বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: পাঠকের প্রস্তুতি

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: পাঠকের প্রস্তুতি | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: শিবিরহীন সমালোচনা সাহিত্যের প্রস্তুতিক্ষেত্র

আমরা আমাদের এই প্রবন্ধের মুখবন্ধে জানিয়েছি সাহিত্যপাঠ একটা অভ্যেস। আর পাঁচটা ভাল অভ্যেসের মতো সাহিত্যপাঠ ব্যক্তিমানুষটাকে যেমন ঋদ্ধ করে, তেমন সামাজিক জীবনকেও উন্নত এক জীবনের পথ বাতলে দেয়। সেই কারণে শোষিতের সাহিত্যপাঠ সময়াসময় শাসকের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাহিত্যের পৃষ্ঠার মধ্যেই যে লুকিয়ে থাকে বিস্ফোরণ। তার মধ্যে আত্মগোপনে থাকে শাসককে প্রশ্ন করার দুরূহ ইচ্ছা। অভিসন্ধি। নিবিড় সাহিত্যপাঠের পরতে-পরতে আবিষ্কৃত হতে থাকে যাবতীয় সমাজিক বুজরুকি। তাই সাহিত্যপাঠের অভ্যাস সমাজে জারি রাখা জরুরি। মন-মর্জি ঠিক রাখার জন্য জরুরি। শিরদাঁড়া শক্ত রাখার জন্য জরুরি। দায়িত্বশীল সামাজিক মানুষ হওয়ার বিকল্প এছাড়া আর কিছুতেই হওয়া নয়।

বলা হয় মেজর লেখকই মেজর পাঠক। কথাটা ভেঙে বললে বলতে হয় পাঠক দুই শ্রেণির। এক শ্রেণির পাঠক হলেন তাঁরা যারা নিজেরাই লেখক। নিজেরাই ঔপন্যাসিক। তাঁদের জ্ঞান অর্জনের জন্য, আরও শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা মানবদরদি উপন্যাস লিখতে তাঁদের যেমন সমসাময়িকদের লেখা আরও উপন্যাস পড়তে হয়, তেমন পড়তে হয় আরও বহু ও বিচিত্র বিষয়। কারণ ভাল বই না পড়লে ভাল ঔপ্যনাসিক হওয়া যায় না। অথচ, খুবই দুঃখের কথা আজ সমাজের বুকে (এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও) এমন বহু মানুষ নিজেদের লেখক কিংবা কবি হিসাবে জাহির করেন, যারা বই কিংবা পত্রিকার একটি পৃষ্ঠাও উলটে নিজেদের বন্ধুবৃত্তের লেখা পড়েন না। তাঁদের জীবনের একমাত্র চাওয়া নিজের লেখাটি ছাপাইব আর প্রকাশিত হইলে সেটি পড়ব। বিভিন্ন অসরল কিংবা বক্র পথে তাহার সম্পর্কে দামি-দামি কথা লিখিব। মানুষের বাহবা কুড়াইব। আর উদ‌্‌গার তুলিয়া বলিব আমা-অপেক্ষায় শ্রেষ্ঠ লেখক স্বয়ং ব্যাস, বাল্মীকিও ছিলেন না। জীবনানন্দের চেয়েও আমার কাব্যপ্রতিভা কয়েকশো গুণ বেশি। এমত কথা তাঁরা ঠিক এইভাবে না বললেও এমনধারা মনে করেন। এঁরা যশের কাঙাল। নামের ভিখারি। সাহিত্য রচনার মূলসূত্র তাঁদের অবগত নয়। ফলে ইহকালে বিবিধ প্যাঁচ–পয়জার করলেও মরণের পরে তাঁরা অশরীরী আত্মা হয়ে যান। তাঁদের কেউ স্মরণ করেন না। এরাই আজকের বাংলা সাহিত্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখক। এঁরা অস্পৃশ্য। এঁদের ত্যাগ বাঞ্ছনীয়। সাহিত্যের এমন আর্বজনা পাঠ করেই পাঠক সাম্প্রতিক সাহিত্যের ওপর বীতশ্রদ্ধ হন। ফলে আমরা এই জাতীয় লেখক ও তাঁদের লেখা নিয়ে আলোচনা করে সময়ের অপব্যবহার করতে রাজি নই। আমাদের সমস্যা অন্যত্র।

