র‍্যাগিং-এর রসায়ন: বিকৃতির ইতিহাস

অনুরাধা কুন্ডা

 


সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। আতুপুতু করে সন্তানকে মানুষ করবেন না। শক্তপোক্ত করে বড় করুন। নতুনরা সিনিয়রদের চোখে চোখ রেখে "না" বলতে শিখুক। একসঙ্গে অনেকজন প্রতিবাদ করলে সব প্রতিরোধ সম্ভব। কর্তৃপক্ষ, আইন, প্রশাসন ইত্যাদি ভারী ভারী বিষয়ে না-ই বা গেলাম

 

টক্সিক ম্যাসকিউলিনিটি। টক্সিক কাস্টিজম (কাস্টিজম ব্যাপারটাই অবশ্য বিষাক্ত)। টক্সিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম।

পৃথিবীতে যা কিছু টক্সিক এবং বিষাক্ত বস্তু আছে, তাদের মধ্যে সর্বাধিক হানিকর এই তিনটি টক্সিসিজম, যা আমরা সামাজিকভাবে মেনে নিই, মেনে এসেছি বহু বছর ধরে। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ হয় আর তারপর তা বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়। তার ফলশ্রুতি আমাদের আজকের সমাজ। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে নিজগোষ্ঠীর অপর একজনকে বিরক্ত করে আনন্দ পায়। অপরকে হেনস্থা করে আনন্দ পায়। এই ‘অপর’ কে? ‘অপর’-এর ধারণাটি কী? যা আমি নই তাই ‘অপর’। আমার চেয়ে অধিকতর সবলকে আমি হেনস্থা করতে পারি না। তাই দুর্বলের ওপর অত্যাচার করি। সামাজিক স্বীকৃতি পেতে পেতে এটাই প্রাতিষ্ঠানিক সত্য হয়ে গেছে। স্কুলে শক্তিমান ছাত্র দুর্বল ছাত্রকে বুলি করে। কলেজে র‍্যাগিং, কর্পোরেট অফিসে র‍্যাগিং, সংসারে র‍্যাগিং। দুর্বলের ওপর সবলের যূথবদ্ধ অত্যাচার।

দুর্বলের ওপর অত্যাচার করা সবলের দুর্বলতা। সবলকে আমরা কখনও চটাই না। অতএব অত্যাচার অব্যাহত থাকে। র‍্যাগিং শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের রাগবি স্কুলগুলোতে। আবাসিক স্কুল। শক্তিমান সিনিয়ররা ছোটদের খাটাত আর শারীরিকভাবে অত্যাচার করত। কবি ম্যাথ্যু আর্নল্ডের বাবা তাঁর বিখ্যাত বই ‘টম ব্রাউন’স স্কুল ডেজ’-এ র‍্যাগিং আর ফ্যাগিং-এর কথা অনেকটা লিখেছেন। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেদের কম্বলে মুড়ে আড়ংধোলাই দিত দাদারা। এই নিষ্ঠুর প্রথা ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে কবে ঢুকে গেল জানা নেই, কিন্তু যখন ঢুকল তখন বেশ জাঁকিয়েই বসল। তথ্যের খোঁজ নিলে দেখা যাবে র‍্যাগিং-এ মৃতের সংখ্যা কম নয়। আর নিগৃহীতের সংখ্যা তো অগুন্তি। টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিকে অনুকরণ করতে গিয়ে মেয়েদের মধ্যেও এল এই স্যাডিস্টিক অভ্যেস, সেও খুব কমদিনের কথা নয়।

