নির্বাসনে ডারউইন

স্বপন ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

ডারউইনবাদের দৃঢ় ভিত্তি সম্পর্কে আর একবার নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ থাকল, কেননা বোঝাই যাচ্ছে আর পাঁচটা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের মতো ডারউইনবাদ কেবল বিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের মগজেই ঝড় তোলেনি। ডারউইন ভাবাতে পেরেছেন ধর্ম ও জিরাফের সব উপাদানকেই, সেটা তাঁর বিরাট সাফল্য। ডারউইনবাদ নিয়ে আজও চিন্তিত ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়ক, আইনজীবি ও আইনপ্রণেতা— এ বড় কম কথা নয়

 

ডারউইনকে নিয়ে অধুনা ভারতবর্ষের শিক্ষাচিন্তকদের ভাবনা বা দুর্ভাবনা থেকে আমরা যে বিষয়টা সম্পর্কে আশান্বিত হতে পারি তা হল ডারউইনের প্রাসঙ্গিকতা। প্রস্তাবনার একশো ষাট বছর বাদেও বিবর্তনবাদ এতটাই জীবন্ত যে এখনও তা নম্র-ভদ্র-কুৎসিত-বিজ্ঞ-মুর্খ-গঠনাত্মক-ধংসাত্মক— সবরকমের প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে। ডারউইনবাদের এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে? একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বিতর্ক ছাড়া মেনে নেওয়ার দায় নেই কারও! বরং সেটাকে নিয়ে যদি বছরের পর বছর ধরে তীব্র কাটাছেঁড়া চলে, সেটা যদি এত বছর ধরে বিতর্কের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারে, তাহলে তার ভিত্তি সুদৃঢ় বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে একটা বিজ্ঞাননির্ভর বিতর্কের প্রতিপক্ষ যুক্তিযুক্তভাবে ঠিক কোন জগৎ বা তার অধিবাসীরা হতে পারে? যে-জগৎ দৃশ্যমান নয়, সে জগতের ওজর নিয়ে যাঁরা ডারউইনের অসারতা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে রয়েছেন এই এতগুলো বছর ধরে, সে-জগতের প্রতিপাদ্য, এমনকি সেই জগৎটির অদৃশ্য এক বা একাধিক অধিবাসীদের সঙ্গেও কীভাবে মোকাবিলা সম্ভব? যেটা কোনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই নয় সেটাকে ডিবেটের মঞ্চ বানিয়ে একটা এঁড়েতর্কের অবতারণা করা যায় মাত্র, কিন্তু সেটাকে বিদ্যার্থী-মগজের আওতার বাইরে রাখতে হবে এই ভাবনা কেবল ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনীয়। এবং আর কিছু না হোক, কেবল এই একটিমাত্র উপজীব্য অনুসরণ করেই বলা যায় ডারউইনবাদ কালাতীত রকমের সফল। হ্যাটস অফ-চার্লস ডারউইন, আপনার মত সাধারণ্যে আলোড়ন তোলা এবং রাষ্ট্রের কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়া এত জীবন্ত একটি প্রকল্পের সন্ধান এমনকি আইনস্টাইনও দিতে পারেননি!

 