আমাদের সমাজের পড়াশুনা জানা এবং পড়াশুনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের সংখ্যা কিছু কম নেই। সমাজে এখনও তাঁদের যথেষ্ট সুনাম ও সম্মান রয়েছে। রয়েছে গুণমুগ্ধের দল। এঁরা কেউ শিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। কেউ অভিনয়, শিল্পকলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেই আবার ছবি আঁকেন। কেউ করপোরেট কিংবা সরকারি স্তরের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। এঁদের জীবন থেকেও কেমন করে যেন সাহিত্যপাঠের অভ্যাসটা হারিয়ে গেছে। খুব নির্মম এই তথ্য। তাঁরা দিনের কয়েক ঘন্টা ব্যয় করে খবরের কাগজ পড়েন। যেখানে সংবাদের চাইতে মুখরোচক কেচ্ছার দিকেই তাঁদের নজর বেশি থাকে। সমাজে তাঁদের অনুগামীর সংখ্যা কিছু কম নয়। তাঁরা সম্পূর্ণত সামাজিক জীব। তবুও কী এক করাল কারণে তাঁদের কাছে বই পরিতাজ্য। অথচ, হয়তো জীবনের প্রথম পর্বে তাঁরা সাহিত্যের পাঠক ছিলেন। পড়ুয়া ছিলেন। তারই ফলশ্রুতি তাঁদের আজকের সামাজিক সাফল্য। তাঁরা নিজেরা যেমন সাহিত্যের সংস্রব থেকে বহু দূরে, ঠিক তেমনই আজকের নবীন প্রজন্মকে সাহিত্যের বই পড়াতে তাঁরা একেবারেই উৎসাহী নন। এক সময় বাঙালি মায়েরা সারাদিনের কাজ সেরে দুপুরে বালিশে মাথা রেখে পাড়ার কোনও লাইব্রেরি থেকে আনা কোনও উপন্যাস কিংবা কোনও সাহিত্যপত্রিকার পৃষ্ঠা ওলটাতেন। সে–ছিল তাঁদের একান্ত জগৎ। ব্যক্তিগত নারী ভুবন। আজ সেই সময় গ্রাস করেছে ফেসবুক। আর সেখানকার অতি সস্তা, হাততালিকাঙ্খী বিভিন্ন মোটা দাগের রচনা। ছবি। আর ভিডিও। আজ মানুষকে কাজের সূত্রে প্রতিদিন দূরের শহরে যেতে হয়। মানুষের চলাচলের জন্য আজ যেমন লোকাল ট্রেন, মেট্রো রেল আছে, তেমন আছে দূরপাল্লার বাস। সেখানেও মানুষের মন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ট্রেনে-বাসে মারপিট করে তাঁদের উঠতে হয় কারণ বসার জায়গা দখল করা দরকার। তারপর বাকি রাস্তাটা সকলের মধ্যে থেকে আলাদা হয়ে  মোবাইলে বুঁদ হয়ে যাওয়া। বঙ্গজীবনে প্রকাশ্যে সাহিত্যের বই হাতে মানুষ বিরলের মধ্যে বিরলতম। আর কিছু মানুষ সেই বিরলতার আশ্রয়ে হাতে নেন ইংরাজি কোনও বইয়ের মোটা সংস্করণ। অনেকটা ফ্যাশন সিম্বলের মতো।

একজন সাহিত্যের পাঠক হয়ে ওঠার জন্য পারিবারিক পরিবেশ খুব জরুরি। আজও জিনিসের দাম যতই ঊর্ধ্বমুখী হোক না কেন, সাহিত্য বইয়ের দাম কিন্তু মানুষের ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই মূলত থাকে। আমরা এমনিতে সারাদিন সিগারেট ফুঁকে যা অপচয় করি, কিংবা বিজ্ঞাপনের চটকের কাছে মাথা নত করে নকল প্রসাধনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করি, তার কণামাত্র খরচ করলে সাহিত্যের পাঠযোগ্য বই কেনা যায়। পড়া যায়। আমরা আমাদের বাড়ির বাচ্চাদের জন্মদিনে কেক কিংবা