সব বই বই নয়, কিছু কিছু বই

সুমেরু মুখোপাধ্যায়

 

রোজই নতুন নতুন বই ছাপা হচ্ছে ঠিকই, এগুলো সব যে নতুন তা ঠিক বলা যায় না। বিশেষত বাংলা ভাষায় যে সব বই ছাপা হয় তার এক শতাংশ বইও কি নতুন? আমরা খুব বড় করে বইমেলা করি, হ্যাঁ কলেজস্ট্রিটে গেলে বাংলা বই কিনিও, আর কিছু কিছু মানুষ আমরা বই ছাপি, কিন্তু কেউই যে বই নিয়ে খুব একটা ভাবনাচিন্তা করি এমন নয়। যারা দুনিয়া বদলে ফেলব অ্যাটিচুডে ফেসবুকে ঝড় তুলি তারাও বইয়ের প্রতি সামান্য যত্নশীল নই। দিন-দুনিয়া বদলেছে, গুটেনবার্গের মতো ভাবনার লোক আমাদের কলেজস্ট্রিটে খুব বেশি চোখে পড়ে না যাঁরা নতুন বিপ্লব এনে ‘বই’ সম্পর্কে নতুন কোনও ধারণার জন্ম দেবেন। আমাদের ভাবনার দৌড় মূলত কন্টেন্ট- কেন্দ্রিক, ছাপার বিজ্ঞান না আর্কিটেকচার নিয়ে আমরা ভাবি না। বাকিটা মুখে মুখে ম্যানেজ করে নিই। এই হল আমাদের নতুন বই ছাপার জগৎ। দর্শন নেই। বরং এই যে পিছিয়ে পড়ার অদম্য মানসিকতা তাকেই পিছড়ে-বর্গ ঘোষণা করি বা পারলে কিছু নেম বা মেম ড্রপ করে মাল সাইজ করিয়ে দিই। প্রকারান্তরে আমাদের বাতেলাই আমাদের বই, সংখ্যা ভরে ওঠে আমাদের বিজ্ঞাপনে, ঘাম শুকালে বুঝি সব বই বই নয়, পণ্ডশ্রম বা কোনওটাই নয়। যে সব কাড়িকাড়ি ছাপা হল, মেলা করলাম, সোমে মিনিস্কার্ট বুধে প্লাজো যথা ইচ্ছা সুখ খুঁজো, স্প্রিং রোল টু বিরিয়ানি সব সত্যি কিন্তু বই? এগুলো ছেপে কাগজ নষ্ট করার কোনও দরকার ছিল না। কাগজ মানে কাড়ি কাড়ি গাছ, ঘচ্যাং ফু। নতুন স্মার্ট প্রজন্ম মোবাইলে স্বচ্ছন্দ, বয়স্ক পাঠক যাদের খবরের কাগজ পড়তে সমস্যা তারাও দেখি ইল্যুমিনেট স্ক্রিনে দিব্যি কাগজ পড়েন। তাহলে কী ছাপবেন কেন ছাপবেন? (বইটা এখনও বার হয়নি, বেরিয়ে যাবে গ্যারেন্টি) হট ইনস্ট্যান্ট টপিক — বই কি উঠে যাবে এমন আলোচনা চলে বছরভর। এর আলোচনায় কাকে আনবেন তার উপর এই অনুষ্ঠানের সাফল্য। সব প্যাকেজ। তেমন তমুক হলে কাগজে কভারেজও করতে পারে বা হাবিজাবি টিভি নিউজে বাইট। ফিল্মস্টার হলে দু’চার জন যায় শুনতে। না হলে এমেলে এমপি ভরসা, দাদার প্রতি পজে হাততালি পড়ে।

