![piyali](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2022/11/piyali.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়
কে খেয়াল রাখে গাছেদের ফুলেদের চলাচল? কে দিশি গাছ, কে বিদেশ থেকে এসে আসর জমাল, এত ঝামেলায় গিয়ে হইচই তোলারই বা কী আছে! আমজনতা আমরা তো ফুলেই খুশি। আমরা ছবি তুলছি, পোস্ট দিচ্ছি, ট্যুইট করছি, পর্যটকের ঢল নামছে, রাজ্যের আয় বাড়ছে… কিন্ত বাস্ততন্ত্র! এত ভারী ভারী বিষয় স্কুলপাঠ্যে পড়ে থাকে, বড়জোর এ নিয়ে বিজ্ঞানীরাই ভাবুন। আমরা হ্যাপি গো লাকি জনসাধারণ জীবনটাকে উপভোগ করব না? তারই মধ্যে কিছু পাগল শ্রেণির মানুষ রিসার্চ করেন, ক্ষেপে গিয়ে লেখালেখি করেন মাত্র। কিন্ত সে কি ওপরতলা অবধি পৌঁছাতে পায়!
কিন্ত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে কারণ অস্তিত্বের সঙ্কট দুয়ারে কড়া নাড়লে কর্তাদের মহলে হুঁশ ফেরে।
আগ্রাসন এক জবরদস্ত শব্দ। বহুমুখী বিস্তার এর। বিজ্ঞানীর ভাষায় বলি,
“কোনও জৈব প্রজাতিকে তার একান্ত নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে তুলে এনে যদি নতুন কোনও পরিবেশে পুনঃসংস্থাপন করা হয়, তাহলে তা অভিবাসন-ক্ষেত্রের জীববৈচিত্র, বাস্তুতান্ত্রিক ক্রিয়াশীলতা, স্বাস্থ্য এবং মানবীয় ব্যবস্থাপনার ওপর এক গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে এই নতুন প্রজাতির উপকরণটিকে ‘ইনভেসিভ অ্যালিয়েন’ প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ এই নতুন প্রজাতির জৈবনিক কার্যকলাপের ফলে অভিবাসনক্ষেত্রের পরিবেশের বাস্তুগত ভারসাম্যের বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই বহিরাগত প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদেরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেদের বংশবিস্তার করে ফলে টান পড়ে স্থানীয় প্রজাতিদের খাদ্য, পানীয় এবং বাসস্থানের পর্যাপ্ত জোগানে। এভাবে অচিরেই স্থানীয়রা আত্মসমর্পণ করে আক্রমণাত্মক বহিরাগতদের কাছে। পরিণতিতে বাস্তুসংস্থানের বৈশ্বিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বলা বাহুল্য এই ক্ষতি এক কথায় অপূরণীয়।”
তাই, দিশি চাই, দিশির অনেক গুণ, সবাই জানে। কিন্ত কে জানত বুনো ঝোপেরও আবার দিশি-বিদিশি আছে। মানে, আমরা আমজনতা তো এই পুটুশের ফুলের বাহারেই খুশি হয়েছি এতক্কাল, কেমন সুন্দর ছেয়ে থাকে বনতল, কেমন প্রজাপতির ঢল নামে, পাখিও ফল খায়। আমাদের এক বন্ধু বাটারফ্লাই গার্ডেন মানে প্রজাপতির বাগান বানানোর জন্যে এই বুনো ঝোপ বেছেছিলেন, শুনেছি। আজ পুটুশের কথা বলছি। আমাদের চেনা বুনো ফুল। এখন বাগানবিলাসীদেরও প্রিয়। ল্যান্টানা ক্যামারা এর খাস নাম।
