বিবর্তন-বিরোধী সাম্প্রতিক বিতর্ক এবং আমাদের ইতিহাস

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

 

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন চিকিৎসক সমাবেশে পৌরাণিক প্লাস্টিক সার্জারি ও পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবি হিসেবে কর্ণকে নিয়ে গল্পস্বল্প করেন তখন তাঁর অনুগামীরা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখবার ক্ষেত্রে, এমনকি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও, সেই সূত্র ধরেই এগোতে চাইলেন। তখন থেকেই গণতান্ত্রিক সমাজের স্তম্ভগুলোকে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উল্টোপথে চলতে উৎসাহ দেওয়া শুরু হল

 

মনে আছে নিশ্চয়ই ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর ভারতবর্ষের নতুন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের স্বাস্থ্যপরিষেবা উন্নত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমাদের দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক সময়ে যে উচ্চতায় গিয়েছিল তা নিয়ে আমরা গর্বিত বোধ করতে পারি। আমরা সবাই মহাভারতে কর্ণের কথা পড়েছি। আরেকটু চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে, মহাভারত বলছে কর্ণ তার মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। এর অর্থ হল সেই সময়ে জিনবিদ্যা উন্নত ছিল। তাই কর্ণ তার মায়ের গর্ভের বাইরে জন্মগ্রহণ করতে পারে।” এখানেই না থেমে শ্রী নরেন্দ্র মোদি চিকিৎসকদের আরও গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন, “আমরা গণেশের পূজা করি। সেই সময়ে নিশ্চয়ই কোনও শল্যবিদ ছিলেন যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা রেখে প্লাস্টিক সার্জারির অনুশীলন করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্র অবশ্যই আছে যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা বড় অবদান রেখেছেন। আমরা যদি মহাকাশবিজ্ঞানের কথা বলি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা মহাকাশবিজ্ঞানে কোনও না কোনও সময়ে দারুণ উচ্চতায় উঠেছিলেন। আর্যভট্টের মতো লোকেরা শতাব্দী আগে যা বলেছিলেন তা আজ বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত হচ্ছে। আমি যা বলতে চাই তা হল, আমরা এমন একটি দেশে (জন্মেছি) যার এই ক্ষমতা ছিল। আমাদের এগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে।”[1]

অবশ্য অনেকে বলতেই পারেন যে, এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই কথা তিনি আগেও বলেছেন। এটা তো হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীদের অন্যতম প্রধান বক্তব্য। তবে কিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রাচীন ভারতবর্ষের স্টেম সেল প্রযুক্তি ও শল্যচিকিৎসা নিয়ে ‘মন কি বাত’ বললে আশা করা যায় দেশের নামজাদা বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং স্বনামধন্য মিডিয়া হাউসগুলো কিছু ভিন্ন বার্তা দেবে। সে আশা দুরাশা; দেশ জুড়ে সেরকম সমালোচনা তখন দেখা যায়নি। বিজ্ঞানী ও জ্ঞানী মানুষেরা এই বিতর্কে ঢোকেননি। এড়িয়ে গেছেন। হয়তো তারা নয়া প্রধানমন্ত্রীকে আরও কিছুটা সময় দিতে চেয়েছেন। আর তার ফলে এই ধরনের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদবিরোধী, সাবুদহীন বার্তা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে বিভিন্ন স্বরে ও সুরে ক্রমাগত পরিবেশিত হতে লাগল।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন চিকিৎসক সমাবেশে পৌরাণিক প্লাস্টিক সার্জারি ও পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবি হিসেবে কর্ণকে নিয়ে গল্পস্বল্প করেন তখন তাঁর অনুগামীরা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখবার ক্ষেত্রে, এমনকি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও, সেই সূত্র ধরেই এগোতে চাইলেন। তখন থেকেই গণতান্ত্রিক সমাজের স্তম্ভগুলোকে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উল্টো পথে চলতে উৎসাহ দেওয়া শুরু হল।

 

ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী বনাম ধারাবাহিক হিন্দু সংস্কৃতি

