টিকায়েতের চোখের জল আগুন হয়ে ফিরছে গাজিপুরে

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

 



গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী

 

 

 

 

 

সরকার যে সমস্ত কদর্য কলাকৌশলে কোনও আন্দোলন ভাঙতে সিদ্ধহস্ত, একদিন না একদিন যে সেইসব শুরু করবে এবং অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনকে দিয়ে দাঁত-নখও বের করবে তা ২৬-এর পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। হলও তাই। আপাতত সঙ্ঘ পরিবারের নিজস্ব রাজ্য যেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৭ রাত থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত কৃষকদের ওপর পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে আনে। তারপর গতকাল সন্ধে থেকে গাজিপুর বর্ডার বিশাল সংখ্যক পুলিশ এবং র্যা ফ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। দুদিক থেকেই— একদিকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ, অন্যদিকে দিল্লি পুলিশ। বলা হয় রাতের মধ্যে কৃষকরা যেন রাস্তা ফাঁকা করে দেন। দিল্লি পুলিশ এর মধ্যে যে কাজগুলি করে নিয়েছে সেগুলিও বলে দেওয়া দরকার। যে সমস্ত কৃষকরা ২৬ তারিখে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দিল্লি পুলিশ তাঁদের সবার বিরুদ্ধে ইউএপিএ দিয়েছে; কৃষক নেতাদের নামে লুকআউট নোটিস জারি করেছে; সিংঘু বর্ডারে বিজেপির শ খানেক গুণ্ডা হামলা চালিয়েছিল— তাদের প্রোটেকশন দিয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু সব শেষে আমাদের অনমনীয় বীর কৃষকদের বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়টা প্রশাসনকেই হজম করতে হল আবারও এ রাউন্ডে। গাজিপুর সীমান্তে কৃষকরা ওইরকমভাবে পুলিশি ঘেরাওয়ের মধ্যেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা কোথাও পালিয়ে যাচ্ছেন না। এনডিটিভিতে রাতেই দেখাচ্ছিল মহিলা কৃষকরা দৃপ্ত কণ্ঠে তাঁদের সঙ্কল্পের কথা জানাচ্ছিলেন। আর রাকেশ টিকায়েত। বিকেইউয়ের এই নেতা পরিষ্কার বলে দিলেন সরার তো কোনও প্রশ্নই নেই, যদি এই কালা কৃষি আইনগুলি চালু হয় তবে তিনি আত্মহত্যা করবেন। তাঁর এই ঘোষণা এবং ঘোষণার সময়কার অশ্রু যেন ঘিয়ের কাজ করল। কাল রাতেই পাঞ্জাব হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে কয়েক হাজার কৃষক ট্রাক্টরে রওনা দিয়েছিলেন গাজিপুর সীমান্তের উদ্দেশ্যে। আজ বিভিন্ন জায়গায় বসল মহাপঞ্চায়েত। এবং সেগুলি থেকে আরও হাজারে হাজারে কৃষক রওনা দিলেন গাজিপুরের দিকে। “য়ে আসুঁ সরকার কো মেহেঙ্গা পঢ়েগা!” স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই কৃষকদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করেছে পুলিশদের সংখ্যা।