পুটুশের নিজের দেশ মধ্য আমেরিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা। সেই কোন যুগে, আঠেরোর দশকে এর ফুলবাহারে মুগ্ধ মানুষ এই পুটুশ নিয়ে যান নিজের দেশে বাগান সাজাতে। হাওয়াই থেকে ফিলিপাইনস এসেছিল আমেরিকা আর ফিলিপাইনসের গাছ আদানপ্রদান চুক্তির মারফৎ। শোনা যায় খুব সম্ভবত ডাচ/ওলন্দাজ অভিযাত্রীদের হাতে করে প্রথম ইউরোপ যায়। বাগান থেকে পালিয়ে কখন সেই গাছ ছড়িয়ে পড়ে খেয়ালখুশিমতো দেশের আনাচেকানাচে। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে বন উজাড় করা যেসব জমি কৃষির জন্যে তৈরি করা হয়েছে, সেসব ফাঁকা জমিতে পুটুশ গুছিয়ে বসেছে সহজে আর তারপর ছেয়ে ফেলেছে খুব দ্রুত। এমনভাবেই সেসব জমিজিরেত সে আপন করে নিয়েছে যে প্রায় স্বাভাবিক উদ্ভিদে পরিণত হয়েছে। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের বহু দেশেই এখন এর আধিপত্য।
এখন মুশকিল হচ্ছে এই যে, সবুজ (গ্রিন কভারেজ) বাড়ছে, পাখিরা ফল খাচ্ছে, প্রজাপতি আসছে, তাহলে সমস্যা কোথায়? সেইটাই এখন গুরুতর আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করবেট টাইগার রিজার্ভে গিয়েছিলাম ২০২১-এ। সেখানকার মিউজিয়ামে দেখি একটা পোস্টার সাঁটা রয়েছে: Eradication of lantana camara। যেখানে বলা হয়েছে এক কর্মসূচি গ্রহণের কথা, যাতে করে ‘বনের ক্যান্সার’-কে নির্মূল করা যায়। বেশ চমকে গেলাম। এত কী ক্ষতি করে এই সুন্দর ফুলের ঝোপ যে এইরকম গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়েছে!
তা পড়াশুনো করে দেখলাম এই গাছের নিজস্ব গুণগুলোই তার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায় বনের বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। গুণই তো বলা উচিত। যেহেতু সে জল ছাড়াও বেশ টিঁকে থাকতে পারে, শুকিয়ে যায় না। এদের হাজারো প্রজাতি এমনকি হাইব্রিড ধরনও হাজির। সবরকম আবহাওয়ায় মানিয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। যেকোনও ধরনের মাটি, ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, খরাপ্রবণ এলাকা, সব জায়গায় টিঁকে যায়। পাখিরা এর ফল ভালবাসে। তাই বিপুল হারে বীজ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। পরিসংখ্যান বলে, একেকটা বছরে একেক গাছে প্রায় ১২০০০ বীজ হয়। ফলে সেই রক্তবীজের ঝাড়ের মতো এর মৃত্যু নেই। হু হু করে এর বংশবিস্তার চলে। গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়ালে মুখ দেয় না, কারণ এর রস বা আঠায় যে পদার্থ (pentacycluc triterpenoids) আছে তাতে পশুদের লিভারের ক্ষতি হয় বা আলোক সংবেদনশীলতাজনিত সমস্যা হয়। কিন্তু যে হারে বসতি বাড়ছে আর ঘাসজমি কমছে তার প্রমাণ তো আমরা রোজ খবরেই পড়ি। হাতির পাল নেমে এল চাষের ক্ষেতে। এইসব গবাদি পশু ঘাস না পেয়ে যদি মুখ দিয়ে ফেলে তাহলে তারা মারাও পড়তে পারে। আসলে এটা পুটুশের নিজস্ব প্রতিরক্ষা-মাধ্যম। আরেকটা ব্যাপার এদের গোষ্ঠীবদ্ধতা। গা থেকে এমন এক নির্যাস (alleopathic chemical) বের করে যা স্থানীয় ঝোপঝাড়ের অগ্রগতি, মানে শিকড় চারানোর বা চারা জন্মানোর ক্ষমতা রুখে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে। এরা যে জঙ্গলে আস্তানা গাড়ে, সেখানে শিকড়ের শৃঙ্খল এমনভাবে চারিয়ে দেয় যে অন্য কেউ সেখানে ঢোকে সাধ্য কী!
