পথ দেখাচ্ছেন হলধারী— এ শুধু এগিয়ে যাওয়ার সময়

প্রতিভা সরকার

 




লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী

 

 

 

 

২০১৬ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি। উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলিতে এক বিরাট জনসভা। দু বছরও পোরেনি, নতুন সরকার দিল্লির মসনদে। আর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আপামর জনগণের মায়বাপ, সেই সভায় বক্তব্য রাখবেন। স্বাভাবিকভাবেই সবার আগ্রহ তুঙ্গে, কী বলেন ভারতভাগ্যবিধাতা।

নরেন্দ্র মোদি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। সুউচ্চ মঞ্চ থেকে যথাযথ নাটকীয়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন ভবিষ্যতের সোনাবাঁধানো সব পরিকল্পনা। সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতো জানিয়ে দিলেন দিব্যদৃষ্টি নয়, চর্মচক্ষুতে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সরকারের সুকর্মের ফলে ২০২২ সালের মধ্যেই ‘ভারতীয় কিসান কি কামাই দুগুনি হো জায়েগি’। ভারতীয় কৃষকের আয় দুগুণ হয়ে যাবে।

তার আগেই অবশ্য এনডিএ-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের (এমএসপি) নিরবচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল স্বামীনাথন কমিশনের সব সুপারিশ কার্যকর করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিকভাবে শোষিত ভারতীয় কৃষক সেদিন যদি আহ্লাদিত হয়ে থাকে, সেটা ন্যায্য আহ্লাদ ছিল। ভবিষ্যতের এই ১৩ কিলোমিটার লম্বা ট্রাক্টর ট্রলির লাইন, দিল্লি আম্বালা হাইওয়েতে প্রবল শীতে রাস্তায় কম্বল মুড়ি দিয়ে বৃদ্ধ কৃষকের নির্ঘুম রাত, রাস্তায় বসে লঙ্গরে খাওয়া, সেদিন অতি বড় নৈরাশ্যবাদীরও দুঃস্বপ্নে হানা দেয়নি। কেউ ভাবেনি ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় আত্মহত্যা ছোঁয়াচে রোগের মতো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে কৃষক সমাজে। আর বিপুল ভোটে নির্বাচিত দেশের সরকার সেদিকে নজর না দিয়ে আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে খাল কেটে কুমির আনার মতো কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটের অবাধ অধিকার কায়েম করে।

দেশের রাজার হাতে এখন তিন বর— প্রথম বরে এমএসপি সম্বন্ধে গভীর নীরবতা পালন করে এবং এগ্রিকালচার প্রডিউস মার্কেট কমিটিকে (এপিএমসি) বেকার বানিয়ে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের কাছে আগলহীন করে দেওয়া। দ্বিতীয় বরে বিভিন্ন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ঊর্ধ্বতন সীমা বানচাল করা, আর সব শেষে চুক্তিচাষের ব্যবস্থা, যেখানে খোলা বাজারে চাষি আর কর্পোরেট ফসল ফলানো এবং বিক্রির ব্যাপারে পরস্পরের মুখোমুখি, মধ্যস্থতা করার কেউ নেই। এই করতে গিয়ে কৃষিতে রাজ্য সরকারের যে গুরুত্ব ছিল তা প্রায় শেষ হল, যদিও সংবিধান অনুযায়ী কৃষি মূলত রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে। উপরন্তু এর সবটাই করা হল অতিমারির অছিলায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলোকে ডিঙিয়েই। কোনও কৃষক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলা হয়নি, পার্লামেন্টে বিরোধীদের সমবেত প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে বিল পাশ করানো হয়েছে। কোনওরকম আলোচনা, সমীক্ষা, মতগ্রহণ কোনওকিছুরই তোয়াক্কা করা হয়নি। বার বার বিরোধী অনুরোধ সত্বেও বিল পার্লামেন্টারি কমিটিতে পাঠানো হয়নি। শেষে ধ্বনি ভোটে সরকার পক্ষ এই বিল পাশ করিয়েছে।  কিছু রাজ্য এই কৃষি আইনের প্রতিবাদে বিধানসভায় নতুন কৃষি আইন পাশ করিয়েছে। এমনকি এনডিএ-র সবচেয়ে পুরনো দোস্তদের মধ্যে একজন শিরোমণি অকালি দল গাঁঠবন্ধন ছিন্ন করলেও সরকারের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি।