পাঠক কমে যাচ্ছে, বই কম বিক্রি হচ্ছে এই রকম অনুযোগের বর্ণালির মধ্যে আমাদের বই করতে আসা। নতুন ধরনের বই চাই। ক্রেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভাষা, আদবকায়দা, খাদ্যরুচিতে এত পরিবর্তন ঘটে থাকলে বইতে ঘটবে না কেন? চাই উন্নততর বই। সমকালীন ভাবনারা উড়ে বেড়াচ্ছে অথচ মুঠোর গুগুলে। চেতনাবিশ্ব ইউটিউবময়। সেসব দেখি, শুনি আর দশটা অন্য কাজ করতে করতে এভাবেই গ্লানির ফোড়নযুক্ত হতাশা রঙের সূর্য ডোবে, ওঠে ইত্যাদি ইত্যাদি। টের পাই ভাবনার ফর্ম বা ফর্ম্যাট সেভাবে নির্দিষ্ট কিছু হয় না। বাংলা বইতে নতুন প্রকাশকেরা আসছেন নানা বিচিত্র পেশা থেকে, তাই আশা জেগে থাকে। নতুন ভাবনা খুঁজে বেড়াই, কী কন্টেন্টে, কী ফর্মে। বারেবারে ব্যর্থ হই। দিনের শেষে নিজেদের বই হাতে নিয়ে ভাবি, আমরাই বা কেন বই করতে এলাম। এই সময়ের বই একটি পলিফোনিক ডিসকোর্স। সে কিছুতেই মান্ধাতাগন্ধী বইয়ের মতো আর নেই, তাকে যৌথ প্রকল্প হিসাবেই দেখতে হবে। সম্পাদনা ও শিল্পনির্দেশনা দুটি অবশ্যাম্ভাবী জিনিস। এই দুটি বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রকাশকদের নেই, ম্যাংগোর কথা বাদ দেওয়াই শ্রেয়। কেউ বলে লেখা বদলালেন কী করে! কেউ বলে বিদেশ হলে নাকি হাজতের ঘানি টানানো যেত! এদের ‘সম্পাদনা’র ধারণা সাবিং বা প্রুফরিডিং অর্থাৎ ‘সহ-সম্পাদনা’র ধারণার সমার্থক, অবশ্য প্রচুর ভুল থেকে যায় তার পরেও অযোগ্য বা কর্মবিমুখ লোকের কারণে। প্রুফ, ছাপাই, বাঁধাই এগুলির মান আমাদের খুব খারাপ। ফন্ট নিয়ে ভাবনার লোকের অভাব। ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট এগুলি নিয়ে কথা বললে লোকে পাগল বলেই ঠাউরে নেয়, মুচকি হাসে বড় জোর। বাংলা বই বেচে কয় টাকা হয় যে সেসব লাগবে? এটা তারা ভাবেন না তাদের বইটা বিক্রি হবে কেন? কন্টেটের জোর অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু কন্টেন্টের বিকাশ হবে বহু ভাবনার স্তরে ও প্রসারে। একটা ধারণা কত রকম ভাবে আলো ফেলে দেখা যায় তা ভাবতে হবে। ই-বুক জনপ্রিয় হয়েছে, অডিও বুক জনপ্রিয় হয়েছে সে সব বাতিল করার প্রশ্ন বা ক্ষমতা কারওরই নেই কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে বই এদের চাইতে অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয় মাধ্যম। কেবল চাই নতুন ভাবনার মানুষ। বহু ভাবনা বা জ্ঞানের সন্মেলক না হলে বই কীভাবে উন্নততর বই হবে? পারস্পরিক সামঞ্জস্য আবার অন্যতম চাহিদা। অন্ধত্ব মানুষকে গোঁড়া করে তোলে। প্রতিটি সম্পাদক, লেখকের কাছে ‘শিল্পবোধ’ আশা করা অন্যায় কিন্তু অন্যের কাজের প্রতি অসূয়া ও অবজ্ঞা তাদের অন্ধত্বকেই নির্দেশ করে। তেমনই শিল্পী বা শিল্পনির্দেশক বা ডিজাইনাররা যদি কন্টেন্ট সম্পর্কেই আগ্রহ না দেখান না ভাবনাচিন্তা করেন তার প্রতিফলন কাজে পড়তে বাধ্য। ইলাস্ট্রেশনের মতো বস্তাপচা ধারণা এখন নেই, কিছুটা স্কুলপাঠ্য বইতে আটকে আছে কাটা অসহায় ঘুড়ির মতো। সমকালীন শিল্পচিন্তা অনেক বেশি ইন্টার‍্যাকটিভ। যা ভাবনা ও চেতনার পরিসর বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু তার প্রতিফলন বাংলা বইতে কোথায়? কেবল প্রকল্প রূপায়ণে নয় অন্ধত্ব ছেয়ে গেছে প্রচার ও বিপণনেও।