সহজ কথায় বিদেশি পুটুশ এসে দেশি ঝোপঝাড়দের অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে এনেছে। দিশি ঝোপ তার নিজস্ব গুণাবলির জন্যে সবসময় স্থানীয় গাছপালা, বন, আর বনের প্রাণীদের জন্যে অতিমাত্রায় প্রয়োজনীয়। বনের কন্দ, মূল, ডাল, পাতা, সবকিছুই বন্যপ্রাণীর কাজে লাগে। আর বলাই বাহুল্য, সেসবের ঘাটতি হলে সেসব ছোট প্রাণীরা মারা পড়ে। খাদ্যশৃঙ্খলের জন্যে আণুবীক্ষণিক প্রাণী, কীটাণুকীট থেকে বড় বড় প্রাণী সকলের বেঁচে থাকাই জরুরি। আর সকলের মাথার ওপর আছি আমরা মানুষ। এই যে উড়ে এসে জুড়ে বসে দিশিদের হঠিয়ে দাদাগিরি করে রাজ্যপাট বিস্তার, এটাই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে ভারতের ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রায় ৪০ শতাংশই দখল করে ফেলেছে এই ঝোপ। তাই রে রে করে সাড়া পড়ে গেছে চতুর্দিকে। জঙ্গলকে পুটুশমুক্ত করাই চাই।
পৃথিবীর দশটা খারাপ জবরদখলকারী ঝোপের একটা হল আমাদের প্রিয় এই বুনো ফুলের ঝোপ। এ নিজে আগুনে পুড়বে না অন্যান্য ঝোপের মতো, উলটে আগুনের গতিমুখ পালটে দিয়ে ফরেস্ট ফায়ারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। নিচুতলার আগুন দমন না হলে সে আগুন সহজেই মাথায় উঠে পড়ে। এমনিতেই এই ঝোপ দু মিটার উঁচু হয়, তবে জায়গায় জায়গায় ছ মিটার পর্যন্ত উঠে যায়। এভাবে শুকনো ভারতীয় সাভানা টাইপের জঙ্গলে (যেমন করবেট) আগুন লাগার সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। চাষের জমির ফলন কমে যায় এমনভাবে যাতে ফসল উৎপাদনে ভাঁটা পড়ে। আরও খারাপ আছে, ম্যালেরিয়া বহনকারী মশা বা সিসি মাছি এইসব ঝোপে থাকতে খুব পছন্দ করে।
তাই যতই পশ্চিম গোলার্ধের মস্ত প্রজাপতি (Papilio-homerus) হোমেরাস এই ফুলে আসক্ত হোক কিংবা জাম্পিং স্পাইডার (Evarcha culicivora) এর ঘন ঝোপে প্রেম করুক আর মধু খাক না কেন, এ থেকে যতই চিরাচরিত ভেষজ ওষুধ (ক্যান্সার, চর্মরোগ, চিকেনপক্স, কুষ্ঠ, হাম, অ্যাসমা, আলসার) তৈরি করা যাক না কেন, একে নিয়ে আপাতত চরম সমস্যায় বনবিভাগ। CEMDE-র তত্বাবধানে করবেটে লালঢ্যাং চাউর সংলগ্ন অন্যান্য এলাকায় “cut root stock method”-এর মাধ্যমে ল্যান্টানার ঝোপ নির্মূলকরণের পাশাপাশি, চারটি দেশজ ঘাসের নার্সারি বানানো হয়েছে বাস্তুতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করার জন্যে। যেসব ঘাস, বাঁশ, মূল খেয়ে বাঁচবে বন্যপ্রাণ, বাঁচব আমরাও।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, যারা জঙ্গলের প্রান্তিক বসবাসকারী, তাদের বুঝিয়ে দড়ি, মাদুর, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদিপ্রভৃতি বানানোর জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে, যদিও এসব কাজ নিবিড়ভাবে শ্রমিকনির্ভর এবং ব্যয়সাপেক্ষ। সবমিলিয়ে পুটুশ হঠাও, বন বাঁচাও রব চতুর্দিকে। দেশজ ঘাস-পাতা-ঝোপ চাই, তাদের বাঁচাও, তাদের ফেরাও— না হলে বিপদ দোরগোড়ায়।