সাহিত্যে এককেন্দ্রিকতা প্রসঙ্গে

মহিউদ্দিন সাইফ

 


সাহিত্যের অধিকাংশই এখন বিশেষ কোনও নগরকেন্দ্রিক নয় বরং অনেক বেশি চুমুকেন্দ্রিক। আমি আপনার মুখে চুমু খাচ্ছি, আপনি এবার আমার মুখে খান। “দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/এই বাংলার সারস্বতের বাজারে বাজারে”। এই কালচারই আমাদেরকে সৃষ্টি ও সৃষ্টির আস্বাদন দুয়েরই আনন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে

 

‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ পত্রিকা আমার কাছে একখানি প্রস্তাব রেখেছেন সাহিত্যের এককেন্দ্রিকতা বিষয়ে। এই প্রস্তাবে সাড়া দিতে পেরে নিজেকে কৃতজ্ঞ মনে করছি। পত্রিকাটিকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা।

 

আমাদের বাংলা সাহিত্যে একটা কথা খুব বেশি প্রচলিত হয়ে আছে, সেটি হল ‘বাংলাবাজার’। হ্যাঁ, বাজার। মানে বাণিজ্য, প্রচার, প্রসার, পুরস্কার ও তার সঙ্গে জড়িত আরও নানা আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্ম। কিন্তু এ-সমস্তই আসলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার কাণ্ডকারখানা। মূলে যেটি হওয়ার সেটি হচ্ছে বাক্যের পর বাক্য আর বচনের পর বচন সাজিয়েও শেষমেশ লেখাখানি সাহিত্য হল কিনা। যদি তা না হতে পারে তাহলে রসজ্ঞ পাঠকের কাছে এই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার কাণ্ডকারখানা হাস্যকর বলেই মনে হওয়ার কথা। কারণ আমরা নিজেরাই দেখেছি এবং দেখছি যে ব্যবসাসফল কিছু প্রকাশক ও সংবাদমাধ্যম সামান্য খাজা লেখককে কুলীন বলে বাজারে চালিয়ে তো দিচ্ছে। কিন্তু কথায় আছে না, “মোল্লার দৌড় মসজিদ অব্ধি”! তো তাদেরও সীমানা ওই। পাঠকের হাতে এসে সে বই পড়লে তার খোলস ঠিক খসে পড়ে। পাঠক তখন টাকা উসুল করার জন্য সময় নষ্ট করে বইটা একবার পড়ে তো নেয়। কিন্তু তারপরে সেটি পড়ে থাকে বিক্রির জন্য রাখা নিউজ পেপারের স্তূপে নতুবা বিরক্তিকর কোনও বন্ধুকে শিক্ষা দিতে জন্মদিন বা ওইরকম কিছু একটা উপলক্ষে বাঁধিয়ে উপহার দেওয়া হয়। এই তো গতি। ফলে বহমান কালের কাছে সবই খোলসহীন। হাজারো টকঝালমিষ্টি স্ন্যাকসের মতো ট্রিক ব্যবহার করে অতি নিম্নমানের লিখিয়েরা করে-কম্মে খাচ্ছে বটে। করে-কম্মে খাওয়ার কারণও আছে। কারণ হল সিংহভাগ পাঠক অদীক্ষিত (দীক্ষিত হওয়ার কেউ দিব্বি দেয়নি যদিও), আসলে খুব মোটা দাগের রসে অভ্যস্ত। চেতনার বিকাশের চেয়ে তাকে জড়তার নিদ্রায় রাখতে বেশি আগ্রহী। ওতে অস্তিত্বের অসহনীয় বোধ থেকে তফাতে থাকা যায়। এমন পাঠকের কাছে পিৎজা-বার্গার যা, বইটিও তা। এখনকার বাংলা সিরিয়াল যা, একটা উপন্যাস বা গল্পের বইও তাই। আবশ্যক নয়, খেয়ালি শখ। অনেকের কাছে ঘর সাজানোর উপকরণ, জ্ঞানের ডিসপ্লে দেখিয়ে মানুষকে ভয় দেখাবার অস্ত্রও অনেকের কাছে। সুতরাং এমন গুণী পাঠকের গুণেই যে এমন লেখকেরা এত সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন তা আর নতুন করে বলার কী? কিন্তু এতে করে দূষিত হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। খুব দূষিত হচ্ছে।

 

এবার আসা যাক একেবারে মূল বিষয়টিতে। এপার বাংলায় কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য কি এখনও চলছে? কলকাত্তাইয়া লেখকেরাই কি বাংলাভাষার মুখ? কলকাতার বাইরের লেখক বা কবিরা কি বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক?