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতবর্ষে আগমনের প্রশ্নটিকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ক্রমাগত জলঘোলা করতে নেমে পড়লেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেন যে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দুরা হিন্দুস্তানে বসবাস করে— তাদের উৎস এক, তাদের সংস্কৃতি এক। তারা চেষ্টা করেন একটি ‘অভিন্ন, ধারাবাহিক হিন্দু সংস্কৃতি’র প্রবর্তক হিসাবে হরপ্পীয় ও বৈদিক সভ্যতাকে উপস্থাপনের। আর্যভাষীরা ভারতের আদি বাসিন্দা। শুধুমাত্র তুর্ক-আফগান-মুঘলরা, এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা এই দেশে বাইরে থেকে এসেছে। তারা বহিরাগত। এক হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই দেশে বিশুদ্ধ, খাঁটি দেশজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষা ছিল। এই ভূমিতে হিন্দু ছাড়া অন্যান্যদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে।[2]

অথচ দীর্ঘদিন ধরে কিছু ভাষাতত্ত্ববিদ ও শব্দতত্ত্ববিদ ইউরোপীয় ভাষাগুলির সঙ্গে উত্তর ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করে এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন। ইউরোপ ও দক্ষিণ ভারতের ভাষা নিয়ে তুলনামূলক চর্চার সাহায্যে তারা নিষ্পত্তি করেন যে, ৬৫০০-৪৫০০ বছর আগে পর্যন্ত, নব্যপ্রস্তর যুগের শেষে ও ব্রোঞ্জ যুগের প্রাথমিক পর্বে, রাশিয়ার পন্টিক-স্তেপভূমিতে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় একটি ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হত। সম্ভবত ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে ওই ভাষার এক শাখা বৈদিক-সংস্কৃত ভারতবর্ষে এসেছে।

সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধুনদের তীরে এই অঞ্চলের প্রথম নগরকেন্দ্রিক হরপ্পীয় সভ্যতার অবসান হয়। তবে ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতে আগমনের সঙ্গে হরপ্পীয় সভ্যতার অবসানের কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নৃতত্ত্ববিদ বা প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রমাণ করতে পারেননি। আরও একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে— হরপ্পীয় সভ্যতায় যেসব লিখিত সিল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতের কোনও যোগাযোগ এখনও কেউ দাবি করেননি।

হরপ্পীয় নগরসভ্যতা

তবে হিন্দুত্ববাদীরা যেহেতু তুলনামূলক ভাষাচর্চা থেকে উপনীত সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করেন, তাই দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই বিতর্কের অবসানে আরও পাথুরে প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। শেষ কুড়ি বছরে আধুনিক জীববিজ্ঞানের কিছু প্রকৌশল, যেমন ‘জনজাতি জিনবিদ্যা’ বা পপুলেশন জেনেটিক্স; মানুষের অভিবাসন চর্চায় ও জাতি গঠনের ধারণায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

জিনবিদ্যার সাহায্যে প্রমাণ করা যায়, বিবর্তনের পথ ধরেই আফ্রিকাতে তিন থেকে সোয়া তিন লক্ষ বছর আগে কোনও এক হোমো প্রজাতি (বৃহৎ মস্তিষ্কের অধিকারী এই প্রজাতিগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারত) থেকে মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) উদ্ভব হয়েছে। তবে সত্তর হাজার বছর আগে একবার তুষার যুগের প্রচণ্ড ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় একদল মানুষ টিকে থাকবার প্রয়োজনে বেরিয়ে পড়েছিল পূর্ব আফ্রিকা থেকে। তারা কেনিয়া থেকে হর্ন অফ আফ্রিকা ধরে চলে আসে ইয়েমেনে। তারপরে সিন্ধু নদ পেরিয়ে একদিন পা ফেলে ভারতভূমিতে। প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে এই দেশে এসে তারা বংশানুক্রমে বাস করতে থাকে।[3] তাদের সঙ্গে আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া, ওঙ্গে ইত্যাদি যারা দীর্ঘদিন ধরে অন্য কোনও জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত না হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছেন, তাদের জেনেটিক সাদৃশ্য খুব বেশি।[4]

এরাই ভারতবর্ষ তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জনগোষ্ঠী। এদের বলা হয় ‘আন্দামানি শিকারি-সংগ্রাহক’।