ঘটনাক্রম যে এদিকেই বাঁক নেবে গত দু মাস ধরে সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর সীমান্তের এই কৃষক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করে ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। সত্যি এখনও আমার বিশ্বাস হয় না যে সত্যিই আমার জীবদ্দশায় এমন একটি মহত্তম ঘটনা ঘটছে। শুধু বড় সংবাদমাধ্যম বা সরকারি দলের উপেক্ষা বা কুৎসা নয়, আমাদের ভাবতে পারার সীমাবদ্ধতাও এই ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃত তাৎপর্য এখনও বুঝে উঠতে দিচ্ছে না। আমাদের অবিশ্বাস এবং হতাশা এতটাই তলানিতে চলে গিয়েছিল যে, যখন উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই হার-না-মানা কৃষক বিদ্রোহ জন্ম নিচ্ছে, তখন আমরা একে এক তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ভেবে অন্য দিকে মনটা ঘুরিয়ে দিয়েছি। তেভাগা আন্দোলন, ষাটের বেনামি বা খাসজমি দখলের কৃষক সংগ্রামের গল্প শোনা আমরা আম-বাঙালিরা দিল্লি সীমান্তে তরুণ কৃষক সন্তানকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে একে বড়লোক কৃষক বা জোতদার জমিদারদের ক্ষমতার টানাপোড়েনের রাজনৈতিক চাপানউতোর ভেবে নিয়েছিলাম। আমাদের কৃষক আন্দোলন মানেই অনাহারক্লিষ্ট মুখ, দীর্ঘ লংমার্চে রক্তাক্ত দরিদ্র মানুষের পায়ের ছবি। আন্দোলন সংগ্রামের পথটা যে আমাদের চেনাভাষ্যের সীমাবদ্ধ ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে তা আমাদের সাধারণ ধারণায় ছিল না। অগ্রগতি ও পশ্চাদপদতার ঘূর্ণিপাক এতটাই জটিল এক জীবনবোধ তৈরি করে যে তরুণ তরুণীর হাতের মোবাইল দিয়েও সবসময় তাদের পারিবারিক অর্থনৈতিক স্তর সম্পর্কে ধারণা করা যায় না আজকাল।

কৃষক সমাজের দিল্লি অভিযান আমাদের অনেক চেনা বদ্ধমূল ধারণার মূলে আঘাত করেছে। এই দেশকে নতুন করে যেন আমাদের চোখের সামনে পরিচিত করছে। সিংঘু সীমান্তে পাঞ্জাবি কৃষক যখন হিন্দি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকার সময় ছবি-শিকারীর ক্যামেরায় ধরা পড়েন, তখন আমরা আবিষ্কার করি আমাদের ভেতরের এক একটি কূপমণ্ডুক ‘গোরা’ও তার বদ্ধমূল ধারণার ভারতকে নতুন করে সত্য পরিচয়ে চিনতে শুরু করেছে। শিখধর্মের একটি মহৎ স্বেচ্ছাশ্রম ‘করসেবা’ শব্দকে হিন্দুত্ববাদীরা গত শতকের নয়ের দশক থেকে কদর্য হিংস্রতায় পরিবর্তিত করেছিল। আজ দিল্লি সীমান্তে নানা ভাষা ধর্ম জাতি বর্ণের মানুষের কাছে শিখদের পবিত্র শব্দ ‘লঙ্গর’ নতুন করে সংগ্রামের ভাষা হয়ে উঠেছে। নানা রাজ্যের সাধারণ মানুষের ভালোবাসার দানে তৈরি হওয়ার এই সংগ্রামী লঙ্গর ভালোবাসা সৌহার্দ্য সহমর্মিতার এক বহুত্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভিষেক ঘটাচ্ছে। এ সবই আমাদের এক মহৎ পাঠ যা ভেসে আসছে দিল্লি সীমান্ত থেকে। ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা এগিয়ে গেলেন রাজধানীর দিকে। ওঁদের এই এগিয়ে যাওয়া সারা ভারতে ছড়িয়ে দিল রাজনীতির এক নতুন বয়ান যা আমাদের অজানা ছিল। সাধারণতন্ত্রের আদর্শকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ২৬ জানুয়ারির কিসান প্যারেড ষাটের ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ রণধ্বণিকে ভারত সীমান্ত থেকে তুলে এনে ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করে নতুন ভারত গড়ার রাজনীতিতে পরিণত করেছে।

কেন বলছি এই কৃষক সংগ্রাম শতাব্দীর এক মহত্তম বিস্ময়? তার কারণ অসংখ্য, অগণন। মোদ্দা কথাগুলি বলেছেন এই আন্দোলনেরই একজন নেতৃস্থানীয় মানুষ, অশোক ধাওয়ালে। যে পাঁচশোটি সংগঠন একত্রে সংযুক্ত কিসান মোর্চা গঠন করেছে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সারা ভারত কৃষক সভার কেন্দ্রীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে। মহারাষ্ট্রের ঐতিহাসিক কৃষক লংমার্চের তিনিই ছিলেন কেন্দ্রীয় সংগঠক। পিপলস ডেমোক্রেসি সাপ্তাহিকের পাতায় লেখা তাঁর নিবন্ধে এই অভূতপূর্ব সংগ্রামের ঐতিহাসিকতা নিয়ে তিনি বলেছেন কয়েকটি কথা। এখানে সেগুলি উল্লেখ করেই আমার কথাগুলো বলতে চাই।

