ওবেলিস্ক

গুলশনারা খাতুন

 

মেলোডিটা একদিন ঝুপ করে বন্ধ হয়ে গেল। মিত্তি ভাবে মাঝেসাঝে, এই ঝুপঝাপ বন্ধ হয়ে যাবার নাম বুঝি মরে যাওয়া। ধুস, চলে যাওয়া-টাওয়া আবার হয় নাকি কিছু। সোজাসুজি, মরে যাওয়া।
–সে মেলোডি তো এক বছর হল ঝাঁপ ফেলেছে।
–যাহ শালা, এক বছর?
–তুই ভাই চোখে ঠুলি, কানে তুলো দিয়ে ঘুরে বেড়ালে এক বছর পরই জানতে পারবি।
সিঁড়ির আড্ডায় অনির্বাণ আর বিল্ব মিলে খুব আওয়াজ দিয়েছিল সেদিন।
মোটা পাওয়ারের চশমার সাথে মিত্তির আর এক গয়না, কানে হেডফোন। দুই ঠুলির যৌথ ঘরণীতে তা মিত্তি প্রায়ই আনদেখা, আনশোনা করে হেঁটে-চলে বেড়ায়।
ইশ তাই বলে মেলোডিটাও মরে গেল! মিত্তি ভাবছিল সেদিন।
মরে যাওয়াটা ভারি সহজ। মিত্তি ভাবে রাতবিরেতে ছাদে গেলে। অথচ এই মরে যাওয়ার প্যানিক থেকে বেরোতে ছোটবেলায় এই ডাক্তার, সেই বদ্যি। মিত্তির মনে পড়লে হাসি পায়। সেই ক্লাস সিক্সে বোনের সঙ্গে মাসির বাড়ি গিয়ে ছিল ক’দিন। যেবার দাদামশাইয়ের অন্ত্যেষ্টিতে এসে ছোটমাসি নিয়ে গেল ওদের। সেই প্রথম মরে যাওয়া চেনা মিত্তির। সারা বাড়িতে কেমন মরে যাওয়ার গন্ধ। বমি পেত। ফিনাইল আর লাইজলে ধোয়া ঘর। ওষুধ আর তারপর রজনীগন্ধা। আর এই বুঝি কেউ কেঁদে উঠল। মিত্তির মাথা ঘুরত, গা গুলোত। কমলালেবু শীতে ছাদে ফেলুদা পড়তে পড়তে ধরেই নিয়েছিল, মরে যাওয়া মানে, রজনীগন্ধা, ওষুধ, ফিনাইল আর ডুকরে কেঁদে ওঠা। দিন কয় পরে দাদামশাইর হাসিখুশি ছবি আর বোবা খাটটা মিত্তিকে বুঝিয়েছিল, মরে যাওয়া মানে ভ্যানিশ হয়ে ছবিতে ঝুলে থাকা। ছোটমাসির বাড়িতে নিন্তুদাদা বলেছিল, মরে যাওয়া মানে চলে যাওয়া। মিত্তির মা-পাপাও নাকি একদিন ভ্যানিশ আর ছবি হয়ে চলে যাবে। খুব রাতে ঘুম ভেঙে পাশে মা নেই সেদিন। মা তো কত দূরে, কলকাতায়। মিত্তি সেদিন ডুকরে কেঁদেছিল। ‘মা গো। তোমরা ছবি হোয়ো না মা গো। আর হোমওয়র্ক ফাঁকি দেব না। লুকিয়ে ফেলুদা পড়ব না। তুমি পাপাকে নিয়ে বড় ঘরে থেকো সারাজীবন, কেমন?’