কাজেই আমাদের বাংলা বইতে নতুন কিছু নেই। পাতায় পাতায় বিপ্লবের বদলে দীনতাই ফুটে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। www.pothi.com এর ওয়েবসাইটটিতে দেখুন ইস্টার্ন জোনে কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও মেজর বইমেলা নেই। সুতরাং যা আছে তা হাহাকার। বাংলা বই বিক্রি হয়নি। এডিশন হয় না, টাকা ফেরত হয় না, রয়্যালটি নেই বরঞ্চ লেখকের থেকেই টাকা দাবি করেন প্রকাশক! কাজেই সেই বই প্রকাশক ব্যতীত কারও জীবন বদলে দিতে পারে না এটা নিশ্চিত। এইভাবে চলবে তো কবে আমরা ভাবতে শিখব? আবার এই রকম পুরস্কার সত্যি আছে, যে বই জীবন বদলে দেয়। www.livingnowawards.com এ খুঁজে পেলাম তাদের। তারা বইয়ের লেখক, শিল্প্‌ সম্পাদক, ডিজাইনার, প্রকাশক তৎসহ অন্যান্য নেপথ্য কুশীলবদের পুরস্কৃত করে প্রতি বছর সেই সব বইকে যে বই জীবন বদলে দেয়। ২০১৭ সালে এরা পুরস্কৃত করেছে ২৯টি আলাদা ক্যাটিগরিতে তিনটি করে বই! তাতে গ্যাস্ট্রোনমি থেকে অ্যাস্ট্রোনমি কিছুই দেখি বাদ নেই। আমরা এখনও ব্যবহারিক প্রয়োজনের কথা বলি বুকপ্রিন্ট না অফসেট — তা নিয়ে দুটির প্রয়োজনের কথা অংশত ভাবি, কোন পাতায় কত গ্রাম কালি লাগানো সম্ভব তা জানতে আমাদের বয়ে গেছে। খেয়াল রাখি না Takaseda Matsutani জাপানি বর্ষীয়ান শিল্পীর সাদা-কালো রোলারের ঘষটানি ছাপতে ডিজিটাল প্রিন্টই হবে উপযুক্ত আবার Shirazeh Houshiary কেওস মুভমেন্টে আত্মবিস্মৃতের ডিজাইন আনা ডিজিটালে কখনওই সম্ভব নয়, তা জানতে আমাদের শিখতে হবে। মোট কথা সাহিত্যে নতুন কিছু হওয়ার নেই, সব নাকি লেখা হয়ে গেছে। প্রবন্ধের নামে অ্যাকাডেমিক লেখাপত্তর গেলানো এখন দুষ্কর, আর কবিতা তো কবিরা নিজে ছাপান আর বিলান। বইটই উঠে যাক তাহলে, নিজেকেই প্রশ্ন করুন না এত বই কেন? এ সব নেহাতই রাগের কথা। তবু দিনের শেষে কাঁড়ি কাঁড়ি কদর্য বই ছাপা হচ্ছে আর ততই দূরে সরে যাচ্ছি আমরা বইয়ের জগৎ থেকে।

[হ্যাশট্যাগ-আর্কিটেকচার]

