বর্ষাদুয়ার: একটি খসড়া প্রস্তাব, যেভাবে উপন্যাসটি পড়া যেতে পারে

রাজদীপ্ত রায়

 

এই বাংলার একেবারে উত্তরদিকের পাহাড় ছুঁয়ে থাকা বিস্তীর্ণ এলাকা, তথাকথিত কিরাতভূমি, সমতল ডুয়ার্স, এককালের পৌণ্ড্রবর্ধন, পরে কামতা রাজ্য বলে পরিচিত হরেক নাম ও নানারকম সীমানার প্রায় সমস্ত ভূগোলটাকেই প্রচলিত মহাকাব্যের কথক বা পাঠকেরা এককথায় পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল বলে দেগে রেখেছে। পাণ্ডবস্পর্শকে ইতিবাচক গুণ হিসেবে ধরে নিয়ে, বাকি ভারতের মতো বৃহৎ বঙ্গের সমূহ ইতিহাসবোধও পাণ্ডববর্জিত নামক অভিধায় নেতিবাচক বাচ্যার্থ খুঁজে পায়। বলা বাহুল্য যে, আজকের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষের মনেও এই এলাকার সাংস্কৃতিক পরিচিতি নির্মাণের সেই গতানুগতিক নেতিনির্ভর দেখার অভ্যেস ভালভাবেই গেড়ে বসে আছে। এই ‘গেজ’ বা সাংস্কৃতিক রাজনীতি-নির্ভর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটা অবশ্য হালের নয়, বেশ ক’শতক ধরেই চলছে। কালে সেই অভ্যেসের শান আরও ধারালো করেছে দুশো বছরের ঔপনিবেশিকতা। অথচ কী পাণ্ডব, কী পরবর্তী ভারতীয় বর্ণবাদী রাজবংশেরা, কী মধ্যযুগের সুলতানদের শাসন অথবা দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল রাজপাট— সব বহির্শত্রুকে সপাটে রুখে দেওয়ার মতো প্রাবল্য ও প্রতাপ যে এই অংশের স্বাভিমানী গরিমার অন্যতম অভিজ্ঞান, সেই সহজ সত্যিটাই যেন পুরোপুরি উবে গেছে। একটা সুবিশাল ভূমিখণ্ডকে বর্জন করতে পাণ্ডবদের বাধ্য করেছেন যে অঞ্চলের নৃপতি বা অধিবাসীরা তাঁরা যে নিজেদের বাঁচামরার বিষয়ে বৃহৎ ভারতের মহাকাব্য বা ইতিহাসে লিখিত আধিপত্যের কোলপোঁছা বক্তব্যকে উপেক্ষা বা অনুকম্পার ধার ধারেন না, সে সার কথা আজকের দিনে এসে অন্তত বোঝা দরকার। আর প্রথাগত ইতিহাস আশ্রয়ের বাইরে যে অখ্যাত ঐতিহাসিকতা চলমান থাকে, সেখানে আভিধানিক অর্থ পালটে গিয়ে পাণ্ডববর্জিত শব্দের ইতিবাচক দ্যোতনাও যে হার না-মানা গৌরব আর অস্মিতায় প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে, সেই ভাষা ও জীবনের রহস্য সহজে বুঝতে গেলে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বর্ষাদুয়ার’ (কৃতি: কোলকাতা, ২০১৪) যেকোনও মনোযোগী পাঠকের কাছে নিঃশর্তে অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। সাহিত্যে ঈপ্সিত নন্দনের যাবতীয় মান্য বা অমান্য জৈব সততার নিয়ম বা দর্শন অনুসারেই।

পাঠ শুরু করা মাত্রই পাঠক বুঝে নেন যে, একটা বিস্তীর্ণ জনপদ জুড়ে শুধু সরে সরে যাওয়ার, ক্রমান্বয়ে মুছে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার ছায়াচিহ্ন লেখা থাকে, আছে, যুগ যুগ ধরে। কাজ অকাজ প্রাণধারণের মাটি কাদা মাখা জল আর বানভাসি পুছনি এই আখ্যানকল্পের মনবসতের উঠোন লেপে নিয়েছে সরল সততায়। বারে বারে মুছে ফেলা কোনও শালগুড়ি অথবা শালবাড়ি অথবা শালদুয়ারের উঠোন ক্যানভাসে জেগে উঠেছে— ওঠে— প্রজন্মান্তরের শুকনো রংরেখার চেনা অচেনা আধো অবয়ব। গোপন জ্যামিতি। জল, জঙ্গল, মাঠ, গাঁ, গঞ্জ, হাট, পাহাড়, অগুন্তি কুড়া আর স্রোত আর ঝোরা আর সোতা আর ঝর্ণার মিলিত সমারোহে ধুম লাগে আঠেরো দুয়ারে। জমিতে। বাতাসে। আকাশের হালকা আর পাহাড়ের গাঢ় নীলে। বনের কালচে সবুজে। ধুম লাগে অপার দুয়ারের মানুষের মনে। জীবনে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক যন্ত্রণায়। সুখে। আর ঐতিহাসিক বিস্মরণের গা-সয়ে যাওয়া অভ্যেসে। ধুম লাগে ডুয়ার্সে।

এইসব ক্রমান্বয়ে সরে সরে যাওয়ার, মুছে যাওয়ার আঁচড় ক্ষত দিয়ে আঁকা স্বপ্নে প্রায় নিঃশব্দে সেঁধিয়ে যায় গোটা ডুয়ার্সের বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠীর কৌম স্মৃতিলেখ। মধ্যবর্তী আবাস কথার আবশ্যিক বিষণ্ণতায় ভারী হয় বর্ষার স্মৃতিসিক্ত রাত। ডুয়ার্সের থাকা আর না-থাকায় বর্ষা লেগে থাকে কোনওদিনই না-ফুরোনো নাছোড় গল্পের মতো। দুয়ারে বর্ষা হয়। বর্ষায় দুয়ার। ভুটান পাহাড়ের নিচে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বেঁচে থাকায় ব্যস্ত অথচ সাবেকি ইতিহাস বহির্ভূত বিস্তীর্ণ জনপদ নদী মাটি পাহাড় অরণ্য চা-বাগান নাবাল কুড়া খেত প্রান্তরের সময় শরীর জুড়ে যেসব ফুটে ওঠা অথচ অলিখিত অক্ষর পড়ে থাকে হেলায়, জলে জঙ্গলে ঝোপ বা ঝাড়ে, প্রত্যাগত ইংরেজ প্রভুর হাত-ময়লা নিয়ম নীতি সর্বাঙ্গে বেঁধে নেওয়া বনবিভাগের নির্ধারিত পেরিফেরি অথবা কোর এরিয়ায়, অজস্র মারা, কাটা, পোতা, গুড়ি, কুড়া, বাড়ি আর দুয়ার বিশিষ্ট ক্লান্তিহীন স্থান নামের আনাচে কানাচে দেহকন্দরে, সেসব অক্ষরের সারিবদ্ধ বিষাদনামা উচ্চাবচ খেলা করে বর্ষার দুয়ারে। খেলা করে, ভাষা পায়, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঠ ঘাট জনজীবন ঘেঁটে ছেনে আনা বহুভাষিক সামাজিকতার একান্ত সজীব আখ্যানে। বর্ষাদুয়ার-এ।