প্রথম বিস্ময় বা ঐতিহাসিকতা হচ্ছে এই আন্দোলনের ব্যাপকতা। ভারতের ইতিহাসে এত বিচিত্র ধারার, বিচিত্র মত পথের এতগুলি সংগঠনের দুটি মাত্র কেন্দ্রীয় দাবির ভিত্তিতে এভাবে ঐক্য গড়ে তোলার পূর্বইতিহাস নেই। এমনকী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও এত বিচিত্র মতাদর্শের মানুষ এভাবে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নজির সম্ভবত নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এত বিচিত্র মতপথের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সর্বসম্মতির এমন দৃষ্টান্তও নেই। এই আন্দোলনের কোনও একজন কেন্দ্রীয় নেতা নেই, একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন নেই যা ছিল ১৯৭৪ সালের রেল ধর্মঘট বা শারদ যোশী কিংবা মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের কৃষক আন্দোলনের সময়।

দ্বিতীয় বিষয় এর অবিশ্বাস্য শান্তিপূর্ণ চরিত্র। নানা অঞ্চল থেকে নানা মত পথের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন দিল্লি সীমান্তের নানা প্রান্তে, অথচ সকলে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। যা অশান্তি হয়েছে তার সবটাই হয়েছে সরকারের তরফে। জলকামান দাগা, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করা, লাঠি চালানো, গ্রেফতারি, স্থানে স্থানে অবরোধ তৈরি করা, রাস্তা কেটে রাখা— সবই করেছে সরকার। কৃষকদের তরফে শান্তিভঙ্গের একটি উদাহরণও নেই। অথচ উস্কানি ছিল প্রতিনিয়ত। সংগ্রামী কৃষকরা যেন পরিবর্তিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সত্যটি উপলব্ধি করেছেন, শক্তি প্রদর্শন আর শান্তিভঙ্গ সমার্থক নয়। শান্ত, নিরস্ত্র হয়েই সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করা যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ধূলার ‘পরে স্বর্গ তোমার গড়তে হবে/ বিনা অস্ত্র বিনা সহায় লড়তে হবে”। বিনা অস্ত্রের শক্তি, পীড়নকে শরীরে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া শান্ত প্রত্যাঘাতের শক্তি রবীন্দ্রনাথের ধনঞ্জয় বৈরাগী বুঝেছিল। আজ সেই মহৎ জীবনসত্যের উপলব্ধি যেন দেখছি দিল্লি সীমান্তে। দেশের সরকার কী না করেছে! কখনও বলেছে এদের পেছনে বিদেশি শক্তির মদত আছে। কখনও বলেছে এরা দেশদ্রোহী খালিস্তানি কিংবা মাওবাদী। কখনও পাকিস্তান বা চিনের দালাল। কখনও বলেছে ক্ষমতালিপ্সু বিরোধী দলগুলি এদের পুতুলের মত ব্যবহার করছে। কখনও ভুয়ো ছবি দিয়ে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছে। আবার কখনও সরাসরি কাঁদানে গ্যাস বা লাঠি বা জলকামান রাস্তা কেটে দেওয়া ব্যারিকেড তৈরির অশান্তির সহিংস পথ নিয়েছে। কৃষকেরা শান্ত হয়ে আছে। উত্তরে যেন ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতই বলছে, ‘এবার যা করবার তা সারো সারো/ আমি হারি কিম্বা তুমি হারো’। এই হার-না-মানা মরণপণ শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের স্বপ্ন গান্ধিজি হয়ত দেখতেন, এমন জীবনবোধের কথাই হয়ত রবীন্দ্রনাথ ধনঞ্জয় বৈরাগীর মুখে বলেছেন। তাঁরা জীবদ্দশায় তা দেখেননি। আজ দিল্লি সীমান্ত সভ্যতার সেই নতুন পাঠই রচনা করছে।