পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্য: ভিতর-বাহির-অন্তর— সপ্তম বর্ষ, পঞ্চম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্ত এপারের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পরিসরকে এই কল্লোলিনী মহানগর যে একচ্ছত্রভাবে শাসন করে আসছে, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ও বাণিজ্যকেন্দ্র, পূর্বভারতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রথম সুবিধাভোক্তা, এবং ভারতীয় রেনেসন্সের প্রকাশভূমি হিসেবে কলকাতার এই সৌভাগ্যযাপন নিতান্ত অলীক অনধিকারচর্চা ছিল না। কিন্তু অভিযোগ এই, সৌভাগ্যলক্ষ্মী বিদায় নেওয়ার পরেও কলকাতা তার সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রেখেছে, ছলেবলেকৌশলে, আক্ষরিক অর্থে দেহের সব রক্ত মুখে এসে জমা হয়েছে। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে মারাত্মক ও ক্ষতিকারক। ঠিক এই মুহূর্তে শারদসাহিত্যের বিস্ফোরণে ভদ্রবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ যখন কলতানমুখর অথবা অতি-চিৎকৃত, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্টোবর সংখ্যায় বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত কেন্দ্র ও প্রান্তের সমীকরণগুলি আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি, ‘পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্য: ভিতর-বাহির-অন্তর’ শীর্ষক মূল ভাবনার ছায়ায়।

রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন, “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে সেটাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে না।” মন্তব্যের প্রসঙ্গটি ছিল দেশে ধনের অসাম্য, জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার অসম বণ্টন, এবং সংখ্যালঘু এক শ্রেণির মানুষের কুক্ষিগত দেশের সম্পদ থেকে বৃহত্তর অংশের মানুষের বঞ্চনা। সেই বাস্তবতার আজও কোনও পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু কবিপ্রদত্ত উপমাটি যদি মূল প্রসঙ্গ থেকে ছিন্ন করে বিষয়ান্তরে প্রয়োগ করা যায়, যেমন ধরা যাক, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, তাহলেও তার যাথার্থ্য হ্রাস পায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্ত এপারের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পরিসরকে এই কল্লোলিনী মহানগর যে একচ্ছত্রভাবে শাসন করে আসছে, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ও বাণিজ্যকেন্দ্র, পূর্বভারতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রথম সুবিধাভোক্তা, এবং ভারতীয় রেনেসন্সের প্রকাশভূমি হিসেবে কলকাতার এই সৌভাগ্যযাপন নিতান্ত অলীক অনধিকারচর্চা ছিল না। কিন্তু অভিযোগ এই, সৌভাগ্যলক্ষ্মী বিদায় নেওয়ার পরেও কলকাতা তার সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রেখেছে, ছলেবলেকৌশলে, আক্ষরিক অর্থে দেহের সব রক্ত মুখে এসে জমা হয়েছে। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে মারাত্মক ও ক্ষতিকারক। ঠিক এই মুহূর্তে শারদসাহিত্যের বিস্ফোরণে ভদ্রবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ যখন কলতানমুখর অথবা অতি-চিৎকৃত, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্টোবর সংখ্যায় বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত কেন্দ্র ও প্রান্তের সমীকরণগুলি আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি, ‘পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্য: ভিতর-বাহির-অন্তর’ শীর্ষক মূল ভাবনার ছায়ায়।

বলা দরকার, বিষয়টি সাবজেক্টিভ ও বহুস্তরীয়। এমন একটি প্রতর্কে শেষ কথা বলার অধিকারী নয় কেউ। আমরা শুধু কিছু প্রশ্ন তুলতে পেরেছি। এই প্রসঙ্গে একজোট করা নানা লেখায় উঁকি দিয়েছে একাধিক সম্ভাবনা ও বিশ্লেষণ।

একটা মেধাকেন্দ্র থাকলে হয়তো ক্ষতি ছিল না তেমন— ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কতকাল ধরেই তো প্যারিস। ক্ষতি ছিল না, যদি বাংলা জুড়ে একাধিক সাংস্কৃতিক উপকেন্দ্র গড়ে উঠত। ঠিক যেমনভাবে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও দু-একটা শিলিগুড়ি-দুর্গাপুর বাদ দিলে পশ্চিমবাংলায় আর কোনও নগরী গড়ে তোলা যায়নি বলে বিপুল মানুষের জীবিকার চাপ এখনও মূলত একটি বা দুটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত, তেমনি সংবাদপত্র-নিয়ন্ত্রিত একটি-দুটি বৃহৎ প্রকাশনার ক্ষমতাকেন্দ্র ছাড়া আর কোথাও কোনও সাংস্কৃতিক মাইলপাথরও গড়ে তোলা গেল না৷ সাতের দশকে যে কয়েকটি সম্ভাবনার অঙ্কুর আমরা দেখলাম, এক দশকেই কবি-আখ্যাত সংঘের মতো তা মূলসহ বিনষ্ট হল। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদ ও শ্রেণি-কারাগারে কুক্ষিগত হল সাহিত্য। প্রতিষ্ঠান যা কিছু তার অভিজাত থালায় সাজিয়ে পাঠকের সামনে পেশ করল, গলাধঃকরণ করতে হল তা-ই। নিয়ন্ত্রিত হল আমাদের স্বাদকোরক। যে-কোনও সৃজনশীল সৃষ্টির মতো সাহিত্যেরও অভিধা শিল্প, যে শব্দের আবার দুটি মাত্রা, একটি ঝুঁকে থাকে আর্ট-এর দিকে, অন্যটি ইন্ডাস্ট্রি-র। বাংলাবাজার সচেতনভাবে দ্বিতীয়টির অর্থাৎ শুধুমাত্র বিক্রয়যোগ্যতার পথ বেছে নিল, সাহিত্য হয়ে উঠল বাজারের আরেকটি প্রোডাক্ট। প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করা প্রতিস্পর্ধী স্বর সবসময়ই ছিল, কিন্তু বহুপ্রজ লেখকদের ভিড় এড়িয়ে অমিয়ভূষণের ‘ফ্রাইডে আইল্যান্ড’-এ বাঙালি পাঠকের পৌঁছনো হল না। আপস বা থান ইট প্রসব— কোনওটিই করতে না পেরে পাঠকসমাজের কাছে অপরিচিত থেকে গেলেন শৈলেশ্বর বা উদয়ন, সম্ভ্রান্ত অভিমান নিয়ে অকালে চলে গেলেন অজিত রায়, প্রবুদ্ধসুন্দর কর।