জীবিত ডুয়ার্স লিখিত হয় স্বমহিমায়। তার রাগ ঝাল শোক আনন্দ সরলতা কুটিলতা পাগলামো সহ। যাবতীয় স্টিরিওটাইপ ঝেড়ে ফেলে। বিশ শতকের শেষভাগে গজিয়ে ওঠা নিসর্গবিলাসী পর্যটনশিল্পের একমাত্রিক একঘেয়েমিতে বেঁধে ফেলা বা দেগে দেওয়ার মূলত বাজারি আধিপত্যের রাজনীতিকে নস্যাৎ করে শেখর বলে যান অকৃত্রিম ডুয়ার্সের মানবজমিনের কিসসা। যেখানে বিষাদ আর বর্ষা শুধুমাত্র শোক আর অশ্রুর মতো নিতান্ত সাদায় কালোয় অর্থবহ নয়। বরং বহুমাত্রিক ছন্দে প্রবহমান এবং আশ্চর্য রকমের অনেকান্তিক। কখনও না-ফুরানো চরৈবেতির এক নিঃসীম চর্যাপদ।

কী হয় বর্ষাদুয়ার নামক এই আকর আখ্যানে? বলা ভালো, কিছুই হয় না। সঙ্গে এও বলা ভালো যে, কী হয় না! কিছু কি আর বাকি ছিল হওয়ার, বা আছে? অন্য কিছুও কি হওয়ার ছিল, বা হওয়া সম্ভব? অপাঙ্গে সেসব না-হয়ে-ওঠা সম্ভাবনাগুলিও কি অবশ্যম্ভাবীভাবেই বর্ষাদুয়ারের অনাখ্যায়িত সম্ভাবনার ইশারা ইঙ্গিতে ইতিমধ্যেই বিধৃত নয়? গোটা আখ্যান পড়ে ফেললে অতিরিক্ত বিদেশি ফিল্ম দেখে ফেলা সাব-ইন্সপেক্টরের মতোই নিজেকে পশ্চিম মোহে দুষ্ট বা অভ্যস্ত বলে মনে হয়। বিব্রত লাগে। আমকান্ত নামক পাগলকে জঙ্গি সন্দেহে হেফাজতে তুলতে এসে এন্তার ‘কপ’-ফিল্মের বিদেশি নায়কের ক্যারিশ্মায় মজে থাকা যুবক সাব-ইন্সপেক্টর তার সঙ্গীসাথীদের “গো-গো-গো” বলে তাড়া দেয়। শালগুড়ি বাজার নামক এক চির-অভ্যস্ত এবং অতি সাধারণ ডুয়ার্স জনপদের ততোধিক সামান্য ভাঙাচোরা হাঁটচালার কোণায় নিজের প্রস্রাবে নিজেই মাখামাখি হয়ে গুটিয়ে থাকা শীর্ণ পাগলের অসহায় গ্রেফতারির মুহূর্তে এই হলিউডি অনুকরণে তোলা পুলিশি উৎসাহব্যঞ্জক “গো-গো-গো” ধ্বনি ঠিক ততটাই উদ্ভট এবং হাস্যকর যতটা অ্যাবসার্ড একটি পাগলকে জঙ্গি বলে ঠাউরানোর ভয়ানক নিস্ফলা রাষ্ট্রযন্ত্রীয় রকমসকম। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় আখ্যান বর্ষাদুয়ার পড়ে ফেলবার পর মানুষ আর অসংখ্য মানুষজনের গল্পে গানে লোককথায় ঠাসাঠাসি বাংলার এই অন্তিম-উত্তর জনপদের যেকোনওরকম ধারণা নির্মাণে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের চূড়ান্ত নিস্ফলা আর হাস্যকর ত্রুটিগুলো অনায়াসে চোখে পড়ে। অভিজ্ঞতায় উঠে আসে জীবিত অথচ অ-কথিত কাহিনির স্বাদ গন্ধ স্পর্শ মায়া ও অনিঃশেষ নিষ্ক্রমণের বিষাদমগ্ন ধ্রুবপদ। পাতায় পাতায়। পর্বে পর্বে। ধ্রুপদী উপস্থাপনের আলাপ বিস্তার গৎ ঝালা তেহাই আর সমের সুরেলা সূত্র মেনে।

কী হয় বর্ষাদুয়ারে, অথবা কী হয় না, পড়তে গেলে সেসব প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে না। ঘটনাপ্রবাহের কার্যকারণ অনুসন্ধানে শেখর অযথা সমাজবিদ্যার পাঠ প্রকল্পের অবতারণা করেন না। ঔপন্যাসিকের অনাসক্ত নান্দনিকতা এক্ষেত্রে তাঁর বেশি অভিপ্রেত। বর্ষাদুয়ারের সহজ ও গতিময় আখ্যানে বরং অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠে আসে অমোঘ জিজ্ঞাসা, এসব কোথায় হয়। কেননা যা হয়, আর যা হয় না বা হতে পারে না, সে সমস্ত কিছুরই হওয়া বা না-হওয়ার একমাত্র ঠিকানা বর্ষাদুয়ার। এমনই তার সুদৃঢ় স্থানিকতার শেকড়, তার আম্বিলিকাল কর্ড, যে সেই জন্মগ্রন্থি থেকে আখ্যানকে আলাদা করা অসম্ভব। আবার সে কারণেই সে বিশ্বাসযোগ্য, ও বিশ্বজনীন।