ডাক্তারকাকুই সাইকোলজিস্ট ঠিক করে দেন। কত কথা জিজ্ঞেস করত লোকটা। মিত্তির অত কথা আর ভাল লাগে না। খালি বোনকে চুপিচুপি চকোলেট ঘুষ খাইয়ে বলত–
–বোনটি আমার সোনা বোনু। মাকে, পাপাকে বলবি ওরা যেন কক্ষণও না মরে যায়।
বোনু কী বুঝত কে জানে? মাথা নাড়ত শুধু।
মিত্তির হাসি পায়। মেলোডিটা মরে গেল আজ এক বছর। ক’দিন পর এখানে অন্য কী জন্মাবে কে জানে। তখন কোনও এক মিত্তি, কবে যেন বব ডিলান ডিক্সোগ্রাফি সিডি কিনে কোনও এক প্রেমিককে দিয়েছিল, সেই গল্পটাও মরে যাবে।
পুরনো পাড়ার আভিজাত্য না থাকলেও, এ পাড়ায় একটা আপন-পর গন্ধ আছে। পাশের বাড়ির দুপুরবেলার মাছের ঝোল পাতে পড়লে মিত্তি সেই আপন-পর গন্ধটা টের পায়। আবার স্কার্টের ঝুল হাঁটুর ওপরে উঠলে, আশপাশের ইতিউতি চাউনিতেও মিত্তি আপন-পর গন্ধটা বুঝতে পারে। মিত্তিদের আগের পাড়াটা ঠিক পাড়া ছিল না যদিও। সার সার ফ্ল্যাট বাড়ি। কমিউনিটি হলে পুজোর মরশুমে একবার জমিয়ে কর্পোরেট খানাপিনা। ব্যস সামাজিকতার দায় শেষ। অ্যাটাক হল যেবার মাঝরাতে, দীপককাকুরা অবশ্য গাড়ি বের করেছিল ঘুম ভেঙে। তারপর সিএমআরআই নাকি বেলভিউ, এই তর্কে হেরে গিয়ে দীপককাকু শ্মশানে পর্যন্ত যায়নি। মিত্তি গেছিল। বাড়ি বদলের আগে দেখা করতে। কাকিমা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন–
–কাকুর কথা শুনে সিএমআরআই নিয়ে গেলে তপনদা এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেন রে মা!
মিত্তি জানে। এইসব কান্না, জড়িয়ে থাকাও তো মরে যাবে। হাসি দিয়ে চেনা পাড়ার শেষ দেখাটুকু খাতায় লেখা থাক বরং।
দালাল লোকটা বেশ ভাল। পানপরাগের দাগ নেই ঠোঁটের কোণে। বুকের দিকে চেয়ে থাকে না। বেশ ছিমছাম ফর্ম্যাটে কথা বলে। সুবোধ ঘোষের গল্প থেকে উঠে আসা এই সময়ের বাড়ির দালাল।
–একা থাকবেন না দোকা?
–দোকা।
–বিয়ে করে নাকি লিভ ইন?
–লিভ ইন।
–সে কী? দুজনেই মেয়েছেলে? ইয়ে মানে মহিলা? লেবু কেস… ইয়ে মানে সমকামী?
–না। উনি আমার মা।
–বললেন যে লিভ ইন?
–হ্যাঁ আমি আর আমার মা একই বাড়িতে থাকব। ইংরেজিতে লিভিং ইন বলতে আপত্তি কোথায়।
–হে হে হে।
দেড়তলা মতো বাড়িটার সামনে একচিলতে মাটি আছে দেখে মায়ের খুব আনন্দ। গাছ পুষবে। মিত্তির নামের পিছনে দত্ত আর মায়ের নামের পিছনে রহমান দেখে বাড়িওয়ালা মেইন গেটের এন্ট্রিতে হনুমানের ছবি ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। মিত্তি ভাবে, একদিন হনুমানের ছবি বদলে হয়তো কাবা শরিফের ছবি বসবে। হনুমান মরে গিয়ে কাবা শরিফের জানাজা শেষে কোনওদিন বব মার্লে। মরতে তো একদিন হবেই। সবাইকে। মানুষ, স্মৃতি, ছবি, অলি-গলি, সময়।
একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো,
মৃত্যুচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারাবেলা প্রিয়বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।
–মৃত্যুগন্ধে ভরা। তাই না?
–তুই এত আবালচোদা কেন রে?
–কী বললাম?
–এত সহজ জীবনবোধে মৃত্যু খুঁজে পেলি? এটা তোদের যাদবপুরের সমস্যা।
–আর এটা তো তোদের নন-যাদবপুরিয়ানদের সমস্যা। সব কিছুকে যাদবপুরের দোষ বলে দেগে দেওয়া। আমার মনে যা হয়েছে, তাই বলেছি।
–ডাক্তার দেখা। তোর মাথায় গণ্ডগোল আছে।
ঝগড়া করে করেই অর্চির সঙ্গে প্রেমটা কেটে গেছিল। মিত্তির প্রেমের বয়স এক বছরের বেশি কোনওটাই না। হুড়ুমতাল শুরু হল। তারপর শ্মশানে যেতে মেরেকেটে চার মাস। ঝগড়া-কান্না সব কিছুর মাঝে কিছুদিন চুমু-টুমু, ঝাপটাঝাপটি তারপর ব্যস বসন্ত ভোগে গেছে। দীপের সঙ্গে প্রথম কয়েক মাসের লং ডিসট্যান্সটা বেশ এক বছরের আয়ুষ্কাল দিয়েছিল। অবশ্য কোনও কিছু মরে গেলেই মিত্তি আর কাঁদে না।
দেড়তলার আধখানা জুড়ে ঘর আর আধখানা বেমক্কা ন্যাড়া ছাদ। মায়ের লংকা, বেগুন, ডালিয়া, গোলাপ গাছের ফাঁকে ফাঁকে মিত্তির কবরখানা। পাশে বাড়িওয়ালার দোতলার ছাদ একেবারে সেন্ট্রাল জেলের পাহারার দেওয়াল তুলেছে। ফলে মিত্তিদের নতুন পাড়ার দেড়তলার ঘর কাম ছাদ কাম কবরখানা একেবারে শূন্য দশকের কবিতার মতো একা রাজ করে। মায়ের ছাদে ওঠার পারমিশন সপ্তাহে একদিন। পাপা মরে যাওয়ার পর মা প্রতিবাদের ধার মাড়ায় না। ছ’মাস মিত্তির কাছে, মিত্তির কথায় ওঠে বসে। ছ’মাস বোনুর কাছে। মিত্তি খুব একটা গায়ে মাখে না। মা-ও তো মরে যাবে কোনওদিন। কী হবে আঁকড়ে থেকে?
