লেখার ভিতর বাহির

স্বপন রায়

 


আমি এই একইরকম ভাষাকে আশ্রয় করে কলকাতা বা জেলা অথবা কেন্দ্র বা প্রান্তের বিভাজনজনিত খেয়োখেয়িতে আস্থাবান নই। সেখানে কে কাকে দাবিয়ে রাখল বা রাখল না, এটা এক অন্য পরিসরের বা স্তরের বাস্তবতা, আছে হয়তো, জানি না। মনে করি যে, সাহিত্যের ইতিহাস তার ভাষাগত ‘টেকনিক’-এর উন্নতির ইতিহাস। একটা নতুন পরিসর হল, যেখানে সবাই একা। একা কিন্তু একাকী নয়। নতুন পথ তো শুধু একজনই খোঁজে না

 

নাখট, ইয়েওয়ান, নোচ, শোনো, শাব, ইয়োরো, বাম, নিঁয়া, নিখতা, নোয়াপ্তে, নুই, ইরাভু, লা-নোচে

বাংলায় রাত্রি।

তো, বিভিন্ন ভাষায় রাত্রি শব্দের উচ্চারণ আলাদা হলেও, রাত্রি বদলায় না। শব্দের সাধ্য নেই রাত কে দিন করার। শব্দ তাই প্রতীক মাত্র। বহু পুরনো কথা, মনে পড়ল এই লেখাটি লিখতে গিয়ে।

কে কোথায় কীভাবে প্রতীকী শব্দে সাহিত্য রচনা করছে এটা কি সত্যিই অনুধাবন করা যায়? করা যায় তখনই যখন সীমার মাঝে অসীমকে অস্বীকার করার কুয়োসুলভ প্রবণতা জারি থাকে। কুয়ো হয়ে ওঠে কেন্দ্র। ক্ষমতার কেন্দ্র।

কেন্দ্র থাকলেই আকর্ষণ থাকবে। শব্দ হয়ে উঠবে সেই ক্ষমতার ‘সুপার কন্ডাকটর’, সেই শব্দে রচিত বাংলা ভাষার বিকিরণে কেন্দ্রোৎসারিত বোলচালই বজায় থাকবে। কেন্দ্রের ভাষাই হয়ে উঠবে জেলার বা অন্য রাজ্যের সাহিত্য-ভাষা। রচিত ভাষাটির ক্ষমতার কাছে বোধগম্যতার নিরিখেই একজন কবি বা গদ্যকারের মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। পুরস্কার দেওয়া হবে। সাহিত্য বা কবি সম্মেলনের ক্লাসে উপস্থিতির খাতায় নাম উঠবে। এটাই ক্ষমতার নিয়ম।

নিয়ম তো নিয়মই। পশ্চিমবাংলায় যাঁরা বিশ্বাস করেন কলকাতার একটি পত্রিকাগোষ্ঠীর চর্চিত ভাষা এবং গঠনশৈলীই একমাত্র নিয়মবদ্ধ উপায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বা বিখ্যাত হওয়ার, তাঁদের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে নেমে লাভ, ক্ষতি ইত্যাদির কিছুই নেই। আমার লেখালেখি কলমবাহিত হয়ে কাগজে নামে ওড়িশার ইস্পাতনগরী রাউরকেলা শহরে। ১৯৮৩ নাগাদ ‘দ্রিদিম’ নামের একটি পত্রিকা আমরা কয়েকজন মিলে শুরু করি। সম্পাদক ছিলেন রাণু মুখোপাধ্যায়। আমি, অরুণজ্যোতি মুখার্জি এবং সুকোমল মাশ্চারক, আমরা তিনজন ছিলাম সহযোগী সম্পাদক হিসেবে। ‘দ্রিদিম’-এর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় ছিল রাজনৈতিক মতবাদ— বামপন্থা। বাণিজ্যিক লেখালিখির উলটো পথেই ছিল ‘দ্রিদিম’-এর অভিমুখ। লেখালেখির ভাষা এবং তার ভিতে থাকা শব্দ তখনও অত বিচার্য ছিল না। কলকাতা থেকে রাউরকেলার দূরত্ব চারশো কিলোমিটারের বেশি। ‘দ্রিদিম’ ছাপা হত কলেজ স্ট্রিট মোড়ে থাকা সাহিত্যিক মধুময় পালের প্রেসে। তখনকার লেটারহেড, ঘটাং ঘটাং শব্দ, পুস্তানির আঠার গন্ধ আর সন্দীপদা (প্রয়াত সন্দীপ দত্ত) প্রতিষ্ঠিত লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি, এই সব মিলে এক অপ্রাতিষ্ঠানিক আবহাওয়ার কলকাতায় নিয়ে এল আমায়। আমি কয়েকদিন কলেজ স্ট্রিট মোড়ের একটা মেস-এ থেকে ‘দ্রিদিম’-এর কাজ শেষ করে তিনশো কপির বান্ডিল নিয়ে ফিরে আসতাম রাউরকেলায়।