স্যাডিস্টিক মানুষজন প্রেমের সন্তান নয়। তারা অপ্রেমের সন্তান। তাদের শৈশব, কৈশোর অপ্রেমে, অযত্নে কেটেছে। গুচ্ছের প্রাইভেট টিউশনে পাঠানো মানেই সন্তানের যত্ন নেওয়া নয়। গাদা গাদা পোশাক কিনে দেওয়া, খাদ্যসম্ভার মুখের সামনে তুলে ধরাও সন্তানের যত্ন নেওয়া নয়। বিবাহের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া নয়। তবু লক্ষ লক্ষ অপ্রেমের বিবাহ হয় ঢাকঢোল বাজিয়ে, বংশরক্ষার্থে যৌনতা হয় এবং সমাজের ভয়ে ক্লান্তিকর সহবাস। সন্তান অবহেলিত। ছেলেটি বা মেয়েটি বড় হচ্ছে ল্যাপটপ আর মোবাইল হাতে নিয়ে। নেট অন। সার্চ করার আগেই পপ আপ করছে নিষিদ্ধ সাইট। স্বভাবতই সেখানে ঢুকে পড়ছে শিশু। মনিটরিং ছাড়া প্রযুক্তি ভয়ঙ্কর। প্রযুক্তি আসার আগে কি অত্যাচার ছিল না? অবশ্যই ছিল। কিন্তু প্রযুক্তি এসে তাকে হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্লাস থ্রি-র বাচ্চা সেক্স চ্যাট করে, শুনেছেন? রেপ থ্রেট দেয় সহপাঠীকে। নিতান্ত মফস্বলে। গ্রামের ইশকুলে খালি পা সিনিয়র আরেক খালি পা জুনিয়রকে টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে মলেস্ট করে। বাকিরা পাহারা দেয়। কারণ মনিটরিং নেই।

তবে র‍্যাগিং-এর আরও মারাত্মক রকমফের আছে। টক্সিক ইন্টেলেকচুয়ালরা ভয়ানক। রণজিৎ দাশের এই কবিতাটি বারবার মনে করি।

ক্ষত

মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়শই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্তবোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ কী মূল্য আমি দেব? যতই মহৎ হোক সেই শিল্পকীর্তি, তবু আমি তার কানাকড়ি মূল্যও দেব কি? পণ্ডিতেরা বলেন, ভুল, এই বিচার ভুল। শিল্পীও একজন মানুষ, আর সব মানুষের মতো তার ভিতরেও রয়েছে একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তান। এবং নিজের ভিতরে এই সাধু-শয়তানের দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে তার শিল্প। সুতরাং, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন দিয়ে তার শিল্পের বিচার এক মারাত্মক ভুল। পণ্ডিতেরা সর্বদাই এত ঠিক কথা বলেন! এত খাঁটি সত্য কথা! এবং সব সত্যই কি অদ্ভুত নির্মম! কোমলতার পক্ষে কি কোনও সত্য নেই? না, কোমলতার পক্ষে কোনও সত্য নেই, শুধু বেদনা রয়েছে। সেই বেদনার কাছে আমি আজীবন গুম হয়ে থাকি। দেখি যে, আমার মনে গোঁজ হয়ে আছে একটিই কঠিন কথা। কথাটা এই যে, শিল্পী হওয়ার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্যে রিলকে-র সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যে পিকাসো-র সব ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি। জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না। সেই অপরাধ, সেই আঘাত আরেকটি নীরব প্রাণে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, শিল্পীর আজীবনের সকল শিল্পকর্ম দিয়েও সেই ক্ষতটির ক্ষমা হয় না, শুশ্রূষা হয় না। সমস্ত শিল্পের চেয়ে সেই ক্ষতটি বড়।

