হালুম

হালুম | সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

দিনকতক বাঘ নিয়ে কি বাগাড়ম্বরই না করলে তোমরা! জল ঠেঙিয়ে, ভিজে শরীরের জল ঝেড়ে একটু ইতিউতি তাকাতেই নজরবন্দি হয়ে গেলুম। ব্যস, আর যায় কোথা! সে এক হইহই রইরই কাণ্ড! লোকালয়ে বাঘ ঢুকেছে, মানুষজন সন্ত্রস্ত। কাজকর্ম বেবাক বন্ধ। এ তো আচ্ছা বে-আদব বাঘ। ধর-ধর-ধর। নিজেদের চেনা এলাকা ছেড়ে গেরামে ঢুকে না-জানি কী সাংঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছি! অথচ বন কেটে বসত বানিয়ে তোমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করেছ। লোকালয়ে বাঘ ঢুকলে অন্যায়, অথচ বনে যথেচ্ছভাবে মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটলে তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, উদ্বেগ নেই, হাহুতাশ নেই। চমৎকার! ভাগ্যিস কুলতলি, গোসাবায় লোকালয়ে আমাদের বন্ধুরা ঢুকেছিল। তাই আজ তোমাদের দরবারে আমাদের হাহাকার জানানোর একটা ফুরসৎ পেলাম। আমাদের বিপন্ন জীবনকথা কেমন লাগল জানাতে ভুলো না…

***

 

আলো-আঁধারি মঞ্চ। দৃশ্যপটে জঙ্গলের আভাস। আলো সামান্য জোরালো হতেই দেখা যায় এক বাঘ ক্লান্ত পদক্ষেপে পথ চলছে। বেশ ধ্বস্ত চেহারা। চলনভঙ্গিতেও উদ্বেগের ছাপ।

বাঘ: বাপরে বাপ! আরেকটু হলেই ধরা পড়েছিলাম আর কি! ভাগ্যিস দিনের আলো এখনও সেভাবে ফোটেনি, নাহলে এ-যাত্রায় রক্ষে পাওয়া সত্যিই মুশকিল হত। আমার আর দোষ কোথায় বলো? কাল রাতে খাবারের খোঁজে নাগালের জঙ্গল ছেড়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকেছিলুম। না ঢুকেই বা উপায় কী! কাঁহাতক আর নদীর চরের কাঁকড়া খেয়ে দিন কাটানো যায় বলো তো! আর তাছাড়া কাঁকড়া খাওয়াতে হ্যাঁপা কি কম ভেবেছ! কাঁকড়াগুলো ভারি চালাক। যতই পা টিপে টিপে হাঁটি না কেন, ব্যাটারা মাটির কাঁপুনি দিব্যি টের পেয়ে যায়, আর ওমনি সেঁধিয়ে যায় ওদের মাটিগুহার অন্তরালে। ব্যস, বাঘবাবাজি বেকুব! মাটি আঁচড়ে আঁচড়ে যতই চেষ্টা করি তাদের বাইরে আনার, ততই কাঁকড়াগুলো মাটির ভেতরে, আরও ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়ে। যদিবা একটা-দুটোকে কোনওরকমে বাগে আনতে পারি তাতেই বা সোয়াস্তি কোথায় বলো! থাবড়ে থুবড়ে শক্ত খোলা ভেঙে মুখে ঢোকানো কি সহজ কম্ম ভেবেছ! মোটেই না। কামড়ের জ্বালা আছে না! সাঁড়াশির মতো শক্ত দাঁড়া দিয়ে এমন দাবড়ে ধরে যে তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়। এই দেখো না আমার নাকের কী হাল করেছে! অমন সুন্দর টিকোলো নাকটাকে দংশে দংশে একেবারে দাড়িম্ব ফলের মতো নালপানা করে দিয়েছে। আমার এই দশা দেখে আমার প্রতিবেশী শার্দুল-কুলে কি হাসাহাসি, হইচই কাণ্ড! কোথায় বলবে ‘আহা রে বাছা রে, কেন এই দশা রে?’— তা না উলটে খটাশগুলোর মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসবে আর টিপ্পনী কাটবে। এ কি! তোমরাও হাসছ? বলি ‘সোঁদরবানের বাঘ এখন নোনাজলের কর্কটক খেয়ে বেঁচে আছে’— এই খবরটা দাও না একবার তোমাদের ওই কাগজগুলোয় ছেপে! দেখবে কাগজগুলোয় খবর পড়ে চারিদিকে কেমন ঢি-ঢি পড়ে যাবে। আরে বাপু, আমাদের কি আর ওইসব ছাইপাঁশ খেলে চলে! শত হলেও আমরা হলাম রাজার জাত!