‘দুয়ার’-আখ্যানের এহেন বৈশ্বিক ইতিকল্পে শেখরের অনায়াস ভাষা অনুসন্ধান প্রায় পাহাড়ি ঝোরার উন্মাদনা আনে। নির্ভুল কিন্তু চাপা এবং মার্জিত কৌতুকে মোড়ানো থাকে অগুনতি অ্যানেকডোটের মত অণু আর চূর্ণবৃত্তান্তের বিরাট সমাহার। জীবননিবিষ্ট পাঠপ্রক্রিয়া উত্তর কাশিয়াপাথার গ্রাম, শালগুড়ি টি এস্টেট, সংলগ্ন শালগুড়ি বাজার এলাকা, ভইসবাথান ফরেস্টের পশ্চিমে তিস্তার পাড়, পাড় উজিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের সদর, উত্তর দিকে লাগোয়া ভুটান পাহাড়ের নেমে আসা ঢল, দক্ষিণে র‍্যাডক্লিফ লাইনের ওপারে ফেলে আসা গ্রাম তন্তর বা রুসদী বা তারপাশা, ডাইলঘাটা নদীর ঘোলাটে স্রোত, পক্ষীহাগা কুড়া, কুড়ার গাছগাছালিতে অজস্র পরিযায়ী পাখিদের আশ্রয় খুঁজে থিতু হওয়ার কোমল শান্তি আর আশ্রয়দাতা আষাঢ়ু বা কাইচালু দেউনিয়ার অসমাপ্ত স্বর্গের সিঁড়িকে সন্ধেরাতের মাঠপাথারে জমে থাকা নিরালম্ব এবং সমান্তরাল কুয়াশার সুতোর মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দেয় গোটা ডুয়ার্সের শিরায় উপশিরায়। কাল্পনিক শালগুড়ি গঞ্জ তার নামগত সমস্ত সম্ভাব্যতা বজায় রেখেও বৃহত্তর সাঙ্কেতিক প্রতিবেশের চেহারায় ক্রমেই নিজেকে মেলে ধরতে থাকে। পরিসর লেখা হয় সময়ের গায়ে। সময় মেপে নেওয়া হয় ভূগোল স্থানাঙ্ক ধরে ধরে। গ্রাম থেকে গঞ্জ হয়। গঞ্জ হয় অঞ্চল। ক্রমে গোটা ডুয়ার্সেরই নাম হয়ে যায় উত্তর কাশিয়াপাথার বা শালগুড়ি।

একটি ছোট অঞ্চল একটা গোটা ভূ-অংশের হয়ে ওঠা বা না-ওঠার ইতিহাসকে বিস্মৃত গল্পের চৌম্বক মায়ায় আর ম্যাজিকে নিজের বুকে সেঁধিয়ে নেয়। হাজারো টুকিটাকি আর ভাষাদের অ-প্রথাগত আদানপ্রদান কখনও সাদরী, কখনও কামতাপুরী রাজবংশী, কখনও মালপাহাড়ী, কখনও শহুরে বাংলা, কখনও পূর্ববঙ্গীয় বাংলা অথবা কখনও সাধু বাংলার প্রবাহ ধরে সংলাপে-প্রলাপে খুঁজে নেয় আখ্যানের কাঙ্ক্ষিত অবজেকটিভ কোরিলেটিভ। মেটনিমি আর সিনেকডকি আদর করে জড়িয়ে নেয় স্থানিক থেকে অস্থানিক হওয়ার যজ্ঞ লহমা। নির্বাস মেনে নিতে অপারগ স্মৃতিসন্ধানী অশীতিপর নিরঞ্জন মাস্টার শেষবারের মতো শালগুড়ি স্টেশনে এসে স্টেশন মাস্টারের বন্ধ দরজাকে চিনে নেন ফেলে আসা দেশের বাড়ির পরিচিত জন হিসেবে। তার নাম ধরে ডাক দেন। মেটনিমির বৃত্ত মুহূর্তে দেশ কাল সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব চরাচরে ইথার তরঙ্গ পাঠায়। নিরঞ্জন মাস্টার বন্ধ দরজাকে বিদায় জানিয়ে বলে ফেলেন, “নুরুদ্দিন, যাই!” দৃশ্যত একটি সিনে-শট তৈরি হয়। ঠিক যেমনটি হয় কোনও এক ঝড়-জল উঠে আসার রাতে, পরিত্যক্ত পাশাখা গড়ের ভাঙাচোরা বারদুয়ারির অন্ধকারে, বনবাবুর হঠাৎ ধাঁধিয়ে ওঠা টর্চের আলোয় উদোম হয়ে যাওয়া সন্ত্রস্ত ও বিপন্ন জঙ্গির বেসামাল নিশ্চল সময় পরিসরে। বনবাবুর টর্চের আলো পড়ে বাড়িছাড়া উদভ্রান্ত বিষাদুর গায়ে। রাষ্ট্রের কাছে সে সশস্ত্র জঙ্গি। নিজের কাছে সে ঠিক কী, তা যে খুব পরিষ্কার এমন নয়। পেশাগত বাধ্যবাধকতায় বনবাবুর চাকরি করা জয়দেবও কি জানে সে কী চায়! বিষাদু গুলি চালায়। ফুরিয়ে যাওয়া বন্দুকে শব্দ ওঠে ক্লিক ক্লিক ক্লিক। কেউ হতাহত হয় না। শুধু আলোকিত যুদ্ধ দৃশ্যের স্বল্পস্থায়ী মহড়ায় লেখা হয়ে থাকে জয়দেবের জীবন ভরা বিমূঢ়তা আর যুযুধান বিষাদুর আমৃত্যু স্বাভিমান। ক্ষণিকের স্থিরচিত্রে চিরকালীন বাঁধা পড়ে আশ্চর্য উদ্বাস বিপন্নতার বিভিন্ন পরত। নানা কৌণিকতায়।