বেলুন কিনতে যত অপব্যয় করি তার থেকে সামান্য অংশ কি আমরা বরাদ্দ করতে পারি না তাদের জন্মদিনে বাংলা বই কিনে? তাদেরকে কি মাতৃভাষায় বই পড়তে উৎসাহ দিতে পারি না? উত্তরটা সকলেরই জানা। আমরা পারি। কিন্তু আমরা সেটা করি না। কারণ সাহিত্যপাঠের মর্ম আমাদের সামাজিক জীবনে মজ্জাগত নয়। আমরা নিজেরাই বইকে জীবনের অংশ করে নিতে পারিনি, কীভাবে আমরা নিজেদের বাচ্চাদের সে শিক্ষা দেব? এভাবেই তবে কি ডোডোপাখির মতো হয়ে যাবে বাংলা সাহিত্য? বাংলা উপন্যাস?

পাঠক হয়ে ওঠার একটা সার্বিক ইচ্ছা না থাকলে পাঠক হয়ে ওঠা যায় না। আর পাঠক যদি মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তবে কীভাবে বাংলা সাহিত্যের মণিমুক্তো স্পর্শযোগ্য হয়ে উঠবে? সমস্যা এমন গভীরে যারা দিনরাত এক করে বাংলা সাহিত্যের নিবিড় চর্চা করে চলেছেন, তাঁদের সংসারেও এমন কেউ নেই যিনি এমন অভ্যাসকে রপ্ত করবেন। খুব সম্প্রতি একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বলছিলেন, এই যে এত প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সংগৃহীত বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালাগুলোর কী অবস্থা? কী হবে এই অতুল গ্রন্থরাজির? কী হয় সেগুলোর ভবিতব্য? লেখকদের পরবর্তী প্রজন্ম, তাঁদের সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনি, ভাইপো-ভাইঝির মধ্যে তো কেউ পড়ুয়া নেই? তাহলে লেখকের সারাজীবন ধরে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থেকে এই বই সংগ্রহের বাতিক, সাহিত্যপাঠের অভ্যাস— এর আর কোনও চিহ্ন থাকছে না। এমন দৃশ্য যদি বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশ সাহিত্যকারদের সংসারের কথা হয়ে থাকে, তা হলে অনুমান করা অসম্ভব নয় যারা মাঝারি কিংবা ক্ষুদ্র বইপ্রেমী, সাহিত্যসেবী, নিয়মিত সাহিত্যের পাঠক, তাঁদের সারাজীবনের সংগৃহীত বিশাল বইয়ের ভাণ্ডারের কী অবস্থা? এই জিজ্ঞাসাচিহ্নটি ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। একদিকে মানুষের সাহিত্যপাঠের অনীহা। অন্যদিকে বিবেকহীন নিম্নস্তরের প্রকাশনা শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি)। যারা সততার সঙ্গে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে সাহিত্যচর্যায় নিবিষ্ট রয়েছেন, তাঁদের সেই সম্ভারের কী গতি হবে? আজকের এই সময় দাঁড়িয়ে নিশ্চিত বলা যায় জীবনানন্দের সারাজীবনে লেখা সমগ্র সাহিত্যসৃষ্টি, যা কালো লোহার ট্রাঙ্কে তিনি বন্ধ করে রেখেছিলেন, (যার কয়েকটা জীবনানন্দের কন্যার সুচরিতা দেবীর ট্রেন ভ্রমণের সময় হারিয়ে গেছে। যার কিছু আত্মীয়জন সংসারের গোপন কথা বলে চিরকালের জন্য নষ্ট করে দিয়েছেন।) আজকের দিনে নিশ্চিত তা পুরনো খবরের কাগজের সঙ্গে বাড়ির লোক বিক্রি করে দিতেন। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা যে সমাজে ঘটে, যে সাহিত্যে ঘটে, সেখানে ভার্চুয়াল পৃথিবীর চটুল আর বিনাপয়সার সাহিত্যের রমরমা আমাদের কাছে অশনিসঙ্কেত ছাড়া আর কিছু নয়।