এই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা এখনও চলছে। চলার কারণ হিসেবে বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী আর সংবাদমাধ্যম এখনও কিছু তৃতীয় শ্রেণির লেখকদেরকে জনমানসে শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে সাব্যস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে আলোকিত আর ব্রাত্য এই পুরনো সীমারেখা সমানে বিদ্যমান থাকছে বলে প্রতীত হচ্ছে। কিন্তু আমার কোথাও যেন প্রশ্ন জাগে এরকম কোনও সীমারেখা প্রকৃতই আর আছে? নেই বোধহয়। আমরা যে-সময়ে বাস করছি, যে-আন্তর্জাতিকতা আমাদেরকে স্পর্শ করছে, যে-টেকনোলজি ভোগ করছি তাতে প্রান্তিকতার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জাহির করায় একধরনের আত্মবিলাস লাগে। একজন লেখক যে প্রান্তিক, কোনও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না অথচ ভাল লেখা নিয়ে উঠে আসছেন, তাঁর দিকে আমাদের সবার খুব করে চোখ ফেরানো দরকার। এসব কথার মধ্যে লেখার চেয়ে দেখা হয় সেই লেখকের এমন সব দিকগুলিকে যা ব্যক্তিলেখকের প্রতি করুণা উদ্রেক করতে পারে, করে। একটি অহেতুক মোহ তৈরি করে, যা লেখাটিকে দেখার, সেটিকে অনুভব করার বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদেরকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। লেখার প্রকৃত ক্ষমতাটিকে চিনে নিতে যথেষ্ট অর্গল সৃষ্টি করে। এও এক ধরনের বিপর্যয়, যা সাহিত্যকে ভুল পথে পরিচালিত করে। বাংলাবাজারে এই ধারাটির রমরমা বেড়েছে। আমরা অমিয়ভূষণ মজুমদার, শৈলেশ্বর ঘোষ, সিদ্ধেশ্বর সেন, শম্ভু রক্ষিত, অজিত রায় ইত্যাদিদের নিয়ে বলি, যে এঁরা যোগ্য মনোযোগ পেলেন না। কিন্তু অমিয়ভূষণ, শম্ভু রক্ষিত বা অজিত রায় যে র‍্যালাটা দেখিয়ে গেছেন, সেই র‍্যালাটা আর কেউ দেখিয়ে যেতে পেরেছেন? মোট কথা হচ্ছে প্রান্তিক-টান্তিক কিছু না। নিজের দাপট দেখিয়ে যেতে হবে। বিনয়ের মতো, শম্ভুর মতো, অজিতের মতো দাপট।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার বন্ধু কবি রাজীব দত্তের কথা। তিনি বলছিলেন, “কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য বলে আর কিছু নেই। দেবদাস আচার্যরা, নিত্য মালাকাররা— শতজল ঝর্ণার ধ্বনি এসে সেই ইমারত ভেঙে ফেলেছে। বিনয় পেরেছেন স্পটলাইটটাকে ঠাকুরনগর-শিমুলপুরের দিকে, শম্ভু মেদিনীপুরের দিকে, দেবদাস নদীয়া আর নির্মল হালদার পুরুলিয়ায় এনে ঢুকিয়ে দিতে।”