ডুয়ার্সের জঙ্গল পাহাড় তাপমাত্রা আর প্রাণীবৈচিত্র‍্য নিয়ে একটা নিসর্গসর্বস্ব এবং বাজার সম্ভাবনায় ভরপুর ছবি অধিকাংশ মানুষের মাথায় গেঁথে আছে। এই বানিয়ে তোলা ছবিতেই মোটের ওপর সার জল দিয়ে চলে সর্বৈব ঔপনিবেশিক ছলাকলায় বেড়ে ওঠা বাঙালির সাবেকি ইতিহাস চর্চা। এমনকি তার আজন্মলালিত বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অভ্যেসও। এই অঞ্চলের আদি মানুষজন, জনজাতি, উদ্বাস্তু সমীকরণ অথবা বাংলার এই উত্তর অংশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ধরার মতো খুব একটা কথাবার্তাও কোথাও চলে না। এখানে যা ঘটে, সেসব মোটের ওপর বাঙালির সারা বছরের সবেধন তিলোত্তমাকেন্দ্রিক প্রশাসনিক বা সাংস্কৃতিক মোচ্ছবের আড়ালেই ঘটে থাকে। এমনকি বেশিরভাগ অভিনিবেশী পাঠকের কাছেও ভুটান পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চল অথবা তিস্তা-কালজানির পাড়ে জঙ্গলে ঝোপে ঝাড়ে হিংস্র বন্যপ্রাণ যতটা প্রত্যাশিত, এক্সটিক খুঁজে ফেরা চোখে অভ্যস্ত, একগণ্ডা আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জিনবাহিত বিপুল ও বিচিত্র জনসমাজের স্পন্দিত উপস্থিতি ততটাই আশাতীত। শেখরের নিটোল আখ্যান নির্মিতির প্রতিটি কোণায় যে বিরাট মানুষের হাটের কলরোল শোনা যায়, তাতে যেন আদ্যন্ত ঔপনিবেশিক অভ্যেসে বেড়ে ওঠা গড়পরতা বাঙালির পাঠপ্রক্রিয়ার অন্তর্জলির সুরটাও অবলীলায় মিশে যায়। বর্ষাদুয়ারে যে জীবনযাত্রার সুখ দুঃখ অ্যাডভেঞ্চার বা অ্যাবসার্ডিটি মিশে আছে, সেখানে প্রকৃতি আছে স্বমহিমায়। এবং স্বভাবতই। ডুয়ার্সের চালচিত্রে তেমনটাই থাকার কথা। কিন্তু অহেতুক নিসর্গ নির্মাণ সেখানে অনুপস্থিত। যতই প্রকৃতির কোলে বাস হোক না কেন, বহুরৈখিক মানুষের কথায় নিসর্গ বিলাস অকারণে সেঁধোলে পাঁচালি যে নিমেষে “ফাইভ নাইটস, ফোর ডেজ স্টে” হয়ে যায়, সে অশ্লীলতার খোঁজখবর শেখর ভালোই রাখেন। যেমনটা রাখতেন অমিয়ভূষণ। স্মর্তব্য, মধু সাধুখাঁ। স্বাধীনতার পর দার্জিলিং পাহাড়ের বাসিন্দাদের পালটাতে থাকা জীবনের প্রেক্ষিতে লেখা উপন্যাস আজ রমিতা ছ-তে যে অশ্লীলতা সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন ইন্দ্র বাহাদুর রাই। প্রায় যুদ্ধ ঘোষণার আদলে নিসর্গভিত্তিক স্টিরিওটাইপের বিরুদ্ধে যে সযত্ন পাঠাভ্যাসের বিনির্মাণ সামনে রাখেন হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখর তাঁর দ্য মিস্টিরিয়াস এইলমেন্ট অব রুপী বাস্কে উপন্যাসে।

জোত-জমি, চাষাবাদ, বন-নির্ভরতা, চা-বাগান, দেশভাগ পরবর্তী শহুরে বিস্তার, নদী-বন্যা-বাঁধ এইসব নিয়ে ডুয়ার্সের দীর্ঘ চলমানতা। শেখরের আখ্যানে এই চলমানতার অশ্রুত ইতিহাস মুখে মুখে ফেরা ছড়া, গান, ধাঁধাঁ, শিল্লুকে পারিবারিক সূত্রক্রমে বাঁধা পড়েছে। জনগোষ্ঠী বা সমাজ শুধু নয়, সংস্কৃতির ওপর অন্য অনেক সংস্কৃতির পলি পড়ে পড়ে আজকের ডুয়ার্স আখ্যানকল্পে বহুফসলি। বহু জাতির বহুস্বরে মথিত এক অতিগ্রন্থনা। মল্লিক সাহেবের থানের পুজো পাওয়া মূর্তির সঙ্গে ম্যাকলয়েড সাহেবের ঘোড়ায় চড়া আত্মার লোককল্পনায় কোনও ভেদ থাকে না ডুয়ার্সে। বা বর্ষাদুয়ারে। থাকার কথাও নয়। বড় কথা হল, সে দৃশ্যের দর্শক বা পাঠক কোন গল্পের উত্তরাধিকার বহন করছে, সেটুকুই। পাঠকের মজ্জায় যদি বৃটিশ রায়ের পূর্বপুরুষের ইতিহাস লেখা থাকে, তাহলে আলো আঁধারিতে ঘোড়ায় চড়া বাঁশের হেলমেট চড়ানো অদ্ভুত লোকটা যে সাক্ষাৎ মল্লিকসাহেব নিজে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। কিন্তু সেই পাঠকই যদি হয় শালগুড়ি টি এস্টেটের এতোয়া লিডারের বাপ, চামা বা জার্মান লাইনের বুধুয়া ওঁরাও, বৃদ্ধ এবং চোখে চশমা, ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সব ছেড়েছুড়ে এই দেশে চা বাগিচায় যার বাপের কাজ করতে আসা শুধুই এক চিলতে ছোট্ট আশাটুকু নিয়ে যে লেবার-কন্ট্রাক্ট ফুরোলে হয়তো একখণ্ড জমি পাওয়া যাবে বনবাগানের নব বসতিতে, এই নতুন দেশে, তার কাছে এমন অদ্ভুত ঘোড়সওয়ার অনেক আগেই মৃত শালগুড়ি টি এস্টেটের প্রবাদপ্রতিম ইংরেজ ম্যানেজার ম্যাকলয়েড সাহেবের জাগ্রত প্রেতমূর্তি হতে বাধ্য। প্রায় তিন সত্যির মতো। ডাকনাম, মাকলা সাহেব। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়েই যার মৃত্যু হয়েছিল বলে লেবার লাইনের জনশ্রুতি।

কিন্তু পরমুহূর্তে এ প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে যে, ১৮৬৫তে বৃটিশদের সঙ্গে ভুটানের যুদ্ধবৃত্তান্তের কী হয়। কী হয় হেরে যাওয়া তিব্বতি ফৌজের কালো খাম্পা সেপাই আর তার টাঙন ঘোড়ার। কী হয় ভোটঘোড়া নদীর নামকাহিনির, অথবা পাহাড়ের গায়ে পাশাখা ফোর্টের! এই যে এতগুলো সূত্র রয়ে গেল, ছেঁড়াখোঁড়া, না-গাঁথা, আজ তাকে গেঁথে তুলবার মতো কেউ নেই পাহাড় জঙ্গলের বিস্তৃত আঠেরো দুয়ারে। কিন্তু তাই বলে তো লোবজাং সেপাই নেই হয়ে যেতে পারে না! তাই সে আসে। প্রায় ঋতুচক্রের মতো অনুবর্তী ধারাবাহিকতায় তার আসা যাওয়া চলতে থাকে উত্তর কাশিয়াপাথার জোত সংলগ্ন এলাকায় পক্ষীহাগা কুড়ার পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা শালগুড়ি টি এস্টেট আর শালগুড়ি বাজারের জনপরিসরে। দুপুরে। বিকেলে। সন্ধেবেলায় বা মাঝরাত্তিরে।