পরবর্তী পরিযানগুলিতে যারা এসেছিল, তাদের আদি বাসভূমি আফ্রিকা হলেও তারা আফ্রিকা ও ভারতের মাঝামাঝি নানা অঞ্চলে বহু সহস্র বছর কাটিয়ে ভারতের দিকে এসেছে।[5] এইসব নবাগত জনগোষ্ঠী যখন ভারতে পরিযান করেছে তখন তাদের পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীর তুলনায় অনেক বেশি। সেই সময়ে ভারতবর্ষের প্রজননক্ষম নারীরা পরবর্তীকালে আসা গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তুলনায় বেশি মিশ্রিত হয়েছে। আর দেশীয় পুরুষরা হয়তো নবাগতদের কাছে হেরে গিয়ে ক্রমাগত সংখ্যায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে অথবা চলে গেছে দূরবর্তী নির্জন প্রান্তরে।

চার হাজার বছর আগে স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকরা ঘোড়া ও রথে চড়ে সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। তাদের মুখে সুললিত ভাষা ছিল, কিন্তু লিখবার লিপি ছিল না। চেহারা ছিল লম্বা, দেহবর্ণ হালকা।

আবার প্রায় একই সময়কালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে উপমহাদেশের প্রথম নগরসভ্যতা, হরপ্পীয় নগরসভ্যতা, অবলুপ্ত হওয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই অবস্থায় হরপ্পীয় মানুষ বেঁচে থাকার তাড়নায় দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে চলে যায়। ইতিমধ্যে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে প্রবেশ করেছে ইন্দো-ইউরোপীয়রা।[6] হরপ্পীয় নাগরিক সভ্যতা ভেঙে গেল, ফলে তার প্রযুক্তি-কৌশলও মানুষ ভুলে গেল। ইন্দো-ইউরোপীয়রা তখন নগরসভ্যতার স্তরে আসেনি। তাই ভারতবর্ষকে আরও দেড় হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আবার নগরসভ্যতায় ফিরে আসতে।

 

একটি ক্যালেন্ডার ও কিছু প্রশ্ন

২০২২ সালের খড়্গপুর আইআইটির ক্যালেন্ডার প্রকাশের পরে অবশ্য বিজ্ঞানীরা প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন। বিজ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র খোদ আইআইটি প্রকাশ করেছে এমন এক ক্যালেন্ডার যার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সংযোগ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ক্যালেন্ডার দেখে মনে হয় ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী বাইরে থেকে ভারতবর্ষে পরিযান করেনি, কোনও জনগোষ্ঠীই ভারতের বাইরে থেকে প্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন যুগে পরিযান করেনি, হরপ্পীয় ও বৈদিক সভ্যতা বলে আলাদা কিছু ছিল না, একই জনগোষ্ঠীর সভ্যতা অবিচ্ছিন্নভাবে এই দেশে প্রবাহিত হয়েছে, এই প্রতিপাদ্য প্রমাণ করবার প্রচেষ্টা আছে। ক্যালেন্ডার শুরু হয়েছে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য দিয়ে— ভারতীয় সভ্যতা ও ইতিহাসের বর্তমান কালপঞ্জি সন্দেহজনক এবং প্রশ্নযোগ্য (The current chronology of Indian civilization is dubious and questionable)। ক্যালেন্ডার প্রস্তুতকারকরা মনে করেন:

  1. মাত্র চার হাজার বছরে ভারতীয় বৈদিক সভ্যতাকে গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না।
  2. আর্যভাষীদের ভারত আক্রমণ তত্ত্ব ভ্রান্ত।
  3. চার হাজার বছর পূর্ববর্তী দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা আর্যভাষীদের আক্রমণে লুপ্ত হয়েছে, এই গল্প (myth) আসলে হরপ্পীয় সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার বিভাজন প্রকল্পে তৈরি হয়েছে।
  4. এই পরিকল্পনা করা হয়েছে পশ্চিমি সভ্যতার প্ররোচনায়। তারা চেয়েছেন বিদেশিদের ভাষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক অবদান যে বেদের মহাজাগতিক ও কল্যাণময়তার থেকে শ্রেষ্ঠতর তা প্রমাণ করতে। এইজন্য জাতিগত এবং জেনেটিক শব্দার্থ (racial and genetic semantics) ধরে তাদের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