শম্ভু রক্ষিত

কথা উঠতে পারে এঁরা সেইভাবে চর্চিত হলেন কই? প্রান্তিক বলেই ব্রাত্য রয়ে গেলেন। কিন্তু আমি বলব যারা পড়ে না তারা যেমন শম্ভু-শৈলেশ্বর পড়ে না তেমন শক্তি-সুনীল বা জয়ও পড়ে না ঠিকমতো। সাহিত্যচর্চা একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার, আয়াসসাধ্য বিষয়। একে প্রকাশনার হাজারো বাহারি চটক দিয়ে গেলানো যায় না। যাঁর লেখায় দম নেই হাজার চেষ্টাতেও তাঁর সেই লেখাকে কুলীন করা যাবে না। যাঁদের মধ্যে সেই ‘grand style’ নেই তাঁরা লিলিপুটের মতো কিছুদিন হেঁটে-চলে বেড়াবে তারপর তাঁদের যা গতি তাই হবে।

আরও সাম্প্রতিক কথা দিয়ে বলতে গেলে উঠে আসবে অচিন্ত্য মাজী, হামিরুদ্দিন মিদ্যা, শুভম চক্রবর্তী, জগন্নাথদেব মণ্ডল, তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়, বাবলু মুদিকোড়া, এরকম আরও অনেকের কথা, যাঁরা নিজের নিজের মাটির থেকে রসদ সংগ্রহ করে কলকাতাকেন্দ্রিকতার ধারণাকে তছনছ করেছেন। হামিরুদ্দিনের কথাই ধরা যাক, তিনি এবছর সাহিত্য অ্যাকাডেমি যুব পুরস্কার পেলেন তাঁর ‘মাঠরাখা’ গল্পগ্রন্থের জন্য। তিনি তো আর কলকাত্তাইয়া লেখক নন। তাঁর লেখাতে কলকাত্তাইয়া কোনও ভাবও নেই। তাঁর সাহিত্যই তাঁকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। প্রকৃত লেখার বিভাতেই আকৃষ্ট হয়ে অমন সম্মান তাঁকে এসে বরণ করেছে। শুধুমাত্র প্রকাশকের ক্যারিকেচারে কোনও লেখা সাহিত্য হয়ে যায় না।

আমদের বাঙালিদের একটা ধারণা আছে যে আমি লিখি মানে আমি সন্ত, আমি শুধু লিখব। বাকি যা কাজ তা পত্রিকার সম্পাদকের বা প্রকাশকের। কিন্তু এখানে আমি একমত হতে পারিনি পুরোপুরি। আপনি যদি লেখক বা কবিযশোপ্রার্থী হন তাহলে পাঠকের কাছ অব্ধি পৌঁছানোও আপনার লেখারই অঙ্গ। লেখা যখন আপন অন্তর্চেতনার বহিঃপ্রকাশ, তখন তার পূর্ণপ্রকাশই কাম্য। আমার মনে পড়ছে কবি নীলাঞ্জন দরিপার কথা। তিনি বলেন, “লেখাটা পড়ানোই যখন আমার লক্ষ্য, তখন আমি ফেসবুককে ব্যবহার করেছি সে-কাজে। অনেকে এটাকে ভাল চোখে দেখে নাই।” কিন্তু পত্রিকাতে লেখা প্রকাশ হওয়ার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানাশুনা লাগে, আর পত্রিকা পড়েই বা কটা লোক? পড়লেও সব লেখা পড়ে না। ফলে তিনি যে নিজের মতো করে উপযুক্ত পথ বেছেছেন, তাতে আমি তাঁরই পক্ষে। জানি যে ফেসবুক বা অন্য মাধ্যমে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় তার বেশির ভাগটাই অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু তারই মাঝে কিছু কিছু মন্তব্য এমন থাকে যা চিন্তার সূত্রতে আঁশ জুগিয়ে যায়। এভাবে বহু মানুষের কাছে লেখাটি পৌঁছাতে পেরে তার পরিণতির দিকে খুব সহজেই অগ্রসর হতে পারছে এখন। এক্ষেত্রে কোনও বিশেষ প্রকাশনা বা সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিতে হচ্ছে না স্রষ্টাকে। মূল বিষয়, যেটির অভাব বেশি বেশি নজরে আসছে তা হল, নিজের লেখার প্রতি loyal থাকার অভাব, কোনওরকম ফাঁকিবাজির আশ্রয় না-নেওয়ার অভাব। এইসব কথার মধ্য দিয়ে আমি আসলে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে আমাদের কাছে এখন বহু উপায় রয়েছে। সেইসব উপায় বাংলাভাষার লেখক ও পাঠকের মাঝের যাবতীয় বেড়া ভেঙে দিয়েছে এবং অনবরত দিচ্ছেও। আমাদের কর্তব্য ঠিক লেখার থেকে প্রকৃত রস সংগ্রহ করে নিজের আস্বাদনক্ষমতাকে আরও উন্নীত করা। একজন চিন্তাশীল, অনুভূতিপ্রবণ প্রাণী হিসেবে নিজের অবস্থানের সঙ্গে, আপন অস্তিত্বের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা।