[হ্যাশট্যাগ-বাইন্ডিং]

আমাদের বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে ছোটবড় নানান পুরস্কার আছে। কমিটি-টমিটিও থাকে। সেই কমিটিতে থাকেন সাহিত্যিক সমালোচক সাংবাদিকরা। নতুন ভাবনার মানুষদের উৎসাহিত করতে তারা চাইবেন না, চান নিজেদের লবি, নিজের অনুগামী। তেল দেওয়া থেকে পালটা পুরস্কারে ছেয়ে থাকে সেই সব ভাবনা। হেসে খেলে সভা-সমিতি করে এরা দিন কাটান এবং নতুন কিছুর যে আদৌ দরকার আছে এমনটা দেখতে কেউ পান না। এভাবে বইয়ের মান আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে, মানে যেটা ছাপা হচ্ছে তার জন্য কাগজ নষ্ট করার মানে ছিল না। কম্পিউটার স্ক্রিনে দিব্য বেঁচেবর্তে থাকত। এসব দেখে পড়ে থাকে কেবল হতাশা। এটা টের পাই, আমার মায়ের ভাষা নিয়ে যতটা গর্ব, সেই ভাষার বই নিয়ে কিছুই পড়ে নেই। এ ভাবে চলবে না। আমাদের বইয়ের মান আন্তর্জাতিক করতে হবে। কথায় নয় কাজে। জগত জুড়ে অনেক ফেস্টিভাল আছে সেখানে যাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন, কত নতুন ভাবনারা এসে জড়ো হয় সেখানে। শেখার অনীহা না থাকলে স্ফূর্তিতে ঘুরতে পারবেন, শুধু খেয়াল রাখবেন পাঠানোর মতো প্রকাশনা আপনার আছে তো? সম্প্রতি ফাইনাল এন্ট্রির ডেডলাইন খতম হল www.jppyawards.comএর, এখানে সারা পৃথিবী থেকে এন্ট্রি আসে, কলকাতার কোনও বই সেখানে যায়নি কখনও, কোপাকাবানা টাইমস স্কোয়ারে আগামী ২৯ মে, ২০১৮ উপস্থিত থাকবেন না কোনও বঙ্গসন্তান। এবং সারা পৃথিবীতে এমন প্রচুর ফেস্টিভাল আছে যেখানে এন্ট্রি পাঠানোর মতো কোনও প্রকাশনা আমাদের নেই। এই সব ফেস্টিভালে, সম্পাদনা, ডিজাইন, ব্লার্ব টেক্সট রাইটিং থেকে মার্কেটিং নানা মজাদার সব কর্মশালা হয়। এগুলিতে গত দশ বছর প্রভূত জোর দেওয়া হয়েছে নিউ মিডিয়াকে। সুতরাং আমাদের হাতে গোনা কয়েকটি তারার তিমির ঢের বেশি আঁধার তৈরি করেছে গতানুগতিক হওয়ার অভ্যাসে। Reuben Margolin-এর কাইনেটিক আর্ট দেখুন আর ভাবুন প্রতিবার নাড়া লাগলে আপনার বইতে আলাদা আলাদা প্রচ্ছদ তৈরি হচ্ছে! অথচ ক্যালাইডোস্কোপে কত চুড়িভাঙার নক্সা সাজিয়েছেন ছোটবেলা থেকে! এই বই হবে আপনার ভালবাসার ধন, যাকে হারাবেন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে।