অনেক আগের সেই ভুলে যাওয়া যুদ্ধে ভুটান আর ভারতের সীমানা নির্ধারিত হয়। বন কাটা পড়ে। চা-বাগান হয়। জলপাইগুড়ি জেলা ঘোষিত হয়। কৃষিজমি, জোত, কুড়া সব নতুন করে বিন্যস্ত হয়। আবার ক’বছর যেতে না যেতেই স্বাধীনতা হয়। দেশভাগ হয়। ১৭৮৭-র তিস্তার মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো দিশেহারা বাস্তুচ্যুত জনস্রোত এসে জমে, আশ্রয় খোঁজে ডুয়ার্সের জমিতে, জোতে, বনে-বাদাড়ে, নদীর পাড়ে। অনেকটা পক্ষীহাগা কুড়ার গাছে বাসা খোঁজা পাখিদের মতো। বৃটিশ রায়ের রাজকীয় মেজাজের বাপ কাইচালু দেউনিয়া, তার বাপ আষাঢ়ু বা তারও বাপ যে জোতজমিতে নিজের জীবন চিনেছে, ছেনেছে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে নির্বাস মানুষের মিছিলকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেয়। জোত, কুড়া এবং কালে কালে সমৃদ্ধি হারায় ক্ষয়িষ্ণু পক্ষীহাগা দেউনিয়াদের সদাই ঘুমোতে চাওয়া উত্তর পুরুষ বৃটিশ রায়। বৃত্তি যায়। জীবিকা যায়। একধরনের অদ্ভুত নির্বাসচেতনা বিষণ্ণ করে তোলে বিশ বা একুশ শতকের সমস্ত বৃটিশ রায় এবং আকালু বর্মনকে। প্রতিবেশী নিরঞ্জন মাস্টার বাংলাদেশের তারপাশায় বা কানীনসারে শৈশব এবং জন্মভিটে ছেড়ে আসার অস্তিত্বগত শরণার্থী বিষাদ বয়ে নিয়ে আসেন। মিশিয়ে দেন বৃটিশ বা পূণ্যবালা বা উপেশ্বরী বা আকালু অথবা আকালুর নিজ-স্বত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য অভিমানী এবং পরে জঙ্গি হয়ে যাওয়া ছেলে বিষাদু বর্মণের হতবাক মন কেমনের অন্য সপ্তকে। চা-বাগিচার শ্রমিকের মিথ্যে আশার উদ্বাসে মিশে যায় বৃটিশের সামাজিক উদ্বাস, আকালুর বৃত্তি-উদ্বাস এবং নিরঞ্জন মাস্টারের দেশ-উদ্বাস। আরও এক ভিন্নতর উদ্বাস দানা বাঁধে নিরঞ্জনের নাতনির প্রজন্মে। শিক্ষা-উদ্বাস। অমল বা অমলের মতো বাকিরা জানে স্বাধীনতার সত্তর বা আশি বছর পরেও ডুয়ার্সের মতো জায়গায় ভোট বাদে আর কোনও রাষ্ট্রীয় সুবিধের সমবণ্টন আজও হয়নি। কাজেই উচ্চশিক্ষা বা কাজের জন্য বাইরে যেতেই হয় তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। অন্তহীন এক ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোরলাগা স্রোত ঢেউহীন নিশ্চয়তায় তাড়িয়ে বেড়ায়, তাড়াতেই থাকে হলং, হোটোনা, বাংগুড়ি, মুলুঙ্গি, কুলটি, গলুন্দি, কুমলাই, জিতি, শিপচু, ইনডং, পরো, আলাইকুড়ি, কালাঝোরা, পানা, বসরা, গরম, নোনাই, চেকো, জৈন্তী, গদাধর, বেথুয়া, তুরতুরি, ধারসী, ধাওলা, কুলকুলি, ঘোড়ামারা, নিপানিয়া, চুনিয়াঝোড়া, বালা, কালকূট, রাইমাটাং, দরিয়া, আমগোরি, ডাবডুব, সুখান্তিতি, তিতি, বীরপিয়া, কুল্লুয়া, আংরাভাসা, ইচা, গরেরঘুটা, গারোতলি, চুকচুকা, রুকরুকা, ধরধরা, নিম, জর্দা, নবনদি, চেল, লিস, ঘিস, তালমা, ঘাটিয়া, রেতিখোলা, বাংরি, গাঙ্গুটিয়া, মৌলানী, ডিমা, ডাইনার সোহাগে বা কোপের জলে ভাসানো দু পাড়ের অগুনতি ছোট ও বড় লোকালয়গুলোকে। এইসবই হয় ইতিহাসের অযত্নে। লিখিত হওয়ার কোনও আবেগ বা অপেক্ষা ছাড়াই। যেন এমন অলিখিত থেকে যাওয়ার অভ্যেসেই নিয়তি বাঁধা আছে এই বিস্তীর্ণ জনপদের। পর্যটন শিল্পের ফাঁপা বাজার যাকে ‘উত্তরবঙ্গ’ নামে রটিয়ে রেখেছে বিশ্ব চরাচরে।

