ক্ষুধার্ত ভারত

উন্মেষ মিত্র

 


ক্ষুধার তালিকায় আমাদের দেশের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম। প্রতিবেদনে ভারতের স্কোর ২৮.৭। এই রিপোর্ট অনুসারে ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশ ক্ষুধা নিরাময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। ২০০০ সালে ভারতের GHI Score ছিল ৩৮.৪, যা ২০০৮ সালে কমে আসে ৩৫.৫-এ, ২০১৫ সালে ৬.৩ অঙ্ক কমে GHI Score হয় ২৯.২। পরবর্তী আট বছরে উন্নতির অঙ্ক মাত্র ০.৫!

 

Concern Worldwide এবং Welt Hungerhilfe নামক দুটি বেসরকারি সংস্থা যৌথভাবে Global Hunger Index শিরোনামে প্রতিবছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথম সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৮ সালে আয়ারল্যান্ডে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ-বছরে তাদের প্রকাশিত ক্ষুধার তালিকায় আমাদের দেশের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে চিনের অবস্থান শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে, শ্রীলঙ্কা তালিকায় ৬০ নম্বরে, নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান রয়েছে যথাক্রমে ৬৯, ৮১ এবং ১০২তম স্থানে। ভারতের পিছনে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, হাইতি, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের মতো ১২টি আফ্রিকার দেশ।

 

আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা ইত্যাদির আগে কীভাবে এই ক্ষুধা সূচক তৈরি করা হয় সে বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা প্রয়োজন। ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতির জন্য মূলত চারটি উপাদানের ওপর নজর দেওয়া হয়। অপুষ্টি, শিশুদের অপর্যাপ্ত দৈহিক বিকাশ, শিশুদের উচ্চতার অনুপাতে কম ওজন এবং শিশুমৃত্যু। এখানে উল্লেখ্য যে, শিশু বলতে এখানে পাঁচ বছরের কমবয়সিদের কথা বলা হয়েছে। এই চারটি উপাদানের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অপুষ্টি এবং শিশুমৃত্যুর ওপর। ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতির জন্য প্রথমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্পন্ন সংস্থাগুলির থেকে প্রতিটি দেশের এই উপরে উল্লিখিত চারটি উপাদান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারপর পরিসংখ্যানবিদ্যার সাহায্য নিয়ে ০ থেকে ১০০ এর পাল্লার মধ্যে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স স্কোর (GHI Score) তৈরি হয়। এই পাল্লাকে আবার ৫টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ১০-এর নিচে স্কোর মানে ‘ভাল’, ১০-২০-র মধ্যে স্কোর ‘মোটামুটি’, ২০-৩৫ স্কোর ‘গুরুতর’, ৩৫-৫০ স্কোরের অর্থ ‘উদ্বেগজনক’ এবং ৫০-এর ওপরে স্কোরের অর্থ ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’। ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের স্কোর ২৮.৭। এই রিপোর্ট অনুসারে ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশ ক্ষুধা নিরাময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। ২০০০ সালে ভারতের GHI Score ছিল ৩৮.৪, যা ২০০৮ সালে কমে আসে ৩৫.৫-এ, ২০১৫ সালে ৬.৩ অঙ্ক কমে GHI Score হয় ২৯.২। পরবর্তী আট বছরে উন্নতির অঙ্ক মাত্র ০.৫!

 