 

জানি, এখনও এমন অনেকে লিখছেন যাঁরা প্রকাশের আলোয় আসছেন না। প্রকাশনা বা সংবাদমাধ্যমগুলি তাঁদের প্রতি কোনও আগ্রহ দেখায় না। এ সত্য কথা। কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যবসাসফল প্রকাশনাগুলি সবসময় চাইবে নিজেদের মতো করে লিখিয়ে নিতে। একটা ছক বেঁধে দিতে। বলা যায় তারা লেখার ব্লু-প্রিন্ট দিয়ে দেয় এক অর্থে। সেই থোড়-বড়ি-খাড়াতে অভ্যস্ত পাঠক আর অন্য কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতাও তো হারিয়ে ফেলে। ফলে নতুনভাবে, নতুন কথা যদি কেউ লিখছেন তো আপাতত তাঁর স্থান ব্রাত্য হয়ে থাকাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু একথাও সত্য যে এই যুগ হল লিটল ম্যাগাজিনের যুগ। মানুষ বড় বড় প্রকাশনীর থেকে মুখ ফেরাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনের দিকে। ছোট ছোট প্রকাশনাগুলি অনেক ভাল ভাল বই করছে, খুব যত্ন করে করছে, মানুষের কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে বিবিধ উপায়ে। যাঁদেরকে আমরা বলছি আড়ালে থাকা তাঁরা আলোতে আসছেন এইসব লিটল ম্যাগ, বিভিন্ন ব্লগ আর ছোট প্রকাশনাগুলির মারফত। ফলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘ব্রাত্য, আড়ালে থাকা, উপেক্ষিত’, এইসব কথাগুলির করুণামাখা মনোযোগ আকর্ষণ করা ছাড়া আর বিশেষ কোনও গুরুত্ব আছে কি এখন?

আর ব্যাপারটা শুধু কলকাত্তাইয়া বলে নয়। কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলেও এমন অনেক কবি ও লেখক আছেন যাঁরা তথাকথিত ব্রাত্য হয়ে আছেন। আমরা শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা কয়জন তুলি? সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অরুণকুমার সরকার, আলোক সরকার, কেদার ভাদুড়ী, রমেন্দ্রকুমার বা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা আমরা কজন বলি? কালীকৃষ্ণ গুহ বা একরাম আলি নিয়ে নিবিষ্ট আলোচনা কটা হয়? যে মণীন্দ্র গুপ্ত নিজের অবস্থানে আমৃত্যু অবিচল রইলেন সেই তাঁকে আমরা যাঁরা সাহিত্য করি তাঁরা কতটা গুরুত্ব দিতে পেরেছি? দেবারতি মিত্র বা সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের চর্চার কতখানি? রবীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীতশোক ভট্টাচার্য নিয়ে চৰ্চা করি আমরা? সৈকত রক্ষিত, মানব চক্রবর্তী, সাযযাদ ফিরদাউস বা লুৎফর রহমান অথবা শামীম আহমেদ আমাদের কাছে কতটা পঠিত?