তখন ছিল কলকাতা-কেন্দ্রিক ক্ষমতায়নের স্বর্ণযুগ। একটি বাণিজ্যিক পত্রিকা তাদের কৌশলী ব্যবসায়িক বুদ্ধির সাহায্যে সাধারণভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে পাঠকের মন, মনের পছন্দ আর রুচি। এ নিয়ে দিস্তা-দিস্তা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা (গালিগালাজ সহ) ছাপিয়ে একটা বৈপ্লবিক ‘ইমেজ’-ও তৈরি করে নিত কিছু পত্রপত্রিকা। ক্ষোভের মূল কারণ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল ক্ষমতার বৃত্তে না ঢুকতে পারার হতাশা। এটা প্রতিষ্ঠান জানত এবং উপভোগ করত।

বাজার চলে পুঁজির নিয়মে। M-C-M (Money-Commodity-Money) অর্থাৎ অর্থ বা পুঁজি-উৎপাদিত দ্রব্য-অর্থ বা পুঁজি। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অর্থ জোগাড় করবে, সেই অর্থমূল্যে বিক্রিযোগ্য দ্রব্য খরিদ করবে এবং বেচে মুনাফা করবে। মুনাফার একটা অংশ আবার ফিরে আসবে ব্যবসায়িক বৃত্তে। লগ্নিকৃত পুঁজি সুরক্ষিত হতে থাকবে। সাহিত্যের বাজারে কিন্তু নতুন অনেক উপাদান থাকে। রুচি, মনন, ভাবনাপদ্ধতি ইত্যাদি। বাজার এই সবকিছুতেই থাবা বসায়। মুনাফার দিকে চালিত করে। গদ্যে, কবিতায় দু-তিনটে জনপ্রিয় ‘প্যাটার্ন’ তৈরি করে এবং তাদের নিজস্ব বৃত্তের ‘প্রফেশনাল’ প্রয়োগশালায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয় লেখক, কবিসহ পাঠকদের একটা বড় অংশকে। এটাই ক্ষমতার বৃত্ত। এর আকর্ষণ-ক্ষমতা অপরিসীম। কলকাতায় থাকুন অথবা বাইরে, এই ক্ষমতার বৃত্তে ঢুকে পড়লে কলকাতা বা জেলা-নির্বিশেষে বিমূর্ত খ্যাতির ভাগ পাওয়া যায়। যোগাযোগের একনিষ্ঠ পরিশ্রমের নিরিখে পুরস্কারও আসে। সভাগৃহে ডাক পড়ে। এটাই পুঁজির ধর্ম। যারা এই ধর্মে দীক্ষিত তাঁরা বৃত্তসুলভ আনন্দ পান। অসুবিধে কোথায়?

এখন সরকারও সাহিত্যক্ষমতার নতুন বৃত্ত তৈরি করেছে। এটা ব্যক্তিপুঁজি শাসিত নয়। আমাদেরই ট্যাক্সের টাকায় এই বৃত্তের ক্ষমতায়ন চলে। এই বৃত্তে না ঢুকতে পারার হতাশা, ক্রোধ থেকে সোশাল মিডিয়ায় নানাবিধ প্রকাশ দেখি। পুঁজির বিরুদ্ধে যে ক্ল্যাসিকাল সমাজতান্ত্রিক বিরোধিতার পরিসরটি ছিল তা ভেঙে পড়েছে। এমনকি ওই পরিসরটিও একটি পালটা সীমায়নেই আবদ্ধ ছিল। এর বাইরে তাহলে কী?

শূন্যতা। মহাশূন্যতা। বাণিজ্যিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রকে চেতনার মহাশূন্যতা দিয়েই ব্যক্তিগত স্তরে ‘ফিউজ’ করে দেওয়া যায়। আমি নিজে এই আবহেই লিখি। নব্বই দশকের গোড়া থেকে, কবিতা ক্যাম্পাস থেকে নতুন কবিতা অব্ধি এই যে সাহিত্যচর্চার পরিসর এতে কোনও বৃত্তের প্রতিই অসূয়া নেই। আছে উদাসীনতা। লক্ষ করলে দেখা যাবে বাণিজ্যিক পত্রিকার গড়ে দেওয়া ভাষাতেই বাংলার প্রতিষ্ঠানমুখী বা বিরোধীরা লেখালিখি করে থাকেন। ‘হাংরি’ এবং ‘শ্রুতি’ সহ কিছু সাহিত্য আন্দোলন নিজেদের প্রকাশ করার জন্য বাংলা ভাষাকে গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে আসতে সফল হন, তবে সেটা ব্যতিক্রমী প্রয়াস।

 

কেউ কাউকে সাহিত্যসীমায় বন্দি করতে পারে না। কিন্তু এটা হয়। কলকাতা ও জেলার বিভাজন এভাবেই। কলকাতা কেন্দ্র এবং জেলাগুলো প্রান্তিক। এই বন্দিত্ব আসে যখন একই রকম আঙ্গিক আর ভাষায় লেখালিখি করেন যুযুধান দু-পক্ষ। এক সময় ভাষার সাযুজ্য ঢেকে দেয় যোদ্ধাদের পরাক্রম। বাংলা কথাসাহিত্য এই জনপ্রিয় আঙ্গিকের কারণেই আটকে থাকে চরিত্রনির্মাণ আর আখ্যানধর্মিতায়। এখন তো টিভি এসে এই জনপ্রিয় ‘টাইপ’টিতে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়েছে। সব গল্প বোকা-বাক্সে। গল্প-লিখিয়েদের একটা অংশ ঝুঁকে পড়ল সিরিয়াল ইত্যাদিতে। কবিদের কেউ কেউ ‘প্রেফার’ করল গান লেখাকে। ভালই হল। কিছু তো পৌঁছে গেল গন্তব্যে!

