প্রবন্ধ In Defence of the ‘Decadents’-এ। সমর সেন ব্যক্তিমানুষের সঙ্কট, অবক্ষয়ের সৎ-চিত্র রচনাকেই প্রগতিপন্থী সাহিত্য বলে মান্যতা দিয়ে লিখেছিলেন: ‘The eternal principles of art, he is told, are beauty and truth, truth and beauty, to deny which is bad taste, a perversion.’ তাঁর মতে যারা নিজেদের প্রগতিবাদী বলে ঘোষণা করছেন, তাঁরা মূলত—

…to write about mazdoors and kisans in a board, sentimental vein, to depict all the glories of the possible proletarian revolution and to do all these in a way which would be understood by the man in the street.[5]

নিজের যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়ে সমর সেন প্রায় বিচারকের রায় দিয়ে বলেন:

If the modern Bengali writer fails to make this difficult choice, we can take a leave of him and ask him not to mourn any longer for the decay of society but rather to mourn for himself.

এখান থেকেই শুরু হয় দুই সহপাঠী বন্ধুর মধ্যে প্রগতি-সাহিত্য বির্তক। সরোজ দত্ত বাংলার প্রথম কবি যিনি মার্কসীয় সন্দর্ভ মেনে সেদিন বাংলা কবিতায় শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন:

সমাজ যেখানে decadence, সামাজিক কোনও আন্দোলনকে সেখানে বিপ্লবী রূপ পরিগ্রহ করিতে হইলে আপনার অঙ্গ হইতে decadence-এর শেষ দাগ পর্যন্ত মুছিয়া ফেলিতে হইবে, সেইজন্য decadence সমাজ হইতে উদ্ভূত সামাজিক বিপ্লবী আন্দোলন Communism-এ হতাশা, অবসাদ, আত্মবিলাপ, সাফল্য-স্বপ্নভীরু পরাজিতের ক্লীবকান্নার স্থান নাই। চিন্তা, কর্ম ও উৎপাদনের উদ্দাম বিশৃঙ্খলার মধ্যে classical শৃঙ্খলাই এই আন্দোলনের উপজীব্য ও justification. Decadence-এর অবলুপ্তি প্রচেষ্টাই Communism-এর সার্থকতা।[6]

আজকের প্রেক্ষিতে এমন আলোচনার অবকাশ প্রায় আর নেই। তবু এই বির্তকটি এখানে উল্লেখ করতে হল এই কারণে যে, এক সময় বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক বীক্ষা আর বিতর্ক ছিল অতি স্বাভাবিক এক ধরন। রাজনৈতিক উদাসীনতার কোনও স্থান ছিল না সেদিনের বাংলা সাহিত্যে। অথচ, ধীরে-ধীরে আমাদের ঔপন্যাসিকেরা বাজার অর্থনীতির কারসাজি মেনে চুপ করে গেলেন। কেবল রাজনৈতিক মতপ্রকাশ থেকে তাঁরা বিরত থাকলেন না, বরং ধীরে-ধীরে ধর্মীয় বাবা শ্রেণির সাহিত্যিকদের জন্য পরোক্ষ বাজার খুলে দিলেন। ফলে রাজনীতি নয়, ধর্মীয় সাহিত্যের (পড়ুন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবননির্ভর সাহিত্য) জিগির উঠল বাংলায়। এর মূল কারণ হয়তো বহুবিধ। তবে সরোজ দত্ত এবং সমর সেনের মধ্যেকার সেদিনের রাজনৈতিক বিতর্কটিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ধামাচাপা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রতি সুবিচার করেনি। পরমেশ আচার্যের মতে:

আমার মনে হয়, ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে যে মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা চেপে না দিয়ে, এই বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ‘বঙ্গ রেনেসাঁ’পন্থী রবীন্দ্রভক্ত লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মতকেই প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়ে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বির্তকের ইতি টেনে দিয়েছিল। পার্টির এই নীতি ও প্রবণতা সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও শিল্পের পক্ষে শুভ হয়নি বলেই আমার মনে হয়।[7]

আজ যখন দেশে, রাজ্যে, সমাজে, পাড়ায় কিংবা সংসারেও বহুস্বরের কোনও জায়গা নেই, যখন আমরা প্রত্যেকেই নিজ-নিজ অবস্থানে ফ্যাসিস্ট মনোভাবাপন্ন, তখন রাজনৈতিক উপন্যাসকে বাদ দিয়ে সমাজ এগোবে না। সেই রাজনৈতিক উপন্যাস দলদাসের কলমে লাঞ্ছিত না হয়ে প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শনতত্ত্বের ওপর সৃষ্টি হোক। কারণ সেই উপন্যাসের বিষয় নিয়ে বিতর্ক হবে। পাঠক কিংবা সমালোচক প্রশ্ন তুলবেন। দলদাসদের কলমে লিখিত উপন্যাসে বিতর্কের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না। তা নির্বাচনী ইস্তেহারের মতো ঠোঙা হয়ে যাওয়া পুরনো খবরের কাগজ। আর যদিও কোনও বিতর্ক ওঠে, তবে তা মাথাচাড়া দিতে পারবে না। ১৯৩৯ সালের মতোই রাজনৈতিক পার্টির খবরদারিতে অঙ্কুরে বিনষ্ট হবে।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


[1] বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক। সাহিত্য করার আগে: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র প্রবন্ধ এবং। সম্পা: মণ্ডল, শুভময়; বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত। কলকাতা: দীপ প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৫। পৃষ্ঠা ১২০। ISBN 978-93-84561-57-4।
[2] Chomsky, Noam. The Responsibility of Intellectuals: American Power & the New Mendarine. India: Penguin Books. First published in India: 2003. Page 324-25. ISBN 9780143030188.
[3] Plato. Republic. New Delhi: Rupa. Rupa Edition 2013. Page 7. ISBN 9788129129437.
[4] ঘোষ, শঙ্খ। অন্ধের স্পর্শের মতো; প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা, ২০০৭। কলকাতা: গাঙচিল। প্রথম প্রকাশ: মে ২০০৭। পৃষ্ঠা ৩৬।
[5] সেন, সমর। In the Defence of the Decadents: অনুষ্টুপ: সমর সেন শতবর্ষ বিশেষ সংখ্যা। ২০১৬। ৫১ বর্ষ ২য় সংখ্যা। সম্পা: আচার্য, অনিল। কলকাতা। পৃষ্ঠা ৭৬৯।
[6] দত্ত, সরোজ। ছিন্ন কর ছদ্মবেশ; মরণে মেলেনি ছুটি— সরোজ দত্ত: সৃষ্টি ও সংকল্প। সম্পা: সরকার, সুখেন্দু। কলকাতা: শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি। জন্মশতবর্ষ, ১৩ মার্চ, ২০১৪। পৃষ্ঠা ১৫।
[7] আচার্য, পরমেশ। আমার চোখে সরোজ দত্ত; মরণে মেলেনি ছুটি— সরোজ দত্ত: সৃষ্টি ও সংকল্প। সম্পা: সরকার, সুখেন্দু। কলকাতা: শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি। জন্মশতবর্ষ, ১৩ মার্চ, ২০১৪। পৃষ্ঠা ২১৮।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...