বই কি আর পাঁচটা জিনিসের মতো স্থাবর সম্পত্তি? বই কি পুরনো সোফা? বিয়ের খাট কিংবা ড্রেসিংটেবিল? বই কি খারাপ হয়ে যাওয়া রেফ্রিজারেটর? পুরনো কারিগরির শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র? বই কি বাতিল চার চাকা? লজ‌্‌ঝড়ে সাইকেল? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই উঠে আসে বইয়ের আত্মকথা। বইয়ের বিশেষত্ব। বইয়ের গায়ে থাকে বইয়ের মালিকের নাম। বির্বণ হয়ে যাওয়া কোনও কালের সুলেখা কালির ফাউন্টেন পেনের তারিখসহ সাক্ষর। বইয়ের লালচে খস‌্‌খসে পুরনো পৃষ্ঠায় লেগে থাকে পাঠকের অদৃশ্য হাতের স্পর্শ। কোনও বেয়াড়া পাঠকের মার্জিনে বিভিন্ন কালিতে লেখা মন্তব্য? তাও তো থাকে পুরনো বইয়ের পৃষ্ঠায়। সেই বই পুরনো কাগজের কারবারির লোক ঠকানো দাড়িপাল্লায় যখন ওজন হয়, তখন বংশানুক্রমে পাওয়া এইসব তথাকথিত আর্বজনাগুলোকে কেবলই আবর্জনার তকমা দেওয়া যায় কি? স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার। রবীন্দ্র কিংবা নজরুলজয়ন্তীতে আবৃত্তি করে পাওয়া পুরস্কার। জীবনের প্রথম ভালবাসার সাক্ষরচিহ্ন নিয়ে থেকে যাওয়া উপহার পাওয়া বই। বইয়ের ভেতরের এমন অগ্রন্থিত বহু কাহিনি, স্মৃতি কাটাকুটি করে অদৃশ্য আখরে। তাকে চিনতে হয়। আজকাল বইমেলার সূত্রে ‘বইপ্রেমী’ নামে নতুন এক শব্দ এসেছে বাজারে। বিদেশি পেপারব্যাকের অণুকরণে লেখা দুটো গোয়েন্দা কাহিনি কিংবা ভৌতিক কাহিনির বই যাঁরা বইমেলা থেকে কিনে আনেন, তাঁরাই হলেন তথাকথিত ‘বইপ্রেমী’। যে সমাজে জীবনের সফলতার অর্থ সম্পূর্ণত অর্থনৈতিক। যেখানে সাহিত্যের নামে অন্তঃসারশূন্য একরৈখিক কাহিনির দবদবা, যেখানে সাহিত্যকে সারাজীবন ভাল না বেসেও সাহিত্যগ্রন্থের প্রকাশক হওয়া যায়, সেখানে সাহিত্যপ্রেম বর্তমান জৈবিক প্রেমের মতো ঠুনকো। সস্তা। অবহেলিত।

আজকের স্থান সঙ্কুলান গৃহে বইয়ের সম্ভার সাজিয়ে রাখা অনেকের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। দু কদম হেঁটে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাড়ার লাইব্রেরির চৌকাঠ পেরোনোয় আলস্য থকতে পারে। কিন্তু বিকল্পধারার সাহিত্যপাঠের জন্য সামান্য কিছু সময় আর অর্থ ব্যয় করা কি যায় না? এমন তো বহু ঘটনা ঘটে, একটা বই কিংবা কোনও একটা বিশেষ সাহিত্য কোনও একজন মানুষের জীবনকে পালটে দেয়? পালটে দিতে পারে? জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে যারা আত্মহননের রাস্তা বেছে নেন, এমন তো দেখাই গেছে যখন তাঁর ‘মরিবার হল সাধ’, তখন একটা বিশেষ বই, বিশেষ সাহিত্যপাঠ তাঁকে জীবনের আলোঝলমলে রাস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে এল?

জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্যের সৃষ্টি। আবার সাহিত্য থেকে জীবনকে পড়ে নেওয়া। দু তরফই সমান ক্রিয়াশীল। দু তরফেই টান সমান তীব্র। ভ্লাদিমির নবোকভ-এর ললিটা জীবন থেকেই তো নেওয়া কাহিনি? শরৎচন্দ্রের বড়দিদি জীবনের বাইরের ঘটনা নয়। তেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওসমান রঞ্জু কিংবা খিজির আলি বাংলার জল-হাওয়ায় তৈরি চরিত্র। আমাদের প্রিয় কবি পুরন্দর ভাটকে কখনও কি মনে হয় জীবনের বাইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক একক চরিত্র? বাল্মীকির রামায়ণ কাহিনির রামচন্দ্র যতটা মানবিক চরিত্র, তার থেকে ঢের বেশি মানুষ রিকশাওলা খিজির আলি কিংবা ফ্যাতাড়ু কবি পুরন্দর ভাট। জীবন ও সাহিত্যকে দুই হাতে মিলিয়ে দিতে পারে কেবল একটা সার্থক উপন্যাস। সেই উপন্যাস জীবনের প্রয়োজনেই পড়ে নিতে হয়। তাতে জীবন সমৃদ্ধ হয়। চারদিকের অস্পষ্ট ছকবাজি স্পষ্ট হয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় উপন্যাস ঐতিহাসিক পেক্ষাপটে রচিত, তবে তা একদেশদর্শী কিংবা ভুল ইতিহাস। শরদিন্দুর উপন্যাস আলোচনায় আমরা দেখেছি একটিমাত্র (তুঙ্গাভদ্রার তীরে) উপন্যাসে তিনি ইতিহাস বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন। ফলে তাঁর এই উপন্যাস অন্য উপন্যাসগুলি থেকে সম্পূর্ণত উন্নততর। সম্পূর্ণত ব্যতিক্রম। অমিয়ভূষণ মজুমদারের রাজনগর বাংলার রেনেসন্সের আলোয় দেখতে চাওয়া প্রকৃত সম্পন্ন মানুষদের জীবনকথা। তেমন ঘটনা ইতিহাসে ঘটেনি। চরিত্রগুলো তেমন অর্থে ঐতিহাসিক নয়। তিনি তাঁর উপন্যাসের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন ‘ইতিহাসকথা’য় তাঁর মন। বাংলার রেনেসন্স নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন সেই সময় রচনা করেন, তখন কিন্তু তিনি আমাদের বঙ্গজীবনের ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। এই উপন্যাস পাঠ করলে ইতিহাস পাঠের বিনোদন যেমন আমরা লাভ করি, ঠিক তেমনই আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয় বাংলার রেনেসন্সের প্রধান মানুষগুলোর আলো-ছায়া কিংবা আবছায়া রূপ। আমাদের চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ওঠেন বিদ্যাসাগর। কালীপ্রসন্নন সিংহের মতো মানুষ। এবং তা কোনও মনগড়া কাহিনি নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন গবেষকের দৃষ্টিতে বাংলার অন্যতম এক আলোকিত অংশের ওপর দৃষ্টি দিয়েছেন। পাঠককে আহ্বান করেছেন সে কাহিনি পাঠের। যা সত্য। যা অনুপ্রেরণার মতো। যা আমাদের বর্তমান সময়কে বুঝে নিতে সাহায্য করে। সেই কাহিনি পাঠ করার দায় তাই পাঠককেই নিতে হবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যতম দুই বন্ধু এবং প্রভাবশালী ঔপ্যনাসিকের তেমনই দুটি কালজয়ী সৃষ্টির একটা হল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত শাহাজাদা দারাশুকো আর অন্যটি দেবেশ রায়ের বরিশালের যোগেন মণ্ডল। আমাদের দেশের প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা এই দুই উপন্যাস পাঠে চোখের সামনে খুলে যায় অদৃশ্য কালো পর্দা। যে পর্দার আড়ালে আছে প্রভূত মিথ্যাচার। ভুল ইতিহাস। নষ্ট রাজনীতি।