কিন্তু এই আইনের বিরুদ্ধে জনমত দানা বেঁধেছে সারা দেশ জুড়েই। শুধু পাঞ্জাব বা হরিয়ানায় নয়, একটা সহানুভূতির ঢেউ, একটা প্রতিবাদের কাঠিন্য টের পাওয়া যাচ্ছিল সর্বত্র। কারণ কৃষক পরিষ্কার বোঝে যে একবার এই ফাঁদে পা দিলে আর মুক্তি নেই। প্রথম প্রথম হয়তো  সে বেশি দাম পাবে, কিন্তু হোলসেল মার্কেট এবং নিশ্চিত দামের অনুপস্থিতিতে সে যদি বেসরকারি লগ্নিকারকদের হাঁকা দামে খুশি না হয়, তাহলেও  তার আর ফেরার কোনও জায়গা থাকবে না। ক্ষেতের ফসল গরু ছাগলকে খাইয়ে দেবে সে উপায়ও থাকবে না। যে দামে বেসরকারি বাবুরা দিতে বলবে, সে দামেই তাকে দিতে হবে। এমনকি নতুন কৃষি বিলে এই ধারাও আছে যে কর্পোরেট চুক্তিভঙ্গ করলেও কৃষক আদালতে যেতে পারবে না।

সরকারি মান্ডিগুলি পাততাড়ি গোটালেই এই লগ্নিকারকরা চাষিকে শোষণ করতে শুরু করবে এবং সেই শোষণ যে কত ভয়াবহ হতে পারে, পৃথিবীর সেই সব দেশ তার সাক্ষী আছে যেখানে যেখানে কৃষিতে বেসরকারিকরণের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমেরিকা থেকে জাপান, সর্বত্র উন্নত দেশগুলোতে কৃষিতে অত্যন্ত উচ্চহারে ভর্তুকি দেওয়া হয়। জমিজমা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনায় আমার দেশের চাষি এই কালা আইনকে সঙ্গতভাবেই ভাবছে তার মৃত্যু পরোয়ানা।

একথা সত্যি, ভারতীয় কৃষিব্যবস্থা সমস্যা জর্জরিত। কম উৎপাদন, স্টোরেজ পরিষেবা, ঋণ জর্জরতা, ফড়ে বা আর্থিয়ারাজ, সবই দিনের আলোর মতো সত্যি। কিন্তু নতুন আইন এদের কোনওটাই মেটাবে না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য বাজারি শক্তিগুলির সামনে কৃষির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া। সরকারি স্কুল হাসপাতালেও তো অনেক ত্রুটি। সেগুলো তুলে দেওয়া সমর্থন করা যায় তো? ত্রুটিপূর্ণ বলে একটি ব্যর্থ মডেলের জায়গা আর একটি ব্যর্থ মডেলকে দিয়ে অধিকার করানো যায় না। কিভাবে করা যায় সে নিয়ে আলোচনা চলতে পারে, কিন্তু মুক্ত বাজারি রাস্তাই একমাত্র উপায় হতে পারে না এ দেশে, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি কোনও না কোনওভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত।

অনেকের মতে এটা শুধু পাঞ্জাব হরিয়ানার বড় চাষিদের আন্দোলন। কেউ ভয় পাচ্ছে যে এই আন্দোলন শুধু এমএসপি কেন্দ্রিক হয়ে যেতে পারে। এখন অবধি এই দুই সম্ভাবনাই নাকচ হয়ে এসেছে। ১১তম দিনেও আন্দোলনে যোগদানকারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। পাঞ্জাব তো আছেই, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও সে রাজ্য থেকে দলে দলে কৃষক আসছেন দিল্লি সীমান্তে। উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের কৃষক ইতোমধ্যেই যোগদান করেছেন। সরকারের কাছে তাদের একটাই দাবি, কালা কানুন বাতিল করো। ইয়েস অর নো। যে বিদ্যুৎ বিল গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, তাকেও বাতিল করো। এই বিদ্যুৎ বিলে সরকার সাবসিডি কমাতে চায় এবং বিদ্যুৎ বন্টন ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে চায়। মেনে নেবে কৃষক এই সাঁড়াশি আক্রমণ? তাই যে আলোচনাই হোক না কেন, তার প্রথম অ্যাজেন্ডা হল কালা কানুন প্রত্যাহারের দাবী।