সমস্ত শিল্পের বিরুদ্ধে, সেই ক্ষতটিই ঈশ্বরের বিষণ্ণ কবিতা…

অবশ্য এক্ষেত্রে যাঁরা র‍্যাগিং করলেন, তাঁরা কেউ মহান শিল্পী নন। তাঁরা একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুবাদে, সিনিয়রিটির সুবাদে নিজেদের ইন্টেলেকচুয়ালি সবল মনে করেন। পুরুষরা পুরুষ হওয়ার সুবাদে প্রভু। নারীরা পুরুষদের প্রভু হন কম কিন্তু যখন হন, নির্মম হয়ে উঠতে তাদের বাঁধে না। “ছেলেদের হস্টেলে এইভাবে র‍্যাগিং হয়। তাহলে মেয়েদের হস্টেলে হবে না কেন?” অতএব পুরুষতুল্য হয়ে ওঠার তাগিদে মেয়েরাও ভয়ঙ্করভাবে র‍্যাগিং করেন। জুনিয়র ছেলেদের হেনস্থা করেন নিষ্ঠুরভাবে। “ওই মেয়েটাকে গিয়ে চুমু খেয়ে আয়” জাতীয় প্র্যাকটিকাল ব্যাপার ঘটে থাকত আশির দশকেও। সিনিয়র মেয়েরা জুনিয়র ছেলেদের অক্লেশে হেনস্থা করত। ভাবতে অবাক লাগে যে মোটা পাওয়ারের চশমা পরা সিরিয়াস দেখতে ছেলে বা শাড়ি কাজল টিপ পরা তুমুল প্রেমিকা মেয়ে কীভাবে এরকম নির্দয় অত্যাচারী হয়ে ওঠে! এদের মধ্যে একইসঙ্গে ডঃ জেকিল আর মিঃ হাইড বাস করে তবে? আশির দশকে যাদবপুরের হস্টেলের কুখ্যাতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে আমরা হস্টেলে ঢুকেছিলাম ভীষণ ভয়ে ভয়ে। ফার্স্ট ইয়ারের ষোলোটি মেয়ে একসঙ্গে থাকতাম। খেয়ে উঠেই দরজা হত বন্ধ ঘরের। সুখের বিষয়, কিছুই হল না। আমরা অ্যান্টি র‍্যাগিং সেল তৈরি করেছিলাম। ঊর্মির দিদি সুমিদি হস্টেলের সিনিয়র বলেও হয়তো আমরা ছাড় পেয়েছিলাম। সেটা নেহাত ভাগ্য। কিন্তু মেইন হস্টেল তখনও বিষাক্ত ছিল। নেশা ও র‍্যাগিং-এ একটি ছেলে তিনতলা থেকে ‘পড়ে যায়’ ওই সময়েও। ক্ষমতার অপব্যবহারে মেয়ে পুরুষের ফারাক থাকে না। মেয়েরা হয়ে ওঠে ছোটখাটো হিটলার। এই কুখ্যাতির গ্লোরি উপভোগ করে তারা। কোন ফ্রাসট্রেশন কাজ করে কে জানে! ভীষণ সফল ছাত্র বা ছাত্রীও যখন কুখ্যাত হয় র‍্যাগিং-এর জন্য, তখন মনে হয়, সমস্যা আপব্রিঙ্গিং-এই।

নারী বা পুরুষ, যেই র‍্যাগিং করুক না কেন, কমন ফ্যাক্টর হল অপরের অস্তিত্বকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। র‍্যাগিং বা ফ্যাগিং যাঁরা করেন, বিকৃতকাম শিল্পীদের মতোই তাঁদের ভিতরকার স্যাডিজম নিজেদের চেয়ে দুর্বল কাউকে দেখলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতীয়দের ওপর যূথবদ্ধভাবে অত্যাচার করে গেছে। ফিকশনের দুনিয়ার ক্লেটনরা কৃষ্ণেন্দুদের র‍্যাগ করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবের ক্লেটনরা কৃষ্ণেন্দুদের খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। অপরকে হেনস্থা করার এই আদিম ইচ্ছা মানুষ সংযত করতে পারে শিক্ষা, সহবত আর সহমর্মিতা দিয়ে। শিশুর গড়ে ওঠার সময় এই মানবিক গুণগুলোর দিকে লক্ষ রাখলে ইংল্যান্ডের রাগবি স্কুলগুলোতে এই জঘন্য প্রথার সৃষ্টি হত না। গভীর রাতে সিনিয়র ছেলেরা এসে কনকনে ঠান্ডায় কচি কচি ছেলেগুলোকে অত্যাচার করত। ম্যাথু আর্নল্ডের পিউরিটান পিতৃদেব ‘টম ব্রাউন’স স্কুল ডেজ’-এ কিছুটা তার বর্ণনা দিয়েছেন কিন্তু পিউরিটান ইংল্যান্ড, ক্রিশ্চিয়ানিটি ইত্যাদি মাথায় রেখে মনে হয় তিনিও সবকিছু লিখে উঠতে পারেননি। আড়াল করেছেন অনেকটাই।

ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে ভারতে আসা র‍্যাগিং পাবলিক স্কুল থেকে ছড়িয়ে পড়ল উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে। যা উত্তরোত্তর বাড়ল। আমাদের ছোটবেলায় সত্তরের দশক থেকেই খবরের কাগজে উঠে আসত ছাত্রের মৃত্যুর খবর। মেয়েদের মধ্যেও শুরু হয়েছে শোনা যেত। হস্টেল যেন হস্টেল নয়। বিভীষিকা। র‍্যাগিং-এর অধ্যায় পার না হওয়া পর্যন্ত তুমি প্রতিষ্ঠানে গৃহীত নও, এইরকম ছিল মানসিকতা। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজের র‍্যাগিং ছিল সর্বাধিক বিকৃত এবং কুখ্যাত। সবচেয়ে মারাত্মক হল নতুন ছাত্রকে জোর করে নেশা করানো এবং তাকে নেশায় অভ্যস্ত করতে বাধ্য করা অথবা জোর করে যৌনতায় লিপ্ত করা। ছিল আইআইটির বিখ্যাত ব্রেন ওয়াশ— কমোডে মাথা ঢুকিয়ে ফ্ল্যাশ টেনে দেওয়া, ব্লেড দিয়ে হাত, পা, যৌনাঙ্গে আঘাত করা, গোটা টুথপেস্ট গেলানো, চারতলার কার্নিশে হাঁটানো, মদ খাইয়ে নির্যাতন এবং আরও আরও বিভিন্ন বিকৃত পদ্ধতি যা দিয়ে সদ্য কলেজে পড়তে আসা একটি শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ ও মেরুদণ্ড সর্বার্থেই ভেঙে দেওয়া যেতে পারে। অপরের মর্যাদাবোধে আঘাত করে মানুষ বড় আনন্দ পায়। র‍্যাগিং তার পৈশাচিক প্রকাশ।

একটা বিষয় খেয়াল করে দেখুন, হস্টেলে কিন্তু মহানগরের কেতাদুরস্ত ছেলেপুলে থাকে না। তারা ডে স্কলার। আসে, পড়াশোনা করে, আড্ডাবাজি, খিস্তিবাজি করে, ফিরে যায়। যাদবপুর বা ব্রেবোর্ন, প্রেসিডেন্সির মতো তারকা প্রতিষ্ঠানেও কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে খিস্তি দেওয়াকে স্মার্টনেস বলে গণ্য করার ট্র্যাডিশন তৈরি হয়েছে। আইআইটি তো পথপ্রদর্শক এসব ব্যাপারে। হস্টেলে থাকে মূলত মফস্বল বা গ্রামের ছেলেমেয়ে। কিছু আসে ভিনরাজ্য থেকে। “একটু আধটু র‍্যাগিং সহ্য করা ভাল, ওতে বন্ধুত্বের ভিত তৈরি হয়” এইসব মিথোপম কথাবার্তা বলে থাকেন সিনিয়ররা। এই একটু আধটু র‍্যাগিং যে কতটা মারাত্মক লেভেলে যেতে পারে তা অভিভাবকরা কল্পনাও করতে পারেন না। কোনও মা ভাবতে পারেন যে তাঁর সন্তান অন্য একটি ছেলের মুখে মূত্রত্যাগ করছে? র‍্যাগিং- এ হয়। কোনও পিতা ভাবতে পারেন তাঁর সন্তান অন্য একটি ছেলেকে তার চটির তলা লেহন করতে বাধ্য করছে? র‍্যাগিং-এ হয়। যূথবদ্ধভাবে দুর্বলকে হেনস্থা করা, অত্যাচার করার প্রবণতা মানুষ মানুষের মধ্যে তৈরি করে দেয়। আপনি সন্তানকে দামি পোশাক কিনে দেন, জুতো কিনে দেন, টিউশন টিচার দেন একের পর এক। এক অভিভাবিকা আমাকে বলেছিলেন, আমার ছেলে নার্সারিতে পড়ে। ওর জন্য ‘একটা’ টিচার ঠিক করে দেবেন? শুনে গা-পিত্তি জ্বলে গেছিল। শিশুপালনের এই পদ্ধতি ভবিষ্যতের ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন তৈরি করে।

সন্তান কতটুকু মানবিক হয়ে উঠছে বা উঠছে না, তার সুস্থ মন তৈরি হচ্ছে কিনা, এইটুকু যে অভিভাবকরা খেয়াল রাখতে পারেন না, তাদের অভিভাবক হওয়ার কোনও অধিকার নেই। তারা অপ্রেমের সন্তান জন্ম দেন বংশবৃদ্ধি করার জন্য আর বিষবৃক্ষ রোপণ করেন সমাজে। “ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কলেজে পড়ে শুধু মেধাবীরা”— এটা একটা মিথ। মেধাবীর সংজ্ঞা এইভাবে নির্মাণ করা যায় না। অথচ শুধু মেধার নাম করে অপরের উপর অত্যাচার করাকে স্বাভাবিক বলে চালানো হয়েছে। যেমন, সিগারেটের ছ্যাঁকা। র‍্যাগিং-এর আরেকটি প্রিয় খেলা।