এটা ঠিক যে অতি প্রাচীনকালে ‘স্রষ্টা নিজের প্রতি অসন্তোষে’ কিছু করে বসেছিলেন কিনা তা যেমন প্রমাণ করা যাবে না, তেমনি প্রাণের উদ্ভব ঠিক কিভাবে ঘটেছিল তাও ল্যাবরেটারিতে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু সৃষ্টির পর জীবনের অভূতপূর্ব বহুধাবিন্যাস, জীবিত প্রাণ এবং বিলুপ্ত প্রাণের ফসিল যার সাক্ষ্য বহন করছে, ভ্রূণের বিকাশ যার সাক্ষ্য বহন করে, বাঁচবার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নিদর্শনগুলি যে সাক্ষ্য বহন করে, প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হয়ে টিকে থাকা বা পরিত্যাজ্য বিবেচনায় হারিয়ে যাওয়ার এত প্রামাণ্য নজির রয়ে গেছে আমাদের দৃশ্য-জগতে, যে সেটাকে অস্বীকার করলে নীহারিকামণ্ডলীকে, সৌরজগৎকে, কন্টিনেণ্টাল ড্রিফটকে, অণু-পরমাণুকে, জিনতত্ত্বকে, বিগ ব্যাং প্রস্তাবনাটিকে এবং যে-কোনও তত্ত্বের নিরিখেই গোটা বিবর্তনবাদ বিষয়টিকেই অস্বীকার করতে হয়। ঘটনা এই যে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানজগৎ প্রকল্পটির প্রস্তাবনার সময় থেকেই স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেয়নি। এখনও তা অতি জীবন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয় এবং আজও এটির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন এবং ব্যাখ্যা নিয়ে অগণিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে চলেছে। কিন্তু কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই বিবর্তনবাদকে, তার গতিময়তাকে এবং উৎসপ্রাণ থেকে বহুধাবিভক্ত প্রাণের ধারণাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। অবিজ্ঞান অবশ্য যুক্তির ও প্রমাণের ধার ধারে না, কেননা দৃশ্যমান জগৎ থেকে কোনও বিকল্প তাস তার পক্ষে ফেলা অসম্ভব। সুতরাং সে চাপিয়ে দিতে চাইবে, প্রমাণরহিত বিষয়কে প্রামাণ্য বলে চালাতে গেলে এমনকি শিশুমগজেও তা আবেদন রাখতে সক্ষম হবে না, এই অনুমানে সে চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বিষয়ের আওতা থেকে মগজকে বিচ্ছিন্ন রাখতে। সুতরাং বিবর্তনবাদ সিলেবাসের বাইরে যাবে— এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু দেখি না। শুধু ভারত নয়, খ্রিস্টান আমেরিকা থেকে ইসলামি সৌদি আরব— নানা দেশে বিবর্তনবাদ হয় পরিত্যাজ্য, নয় পরিত্যাগ করার আবেদনে প্রচুর জনসমর্থন আছে। এতে অবশ্য প্রকল্পটির দৃঢ় ভিত্তি সম্পর্কে আর একবার নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ থাকল, কেননা বোঝাই যাচ্ছে আর পাঁচটা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের মতো ডারউইনবাদ কেবল বিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের মগজে ঝড় তোলেনি, তাকে নিয়ে চিন্তিত যারা তাদের হয়ত ন্যূনতম বায়োলজির ট্রেনিংটাও নেই। ডারউইন ভাবাতে পেরেছেন ধর্ম ও জিরাফের সব উপাদানকেই, সেটা তাঁর বিরাট সাফল্য। ডারউইনবাদ নিয়ে আজও চিন্তিত ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়ক, আইনজীবি ও আইনপ্রণেতা— এ বড় কম কথা নয়। বলছি না বিজ্ঞান কারও জন্য ‘অফ-লিমিট’ হয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু বিবর্তনকে যত সহজে ছেঁটে ফেলতে চান তাঁরা, তারার জন্মকে তেমনভাবে ছেঁটে ফেলার কথা ভাবেন? অভিকর্ষ বল নিয়ে এত চিন্তিত হন কি তাঁরা? সাব-অ্যাটমিক কণা যা চোখে দেখা যায় না, এমনকী ঈশ্বরকণা নামের কোনও উপাদানকেও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা নেই— যত গোল ডারউইনকে নিয়ে এবং গদি আঁটা চেয়ারে বসলেই এ সম্পর্কে মতামত দেওয়ার এক্তিয়ার পাওয়া যায়? মনে হয় এর পেছনের কারণটি গূঢ় মনস্তত্ত্ববাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। দৃশ্যমান জগতে, সৃষ্টির মহাফেজখানায় মানুষের ‘বিশেষ’ আশীর্বাদধন্য স্টেটাসটিকে তেমন আমল দেয় না বিবর্তনবাদ। নার্ভাসনেসের উৎস সেটাই, কেননা ‘এলেম আমি কোথা হতে’ এই প্রশ্ন যে উত্তরের অবতারণা করবে তাতে বিশ্বাসে মুক্তি মেলানোর রাস্তা কিছু দুর্গম বিবেচিত হতে বাধ্য।