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সত্য এই সংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। আমি সচেতনভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার কথাটি পরিহার করে অসাম্প্রদায়িক শব্দটি ব্যবহার করেছি। ইউরোপীয় ধরনে ধর্ম থেকে দূরত্বে থেকে নির্মাণ করা ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম আমাদের এই উপমহাদেশে বাস্তবে সম্ভব নয়। অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই। ধর্মের ভেতরে সবসময়ই অন্তত দুটি সমান্তরাল ধারা রয়েছে যাদের মধ্যে মাঝেমাঝেই সংঘাত হয়। যবে থেকে ধর্মের গভীরে দুটি সমান্তরাল ধারার জন্ম হয়েছে তখন থেকেই এর একটি ধারা সমাজের ওপরতলার সহযাত্রী হয়েছে। আরেকটি ধারা সমাজের প্রান্তিক মানুষের সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গী হয়ে তার একক ও সামূহিক সংগ্রামেও শরিক হয়েছে। একটি ধারা আচারের শৃঙ্খলে বেঁধে মানুষের বিচারবোধকে একটি কারাগারে বন্দি করে। আরেকটি ধারায় বিচারবোধ সর্বোচ্চে স্থাপিত হয়ে আচারগুলিও সামূহিক মানুষের মঙ্গলকামনায় পালিত হয়। একই ধর্মের একটি ধারা হয়ে যায় শোষকের ধর্ম। আরেকটি ধারায় শোনা যায় শোষিতের দীর্ঘশ্বাস কান্না এবং তার দুঃখজয়ের সংগ্রামের সুর। দিল্লির কৃষক সংগ্রামেও ধর্ম আছে। ধর্ম আছে এক নতুন ভারত গড়ার মহৎ বিচারবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা আচার পালনের মধ্যে। লঙ্গর তৈরি করা, লোহরী উদযাপন এসবই ধর্মীয় বা পরম্পরাগত আচার। কিন্তু এই সমস্ত কিছুই নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে চলমান কৃষক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে। তাছাড়াও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র এই লড়াইয়ের অংশগ্রহণে। হিন্দু মুসলিম শিখ বৌদ্ধ খ্রিস্টান নানা ধর্মের মানুষ, অবিশ্বাসী মানুষ সবাই জড়ো হয়েছেন এই সংগ্রামের ময়দানে। এই অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম গড়ে উঠছে এমন সময় যখন সারা দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যাগুরুবাদী ধর্মীয় উগ্রতার হুঙ্কারবাণী শাসকদল ও সরকারের নানা শিখর থেকে ভেসে আসছে। দাঙ্গার রক্তস্নানে নির্মিত হতে চলা রামমন্দিরের তহবিলে অর্থদানের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে শাসকঘনিষ্ঠ মানুষেরা। এই কৃষক সংগ্রাম স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়। অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক রূপটি অত্যন্ত সচেতনভাবে সংগঠিত। এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের পতাকা উর্ধে তোলার মধ্য দিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের সংখ্যাগুরুবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধেই ধ্বনি তুলছে এই সংগ্রাম। এমন সচেতন অসাম্প্রদায়িক উচ্চারণও ভারতের ইতিহাসে বিরল। আরেকটি কথা, মূলধারার সংবাদ মাধ্যম বা সরকার যতই একে পাঞ্জাব বা হরিয়ানার আন্দোলন বলে সঙ্কীর্ণ করে দেখাতে চাক, এই আন্দোলন মূলগতভাবেই সর্বভারতীয়। এর সর্বভারতীয় রূপ প্রথম অবস্থায় এতটা দৃশ্যমান না হলেও যতদিন যাচ্ছে এর সর্বভারতীয় চেহারাও ক্রমে সুস্পষ্ট হচ্ছে। যতই একে ধনী কৃষকের আন্দোলন হিসেবে দেখানো হোক, এই আন্দোলনে প্রকৃতপক্ষে উঠে এসেছে সামগ্রিক কৃষক সমাজের অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটি। এই তিনটি সর্বনাশা কৃষি বিল গোটা কৃষিব্যবস্থাকেই