পপ আপ বুক, পিকচার বুক এমনকি গ্রাফিক নভেলের সঙ্গে আপনারা অল্পবিস্তর পরিচিত। বুক উইথ মিউজিক বা থিয়েট্রিকাল বিদেশে বেশ জনপ্রিয় মাধ্যম। মোবাইলে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং এখন সহজ হয়েছে কাজেই ডাকাবুকো কবি বা সাহসী সম্পাদক আপনি লিটিল ম্যাগাজিনেও ভাবতে পারেন এর ব্যবহার করা যায় কিনা। আসলে পরীক্ষা ছাড়া নতুন কিছু তৈরি হতে পারে না। বিদেশে পেপার ইঞ্জিনিয়ার বলে একটি পদ তৈরি হয়েছে। শুধু প্রিন্টিং টেকনোলিজিস্টরা নন দার্শনিক, স্থপতি বা ভাস্কররা এই কাজে বেশ সফল হয়েছেন। মুনবিম বলে একটি সংস্থা আছে যারা ছোটদের বইয়ের জন্য পুরস্কার দিয়ে বিখ্যাত। প্রায় চল্লিশটি ক্যাটিগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে book arts/ pop-up/ cut out বিভাগে স্বর্ণপদক ও ব্রোঞ্জ পান একই প্রকাশনা সংস্থা Jumping Jack Press। পেপার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন যথাক্রমে Yoojin Kim এবং Renee Jablow। এর মধ্যে দ্বিতীয় জন ওরিগ্যামির লোক। এটা বেশ পরিস্কার জ্ঞান নির্দিষ্ট চৌহদ্দিতে আটকে থাকার দিন শেষ। বইকে যে বইয়ের মতোই দেখতে হবে তাও আর হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

[ক্রিম]

শৈলেশ প্রভু একজন নামজাদা গেম ডিজাইনার। স্ল্যাশ নামে সারা বিশ্ব চেনে মধ্য চল্লিশের এই নিউ মিডিয়াম্যানকে। ইঞ্জিনিয়ারিং করার পর একদিন ধুত্তোরি করে ছেড়ে দিয়ে এলেন গেম ডিজাইনিং-এ। বছর পাঁচেক বয়েসেই সাড়া ফেলেছে ইন্টারাক্টিভ গেম ডিজাইনে তাঁর ‘ইয়োলো মাংকি স্টুডিও’। ধরুন একটা বইয়ের মধ্যে ইলাস্ট্রেশন নেই, আছে কিছু গেম, মাঝে মাঝে খেলে নিচ্ছেন। তা যেমন আপনাকে রিলিফ দিচ্ছে তেমনই আশার আলো দিচ্ছে নতুন কোনও প্লটের সমাধানের, এতটাই সাবজেক্টিভ এতই মজাদার এই নিউ মিডিয়া। এই পাজেলগুলোর নাম socioball, এছাড়াও আরও অনেক পাজেল আছে এদের ওয়েবসাইটে www.yellowmonkystudios.comএ দেখতে পারেন sky sutra, BLUK, One more press ইত্যাদি চরম উদ্ভাবনী খেলা। ই সুরেশের নাম শুনে থাকতে পারেন অ্যানিমেশন নিয়ে যারা মাথা ঘামান। এনার অ্যানিমেশন প্রোজেক্টের বিশেষত্ব ইন্টারাক্টিভিটি। পাঠকের মনের সঙ্গে পালটে যাবে ছবি। অনেকটা যেমন কিছু বিলবোর্ড দেখেন না, নানা দিক থেকে নানা ছবি মনে হয়। এমনই বিচিত্র কাজকর্ম তার। এনআইডিতে পড়ার সময়কার কাজ দেখলে আজও অদ্ভুত লাগে, একটি অ্যানিমেশন ফিল্ম ছিল ধোঁয়া নিয়ে! ইনি দেশেবিদেশে নানা উদ্ভট ‘আইডিয়া’ পড়িয়ে বেড়ান, ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় ঘোরানো আর কি। নানা ফান্ডিং এজেন্সি নিয়ে যায় তাকে তরুণদের উদ্ভট আইডিয়ার সলিউশনের জন্য। বই ডিজাইনার জুলিয়া হাসটিং থাকেন জুরিখে। ফাইডন কোম্পানির বইগুলি বর্তমানে তার ডিজাইন করা, যারা ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে বুক আর্কিটেকচারের ধারণা। এই জুলিয়ার প্রথম বই-এর ডিজাইন দেখলে আজও চমকে যেতে হয়। CREAM বইটা ছিল সাবানের মতো দেখতে। পাওয়া যেত প্লাস্টিকের মোড়কে। এর একটি পাতা আমাকে আজও সহজ পাঠের কথা মনে পড়ায়। আমরা যখন হ্যান্ড বাইন্ডিং ছেড়ে মেশিন বাইন্ডিং-এ ঝুঁকছি, তখন ফাইডন থেকে জুলিয়া এমন এমন বই ভাবছেন তার জন্যই টিকে আছেন একদল কারিগর। সে সব বই যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনই আশ্চর্যময়। এই যে পুরাতনকে বিদায় না করে নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করার শিক্ষাটা তিনি সুকৌশলে আমাদের দিয়ে চলেছেন তাঁর প্রতিটি কাজে।