 

বিজ্ঞানশিক্ষার গোড়ায় গলদ অবশ্য এই মনুষ্যকেন্দ্রিক বীশ্ববীক্ষা। আমরা গোড়া থেকেই খুব সচেতন ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের স্পেশাল স্টেটাস নিয়ে। এ আমাদের বহুদিনের অধীত এবং সংস্কৃতিলব্ধ বিশ্বাস। এই কারণেই সূর্যকেন্দ্রিক সৌরমণ্ডলের ধারণাকে মেনে নিতে এত কষ্ট হচ্ছিল চার্চের। লুই পাস্তুরের অতি সাধারণ পরীক্ষা যখন দেখাল জীবন আসে পূর্ববর্তী জীবন থেকেই, তখন হাওয়া থেকে, জল থেকে, দৈবী কৃপা থেকে জীবনের উদ্ভবের নানা প্রকল্পের সঙ্গে দোন কিহোতের মতো যুদ্ধ করতে হয়নি তাঁকে, কেননা বিশ্বাস ও যুক্তির পথ ততদিনে আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু মহামহিম চার্চ দ্বারা চর্চিত ‘অপার করুণা’-র ধারণাটির প্রমাণ চেয়ে বসলে হয়ত তখনও গর্দান যেতে পারত, এখনও যেতে পারে। ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের প্রকল্পটি গুবলেট হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ফোকাস বদলেছে। আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি আমরা এ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে থাকি না বটে, কিন্তু আমরা সৃষ্টি হিসেবে বিশেষ। চার্চ-মন্দির-মসজিদ আমাদের তদুপরি বুঝিয়ে এসেছে আমাদের মধ্যে বিশেষরা বিশেষের মধ্যে বিশেষ। ডারউইনবাদ এই ধারণার গোড়ায় আঘাত। মানুষের এই ‘বিশেষ’ অবস্থানকে বিবর্তনবাদ মানলে হজম করা মুশকিল। যে জীবনধারার অংশ অ্যামিবা, ছত্রাক, গিরগিটি, মাছ বা বাঁদর-মানুষও সেই জীবনধারাতেই পুষ্ট হয়েছে। এই সত্য আজকের জিনযুগে শিশুবোধের অন্তর্গত হওয়া উচিত কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের, বোঝাই যাচ্ছে, কিছু সমস্যা থাকে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের পথে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

