জলগুচ্ছ— আসলে জল বিষয়ক কোনও গদ্য নয়

জলগুচ্ছ— আসলে জল বিষয়ক কোনও গদ্য নয় | প্রীতম বসাক

প্রীতম বসাক

 

১.

শিল্পীর শুশ্রূষা বলে কিছু হয় না। কোথাও নেই সেই আদিম গঠন যা তোমাকে সৃষ্টির মুহূর্তে ফিরিয়ে দিতে পারে। বরং এক পেয়লা বিশুদ্ধ— যদি আদৌ কিছু ওই নামে থেকে থাকে— পান করে কেউ ভাবতে পারে এই তো পরমকে পাওয়া হল! কিন্তু কথাটার কোনও গাছমাথা নাই। অসংখ্য ডালপালা অথচ পাতার অভাবে মরে যেতে পারে প্রকৃত আর্ট। একজন কবির কাছে যা পড়ে থাকে তা হল অপমান থেকে নিজেকে বাঁচানো। শেষ পর্যন্ত পাখিদের সঙ্গে পালক হস্তান্তর করা। এবং যা লিখতে চেয়েছিলাম তা লেখার চেষ্টা করে যাওয়া। এ বিষয়ে কোনও গুরু বা গুরুত্বপূর্ণ গাথা রচনা হওয়া বাকি আছে বলে মনে করি। তুমি আমাকে চালনা করো এর চেয়ে পবিত্র নিচতা আর কিছু নেই। সমুদ্রের কাছে গিয়ে একবার জেনে নিও প্রকৃত প্রস্তাবে সে নিজের গভীরতা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত কি না! এখানে কোনও মায়া দেখিও না। আল বাঁধা তোমার কাজ নয়। তুমি প্রশ্নের গথিক বানাও মাথায়। উত্তরের অপচয় না করেই।

 

২.

সাহিত্য করতে এসে জল মাপার কোনও মিটার স্কেল না রাখাই ভাল। মাস্টারপিস লিখব বলে ওই যে গায়ে ভস্ম মাখছ, ফেলে রেখে যাচ্ছ প্রতিদিনের অনুল্লেখ্য— ও হল সোনার হরিণ। ভাবনার ক্লান্তিমাত্র। বরং হাঁস হও। জলকে বিশ্বাস করো। একটা দুটো পালক খসবে নির্জন দুপুরে। ওই একটি শিশু আসছে। নিচু হল। তুলে নিল সাদা ভাতের মত পালকটিকে। ওটুকুই সাফল্য। চরিতকথা। সামান্যের মত মহৎ কিছু নাই। মহতের মত সামান্যও কিছু নাই। প্রার্থনা করো দীর্ঘ আয়ু। চাষ করো নিত্যতার সূত্র। মেধাকে সরলতা দিয়ে গুণ করলে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে রান্না করতে হবে লেখা বিষয়ক শাকান্ন। এরপর আর তোমার কিছু করার নেই। যার ক্ষুধা সে ঠিক ওই শাকপাতা গুগলি খেয়েই বলবে আর একটু ভাত হলে মন্দ হত না। তুমি সলজ্জ হাসিটুকু রেখো পানপাত্রে। বলো সে যেন ফিরে আসে আবার।

 

৩.