মুঘল রাজত্বের সবচাইতে সঙ্কটময় সময়কে উপজীব্য করে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রচনা করেছেন তাঁর আকর উপন্যাস শাহাজাদা দাারাশুকো। এই উপন্যাসের প্রতিটা পৃষ্ঠায়, প্রতিটা অক্ষরে রয়েছে ঔপ্যনাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দীর্ঘ গবেষণা। ঠিক তেমনই ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতির পাশাখেলায় যে উপমহাদেশকে তিনটে টুকরো করে দেওয়া হয় ১৯৪৭ সালে, তার ওপর এক সার্থক মহাকাব্যিক উপন্যাস বরিশালের যোগেন মণ্ডল। যোগেন মণ্ডল ছিলেন নমঃশূদ্র সম্প্রদাযের মানুষ। তিনি পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় হিন্দু মন্ত্রী। দেশভাগের দায়ের চাপানউতোর বর্ডারের দুই তরফে এখনও চলেছে। কেবল শ্রেণিকক্ষে নয়। রাজনৈতিক অসূয়াজনিত কারণে আজও বারবার উঠে আসে দেশভাগ আর তার রাজনৈতিক দায়। আমাদের উল্লেখিত অন্য দুটি উপন্যাসের চাইতে সময়ের নিরিখে সাম্প্রতিক ঘটনানির্ভর কাহিনি এই বরিশালের যোগেন মণ্ডল। ফলে এখানে ঐতিহাসিক সূত্র বা তথ্যের নূন্যতম বিচ্যূতির অবকাশ নেই। দেবেশ রায় জীবন প্রণিপাত করে লিখে গেছেন এই উপন্যাস। শুধুমাত্র শরীর দিয়ে নয়। কেবলমাত্র মেধা দিয়ে নয়। বাংলা সাহিত্যের এই তিন প্রধান পুরুষ তাঁদের পরিণত বয়সে যখন শরীরের শক্তি কমে এসেছে, তখন মরণকামড় দিয়ে গ্রন্থিত করে গেছেন এমন মহাগ্রন্থ। কাদের জন্য? পাঠকের প্রত্যাশায়। এই উপন্যাসগুলো না পাঠ করলে অতীতকে চেনা যায় না। নিজের পূর্বজ এবং তাঁদের কীর্তিকাহিনি আচেনা থেকে যায়। তৈরি হয় না ইতিহাসচেতনা। ফলে সমকালকে নির্মোহভাবে বিচার করা যায় না। বরং ভাববাদীদের মতো ‘সবই ওপরওলার ইচ্ছা’ এমন একটা মেধাহীন, বিবেকবর্জিত সিদ্ধান্তে আসতে হয়। তেমন সিদ্ধান্ত মর্মান্তিক। আর আমাদের এই অবিমৃষ্যকারিতার সুযোগ নিয়ে রাজনীতির কারবারিরা দিনের পর দিন আমাদের শোষণ করেন। আমাদের ছিবড়ে করেন। আমরা দেখি রাজার পোশাকের রং কেবল পালটায়। রাজার মানসিক প্রবৃত্তি পালটায় না। সৎ সাহিত্যপাঠের জন্য কোনও আড়ম্বরের দরকার দেখি না। যেটা দেখি তা হল সামান্য একটু ইচ্ছা। সামান্য একটু সাহিত্যপ্রীতি। ভূত বা ভগবানের গল্পের চাইতে জীবনকেন্দ্রিক সাহিত্যপাঠ কোনও আড়ম্বর ছাড়াই শুরু করা যায়। সারাদিনের শরীরচর্চার জন্য যেমন মাত্র এক ঘন্টা যথেষ্ট, তেমনই মেধা আর মননের চর্চার জন্য নিয়ম করে সামান্য এক ঘন্টা সাহিত্যপাঠ করলেই তা অভ্যেসে পরিণত হয়। সেটুকু মনোযোগ, সেটুকু দাবি যারা জীবনকে বাজি রেখে সাহিত্যচর্চা করেন সেই লেখক, প্রকৃত প্রকাশক কিংবা শিবিরবিহীন সাহিত্য আলোচক দাবি করতেই পারেন বাঙালি পাঠকদের কাছ থেকে। যা কেবলমাত্র গ্রন্থপাঠের মধ্যে থেকেই পাওয়া সম্ভব। তথ্য নয়। জ্ঞান। পরনিন্দা নয়, নির্মল বিনোদনের জন্য তাই সাহিত্যপাঠ খুব জরুরি। নিজের বেঁচে থাকার জন্য যেমন জরুরি এই অভ্যাস। তেমন জরুরি নিজের প্রিয়জনদেরও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। নিশ্চিত ভবিষ্যতের খাতিরে।