কর্পোরেট ক্ষেত্রের সামনে এতটাই উন্মুক্ত করে দেবে যে তাতে ধনী কৃষক দরিদ্র কৃষক ক্ষেতমজুর— সবারই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠবে। এই সংগ্রাম শুধু ফসলের দাম নয়, কৃষি বাঁচানোর লড়াই। এখানে মহারাষ্ট্রের নিরক্ষর ক্ষেতমজুর যেমন আছে, আছে পাঞ্জাবের উচ্চশিক্ষিত কৃষক পরিবারের তরুণও। এক সময়ে কৃষক সংগ্রাম ছিল জমিরক্ষার লড়াই, ফসল রক্ষার লড়াই। তখন লড়াই ছিল জমিদারের বিরুদ্ধে। আজকের লড়াই কৃষিরক্ষার লড়াই, যে লড়াই পরিচালিত হচ্ছে দেশি বিদেশি কর্পোরেট মহল ও তাদের স্বার্থের রক্ষক সরকারের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ যে কারণে এর ঐতিহাসিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল এর রাজনৈতিক মর্মবাণীটি। এই সংগ্রাম শুধু কৃষক বা কৃষির লড়াই নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নরেন্দ্র মোদির সরকার যেভাবে একদিকে সংখ্যাগুরুবাদের সহিংস আক্রমণ ও অন্যদিকে সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ভারতের সাধারণতন্ত্রের ব্যবস্থার ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, এই কৃষক সংগ্রাম সেই রাজনীতির প্রতি প্রত্যাহ্বান ছুড়ে এক বিকল্প রাজনীতির কথা সামনে নিয়ে এসেছে। গত শতকের নয়ের দশকে নয়া উদারবাদী নীতির আগমনের পর বিশ্বের নানা প্রান্তেই সর্বাত্মক নয়া উদারবাদ বিরোধী গণসংগ্রাম গড়ে উঠেছে। সিয়াটল থেকে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট, মেক্সিকোর চিয়াপাসের পাহাড়, চিলি থেকে ভেনিজুয়েলা যে অসংখ্য লড়াই গড়ে উঠেছিল তার সমপ্রতিধ্বনি ভারতে আমরা তেমনভাবে শুনতে পাইনি। জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি তখন থেকেই সর্বভারতীয় ধর্মঘট ও নানা সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু ভারতের মাটিতে নয়া উদারবাদের মর্মমূল ধরে টান দেওয়া এমন সর্বাত্মক সংগ্রাম এই প্রথম। দিল্লির কৃষক সংগ্রাম আসলে শুধু কৃষক সংগ্রাম নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে ভারতের শ্রমজীবী জনতার বৃহত্তম গণ অভ্যুত্থান। এক অভূতপূর্ব অথচ শান্তিপূর্ণ অমিত শক্তিধর গণ অভ্যুত্থান।

কী হবে এই সংগ্রামের ভবিষ্যৎ? এই সংগ্রাম জয়ী হলেই ভারতবর্ষ পাল্টাবে না। কারণ পাল্টানোর সংগ্রামকে আরও নানা পর্যায়ে সফলভাবে পরিচালনার ওপর নির্ভর করবে কতটা পাল্টাবে ভারত।

যদি হেরে যায়? তবে নিশ্চিত আরও দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের জন্যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসীবাদী অগণতান্ত্রিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে ভারত যা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যাবে না। আর সেজন্যেই এই মহত্তম ঐতিহাসিক সংগ্রামকে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহের মত, পারী কমিউনের মত, বলশেভিক বিপ্লবের মত পরাজয়ে শেষ হতে দেওয়া যাবে না। জয় ছিনিয়ে আনতেই হবে। এবং গত ২৬ জানুয়ারি বা এই গত রাতের গাজিপুর সীমান্তের অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে এই জয়ের পথ মসৃণ নয়। এখানেও অগণন কাঁটা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. যেভাবে চলল কৃষক আন্দোলন— একটি সালতামামি – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...