Aners Lind-এর কাজ সহজেই দেখতে পারেন ইউটিউবে। ইন্টার‍্যাকটিভ সাউন্ড ইন্সটলেশন। সারাঘর জুড়ে রঙের ফেট্টি। দেখে মনে হয় অকাতরে শুয়ে থাকা কতগুলি বারকোড। মাথায় রাখুন এই কাজ লিন্ড করছেন মস্ত ক্যুয়ের ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা ব্যঙ্গ-বিদ্রপের মধ্যে দাঁড়িয়ে একবগ্‌গা সুরের মতোই তিনি অবিচল। ধীরে ধীরে ঘর জুড়ে উঠছে হারমনি বা সন্মেলক। দেখুন কন্টেন্ট কী করে শত অভিধায় ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে অবলীলায়। এইভাবেই বই জুড়ে তৈরি হোক অপরূপ। লিন্ডের ঘর জোড়া প্যাটার্নগুলি লক্ষ করুন, যেন একেকটি চ্যাপটার। বই কীভাবে পড়বেন তা কেবল পাঠকের। এই ধরণের লাইন সহজেই বইতে এনে ফেলা যায়, পাঠক কেবল ভাবনার স্তরগুলি জুড়বেন বুকমার্ক বা ক্লিপ দিয়ে। আমি সারক্ষণ ধরে যা বোঝাতে চাইছি, বই একটি সন্মেলক ও উপস্থাপনার একটি ফর্ম, এর অভিধা বহুমাত্রিক সেখানেই এর সাফল্য। এর আকার, গঠন এমনকি ব্যবহার নিয়েও বিন্দুমাত্র ট্যাবু রাখবেন না। একদিন হয়তো দেখবেন পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে চায়ে ডুবিয়ে খেয়ে নিচ্ছেন রোজ সকালে গোটা একটা বইয়ের কিছু কিছু। আপনারা বলবেন এ আর মশাই নতুন কী! আমরা কত্ত বই দিয়ে চৌকির পায়ার অমধুর ‘ধকধক করনে লাগা’ ঠাণ্ডা করে দিয়েছি, বালিশের কাঠখোট্টা সংস্করণ হিসাবেও ব্যবহার করেছি ঢের। আমিও তাই বলি, সে আর নতুন কি! আর একটু নতুন করে ভাবতে দ্বিধা কোথায়, প্রতিদিনই বদলে যাবে বই। আপনার চেতনার রঙে সে উঠুক রাঙা হয়ে। সে হোক প্রতিদিনের ভাবনার সঞ্চয়ের প্রতিফলন।