তবে রাজার জাত বলে তর্জে-গর্জে যতই যতই বাজার মাত করার চেষ্টা করি না কেন আমাদের সেই সুখের দিন আর নেই রে ভাই, সুখের দিন আর নেই। এই কালকের কথাই ধরো না কেন। নোদাখালির জঙ্গল ছেড়ে, ডুবডুবি নদী সাঁতরে পার হয়ে, সবে গজামারির জঙ্গলে ঢুকব বলে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ নজর পড়ল ঈশান কোণে একটা কালো মেঘ দলা পাকিয়ে উঠছে। মনে একটু চিন্তা হল। বেশ কয়েকটা বসন্ত তো কাটল এই জঙ্গলে, এখন এসব বদলগুলো আগাম বুঝতে পারি। আর তাছাড়া আমাদের তো তোমাদের মতো হাওয়া আপিস নেই যে তার গোছানো কথায় ভরসা করে চলব! জানো, আমার আশঙ্কাই ঠিক হল। মুহূর্তের মধ্যে গোটা আকাশটা কালো মেঘে গেল ছেয়ে। শনশন শব্দে বাদাবন কাঁপিয়ে ধেয়ে এল ঝড়, ডুবডুবির জল উথলে উঠে আছড়ে পড়তে থাকল পাড়ের ওপর। একবার মনে হল ঘাপটি মেরে চুপচাপ একঠাঁয় বসে থাকি, কিন্তু তাও তো নিরাপদ নয়। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে কোনওরকমে পথ চলার চেষ্টা করতেই টের পেলাম এমন ঝোড়ো রাতে ওই কাজটাও মোটেই সহজ নয়। কেবলই মনে হতে লাগল কে যেন আমাকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে। বুঝতে পারছি ক্রমশই দূরে, আমার চেনা আস্তানা থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুই নিজের মতো করে করে উঠতে পারছিলাম না। এক সময় টের পেলাম আমি আর ডাঙায় নেই। আমার লোমশ ডোরাকাটা শরীর ঘিরে তখন নোনাজলের উথালপাথাল। ভাসতে ভাসতে একসময় আটকে গেলাম কোন এক নদীর চরে। ঝড়ের দাপট তখন বুঝিবা খানিকটা কমেছে, কিন্তু বৃষ্টির দাপট চলেছে সমানে। লক্ষ্যহীনভাবে চলতে চলতে কখন যে গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়েছি তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। গ্রামের ভেতরেও যে তখন হইহই-রইরই কাণ্ড। ঝড়ের তাণ্ডবে উপড়ে পড়া গাছ, ভেঙে পড়া বাড়িঘর, বিপন্ন লোকজনের আর্তনাদ—সব মন মোচড় দেওয়ার মতো ঘটনা। একটু আড়ালের আশায় গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছুতেই শুনি ‘বাঘ, বাঘ’ বলে চিৎকার! জলে জবজবিয়ে ভেজা ভারী ক্লান্ত দেহটাকে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আমার দিকে ধেয়ে আসা মানুষজনকে ভয় দেখানোর জন্যে প্রাণপণে ‘হালুম’ বলে হাঁক দিলাম, কিন্তু ভিজে গলায় সেই জোর কোথায়! বাঁচার আর কোনও উপায় নেই দেখে আবার লাফ দিলাম গাঙের জলে। আবার ভেসে চলা। এতকাল বাদাবনে ঘর করছি মানুষজনের সহবাসী হয়ে অথচ তাদের একফোঁটা সহানুভূতি অর্জন করতে পারলাম না। একটা ভয় আর অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে এভাবে বেঁচে থাকা যায়!

জানো, মাঝে মাঝে ভারি গোঁসা হয় পূর্বপুরুষদের ওপর! সেই সুদূর কোন এক কালে নাকি পৃথিবী ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আর সেই শীতলতা সইতে না পেরে সাইবেরিয়ার সমভূমি ছেড়ে তারা পাড়ি জমিয়েছিল দক্ষিণের দেশগুলিতে। এভাবেই চলতে চলতে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে তারা এসে ঠাঁই নিল এই বাদাবনের জঙ্গলে। সেই থেকে আমরা এখানে। আগে বিস্তর সংখ্যায় ছিলুম, বাদাবন তখন ছিল অনেক গহীন। সুঁদরী, গরাণ, গেঁও, হেতাল, বাইন, পুশুর— এমনই সব গাছ গলায় গলা মিলিয়ে পরম আদরে আগলে রাখত আমাদের। কিন্তু যেদিন থেকে বাদাবনে মানুষের আনাগোনা বাড়ল, সেদিন থেকেই কমতে থাকল অরণ্যের পরিসর, একে একে উজাড় হতে থাকলাম আমরা। আর আজ! চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি আমরা। আজ আমরা হারালে হারিয়ে যাবে বাদাবন, হারিয়ে যাবে বাদাবনের এক আশ্চর্য জীবনপ্রবাহ। যে ঝড়ের দামাল দাপটে বিপর্যস্ত হলাম আমরা, সেই ঝড়টা যদি বাদাবনে না থমকে সটান আছড়ে পড়ত তোমাদের সাধের কলকাতা শহরে, তাহলে শহরটার কেমন হাল হত তা আন্দাজ করতে পারো তোমরা? এই বাদাবন বুক চিতিয়ে ঝড়ের দাপত সামলায় বলেই না তোমরা টিঁকে আছ! অথচ বাদাবনের রাজার আজ কি হাল! প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া এই ডোরাকাটা পোশাকটা আছে বলে এখনও প্যান্থেরা টাইগ্রিস বলে আমাকে চিনতে পারছ। দুদিন পরে যখন চিরকালের মতো হারিয়ে যাব, তখন আমাদের খুঁজবে কোথায়? বাঘ বাঁচলে বন বাঁচবে, বন বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, প্রকৃতি বাঁচবে, পৃথিবী বাঁচবে। এই সহজ সত্যটা কবে বুঝবে তোমরা? ক্লান্ত শরীরটাকে একটু জুড়োব বলে এখানে থেমেছিলাম। মন চাইল, তাই আগল খুলে না-জানি সুখ-সুখের কি আবোলতাবোল কথা বলে গেলাম। শহরের বাবুমশাইরা, আমাকে ক্ষমা কোরো! চললাম গো তোমাদের এই জনজঙ্গল ছেড়ে আমার চেনা জলজঙ্গলে। আর দেখা হবে কি না জানি না। আমার কথাগুলো একটু মনে রেখো। তাহলেই আমার কথা, আমাদের কথা মনে পড়বে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগল , অতি সহজ সরল ছন্দে খুব ভাবনার একটা বিষয়কে তুলে ধরা । পড়ার সময় এক দারুণ অনুভূতি কাজ করছিল ।

Leave a Reply to R Gupta Cancel reply