অমৃতকালে এরকম বেয়াদপের মতন রিপোর্ট বিশ্বগুরুর পক্ষে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সরকার থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়েছে এই সূচক ভুল। সূচক প্রস্তুতির পদ্ধতি ভুল। সূচক প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত চারটি উপাদানের মধ্যে তিনটি শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কীয়, কোনওভাবেই দেশের ক্ষুধার প্রকৃত চিত্র নয়। অপুষ্টির তথ্য সংগ্রহের জন্য মাত্র তিন হাজার জন মানুষের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে, যা দিয়ে দেশের সার্বিক অপুষ্টির চিত্র কোনওভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। এই সব বিষয়ে প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে প্রস্তুতকারক সংস্থা জানিয়েছে প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করেই এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, তাই এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। শিশুদের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য দিয়ে প্রস্তুত রিপোর্টের নাম “ক্ষুধা সূচক” হওয়া অনুচিত এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের জবাব, শিশুদের বেহাল স্বাস্থ্য ইঙ্গিত করে অপ্রতুল খাদ্যনিরাপত্তা, গর্ভবতী মায়েদের অপুষ্টি, দেশের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পানীয় জল এবং পরিচ্ছন্ন আবাসের সুবিধা না-থাকা। আর এই সবকিছুই একটি দেশের খাদ্যসঙ্কটকে চিহ্নিত করে। অপুষ্টির তথ্য সংগ্রহের জন্য মাত্র তিন হাজার মানুষের ওপর সমীক্ষার অভিযোগকে নস্যাৎ করে সূচক প্রস্তুতকারকেরা জানিয়েছে, কোনও সমীক্ষা নয় বরং অপুষ্টি বিষয়ে ভারত সরকারের প্রকাশ করা ‘ফুড ব্যালেন্স শিট’-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সূচক প্রস্তুত করা হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নিয়ে অমৃতকালের সরকারের সবচেয়ে বড় অভিযোগ শিশুদের উচ্চতার অনুপাতে কম ওজন (Child wasting)-এর আসল সংখ্যা ২০২১ সালে চালু করা ‘পোশন-ট্র্যাকার’ অনুসারে ৭.২ শতাংশ হলেও ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতকারকেরা ১৮.৭ শতাংশ হিসেবে তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন। চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র এর চিত্রনাট্য রচনার মধ্যেই অবশ্য জানা গেছে ২০১৯-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রালয়ের ‘ন্যাশানল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৫’-এর রিপোর্ট অনুসারে আমাদের দেশে Child wasting-এর সরকার প্রদত্ত সংখ্যাটি ১৮.৭%।

 

দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম সযত্নে এড়িয়ে গেছে এই রিপোর্ট সংক্রান্ত সব খবর। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা সাংবাদিক সত্তার দায়ে খবরকাগজের কোনও এক কোণে বা দিনের কোনও অলস সময়ে কিছু সময়ের জন্য টিভিপর্দায় স্থান পেয়েছে দেশের ক্ষুধার চিত্র। এই খবর প্রকাশে যা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ করা হয়েছে এই রিপোর্টকে অভিসন্ধিমূলক, মিথ্যা, বিদেশি চক্রান্ত প্রমাণে। অবশ্য প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে থাকা দেশে সেটাই স্বাভাবিক। তবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো কিছুতেই দেশের বে-আব্রু দশাকে আড়াল করতে পারছে না সরকার, সরকারি দল এবং তাঁদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম। প্রতিদিন দেশের মানুষের সামনে আলগা হয়ে যাচ্ছে মিথ্যের মুখোশ। সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমের নামে উগ্রবাদের মাদকে আচ্ছন্ন রেখে দেশের সম্পত্তি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘৃণ্য রাজনীতি প্রতিদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। হাজার পর্দার আস্তরণে ঢেকে ফেলার চেষ্টা হলেও এক ধাক্কায় দেশের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯। জাঁকজমকপূর্ণ জি-২০ অধিবেশনের আয়োজন হোক কিংবা ২০৩৬ সালে ভারতে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের পরিকল্পনা, সবেতেই দেশের রুগ্নতর অর্থনৈতিক অবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টা হলেও, ভুখা পেট ভরানো যায় না। ‘খিদে’কে আড়াল করা যায় না। খিদেকে দমন করার ক্ষমতা কোনও রাষ্ট্রশক্তির নেই। আজ নয় তো কাল, ক্ষুধার্ত মানুষ সব চিবিয়ে খাবে। স্বৈরাচারীর শেষ নখদন্তটুকুও।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...