আমরা উপন্যাসের বিষয় আর বক্তব্য নিয়ে আলোচনার সময় বলতে চেয়েছি লেখকের উপনিবেশের কথা। আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এও বলেছি সামুদ্রিক অভিযানের মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ অচেনা, অনির্দিষ্ট পথে ছোট ডিঙি নিয়ে ভেসে পড়ার কথা। নতুন উপনিবেশ তৈরি হয় নতুন মানবসমাজের জন্য। ইতিহাস তাই বলে। আজ যে পৃথিবীর প্রতিটা কোণে পৌঁছে গেছে মানুষের পায়ের ছাপ সে তো সেই নিশ্চিন্দিপুরের গ্রাম্য বালক শ্রীমান অপূর্বকুমার রায়ের অচেনাকে চেনার ঈচ্ছার মতো শাশ্বত এক ইচ্ছার ফল। তার জন্য বহু মানুষকে জীবনের মূল্য দিয়ে এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগেকে এভারেস্ট শিখরে পৌঁছাতে হয়। আমরা জানি দক্ষিণ মেরুর অভিযানে জীবনের মূল্য দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন স্কট। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর লিখিত ডায়রি থেকে আমরা জানতে পারি জীবনের শেষদিকে তাঁদেরকে নিজেদের শ্লেজটানা কুকুরগুলোকে মেরে তার মাংস খেতে হয়েছিল। দক্ষিণ মেরুর খোঁজে শেষমেশ সফল হননি ক্যাপ্টেন স্কট। তবুও তাঁর অভিযান, তাঁর জীবনকাহিনি আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে। একজন সৎ সাহিত্যিকের জীবনও অনেকটাই তেমন। তাঁরা বারবার অভিযানের নেশায় রাস্তায় নামেন। খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন অচেনা দ্বীপভূমি। মানুষকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য করে তুলতে সাহায্য করেন। সমাজের ভেতরে গেড়ে বসা মানসিক কুসংস্কার আর শাসকের রং-বেরঙের ভাঁওতাবাজিকে স্পষ্ট করে দেন। সাহস করে উচ্চারণ করেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়? এসব ছোট বয়সের ঝুলনখেলার মতো অনাবিল আনন্দের বিষয় নয়। এসব শিশুকালের খেলনাবাটির সংসারের মতো ক্ষণস্থায়ী বিনোদন নয়। আমাদের পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক হয়ে ওঠে একান্ত জরুরি। যেমন জানা জরুরি আমার ঘরের পাশের আমগাছটাকে। যেমন জানা দরকার আমার বাড়ির পাশের চোরপলতে গাছের কাকের বাসায় ডিম এল কি না। যেমন দেখা দরকার আজ সকাল থেকেই ঝুঁটিবাঁধা ডাকাত সেজে মেঘগুলো আকাশ ছেয়ে ফেলেছে আমাদের মন কেমন করবে বলে। কিংবা দূরের ছাদে ছোট্ট মেয়ে যখন রোদ্দুরে দেয় বেগুনি রঙের শাড়ি তখন তার রূপ। তার বিভা। জীবন তো এই। জীবনের প্রাপ্তি তো এমন চুম্বন থেকে বিদ্রোহে। সাহিত্যকে হাতছাড়া করলে আমাদের অকালমরণ কে আটকাবে?