আমি এই একইরকম ভাষাকে আশ্রয় করে কলকাতা বা জেলা অথবা কেন্দ্র বা প্রান্তের বিভাজনজনিত খেয়োখেয়িতে আস্থাবান নই। সেখানে কে কাকে দাবিয়ে রাখল বা রাখল না, এটা এক অন্য পরিসরের বা স্তরের বাস্তবতা, আছে হয়তো, জানি না। মনে করি যে, সাহিত্যের ইতিহাস তার ভাষাগত ‘টেকনিক’-এর উন্নতির ইতিহাস। এই যে একটা নতুন পরিসর হল, এখানে সবাই একা। একা কিন্তু একাকী নয়। নতুন পথ তো শুধু একজনই খোঁজে না। কৌরব ছিল জামশেদপুরের পত্রিকা। নব্বই দশকে এই কৌরবের অন্যতম কাণ্ডারী প্রয়াত কবি, গদ্যকার বারীন ঘোষালের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে আশি-দশকের কিছু কবিতা-খুঁজিয়ের। তো, বারীনও ছিলেন এই নতুন পথের হাঁটিয়ে। একে একে ইছাপুরের রঞ্জন মৈত্র, কলকাতার ধীমান চক্রবর্তী, হাওড়ার প্রণব পাল, অলোক বিশ্বাস, তপোন দাশ, বহরমপুরের উমাপদ কর, জলপাইগুড়ির অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল ঘোষ, খড়গপুরের আমি ছাড়াও নব্বই ও শূন্য দশকের এক ঝাঁক কবির বিভিন্ন সময়ে গন্তব্য হয়ে উঠল বারীন ঘোষালের জামশেদপুরের ফ্ল্যাট আর আমার খড়গপুরের বাড়ি। জামশেদপুরে উপস্থিত থাকতেন কবি স্বদেশ সেন, কমল চক্রবর্তী, যাদব দত্ত, শংকর লাহিড়ী সহ আরও অনেকে। ক্ষমতার সাধ্য ছিল না এই কেন্দ্রাতিগ শক্তিকে আটকাবার। এক হয়ে গেল, একাকার হয়ে গেল বাংলা-কবিতার একটা অংশের সব বিভাজনরেখা।

ফর্মুলা সেভাবে কিছু নেই, ভালবাসা ছাড়া। নিজের লেখায় একেবারে আনকোরা ভাবনার স্ফূরণ আনাই ছিল এর লক্ষ্য, পুরস্কার ইত্যাদি নয়। একই ভাবনা, আঙ্গিক এবং বহু প্রচলিত শব্দের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ডানা মেলল ওই সময়টায়। একটা দ্বিতীয় পৃথিবী গড়ে উঠল।

আমি সামান্য লিখিয়ে। লেখালেখিকে বাজারজাত পণ্য যারা করে তারা তো স্বভাবগুণেই তা করবে। করুক। দ্বিতীয় পৃথিবীতে এ সবকিছুই অবান্তর। কবিতার ক্ষেত্রে বিষয় মুছে দেওয়া হল, কেন্দ্রাতিগ চেতনা ডানা মেলল (অতি চেতনা), শব্দ অনুভবের প্রতীক হিসেবে প্রতিস্থাপিত হল, ধ্বনিচিত্র এল চিত্রকল্পের বদলে, বলা হল সম্ভাবনাই সত্য এই আপেক্ষিক মহাবিশ্বে, কবিতায় এল চেতনার অনুগত বিস্ফারের প্রেক্ষাপটে এক অনাস্বাদিত ‘কেওস’-এর সদা-পরিবর্তনশীল ‘প্যাটার্ন’। জীবন হয়ে উঠল আনন্দধারায় স্নাত এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা।

আমার সত্যিই কোনও ‘রিগ্রেটস’ নেই। আই লিভড মাই লাইফ, রাদার স্টিল লিভিং! কোনও প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক শক্তির কাছে লেখালেখি নিয়ে সামান্যতম প্রত্যাশা নেই। ওটা প্রথম পৃথিবীর ব্যাপার। হ্যাঁ, নিজের লেখালেখি নিয়েও কোনও ‘ক্লেম’ নেই।

‘কভি কিসি কো মুকম্মল জাহাঁ নহি মিলতা/ কহি জমিন তো কহি আসমাঁ নহি মিলতা’ (নিদা ফাজলি)। তো, সম্পূর্ণ একটা দুনিয়া কেউই পায় না। একজন সামান্য মাটি তো অন্য কেউ আকাশ পায় না।

কেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। ফিরব না আর।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...