মণীন্দ্র গুপ্ত

ফলে নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে দাবি করা আমরাই যখন আমাদের শক্তিশালী পূর্বসূরিদেরকে ব্রাত্য করে রেখেছি তখন ব্যবসাবুদ্ধিধারী প্রকাশক আর নিজের লাভ দেখে নেওয়া সংবাদমাধ্যম তো নিজের কাজই করে যাচ্ছে। ওরা নিজেদের স্বার্থের কথাই সর্বপ্রথম মাথায় রাখবে, এ তো স্বাভাবিক কথা। সাহিত্যের উত্তরণ বা অবনমনে তাদের কী এসে যায়? আর যাঁরা বাংলা সিরিয়ালের মতো একের পরে এক খাজা লেখা লিখে বহু সন্তানের জনক বা জননী হচ্ছেন, তাঁদের কাছে সন্তানের চেয়ে প্ৰিয় হল সন্তান বিক্রির থেকে প্রাপ্ত অর্থ। আর এ সন্তানও সারোগেসি করা। ফলে তাঁদের মতে যত্রতত্র বিইয়ে দিলেই চলে, ভাল মন্দের বিচার কে করে? শত কুসন্তানের চেয়ে এক গুণময় সন্তান শ্রেষ্ঠ, এই প্রবাদবাক্যের ওঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। ওঁরা ভেবেও দেখেন না যে রসজ্ঞ পাঠকের কাছে সতীনাথই প্ৰিয়, প্ৰিয় অদ্বৈত মল্লবর্মন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মতো স্রষ্টারা।

 

আমি বললাম আমাদের কাছে এখন একটা খোলা প্রান্তর আছে। এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যার কোনও সীমা নেই। পৃথিবীর যেকোনও জায়গার বাংলা পাঠক খুব সহজেই স্রষ্টার সৃষ্টির সংস্পর্শে আসতে পারে। কিন্তু এই অতুলন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কালচার অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আমরা এক কুসংস্কৃতির জন্ম দিয়ে তারই পাকে পড়ে গেছি। একধরনের আত্মকাম আমাদেরকে বশীভূত করে ফেলেছে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা আমাদের অসহ্য লাগে। আমার জানাকে কেউ শুধরে দিলে অথবা আরেকটু সমৃদ্ধ করলে আমার ছদ্ম-পাণ্ডিত্যে মোক্ষম আঘাত লাগে। এমত হকিকতে আমরা নিজেরাই প্রকৃত লেখার কাছে যেতে চাই না। আমরা কোনও লেখা পড়ি তো সে তার লেখককে দেখে পড়ি। তিনি যাই লেখেন তাই ‘আহা! আহা!’, ‘উহু উহু’, ‘আমাদের বোধের উত্তরণ হল’ ইত্যাদি। কিন্তু বোধের উত্তরণ হল কই? প্রশ্নহীন মুগ্ধতা আমার বোধের কতটা সহায়ক?

আমরা তো এখন একে-অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাও আবার মোটা দাগের ছদ্ম প্রশংসা, যা ঘাসে মুখ দিয়ে চরে বেড়ানো প্রাণীও বুঝতে পারে। যাঁরা সেই প্রশংসায় অকূল হয়ে ভেসে বেড়ান তাঁরা জানি না কোন গ্রহ থেকে এসেছেন! যুগ এমন যে আমি যদি মুখ ফসকে সত্যটি বলে ফেলি যে, লেখাটি আপনার খাজা হয়েছে মশাই, তাহলেই আর কী! আমি হয়ে গেলাম চরম কোপের পাত্র। যে আমি তাঁর কাছে ছিলাম রসজ্ঞ, গভীরে গিয়ে কবিতা বুঝতে পারার মতো সমঝদার, সেই আমিই তখন আর তাঁর কাছে লেখক পদবাচ্য না। আমি নির্বোধ, অরসজ্ঞ, সাহিত্যজ্ঞানরহিত, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে আমার মনে হতে শুরু করেছে যে সাহিত্যের অধিকাংশই এখন বিশেষ কোনও নগরকেন্দ্রিক নয় বরং অনেক বেশি চুমুকেন্দ্রিক। আমি আপনার মুখে চুমু খাচ্ছি, আপনি এবার আমার মুখে খান। “দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/এই বাংলার সারস্বতের বাজারে বাজারে”। এই কালচারই আমাদেরকে সৃষ্টি ও সৃষ্টির আস্বাদন দুয়েরই আনন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমরা বৃথাই বড় প্রকাশনীর একদেশদর্শিতা আর পাঠকসংগ্রহকারী খাজা লেখকদেরকে দোষ দিচ্ছি। আমরা নিজেরা কবে তন্ময়ী হব আমি শুধু সেইটুকু ভাবি।

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...