নিজের লেখা নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমে মনে হয় কত পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। মাছেরা গৃহহারা হল। আর গাছের কথা ছেড়েই দেওয়াই ভাল। পৃথিবীটা আরও অগভীর হয়ে যাচ্ছে। দুঃখগুলো গ্রিলড করে উপাদেয় বানিয়ে কী সুন্দর খেয়ে নিচ্ছে সকলে। নাকি আদতে অপমান মাপার রিখটার স্কেল অকেজো হয়ে গেছে। দাগ পড়ছে না। টের পাচ্ছে না ক্ষয়ক্ষতি। তুমি সজাগ থেকো জলের ব্যবহারে যেন অক্ষরবৃত্ত ঠিকঠাক গণনা করা হয়। মণীন্দ্র গুপ্ত চেয়েছিলেন মানুষ কমুক। আমাকে আবার মানুষে পেয়েছে সেই সকাল থেকে। আমি তাদের হাসিকান্নার বৈচিত্র্য ও ফাটলগুলো আবিষ্কার করতে চাই। তাদের অবচেতনে নিসর্গ ঢুকিয়ে দিতে চাই। দেখতে চাই তারা আবার দলে দলে ফিরে আসছে নদীতর জীবন পেতে। বালি সরিয়ে দিচ্ছে বুকের। পুঁতে দিচ্ছে চিরহরিৎ বিশ্বাসগুলো। সুতরাং আমি লেখায় অসংখ্য মানুষের কথা বলে যেতে থাকি। মার ও মারি নিয়ে নিরবধি হেঁটে যায় যে মানুষ, নিজের অপূর্ণতার মুখোমুখি হতে ভয় পায় যে মানুষ, রাগে আর প্রেমে, ভীরুতা আর সাহসে কনট্রাস্ট যে মানুষ, যে-মানুষ পাখির ঘাতক আর যে মানুষ পাখির বেদনায় বুদ্ধ হয়ে যায়— তাকে লিখতে চেয়ে আমি পাহাড় ভাঙি। নেমে যাই অতলে। তাই লেখা একঘেয়ে হয়ে ওঠে। একটানা হয়ে যায়। আপনারা তার সঙ্গী হতে পারেন। কিংবা পারেন না।

 

৪.

আমি চেয়েছি আমার লেখায় সবসময়ই একজন নারী জেগে থাকুক। কন্যা-জায়া-জননী। আমি মনে প্রাণে মেয়েদের স্বভাব পেতে চেয়েছি। ওদের বাস্তুতন্ত্র, একরোখা জেদ আর মৃত্তিকারূপ পেতে চেয়েছি আমি। যে কোনও সমস্যাকে গভীর মাছের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে জানা আমি শিখতে চেয়েছি। পিতা-পুরাণ লিখতে গিয়ে আমি বারবার একজন মায়ের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছি। আমার স্তন টনটন করে উঠেছে বেদনায়!

 

৫.

এক বন্ধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল আমার লেখায় স্তন শব্দটার এত প্রয়োগ কেন? কিছু বলা হয়ে ওঠেনি তখন। আসলে বলার তো কিছু নেই। জন্মের পর মানুষের বাচ্চার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ওই মধুভাণ্ডটির সঙ্গে। ওই যে নেশায় ধরে তা আর জীবনে ছাড়ে কি! যেদিকে তাকিয়ে দেখো অনন্ত ফুল ফুটে আছে। কীভাবে যে একটা বালকের হাতেখড়ি হয়ে যায় কেউ জানে না। শুধু অন্তরীক্ষ জানে। বালক কেবলই সেই মধুরের পায়ে মাথা কুটে মরে। পুড়ে যায়। ক্ষুধা তবু মরে না গোঁসাই। দুপুরগুলো অসীম থেকে ডাকে, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে কলস। পাথর ঢেলে ঢেলে পিপাসা মেটায়। অতঃপর মুখ মুছে নতুন হাঁড়ির দিকে চলে যেতে থাকে। আমিও গিয়েছি সমগ্র পরিচ্ছদ জুড়ে। জানু পেতে বসেছি সুগোল গন্ধে। দেখেছি ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’। দেখেছি বৃষ্টির দেশে অমায়িক গাভী ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি কতদূর সহ্য করবে এই ধারাস্নান। প্রকাশের অনুমোদন পাবে তারা! নাকি লেখা থেকে ডিলিট করে দেবে স্তনবাচক আমিগুলো।

 

৬.