মেয়েরা যেহেতু স্বভাবত কিছুটা নরম ধাঁচের, মেয়ে হস্টেলে র‍্যাগিং-এর ইতিহাস তাই অন্যরকম। কিন্তু যবে থেকে মেয়েরা পুরুষের স্রেফ সমকক্ষ হওয়ার জন্য পুরুষালি হতে চেষ্টা শুরু করল, সিগারেট ফুঁকে বা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, মেয়ে হস্টেলের র‍্যাগিং-এর চেহারা পাল্টে গেল। সুপার বা মেট্রনরা কোনওকালেই এই অপরাধ বন্ধ করার চেষ্টাও করেননি, পারেনওনি। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীরব থেকেছেন। লাজুক, নরম ছেলে বা মেয়ে হল সফট টার্গেট। মৌখিক র‍্যাগিং-এর কথাই তুলছি না। কিন্তু শারীরিক নিগ্রহ মানুষকে পঙ্গু করে দিতে পারে। দিয়েছে। মানসিকভাবে চিরকালের জন্য অসুস্থ করে দিতে পারে। বা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তার প্রতিকার হয় না কেন? একজন বিশেষ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন। অথচ র‍্যাগিং হল অর্গ্যানাইজড ক্রাইম। সমবেত অপরাধ। মব লিঞ্চিং-এর মতো। শিশুর মধ্যে নিষ্ঠুরতার প্রবৃত্তি থাকলে তাকে সংযত করার কাজ যদি অভিভাবক না করেন, তাহলে যে সমাজ তৈরি হয়, আমরা ঠিক সেই সমাজ পেয়েছি।

যাদবপুরের মৃত ছাত্রটিকে যা যা করতে বলা হয়েছিল দুদিনে, তা শুধু  থ্রি ইডিয়টসের র‍্যাঞ্চো কেন, আরও অনেক অনেক মেধাবী, অমেধাবী ছেলে অক্লেশে করে দেবে, একটুও অস্বস্তি বোধ না করে। কিন্তু কেউ কেউ আহত হবে। সকলের সংবেদনশীলতার লেভেল সমান নয়। সকলের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া সমান নয়। সকলের সপ্রতিভতা সমান নয় এবং ছবির র‍্যাঞ্চোরা আদতে সংখ্যায় খুব খুব কম। শিশু সংবেদনশীল হয়ে বড় হচ্ছে কিনা, সেই খেয়াল রাখার মতো শিক্ষিত অভিভাবক যদি না থাকেন, তবে শয়তানের এই তাণ্ডব অপ্রতিরোধ্য থাকবে। যত বেশি মেধাবী তত বেশি শয়তানি বুদ্ধি, যদি না মানবিকতা, সহমর্মিতা আর সংবেদনশীলতা থাকে। সেমেস্টার, মেজর, মাইনর বা সংস্কৃতি বা ফেস্ট করে একটা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হয় না। সহবতহীন এই পৃথিবীতে সভ্য ছাত্র আশা করি কী করে? গোড়াতেই গুচ্ছ গুচ্ছ গলদ। তাই সিনিয়ররা জুনিয়রদের দিয়ে জল ভরিয়ে আনন্দ পায়। নতুন সহকর্মীকে হেনস্থা করে বিকৃত আনন্দ পান সিনিয়র সহকর্মীরা। ভাল জিনিস ছড়ায় কম। খারাপ যা কিছু আছে, সহজে ছড়ায়। নেশা। ধর্ষণ। র‍্যাগিং।

সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। আতুপুতু করে সন্তানকে মানুষ করবেন না। শক্তপোক্ত করে বড় করুন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঔপনিবেশিক শাসকের মুখের সামনে চটি তুলে দিতে পেরেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বিদেশি শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করতে পারতেন। আমাদের আইআইটিয়ান বা যদুবংশীয়রা নিঃসন্দেহে তাঁদের চেয়ে কম মেধাবী তো বটেই! নতুনরা সিনিয়রদের চোখে চোখ রেখে “না” বলতে শিখুক। একসঙ্গে অনেকজন প্রতিবাদ করলে সব প্রতিরোধ সম্ভব।

কর্তৃপক্ষ, আইন, প্রশাসন ইত্যাদি ভারী ভারী বিষয়ে না-ই বা গেলাম। ছাত্রসমাজ বলতে যা বোঝায়, তা কি আদৌ আছে এখন? না কি শুধু বৃহৎ বৃহৎ আত্মকেন্দ্রিকতার ব্ল্যাকহোল? তাহলে পচন অনিবার্য এবং সেটা ধরে গেছে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...