লোবজাং সেপাই এত শত জানে না। জানার কথাও নয়। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে মরে যাওয়া, মৃত্যুর পরেও অনুগত, টংসা পেনলোপের কঠোর নির্দেশ মেনে চলা কালো সেপাই লোবজাং এখনও যুদ্ধের খোঁজে চষে বেড়ায় ভুটনির ঘাট থেকে ভোটপট্টি, সেখান থেকে যমেরকোট, যমেরকোট থেকে লক্ষ্মীদুয়ার, লক্ষ্মীদুয়ার থেকে ডালিমকোট, ডালিমকোট থেকে পাশাখা, পাশাখা থেকে কালিখোলা, কালিখোলা থেকে যমদুয়ার, যমদুয়ার থেকে চামুর্চিদুয়ার, চামুর্চিদুয়ার থেকে ভলকা হয়ে বাঘদুয়ার থেকে বিষেণসিং। তার পেছনে দড়িতে বাঁধা থাকে দেড়শো বছরের বেশি বয়সী সাতপুরুষের আধিয়ার আন্ধারু দাস। যুদ্ধ করা লোবজাঙের একমাত্র অতীত। অথবা, ভবিতব্য। জীবন ও মৃত্যুর সীমানা পেরুনো অন্তহীন বর্তমান। তার নিঃশর্ত নিয়তি। সে জানে না ভইসবাথান ফরেস্টের মাঝে কত গাছ কাটা পড়েছে গত দেড়শো বছরে। সে শোনেনি কোনও নতুন স্লোগান— ‘একটি গাছ, একটি মোবাইল’। ফি বর্ষায় তিস্তার বাঁধ কেন ভেঙে যায়, সে আধুনিক সদাগরি রহস্য তার কাছে অজানা। সে জানে না, শুধু বারবার ভেঙে যাবে বলে সারাইয়ের ঠিকেদারের কাছে জলের আরেক নাম উপার্জন। আর উপার্জনের অপর নাম জীবন। একবগগা যুদ্ধ খুঁজে খুঁজে একুশ শতকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া লোবজাং তার চারপাশের পালটে যাওয়া পৃথিবীটাকে ধরতে না পেরে নিজস্ব চেনা ছকেই বেঁধে ফেলে। বেমানান স্পর্ধায় আর অভিমানে সার্ভেন্তেসের দন কিহোতে আর সানকো পাঞ্জা তাদের লা-মাঞ্চার স্থানিক পরিধি ছাপিয়ে একাকার হয়ে যায় মায়াবী বাস্তবের ভাড়াটে সেপাই লোবজাং ও তার সাতজন্মের আধিয়ার আন্ধারুর নিদ্রাহীন পরিভ্রমণের ডুয়ার্স প্রান্তরে। অনৈতিহাসিক ডুয়ার্সে জঙ্গি বিষাদুর ফুরিয়ে যাওয়া কালাশনিকভের উদ্যত নলের সামনে টর্চ ধরে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত শহুরে জয়দেবের নেশাতুর চোখের আড়ালে পরিত্যক্ত পাশাখা গড়ের দুয়ারে রাতের আঁধার বেয়ে উঠে আসে কালো সেপাই লোবজাং, তার লেজকাটা টাঙন ঘোড়া এবং গলায় দড়ি বাঁধা আন্ধারু আধিয়ার। একুশ শতকের ডুয়ার্সের একমাত্র যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কুহকি খাম্পা সেপাইয়ের নিষ্কৃতিহীনভাবে যুদ্ধ খুঁজে বেড়ানো শতাব্দীপ্রাচীন উপস্থিতি আরও অনেক অজানা মাত্রা, অনেক স্তর আর সম্ভাবনা সহ সনাতন প্রত্নসঙ্কেতের পুনঃনির্মাণ উপক্রম সেরে ফেলে। এসবই ঘটে রাষ্ট্র আর ইতিহাসের চোখে পড়ার মতো অনুপস্থিতিতে। নিতান্ত প্রাকৃত অনুশাসন বা নীতির বশবর্তী হয়ে। কোনও গণতান্ত্রিক উপশমের মহান ফুসলানি ছাড়াই। তখন ডুয়ার্সে বর্ষা নামে। বৃষ্টি নামে বর্ষাদুয়ারেও।

কুরোসাওয়ার সামুরাইয়ের মতো বাঁশের হেলমেট মাথায় দেওয়া জাদুবাস্তবিক কালো ঘোড়সওয়ারের উপস্থিতির বিষয়ে এক্কেবারে অনবহিত প্রশাসন বিচ্ছিন্নতার দাবীতে বুঁদ আন্দোলনের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখে। ঠিক যেমনটি রাখলে প্রলাপকে সংলাপ বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। জঙ্গি নিরূপণের প্রশাসনিক পদ্ধতি বহুমাত্রিক নির্বাসে সম্পৃক্ত মিশ্র সমাজের ভেতরে চিড় ধরায়। অন্যদিকে স্বজাতের ক্ষুব্ধ অভিমান আর আবেগের উতরোল আড়াল করে শ্রেণিবৈষম্য। দু-পক্ষেই। সমস্যার অভ্যন্তরে যাওয়ার বদলে এক কেন্দ্রাতিগ বোঝাপড়ার টান ভর করে সমস্ত সমাজের মানুষের মধ্যে। ডুয়ার্সের মানবজমিন অন্তঃক্ষরা হয়। ক্ষমতা আর অর্থের পিশাচ তারিণী ডিলার আকালুর শেষ সম্বল জমি কাড়ে আর নিজের সদ্য পঞ্চায়েত হওয়া বউকে আদর করে জনসেবার দোহাই পেড়ে। ডুয়ার্সের পাকা কাঁঠালের মতো হলদে রোদে অন্য রং লাগে। আজীবন দেশভাগ মানতে না পারা নিরঞ্জন মাস্টারের সফল ঠিকাদার ছেলে অমলের লাভ হয় বাঁধ মেরামতিতে। গাড়ি হয়। অকালে জঙ্গি হয়ে যাওয়া ছেলে বিষাদুর জন্য পুলিশের কোপ পড়ে আকালুর ওপর। বগলের দাদ বা পায়ের হাজা চুলকোনো ছাড়া যার জীবনে আর কোনও সান্ধ্য ধারাবাহিকতার লেশমাত্র ছিল না, সেই আকালু ভয়ে তটস্থ হয়ে ফালাকাটায় পুলিশবাবার থানে পুজো দেয়। খিদে, দারিদ্র্য, পুলিশের মারের আতঙ্ক, ছেলের বিরহ আর এক টুকরো জমির শোকে বিহ্বল আকালু ভারসাম্য হারাতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই। শালগুড়ি চা-বাগানের সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ম্যানেজারবাবু দীপঙ্কর ক্রমশ ধুঁকতে থাকা বাগানের উৎপাদন বাড়ানোর দুশ্চিন্তায় আর ডুয়ার্সের চা-শিল্পের রুগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিষাদাচ্ছন্ন হতে থাকে। দীপঙ্করের সেমেন কাউন্ট অনুপযোগী হওয়ায় কোনওদিন মা হতে না পারা সুরঙ্গমার সারাদিনের নিঃসঙ্গতায় ধরা পড়ে ক্রমশ জৌলুশ হারানো চা-বাগানের অন্তর্গত ক্ষয় ও দুঃখ। ভালোবাসার তুঙ্গ মুহূর্তে সুরঙ্গমাকে একটা ভরাভরন্ত ক্যামেলিয়া সাইনেনসিয়ার গাছ বলে মনে হয় চা-অন্ত প্রাণ দীপঙ্করের। অথচ পরমুহূর্তে সুরঙ্গমার গলায় চা শ্রমিকের সদ্য মা-হারা সন্তান অ্যাডপশনের প্রস্তাব শুনে তার রতিমুগ্ধতা কেটে যায়। সুরঙ্গমার মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা তাকে জাত-পাত/ বাবু-বিবি/ শ্রমিক-ম্যানেজার/ বাঙালি-অবাঙালি ইত্যাদি নানা সনাতন ও ঔপনিবেশিক প্রতাপভাষ্য এবং বাইনারি ডিঙিয়ে যেতে সাহায্য করে। অথচ তার সহোদর ভাই জয়দেবের প্রেম ভেঙে যাওয়া দেহে স্থানীয় কোনও আদিবাসী রমণীর আকর্ষণ ঢেউ তুললেও বিরহী মনে সেই ঢেউ সহজে সাংস্কৃতিক ট্যাবুর বাধা পার করতে পারে না। জয়দেব বোঝে সে কথা। পরের বর্ষায় সেই ট্যাবু অতিক্রমণের ‘হলেও হতে পারে’ জাতীয় মুক্ত সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে জয়দেবের আনাগোনা বাড়ে গেশিলিঙের অধিবাসী যুবতী নিম পেমের বাড়িতে। পরিত্যক্ত পাশাখা গড়ের রাস্তার ধার ঘেঁষে শুরু হয় তার পথচলা যার পাহাড়ের ঢালে আজও কবরে শুয়ে আছে মেজর জন ইয়াং অব বেঙ্গল ক্যাভালরি। ১৮৬৭-র ৬ই জুলাই পাশাখার যুদ্ধে মরে যাওয়া হতভাগ্য বৃটিশ যুবকের পার্ক স্ট্রিটের বহুচর্চিত গোরস্থানে স্থান না হওয়ায় বাঙালির আগাপাশতলা ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার মান্য ধারায় তাকে ঘিরে কোনও লোককথা বা গোয়েন্দা উপন্যাস লেখা হয়নি আজও— এও একধরনের বিষাদ বইকি। যে বিষাদে একাকার হয়ে যায় উপনিবেশের প্রভু ও ভৃত্য, আর বিষাদ বাষ্প হয়ে পাহাড়ের মেঘ হয়, দানা হয়, জলকণা হয় ফি বছর শুধু এবং শুধুই মাত্র মৌসুমী বায়ুর অছিলায় গোটা বর্ষাদুয়ার ভরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে গড়িয়ে পড়বে বলে। তখন, কিছু চা-ইউনিয়নের বিবাদ, মালিকের লুকনো এবং অনাদায়ী ব্যাঙ্ক ঋণের জালে মাঝারি বাগানের রোগজীর্ণতা বেড়ে ওঠা, জঙ্গি-পুলিশ এনকাউন্টার, অপহরণ, বিচ্ছিন্নতাবাদ বা মোবাইল টাওয়ারও হয় উত্তর কাশিয়াপাথার সংলগ্ন শালগুড়ি টি এস্টেট, বাজার বা ডুয়ার্সের অন্যান্য অঞ্চলে। অবশ্য, রঙ্গে ভরা এই বঙ্গের মান্য সংস্কৃতির রাজনৈতিক রীতিনীতি মেনে সেইসব ‘হয়ে ওঠা’র কোনও খবর ইতিহাস আগেও রাখেনি, আজও রাখে না।

অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক-এ মার্কেজ লিখেছিলেন ইতিহাসের বাইরে বেঁচেবর্তে থাকা মানুষজনের কথা। বর্ষাদুয়ারে শেখর লেখেন এমন এক অনৈতিহাসিকতার আখ্যান যেখানে ইতিহাস শব্দটাই “লুজ ক্যারেকটার” হয়ে যায় “বকাউল্লা” আর “সোনাউল্লা”র অবিবেচক বাইনারির চক্করে। জোত জমি বন বাদাড় কুড়া গাছ পাখি বৃত্তি পরিচয় ভিটে মাটি দেশ সব ভাগ হয়ে যায়। অভ্যেস ভাগ হয়ে যায়। কন্যার কবর আর সজলচক্ষু পিতার ঠিকানার মাঝে দেশভাগ কাঁটাতার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোহার কাঁটা জানান দেয় সীমা সুরক্ষা আর সার্বভৌমত্বের। ওপারের নিরঞ্জন মাস্টার এপারের শালগুড়িতে রেল কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার নুরুদ্দিন সাহেবের জমিতে উঠে আসতে বাধ্য হন। ওপারে নিরঞ্জনের আদিবাড়িতে ঠাঁই হয় এপারে কন্যাহারা নুরুদ্দিনের। অথচ ইতিহাস কোনও দোহাই দেয় না। মাথার মধ্যে নদী নিয়ে বসে থাকেন নিরঞ্জন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তাঁর চির নির্বাসিত প্রলাপ চেতনের সঙ্গী হয় নুরুদ্দিনের অকালমৃত কন্যা ইফাত আরার খণ্ডস্মৃতি। ইফাত আরা যেন এক জলকন্যা হয়ে নিরঞ্জনের শেষ লহমার শৈশব দর্শনে প্রোথিত হয়। ছাদের ওপর থেকে গোলাপজামের গন্ধ মাখা রোদ্দুর গায়ে নিয়ে নিরঞ্জন শূন্যে পা বাড়ান স্বপ্নোত্থিত পথিকের মতো। যে যাত্রার আরম্ভ আসলে অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল কোনও বিকেলে, যখন শালগুড়ি স্টেশনের বন্ধ দরজায় হাত রেখে তিনি অস্ফুটে বলে এসেছিলেন, “নুরুদ্দিন, যাই।”