এখানেই কাহিনির শেষ হল না, প্রিয় পাঠক। সমস্ত নষ্টামির দায় প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মুখোশ ও নামাবলি চাপিয়ে ‘বেওসা’ শুরু করল কিছু তথাকথিত ‘চড়ুই’ পত্রিকা ও ‘ছোট’ প্রকাশন। এক্ষেত্রেও প্রতারিত হলেন লেখক। প্রকাশনার ভণ্ডামি ও পাঠকের অস্বীকার তাঁকে আরও বেশি করে ঠেলে দিল প্রান্তের দিকে। অসামান্য প্রতিভাবান কিন্তু আপসহীন বাঙালি লেখকের করুণতম বিজ্ঞাপন হয়ে আজও রয়ে গেল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন, ও তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু। কবিদের কথা না-ই বা বললাম। যে ভাষায় এই মুহূর্তে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষিক জনগোষ্ঠীর মানুষ কথা বলেন, সেই ভাষার লেখক অন্য পথে উপার্জনের চেষ্টা না করে শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেমতো লেখালেখি করে সম্মানজনক শর্তে বাঁচার চেষ্টায় রত, এই মুহূর্তে এমন দুঃসাহসী কজন বাঙালি লেখক আছেন তা এক হাতের আঙুল গুণেই বলে দেওয়া যায়।

আশার কথা, বাংলা সাহিত্যের কলকাতা-কেন্দ্রিকতা লেখক ও পাঠকের মধ্যে যে চতুর্থ দেওয়াল গড়ে তুলেছিল, তা আজ ভেঙে পড়ছে। বাংলা সাহিত্যে সংবাদপত্র ও প্রকাশনার ফড়ে ও গুরুঠাকুরদের নিয়ন্ত্রণ কমছে। এই ঘটনার জন্য ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া ও মাতৃভাষায় লেখালেখি করতে পারার প্রযুক্তিগত সুবিধাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। সম্পাদনাহীন অসংখ্য জঞ্জালের পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে হীরের পলকাটা দ্যুতি নিয়ে ঝিকিয়ে উঠছে নদীয়া, বাঁকুড়া, মালদহ অথবা কোচবিহারের নবীন প্রজন্মের সাহিত্যচর্চা। বলতে দ্বিধা নেই, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ প্রতিষ্ঠিত প্রবীণের পাশে নির্দ্বিধায় বসানো গেছে সেইসব তরুণতরুণীর লেখালেখি, পাঠক সাদরে গ্রহণ করেছেন যাঁদের লেখা। আজ থেকে পনেরো বছর আগেও এই গণতান্ত্রিক পরিসরের কথা ভাবা যেত না। প্রমাদ গুণছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। দীর্ঘদিন ধরেই বড় পত্রিকা-প্রকাশনা আয়োজিত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সেমিনারে লিটল ম্যাগাজিনের সাহিত্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে উগরে দেওয়া হত প্রতিষ্ঠানের ক্ষোভ ও তাচ্ছিল্য। এখন তার নতুনতর প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্ত হয়েছে সমাজমাধ্যমের সাহিত্যচর্চা। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত কলকাতা-কেন্দ্রিকতায় যে ফাটল ধরেছে, তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে শরীর জুড়ে— একথা বলাই যায়।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্টোবর সংখ্যায় আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি কেন্দ্র ও প্রান্তের রসায়নকে। এই অধ্যয়নের যাত্রায় লিখে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন তপোধীর ভট্টাচার্য, স্বপন রায়, দেবজ্যোতি রায়, অনুরাধা কুন্ডা, অশোক দেব, পার্থজিৎ চন্দ, অভিষেক ঝা এবং মহিউদ্দিন সাইফ। আমরা তাঁদের বিনম্র চিত্তে কৃতজ্ঞতা জানাই।

সঙ্গে অন্যান্য বিভাগগুলিও রইল যথারীতি।

শেষ করছি, পাঠক, আপনাদের প্রণাম জানিয়ে। পড়ুন আমাদের সংখ্যাটি, মতামত জানান দ্বিধাহীন মনে। আপনাদের উৎসব-মরশুম সুখের হোক।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...