‘সুর তো ফকির’, শরীরে কালশিটে

অর্ক

 

 

নব্বই দশকের মাঝামাঝি প্রথম সমুদ্র ছুঁয়েছিল যে শিশু, তার বয়স এখন পঁচিশ। অক্টোবরের রোদ কমে আসা অবসন্ন অপরাহ্নে তার মনে পড়ে, তুলতুলে দু’টো পায়ে ঠোক্কর দিয়ে চলে যাচ্ছিল ঢেউ। একের পর এক। ক্লান্তিহীন, অনর্গল। মনে পড়ে, অমনই এক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাবাকে। সেই প্রথম সে শিখে নিয়েছিল, ঢেউ সর্বদা উপেক্ষনীয় নয়। কখনও জোয়ার আসে, ভেসে যায় ব্যক্তির নিজস্ব পরিসর, সংসার, বাড়িঘর-বিছানা-বালিশ। দর্শক বা ভাষ্যকার হিসাবে বেঁচে থাকা যায় না তখন।

এককুড়ি বসন্ত পেরিয়ে আসার ফাঁকে সে চিনেছে শরীর, ব্যর্থতা, ডিপ্রেশন। দেখেছে অসংখ্য মৃত্যু। প্রতিদিন। সে জানে মৃত্যু মানে পঞ্চাশটি শব্দ, তিনখানা ফেসবুক পোস্ট। সে দেখেছে একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে যাবতীয় অর্জন। ভেসে যাচ্ছে ভয়, রাগ, ঘেন্না। কখনও কখনও মনে হয়, এখনও সে দাঁড়িয়ে আছে একটা মস্ত সমুদ্রের মাঝখানে। হাঁটুর নীচে এসে ধাক্কা খাচ্ছে একটার পর একটা লাশ। থ্যাঁতলানো, কালশিটে পড়া, মাথানীচু মরা মানুষের শরীর সব। কাউকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তার ঠোঁটের পাশে একটা বেয়াক্কেলে গর্ত। কারও যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক পাথরকুচি। পা ফাঁক করে শুয়ে আছে। কারও শিঁরদাড়া ফালা ফালা করে দিয়েছে মানচিত্র। কেউ মরেছে সাজানো এনকাউন্টারে। সেই হাঁ মুখের দিকে তাকালে সে দেখতে পায় মরা বাপের চোখ— ফ্যাকাশে, নির্বোধ, গাম্বাট।

প্রত্যেকটা মৃত্যুসংবাদ তার কাছে প্রিয়জনের লাশের স্মৃতি বয়ে আনে।

আমাদ খান গান গাইতেন। ভক্তিমূলক লোকগান। জয়পুরের দন্তালের হিন্দু মন্দিরের পুরোহিত রমেশ সুথার আর তাঁর দুই ছেলে সেই গান শুনতেন। মুসলমান আমাদের গানের সুর পুরোহিতের অলৌকিক কাজকর্মের সহায়ক হত। নিবিড় মনোসংযোগে রমেশ পৌঁছতে পারতেন ঈশ্বরের কাছে। তাঁর আর্শীবাদে সেরে উঠত রোগবালাই। আরোগ্য আর শান্তিতে ভরে উঠত মানুষজীবন। রমেশ আর ঈশ্বরের মাঝখানের ওই সিঁড়িটির নাম আমাদ খানের গান।

বৈশাখ মাসের দুপুরবেলা সবকটা জানলা, দরজা বন্ধ করা থাকত চেপেচুপে। বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া একচিলতে আলোর হাত ধরে আকাশপানে উড়ে যেতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। অনুরোধের আসরের শরীরজুড়ে শুধু আদর, আদর আর আদর। আদরের নাম গান। নিঃসঙ্গ পুকুরপাড়ের বকবকম দুপুর থেকে আদরগানেরা ঢুকে পড়ত সন্ধ্যাবেলার মনখারাপিয়া সরণিতে। একটা পুরনো আমলের ডোয়ার্কিন হারমোনিয়ামের হাঁফ ছাড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘরজুড়ে নেচে বেড়াতেন সন্ধ্যা। গান এখানেও সিঁড়ি, যার ধাপে ধাপে পা রেখে পৌঁছে যাওয়া যায় দুপুর থেকে সন্ধ্যায়।