সকলেই যদিও ভাবছেন, আদৌ এসবের সঙ্গে বইয়ের কী সম্পর্ক রে! জীবন বয়ে চলে, এভাবেই কিছু মায়া লিখি, কিছু আঁকি বাতায়ন। ভাবনাহীনতার দৈন্যে রাতচরা জেগে থাকে। ভাবনার সমুদ্রে সারসার অহেতুক ডিজাইনে পাড় বুনেছে বালুকণা, তার চোখ চিকমিক চিকমিক। তটজুড়ে আলোর নাচন, শব্দের কম্পন। এভাবেই Carsten Nicolai বার্লিনে তার নিজের স্টুডিওতে বসে গাঁথছেন ভাবনার মালা, কাহার তরে? যারা জেগে দূরে বহুদূরে, এক ভাবনার সমুদ্রের কিনারে কিনারে, কেউ ভাবছেন বিজ্ঞান নিয়ে, কেউ ভাবছেন নাচ নিয়ে, কেউ জেন্ডারযুদ্ধে নিয়োজিত, এমনই হয়তো কেউ ভাবছেন ‘উন্নততর’ বই নিয়ে। মেলাবেন তিনি মেলাবেন। তিনিই কার্স্টেন নিকোলে এই তো রাস্তায় দেখতে পাচ্ছি দূরে দূরে গাছেদের মাইলস্টোন, কোটরে রাখা আছে আমাদের স্বপ্নের বইটি। নাচতে নাচতে আসছে লেজারের কাঠবিড়ালি। তার গুগলি-দুসরা-চায়নাম্যান বোঝার সাধ্য কুলাচ্ছে না দুয়োরানি বেচারি ভিডিও পর্দার, আর তাঁর সেবায়েত-দাসদাসী অ্যাপ শাসিত মোবাইলগুচ্ছ হতাশ ও ক্লিশে। কার্স্টেন নিকোলের কাজ উঠে আসছে সমকালীন শিল্পে, সিনেমায় (লিও ক্যারক্সের ‘হোলি মোটরস’ যারা দেখেছেন বুঝবেন), নতুন দিনের ভাবনায় এনে দিচ্ছে সম্ভাবনার জোয়ার। লেজার বর্ণমালার নাচার জন্য চাই ট্যারাব্যাকা উঠোন, বইয়ের পাতা পেতে পেতে আদরের স্পেস দিন তাদের। অক্ষরের দিনগুলি এখন আহ্লাদের। আর ঠিক এখানেই বইয়ের ভবিষ্যৎ। তবে, আপনার ধারণার বইটি হয়তো থাকবে না আর। তৈরি হবে উন্নততর বই। এ তো জেনেই গেছেন, সব বই কখনওই বই নয়, গঙ্গায় ভেসে যায় শুকনো ফুল, দেবীর কাঠামো, একদা প্রিয় শাবকের দেহ। সেই মতো ভাসিয়ে দিন বস্তাপচা ধারণাদের। শত ক্লেশ ও ক্লিশের মধ্যে বই তবু জাগে নবীন উল্লাসে, নতুন ভাবনার প্রাণের সঞ্চয়নে। এভাবেই আসে আধ মুড়ানো নোটে গাছে, আসে নতুন পাতা হয়ে, ক্লোরোফিলে-ক্লোরোফিলে শিহরণ তুলে বসন্ত কড়া নাড়ে দিগন্তের প্লাবনে। আজও তাই জাগি, তাই আজও আমরা ভাবি, শ্রীজাত’র বান্ধবীদের সিঁদুরের মতো ভালোবাসার পরাগরেণু এসে লাগে জংধরা-উইধরা বইয়ের পাতায়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. অনেক ধন্যবাদ। বই ছাপা কমাতেই হবে, গাছ কাটা কমাতেই হবে। এত বই ছাপানোর কোনও প্রয়োজন নেই। মোবাইল ও নেট পরিসেবা সুলভ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে। আপনাদের ধর্মগ্রন্থগুলি বা ম্যানিফেস্টো যেগুলি অধিক সংখ্যক লোকের মধ্যে ছড়ানোই মুখ্য উদ্দেশ্য সেগুলির ছাপা অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা হোক। আমি টেক্সট বুকও ছাপার বিরুদ্ধে, সবুজসাথীর সাইকেল অচিরেই সবুজ মোবাইলে বদলে যাক।

Leave a Reply to যোষিতা Cancel reply