দেশভাগ পরবর্তী নানা কিসিমের সৌহার্দ্য বিনিময়ের আন্তর্জাতিক তাজিয়া চালু থাকলেও যেহেতু ইতিহাসে কোনও স্মৃতিবিনিময়ের সুযোগ নেই, কাজেই বিশ্বের সবচাইতে বড় উদ্বাস্তু মিছিলের একজন অংশীদার হিসেবে নিরঞ্জন মাস্টারের এই একান্ত এবং আত্মমগ্ন বিদায়ী সংলাপ যে প্রথামতোই ইতিহাসের আড়ালে থেকে যাবে, এতে কারওই সন্দেহের খুব একটা অবকাশ থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রেও ছিল না, কেননা নিরঞ্জনের মৃত্যুর পর নিজস্ব নিয়মেই বছর ঘুরবে এবং আবার অবিরাম বর্ষালীলা জারি হবে বলে খবর পাওয়া যায়। আর প্রকৃতির সাবলীল নিয়মে বর্ষা আবার আসে, বারবার আসে বলে দুয়ারে কোনও গল্প শেষ হয় না। হতে পারে না। ইতিহাসের বাইরে বাস করে অভ্যস্ত মানুষজন বর্ষার নিজস্ব নিয়মেই অলিখিত বাঁচতে শিখে গেছে বলে বর্ষাদুয়ারেও শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। বাজারের পাগল আমকান্ত কার্নিভ্যালের ঢঙে পুলিশের হাতে প্রথমে ঠ্যাঙানি এবং পরে ছাড়া পেলেও সে যে কোনও ছদ্মবেশী দার্শনিক, গুপ্তচর বা গোপন জঙ্গি নয় এবং নিতান্তই স্মৃতিভ্রষ্ট এক অসহায় মানসিক রোগী মাত্র, এই বাস্তব স্থায়ী হলেও অনৈতিহাসিক জনপদের কিসসা হিসেবে কোনওদিন এপিফ্যানির মর্যাদা পাবে কি পাবে না সে বিচারের দায় শেখর সম্পূর্ণই পাঠকের ওপর ছেড়ে দেন। বর্ষাদুয়ারের আখ্যান অংশে আপাতত বিরতি আসে স্পষ্টত মুক্ত সম্ভাবনায় ধনী হয়ে।

জল, বাষ্প, বৃষ্টি সহ বর্ষার আবহমান চক্রে যে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই শেষ বলে কোনও কথা থাকতে নেই, আখ্যান সে গূঢ় তত্ত্ব জানলেও ইতিহাসের রাজনৈতিক সংসক্তিতে অভ্যস্ত পাঠকের কাছে সেই একই কাহিনির ঘটনাবিহীন অনুবর্তন বিস্ময়কর ঠেকলেও ঠেকতে পারে। উত্তরের পাহাড় ও পাহাড়ঘেঁষা সমতলের চূর্ণ আখ্যায়িকার বর্ষামুখর ঢল অবশ্য এই অনিঃশেষ গ্রন্থনায় আবাল্য অভ্যস্ত। কাইচালু দেউনিয়ার মুখে মুখে বলা শিল্লুকেরাও তেমনটাই বলে থাকে। ঠিক যেমন করে জুডিথ বাটলারের কাছে আমরা শিখে নিই যে প্রথাগত লিঙ্গপরিচিতির মাঝে যে লিঙ্গরা ধূসর বলে আটকে গেল, তাদের বিষাদ-লিঙ্গ বললেও বলা যায়, মেলানকলি জেন্ডার, তেমনি অবধারিতভাবে থাকা বা না-থাকা, ভাষা আর লিখন, শুধুই সরে সরে যাওয়া অপসৃয়মান বাস্তব আর মায়ার মাঝের ধূসরতায় জন্ম-জন্মান্তরের মতো আটকে যাওয়া ইতিহাসবহির্ভূত নিরঞ্জন মাস্টার, এতোয়া লিডার, কালুয়া কুক, অমল ঠিকাদার, তার স্ত্রী মিলু, আকালু বর্মণ এবং উপেশ্বরী, বৃটিশ রায় আর তার মা পূণ্যবালা, দেশ, কাল, রাজবংশী ক্ষত্রিয়, ভাটিয়া, চক্রবর্তী, বিটবাবু, ওঁরাও, মুণ্ডা, ফেলে আসা ছোটনাগপুরের অসহায় চা-শ্রমিক, ম্যানেজার, কাজের খোঁজে আসা শহুরে বাবু, যমুনা, নিম পেম, উন্মাদ আমকান্ত, কবেকার রাজার রাজা কামতারাজ নীলাম্বর— সক্কলে মিলে মিশে হয়ে ওঠে এক অদ্ভুত নির্জ্ঞান অনুমিত বিষাদ পরিচিতি। বিষাদ বাহক। বিষাদ আকর।

ইতিহাস অনুল্লিখিত রেখেছে বলে থেকেও এক ধরনের না-থাকা হয়ে যাওয়া এবং পাকাপাকিভাবে মধ্যবর্তী পরিসরের বাসিন্দা গোটা বর্ষাদুয়ারের সকল অধিবাসীর নাম কখন বিষাদু বর্মন হয়ে যায়, সে প্রশ্নের হাতেগরম উত্তর বয়ান সম্ভব নয়। আর সেটা সম্ভব নয় বলেই শেখরের আখ্যানে সচেতন অসমাপ্তির ঘোষণাপত্র টাঙানো থাকে। জাদু আয়নায় ধরে রাখা বিশ্বস্ত জীবনছবি পড়তে পড়তে পাঠক অজান্তেই অনুকরণ করে ফেলে আখ্যানে বর্ণিত সাব-ইন্সপেক্টরের হলিউডি সংলাপ আওড়ানোর অভ্যেস। বর্ষাদুয়ারের কাহিনি বা আখ্যান প্রেক্ষিতে সহজাত ফুটে ওঠা ডুয়ার্সের নিপুণ জীবনযাত্রা এবং মানুষজনের একান্ত রেখাচিত্র পড়তে পড়তে জেমস বন্ড ফ্র‍্যাঞ্চাইজির স্কাইফল ছবির দুর্দান্ত খলনায়কের মতো বলে উঠতেই হয়, ইয়েস, ইট হ্যাড টু বি লাইক দিস! ইট হ্যাড টু বি হিয়ার!

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ষাদুয়ার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমানাঘেঁষা হিমালয়সন্নিহিত সমতলের চলমান আখ্যান হয়ে রইল। আপাদমস্তক নগর আঁকড়ে পড়ে থাকা প্রথাগত বাঙালি পাঠকের সাধারণ পাঠ-অভ্যেসের যে চেনা ইতিহাস, তার চোখে স্পর্ধিত চোখ রেখে। কিহোতে বা লোবজাঙের নিরাসক্ত জেদ নিয়ে ছোট স্থান বা কালের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে। স্থির নিশ্চিত মৌসুমী বায়ুর হাত ধরে বারবার ঘুরে ঘুরে আসা বর্ষার বহমান আশ্বাস সহ। উপন্যাসের উৎসর্গপত্রেই সে বিন্দুতে জলসিঞ্চন করা হয়েছিল। ঝরে পড়বার জন্য পাঠকের উন্মুখ প্রতীক্ষাটুকু শেষ পর্বের বর্ষায় তাকে যে ভাসাবেই, সে ব্যাপারে পাঠক মাত্রেই নিশ্চিত হতে পারেন। অনেকান্তিক আভাস মাখা বর্ষাদুয়ারে বর্ষা বা দুয়ার, দুইই এমন নিশ্চিত ভরসায় থিতু।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...