আমাদ খান একজন পারফর্মার। একজন পারফর্মারের ব্যর্থতার কোনও ক্ষমা নেই। প্রত্যেকদিন তাকে পারফর্ম করে যেতে হয়, যন্ত্রবৎ। আমাদ খান পারেননি। প্রথমেই এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, আমাদ খান হেরে গিয়েছেন। হেরো মানুষের জীবনের কোনও দাম নেই। হেরেছেন, কারণ একটানা অনেকদিন, অনেক অনেকগুলো বছর পুরোহিত রমেশকে ঈশ্বরের  মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়ার পর একদিন আর পারলেন না। সেদিন তাঁর গান শুনে মনোসংযোগ করতে পারছিলেন না রমেশ। আর যদি তিনি মনোসংযোগ করতে না পারেন, যদি তাঁর না ভালোলাগে আমাদ খানের গান, তাহলে সেই সঙ্গীতের মূল্য কী! আমাদের মনে রাখতে হবে, রমেশ সুথার পুরোহিত। ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাঁর সাড়ে তিন হাত শরীর উত্তরপ্রদেশের অক্সিজেন না পেয়ে টেঁসে যাওয়া জঞ্জালের মতো মূল্যহীন নয়। তাই আমাদ খান অপরাধী।

দিনভর নানারকম পারফর্ম করত হত বলেই তার মা ছেড়ে দিয়েছেন গান। ছেলে মানুষ করতে হত, রান্না করতে হত, লোকজন বাড়িতে এলে হেসে দু’কথা বলতে হত নিয়ম করে। এত কিছুর চাপে গান হয়? হয় না। তাছাড়া গান গেয়ে হবেই বা কী! ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের একলা বিধবা মেয়েমানুষ। কেন যাবে বেপাড়ার জলসায়! আমরা বামপন্থী, প্রগতিশীল, তবে বেহায়াপনা মানব না।

গান থামিয়ে দেওয়া মানে খুন নয়, কারণ খুন একটি রাজনৈতিক ইভেন্ট।

আমাদ খানের গান পুরোহিত রমেশ সুথারের পছন্দ হয়নি। বিরক্তি চেপে রেখে বলেছিলেন, ঠিকভাবে গাইতে। আমেদ পারেননি। আবারও বলেছিলেন। এবারও হল না। বাধ্য হয়ে আসন ছেড়ে উঠে নোংরা মুসলমানটিকে মারতে শুরু করেন ওই পুরোহিত। সঙ্গে যোগ দেন তাঁর দুই ছেলে। পেটাতে পেটাতে আমেদ খানকে মেরে ফেলা হয়। যেমন মেরে ফেলা হয়েছিল মহম্মদ আখলাক বা পেহলু খানদের।

আমাদের পায়ের কাছে একটির পর একটি মৃতদেহ ভেসে আসছে। আমরা রোহিথ ভেমূলার শরীরকে দেখে পা সরিয়ে নিতেই হাঁটুতে ঠোক্কর দিল নাজীব আহমেদ। নাজীবের মা’কে পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর পাকা রাস্তা দিয়ে। আমরা দেখছি বুড়ির শরীর হাস্যকরভাবে ছ্যাঁচড়াচ্ছে, কেটে যাচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই কৃষ্ণের হাঁ-মুখের ভিতরে ঢুকে পড়ছি আর বুঝতে পারছি ওটা আসলে সোনি সোরির যোনি। আমাদের চোখে গেঁথে যাচ্ছে টুকরো টুকরো পাথর। কোনওমতে বেরিয়ে আসতেই দেখছি কালবুর্গি, মোহানন, পনসরে শুয়ে রয়েছেন। শুয়ে রয়েছেন বৃদ্ধা গৌরী লঙ্কেশ। আমাদের পায়ে একটার পর একটা ঢেউ ধাক্কা দিচ্ছে। আমরা ইগনোর করছি। আমরা ইগনোর করব। কারণ, এখনও আমাদের ঘরে জল ওঠেনি।

খুন একটি রাজনৈতিক ইভেন্ট, যেমন গান। তাই আমাদ খানের মৃত্যুর পরেই ওই গ্রাম ছেড়ে সটকে পড়েছেন মুসলমানেরা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5117 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আমাদ খানের কথা যতবার শুনছি, চোখে ভেসে উঠছে সোনার কেল্লার সেই দৃশ্য …. নকল হাজরা গাড়িতে ঝিমোচ্ছে, মুকুল রাস্তার ধারে গান শুনছে আর আসল হাজরা লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন মুকুলের দিকে৷ ব্যাকগ্রাউন্ডে গান, “মন মেরা রাম রাম বলে…”

Leave a Reply to অতনু কুমার Cancel reply