বাঙালি পড়ুয়ার জাত। সাহিত্য সংস্কৃতি বাঙালির মজ্জাগত। এই প্রশংসা, এই পরিচিত আমাদের পূর্বপুরুষদের কারণে আমাদের প্রাপ্ত। আমাদের কোনও অধিকার নেই তাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে পরকীয়া প্রেম কিংবা টেলিভিশন মিডিয়ার সান্ধ্য খেউরে জীবনকে বইয়ে দেওয়ার। আমাদের বাঙালিদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙালি। সেটাই আমরা জাঁক করে বলি। আমাদের ব্যক্তিগত ধর্মপরিচয় আমাদের বৃহত্তর জাতিপরিচয়ের কাছে গৌণ। সেটাও হয়েছে বাংলার ধর্মমত নির্বিশেষে সাহিত্যস্রষ্টাদের অবিরাম অধ্যাবসায়ে। কাজি নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত কিংবা লালন সাঁইযের গভীর নির্জন পথ আমাদের দিয়েছে সেই দেশজ পরিচয়। তাকে অপমান করার আধিকার আমাদের নেই। তাই ধর্মের জিগির তোলা কিংবা একই ছাদের নিচে একাধিক স্ত্রী নিয়ে বাস করার উদ্ভট সিরিয়াল কাহিনি থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে হবে সমস্ত সংবেদনশীল বাঙালিকে। তাঁদের সাহিত্যপাঠে ফিরে যেতে হবে। খুঁজে নিতে হবে আমাদের সামাজিক ত্বকের গোপন অসুখ। চিহ্নিত করতে হবে মুখ আর মুখোশকে। চিনতে হবে রাষ্ট্রের গা-জোয়ারি মতলব আর তাকে যোগ্য জবাব দেওয়ার কৌশল। সময়ের সঙ্গে যারা বাঙালিকে বদলে যেতে বলেন তারা ভুলে যান সবকিছু বিলকুল ভুলে গিয়ে বাঙালি যদি মারোয়াড়ি, পাঞ্জাবি, ইয়াঙ্কি হতে চায় তবে সৃষ্টিছাড়া কিম্ভূতকিমাকার একটা জীব হয়ে ক্রমে দুনিয়া থেকে লুপ্ত হবে। বাঙালিকে বাঙালি থেকেই বিবর্তিত হতে হবে। তাকে স্মরণ করতে হবে তার সৌভাগ্যের দিনের কথা। তার ইতিহাসকথা। ইতিহাসচেতনা। আর তা সম্ভব, একমাত্র সম্ভব বাঙালি যদি সত্যি সত্যিই সাহিত্যের পাঠক হয়ে ওঠে। শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে যদি তার ফের পুনর্জন্ম ঘটে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. উপন্যাসের আলোচনায় বঙ্কিম থেকে শুরু করে দেবেশ রায় অবদি এসে থেমে গেলেন। এর মানে কি এই যে, পরের লেখকদের লেখা আপনার পড়া নেই? কেবলমাত্র একাডেমিক ক্ষেত্র পর্যন্ত আপনার পড়াশুনো?
    অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী।

Leave a Reply to Aniruddha Chakraborty Cancel reply