আমার শহরে কোনও বৃক্ষ-জাতক জন্মাননি। কোনও অনুবাদক যিনি বীজের তর্জমা করবেন! তাই এই শহর ঘন ঘন জ্বরে পড়ে। আর তা এত দীর্ঘ যে বাচ্চারা ভুলে যায় তাদের মায়েদের আদিম গঠন। তারা জিভে কোনও গন্ধ পায় না। চাদরের মধ্যে তাদের ঘুমগুলো একা হয়ে থাকে। তুমি তাকিয়ে দেখো কোনও সামাজিক দূরত্ব না মেনে কীভাবে একটার পর একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে যখন সূর্য লম্বভাবে নেমে আসে বাড়িগুলো এত ঘেমে যায় যে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। গলি— তার ভেতর জমে থাকা প্রাগৈতিহাসিক হাওয়া— দুশো বছরের পুরনো শহরকে মনে করিয়ে দেয় তারা একদা বনমোরগ মেরে কী অনায়াসে রান্না করে খেয়েছে! কারও কারও স্মৃতিতে দু-একটা বাঘের পায়ের নরম জেগে ওঠে। কারও বুক ফেটে বেরিয়ে আসে বটগাছের শেকড়। কিন্তু কথাটা হল আমাদের মাথায় তাতে কোনও বৃষ্টি ফোটে না। আমি অবশ্য এখনও এবংগুলোকে সংরক্ষণ করি। কবিতার মধ্যে অসংখ্য গাছ বসিয়ে দিই। নদী পেতে রাখি। তার পাশেই মাটির অভিজ্ঞান। স্তন্যপায়ী ভোর! এভাবে আমি নিজেকে ফিরিয়ে আনি বাংলাভাষার আলাদীনে।

 

৭.

এখন কথা হল নিজের ভাষা সম্পর্কে তুমি কী কী জানো তার উপর নির্ভর করছে তুমি কতটা জীবাণু বিষয়ে সিরিয়াস। আবার পাখি বিষয়ক ছন্দজ্ঞান না হলে তোমার কোনও যোগ্যতা নেই চুম্বনে— এটা মনে রেখো। জেনো নদীকে নদী বলে জানাটাই হল আসল। তুমি কি বকফুলের দুঃখের কাছে গিয়ে বসেছ কোনওদিন! এই যে একটা কবিতা লেখার জন্য দশটা পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছ আর ভাবছ অনন্ত পাবে, ভেবে দেখেছ কটা বৃক্ষের সম্ভাবনাকে হত্যা করলে! অথচ তোমাকে আমি দিতে চেয়েছিলাম সরল ন্যুডিটি। অরণ্যে অরণ্যে সামান্য জীবন। কিন্তু না, তোমাকে নিষিদ্ধ আগুনের দিকে যেতেই হত। ছুঁয়ে দিতে হত ওই লাল আলোর অভিমুখ! আমি তো কনফেশন-ঘরও রেখেছিলাম। পাখি রেখেছিলাম! অজস্র মীন। ওদের কাছে গিয়েও স্বীকার করে নিতে পারতে রাজা হওয়ার জন্য তুমি কী কী অপরাধ করেছ? লোভেক্কে লোভ, লোভ দুগুণে আরও লোভ, লোভ তিনেক্কে অনন্ত লোভ। প্রতিবিম্বে নিজের মুখ দেখে একবার অন্তত ফিরে আসার কথা ভাবতে সামান্য মানুষে। দুঃখের কবিতায়। না, তোমার ছিল যুদ্ধ। তোমার ছিল নেশা। তোমার ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার বাসনা। আমি তোমাকে বলেছিলাম চলো কুটির বানাই। গৃহ পালন করি। শুনলে শূন্যতার দিকে আরও একটু এগিয়ে যেতে পারতে। বুদ্ধের দিকেও।

 

৮.

দেখো ওই মৃত্যুর মুখ। করুণ একটি কাব্য। যার প্রতিটি শব্দে মানুষের অনুশোচনা লেগে আছে। সকালে খালি পেটে কৃষিকাজে চলে যাচ্ছে যে গৃহস্থ তার পথে কোন্ অলঙ্কার বসাবে তুমি? যে মেয়েটির গর্ভ এল এবং খসে গেল তাকে কোন ব্যঞ্জনায় ধরবে তোমার কবিতা! ওই যে স্কুলছুট ছেলেটি আইসক্রিম নিয়ে বসে আছে তার বন্ধুরা টিফিনের সময় তার কাছ থেকেই কিনবে বলে— তাকে দেওয়ার মত কোনও শব্দরূপ আছে তোমার কাছে! মানুষের কান্নার মত সহজ সরল বিষয় নিয়ে লেখাটাই সবচেয়ে কঠিন জেনে তুমি সাদা রেখে দিচ্ছ পাতায়। তোমার লেখার এই নিয়তি দেখে হেসে উঠছে তোমার সন্তান!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...