হরপ্পীয় ও বৈদিক সভ্যতা অবিচ্ছিন্নভাবে এই দেশে প্রবাহিত হয়েছে, ক্যালেন্ডারে এই প্রতিপাদ্য প্রমাণ করবার প্রচেষ্টা আছে। ইতিহাস রচনায় ভিন্ন প্রতিপাদ্য থাকতেই পারে। কিন্তু সেই প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠা করতে ক্যালেন্ডার কোনও মাধ্যম কিনা এই প্রশ্ন না তুলেও বলতে পারা যায়, প্রতিপাদ্য প্রমাণ করবার জন্য প্রয়োজন ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায় যে তথ্য নথিবদ্ধ হয়েছে প্রমাণ সহকারে তার খণ্ডন। ক্যালেন্ডারটি সেইসব বিদ্যাচর্চাকে হেয় করতে চাইলেও তার জন্য যুক্তিসিদ্ধ কোনও প্রমাণ দেয়নি। ১৯৯৬ সালের ম্যাগাজিন ডাউন টু আর্থ, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিন, বিষ্ণু পুরাণ ইত্যাদি খড়্গপুর আইআইটির ক্যালেন্ডারে প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে দেখে জীববিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা হতাশ হবেন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতার সঙ্গে হরপ্পীয় কিশোরীর মূর্তি, কসমিক লাইট, বুদ্ধের ছবির সঙ্গে হরপ্পীয় সিল, মহাজাগতিক আলোর স্তম্ভ, মহাজাগতিক প্রতিসাম্য ও সপ্তসুর— এসবের মধ্যে কোনও বিধিবদ্ধ জ্ঞানচর্চার আভাস নেই। ইউরোপীয় ইউনিকর্নের সঙ্গে হরপ্পীয় সিলের একশৃঙ্গ পশু বা বৈদিক যুগের ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি সংযুক্ত এমন দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে সম্পর্কহীন কয়েকটা ছবি একসঙ্গে দিলেই হয় না।

বিবর্তনবিরোধী, যুক্তিবাদবিরোধী বক্তব্য পেশ করতে হলে তার সপক্ষে জবরদস্ত প্রমাণ দিতে হবে। বিংশ শতকের সত্তরের দশকে এরিক ভন দানিকেনের ‘দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ’ প্রসঙ্গে বিগত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেছিলেন, “Extraordinary claims require extraordinary evidence.” এই ক্যালেন্ডার দেখে মনে হল “That which can be asserted without evidence, can be dismissed without evidence.” তবু ভারতবর্ষের প্রথম আইআইটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাচর্চার অন্যতম পীঠস্থান, যদি এমন দাবি তোলে তাহলে তাকে গুরুত্ব দিয়ে, তথ্যপ্রমাণ সহকারেই খণ্ডন করতে হয়।

ইতিহাস লেখা হয় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান; প্রমাণসাপেক্ষে অর্জিত জ্ঞান ও তা নথিবদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে। এই কাজ কোনও একজনের দ্বারা, কোনও একদিনে হয় না। আবার একথাও সত্য, ইতিহাস লেখাতে শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। তবে আজকে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন জিনবিদ্যা, প্রত্ন-জিনবিদ্যা, প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদির সাহায্যে প্রাচীন ইতিহাস লেখা হচ্ছে। বিভিন্ন ধারার জ্ঞানের আদানপ্রদান, প্রতিযাচাই ও তার সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই মানবসভ্যতা এগিয়েছে। সেই জ্ঞান অন্বেষণে সকল ধারার মধ্যে সাযুজ্য থাকতে হয়। যেহেতু জিনবিদ্যা বিশেষভাবে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য প্রদান করে তাই ইতিহাসবিদরাও আজ জিনবিদদের দেওয়া তথ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ওই সময়ের ইতিহাস লিখছেন।

 

শেষের কথা

হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়প্রাপ্তির পরে তার প্রযুক্তিগত বিদ্যার ধারাবাহিকতা আর থাকল না। আজকের ডিএনএ তথ্য বলছে তারা পরবর্তীকালে প্রায় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ছোট ছোট ইতস্তত বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত গোষ্ঠীর নেতৃত্বহীন মানুষ গ্রামীণ সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহন করেছে সারা ভারতবর্ষে। চাষের কাজে বলদের ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের গহনা, দাবা ও পাশাখেলা, মূর্তি ও বৃক্ষপূজা, শিশ্নপূজা, জীবনচর্যায় গাছ ও পশুর গুরুত্ব, বলদে টানা যানবাহন, মৃৎ ও ধাতুশিল্প, নাচের মুদ্রা, সঙ্গীতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বাজনা ইত্যাদির ধারাবাহিকতা আজও চলেছে।

চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে এদেশে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত হয়। কিছু ধর্মীয় জীবনচর্যা যেমন শবদাহ ও অন্যান্য অগ্নিসংস্কার এদের থেকেই এসেছে। তারা মূর্তিপূজক ছিল না, ঘৃণা করত শিশ্নপূজাকে। অগ্নিসংস্কার ও যজ্ঞে রাখত আস্থা, আস্থা ছিল বেদের মহত্বে। স্বজন হারালে শবদাহ করত। মানুষ নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর। আত্মজন চলে গেলেও জীবন চলবে নিজের ছন্দে।

স্তেপভূমির সেই জনগোষ্ঠীতে নারী সংখ্যায় ছিল কম। এদেশের নারীদের সঙ্গে তাদের মিশ্রণ হয়, আর ধীরে ধীরে তারা আংশিকভাবে আত্তীকরণ করে দেশের আচার। আজকের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান জীবনচর্যা ও সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানপ্রণালী অন্নপ্রাশন, বৈবাহিক ও শ্রাদ্ধ ক্রিয়ার মূলে আছে অগ্নিসংস্কার, যজ্ঞ। এছাড়া বিবাহে আছে আরও অনেক স্ত্রী-আচার যেগুলি মূলত হাজার হাজার বছরের দেশজ প্রথা। মৃতদেহ সৎকার হয় বৈদিক প্রথায়।

মূর্তিপূজা, ধর্মে বৃক্ষ ও পশুর গুরুত্ব এসেছে হরপ্পীয় সভ্যতা থেকে। তার সঙ্গে স্থানীয় ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর নানা আচারও হয়তো স্থানীয় রূপভেদের মধ্যে এসে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচারসমগ্র এক অনমনীয় ধর্মের রূপ নেয়। তবু আজও খাদ্যাভাস, বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরির নিয়মবিধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন।

আবার ভারতের সংস্কৃতিতে ইন্দো-ইউরোপীয়দের প্রাথমিক অবদান সুললিত ভাষা; পরবর্তীকালে এই সভ্যতার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞানের নানা শাখা, শিল্প, ভাস্কর্য ইত্যাদির চর্চা। দার্শনিক চিন্তা, গণিত, বিজ্ঞান ও অর্থনীতি-রাজনীতির চর্চা এই সভ্যতা-সঞ্জাত।

আমাদের সংস্কৃতি বহু জনগোষ্ঠীর পরিযান, মিশ্রণ ও মন্থনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে বা অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে অবিমিশ্র ‘বিশুদ্ধ’ জনগোষ্ঠী হিসেবে থেকেছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেই আদি অধিবাসীরা সভ্যতার আদিম স্তরে রয়ে গেল। আর এদিকে সভ্য পৃথিবীর মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের ছবি তুলে মুহূর্তে তা পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এবং গড় জীবনকাল বাড়িয়ে নিল ৭৯ বছরে।

‘বিশুদ্ধ জাতি’ হওয়া অবিমিশ্র সৌভাগ্য কিনা, সেটাও একবার ভাবতে পারি।


[1] PM Modi takes leaf from Batra book: Mahabharata genetics, Lord Ganesha surgery. The Indian Express. Oct 28, 2014.
[2] Golwalkar, M.S. “We or Our Nationhood Defined”. Nagpur: Bharat Publications. 1939.
[3] Oppenheimer, Stephen. “Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: tracing uniparental gene trees across the map”. Phil. Trans. R. Soc. B367770–784. 2012.
[4] Thangaraj, Kumarasamy. et al. “In situ origin of deep rooting lineages of mitochondrial Macrohaplogroup ‘M’ in India”. BMC Genomics. 7(151). 2006.
[5] Thapar, Romila; Witzel, Michael; Menon, Jaya; Friese, Kai; Khan, Razib. “Which of Us Are Aryans?”. Aleph Book Company. Chapter 2. 2019.; Underhil, Peter. A. et al. “The Phylogenetic and Geographic structure of Y-Chromosome haplogroup R1a,” European Journal of Human Genetics, 23: 124-131. 2015.
[6] Shinde, Vasant et al. “An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers”. NIH. Cell, 179(3): 729-735. 2019; Narasimhan, V.M. et al. “The formation of human populations in South and Central Asia”. Science. 365(6457). 2019.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...