কবরখানায় নতুন অতিথি। আছে তা প্রায় খান পঁচিশ সমাধি। ওবেলিস্কগুলো নিজেই বানায় মিত্তি। ক্লে গাম শুকিয়ে, শক্ত করে ওবেলিস্ক। রং করে। পছন্দের সমাধিতে লাল রঙের ওবেলিস্ক। অপছন্দের সমাধিতে নীল রঙের। পাপা শিখিয়েছিল বাঁধিয়ে রাখা। সব নাকি মাটিতে মিশে যায়। তাই মাটিতে বাঁধিয়ে রাখো। এইভাবে মিত্তি যেদিন মরে যাবে ঠিক টুকটুক করে মাটি বেয়ে পাপার কাছে কোলে চলে যাবে। পাপা যেমন এখন মিত্তির ছাদের চারকোণা ১০ ফুট বাই ১০ ফুট সিমেন্টের টবের কবরখানায় দাদুর পাশে শুয়ে আছে।
মিত্তি ভেবেছিল। পাপা মরে যাবার রাতেই ভেবেছিল। আচ্ছা এই যে ছবি বাঁধিয়ে লোক আসবে, কাঁদবে, মিষ্টি খাবে, চলে যাবে। পরদিন মোহনামাসি রজনীগন্ধাগুলো ফেলে দিলেই তো মরে যাওয়ার গন্ধটাও মরে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো। ছাদের কবরখানা খুঁড়ে মরে যাওয়া বাঁচিয়ে রাখো। পাপার সেই একটা দাঁত পড়ে গেছিল বারুইপুরে পিকনিকে অ্যাক্সিডেন্টে। মিত্তি কাউকে না বলে ভিক্সের কৌটোয় তুলে রেখেছিল। পাপার লাল ওবেলিক্সের তলায় দাঁতটা পুঁতে রেখেছে। নীলাঞ্জনের সঙ্গে ব্রেক-আপের দিন মেরেধরে মাথার চুল ছিঁড়ে দিয়েছিল। নীল বাঁকা মতো ওবেলিক্সের নিচে ওই শালার চুল পুঁতে রেখেছে। যাদবপুরে ফেয়ারওয়েলের দিন ঝিল থেকে তুলে আনা একমুঠো পাথরকুচি কবরখানার মাটিতে শুয়ে আছে শান্তিতে। দাদির শাড়ির ছেঁড়া অংশটা ওবেলিস্কের ওপর বিষাদসিন্ধুর লাইন লিখে রেখেছে। মেলোডির সামনে সেদিন অনেক রাত অব্ধি ঘুরঘুর করেছিল মিত্তি। বেশ রাতে লাল মরচে শাটারের জং চেঁছে তুলে এনেছে। মেলোডির ওবেলিস্কটা বেশ মিষ্টি প্রেমের গপ্পো টাইপ হয়েছে। রবিবার মা ছাদে উঠবে শ্যাওলা, পচা পাতা, খৈল-সার দিতে গাছে। মিত্তি জানে। মা মনে মনে বিড়বিড় করে আরবি মন্ত্র পড়ে। মিত্তির জানে, মা একটু ভীতু আছে। ভূতের ভয়। মিত্তি জানে, মা ভাবে মিত্তি পাগল। তাই ভাতের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে ওষুধ মেখে দেয়। মা মরে গেলে মিত্তি ওষুধগুলো পুঁতে রাখবে একটা চৌকো ওবেলিস্কের নিচে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to তিষ্য Cancel reply