দাবীর এই স্পষ্টতা এই গণ আন্দোলনের সেরা বৈশিষ্ট্য। কোনও ধোঁয়াশা নেই, গোল গোল কথার মারপ্যাঁচ নেই। স্পষ্ট কথায় কোনওই কষ্ট নেই।

কৃষকরা জানেন, এ লড়াই দীর্ঘমেয়াদি। নিষ্ঠুর এবং কঠিন শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার আগে তাঁরা প্রস্তুত করেছেন নিজেদের। ট্রাক্টর এবং ট্রলির ওপর ছাউনি দিয়ে ডেরা বানিয়েছেন। ছ মাসের রসদ রয়েছে সঙ্গে। এই সরকারের জল গ্রহণ করবেন না এই পণ নিয়ে আলোচনার জন্য বিজ্ঞান ভবনে পৌঁছে প্রত্যাখান করেছেন সরকারি আতিথেয়তা। বিজ্ঞান ভবনের ঝাঁ চকচকে মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে নিজেদের লঙ্গরের খাবারে খিদে মিটিয়েছেন এই দৃঢ় প্রত্যয়ী কৃষকেরা।

কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা তারা ফেরাননি। যেখানে এদের ক্যারাভান, সেখানকার মানুষ দলে দলে এগিয়ে এসেছেন জল, খাবার, কম্বল, চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে। পথের পাশের বহু দোকান ও হোটেল কৃষকদের প্রাতঃকৃত্য এবং স্নানের ব্যবস্থা করেছে। যাদের এই প্রবল শীতে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল জলকামান, টিয়ার গ্যাস আর লাঠির ঘা দিয়ে, তারা তাদের আন্দোলনের বিশালতা এবং জনসমর্থনের বিপুলতায় নয়া গণআন্দোলনের ইতিহাস তৈরি করবার পথে।

আরও স্পষ্ট কৃষকের শত্রুমিত্র চেনার ক্ষমতা। সারা দেশ জুড়ে মোদি শাহের কুশপুত্তলির সঙ্গে পুড়ছে আম্বানি আদানির কুশপুতুল। উড়ে আসছে শাণিত প্রশ্ন— জিও আসবার আগে বাজারে কতগুলো অপশন ছিল? আইডিয়া, হাচ, এয়ারসেল…! বিএসএনএলের হাঁড়ির হাল কে করেছে? কর্পোরেট হাঙর সব গিলে খাবে বলেই কি এত আয়োজন?

ফলে অবরুদ্ধ রাজধানী। প্রাসাদকূটে বাদশাজাদাদের নিদ্রা যতই টুটুক না কেন, সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, পলওয়ালের পর আরও সমস্ত প্রবেশপথগুলি অবরুদ্ধ করবার তোড়জোড় চলছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আরও কৃষক, আরও ট্র‍্যাক্টর, আরও প্রতিজ্ঞার রেশ আছড়ে পড়ছে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের বাঁধা গান গাইছেন ভোপালের ছাত্রযুবরা, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কেরল, তামিলনাড়ু, সর্বত্র কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল, নাড়াবাজি চলছে। উড়ে আসছে দেশবিদেশের সমর্থন। এমনকি UN-এর সেক্রেটারি জেনেরালের মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। আজকের ভারত বনধকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভূতপূর্ব বিরোধী ঐক্য। সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে এই কালা কানুনের বিরোধিতা করছে। সামনে পথ দেখাচ্ছেন হলধারী। এখন পেছনে না ফিরে শুধু এগিয়ে যাওয়ার সময়।

করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4655 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুব পরিষ্কার একটা চিত্র উঠে এসেছে লেখাটির মাধ্যমে।

Leave a Reply to অচিন্ত্য Cancel reply