এমনিতে নিজ নিজ পরিসরে চর্চা রাখলে, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে তেমন বৈরিতা দেখি না। বহু বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ধর্মে বিশ্বস্ত। ডারউইন নিজে ৭ মে, ১৮৭৯-এ লেখক উইলিয়াম গ্রাহামকে লিখছেন “ইন মাই মোস্ট এক্সট্রিম ফ্লাকচুয়েশনস আই হ্যাভ নেভার বিন এথিস্ট ইন দ্য সেন্স অফ ডিনাইং দি এক্সিসটেন্স অফ গড।” একইভাবে বিবর্তনবাদকে বিপজ্জনক না ভেবে নিয়ে ধর্মচর্চায় কোনও বাধা থাকার কথা নয় যদি বিষয়টি গোঁড়ামি বর্জন করে দেখা যায়। পোপও শুনেছি বিবর্তনবাদ মেনে নেওয়ার কথাই বলেছেন। এদেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালায় তাদের কখনও কোনওদিন বিবর্তনবাদকে নিয়ে বড়সড় কোনও সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি, যা আমেরিকার দক্ষিণের বহু প্রদেশে এখনও জীবন্ত ইস্যু। সেখানে রিপাবলিকান জনভিত্তির অন্যতম গোড়ার কথাই হল ‘ক্রিয়েশনিজমে’ অসংশয়ী আস্থা। বোঝা মুশকিল সমস্ত জীবের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টির যে ধারাটি প্রবাহিত হয়ে চলেছে তা ঈশ্বরের ধারণার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল কীভাবে, আর উঠল যদিও বা, আজও এই একুশ শতকে তা পুষ্ট হচ্ছে কীভাবে? এর কারণ দুটো— দৃশ্যমান জগতে যার প্রমাণ নেই তাকে বিশ্বাসের আওতায় আনতে গেলে যে অন্ধত্ব লাগে বিজ্ঞান হাজার চেষ্টাতেও তার সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারবে না; আর দুই— মানুষকে বিবর্তনের উচ্চতম অবস্থানে স্বীকার করতে বাধা না থাকলেও জীবনের বৃহত্তর পরিসরে তার অবস্থান অদ্বিতীয় নয় বরং বহুর মধ্যে এক, একথা বিজ্ঞান অস্বীকার করতে পারবে না। বাঁদর বা প্রাইমেটদের থেকে মানুষের উদ্ভব এ-কথা যত সহজে রূপকথার অঙ্গীভূত হয়, তত সহজে ধর্মে হয় না। সুতরাং ধর্ম যদি রাষ্ট্রের আফিম হয় বিবর্তনবাদকে নিয়ে তার কিছু অসুবিধে থাকবেই। যেমন অসুবিধে হেলিওসেন্ট্রিক বা সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে ছিল। যে কারণে সিলেবাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বাবর-আলমগীর, গান্ধিহত্যা, ঠিক সেই একই কারণে পাঠ্যতালিকায় ঢুকে পড়ছে জ্যোতিষশাস্ত্র আর গোবরের গুণাগুণ।

 

এসবই ‘ক্রিয়েশনিজম’-এর (সর্বশক্তিমানের কেরামতিতে আস্থা) হাতে যুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে তুলে দেওয়ার তাগিদ কেননা একই ইন্টেলেকচুয়াল প্ল্যাটফর্মে এ-দুয়ের সহাবস্থান কার্যত অসম্ভব। বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে যে বিকল্প কার্যক্রমগুলির অবতারণা করা হচ্ছে তার মূল বিষয় চারটি: ডারউইন সম্পর্কে ঔৎসুক্য তৈরি হওয়ার রাস্তাটিকেই রূদ্ধ করা; বিজ্ঞান সাধারণভাবে যা বলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণিত হয়ে থাকুক বা না-থাকুক ঐশ্বরীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তা কিছুতেই নয় এটা চাপিয়ে দেওয়া; এ একটা এক্সপেরিমেন্ট যা পরে বিগ ব্যাং বা জিনতত্ত্বের ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করবার পথ সুগম করবে; এবং  প্রাণপ্রবাহের মধ্যে উৎসগত সাম্যের ধারণা যে যৌক্তিক বোধের জন্ম দেয় তার অবস্থান মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী বোধের বিপ্রতীপে, ফলে সেটাকে গোড়াতেই ছেঁটে ফেলা। যে-পৃথিবীতে ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা সবকিছুতেই বহুত্বের বোধকে বিসর্জন দিতে গেলে ডারউইন সাহেব অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবেন সে-পৃথিবীতে আমাদের সন্তানেরা ততটা গিনিপিগ হয়ে উঠতে পারবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কেননা ডারউইন সাহেব বৃদ্ধ হয়েছেন, তবে মরে যাননি। এমনকি নির্বাসনে পাঠিয়েও তাঁকে মুছে ফেলা অসম্ভব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...