ডোকরা গ্রামের গল্প

সোহিনী দেবরায় 

 

ডোকরার গয়না পছন্দের তালিকায় অন্যতম জায়গা করে নেওয়ার পর থেকেই গুসকরার কাছে দরিয়াপুর গ্রামে ডোকরা শিল্পের আঁতুড়ঘরখানা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ব্যস্ত জীবনে খানিক ফুরসত মিলতেই কয়েকজন বন্ধু মিলে চলে গিয়েছিলাম দরিয়াপুরের এই ডোকরা গ্রামে। বড় রাস্তার পাশেই গ্রামে প্রবেশ করার সুসজ্জিত তোরণদ্বার। ডোকরার সূক্ষ্মচিত্র দিয়ে বানানো তোরণদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর এগোলেই পড়বে বেশ কিছু দোকান, দোকানের ওপরে অতিথি নিবাস। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ডোকরা শিল্পীদের হাতে বানানো নিঁখুত সব সামগ্রী আপনার চোখ টানবে। আপনি অধীর আগ্রহে সেসব দেখা শুরু করতেই দোকানি সলজ্জ হাসি হেসে আপনার হাতে বাড়িয়ে দেবে এক জোড়া কানের দুল, খোঁপার কাঁটা, হাতের বালা কিংবা গলার হার। গ্রাম্য ভাষায়, সরল বিশ্বাসে আপনাকে বলবে, ‘দিদি, ইটা খুউউব মানাবে’…। বা আরেকটু প্রশ্র‍য় পেলে কানের দুলখানা আপনার কানে ধরেও দেখিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে সরল হাসি হাসতে পারে। আপনি কিনলে দ্বিগুণ খুশিতে ডগমগ হয়ে সে আপনার হাতে আপনার পছন্দ করা সামগ্রী তুলে দেবে। আর নিতে না চাইলে মৃদু হেসে মাথা নামিয়ে নেবে। দোকানির সে মৃদু হাসিতেই ধরা পড়বে ডোকরা শিল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা ডোকরা গ্রামের গল্প, ডোকরা শিল্পীদের জীবনযাপনের গল্প, লকডাউনে ডোকরা শিল্পের ক্ষতির গল্প, আরও আরও অনেক না বলা গল্প।

দোকানগুলো পেরিয়ে একটু গেলেই দরিয়াপুর গ্রাম। গ্রামে এখন ৪৫টি ঘর মিলিয়ে মোট ৮০টি পরিবার থাকে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলছে, বড়রা বাড়ির সামনে থাকা পথটিকেই ‘উঠোন’ জ্ঞানে সেখানে বসে চাল বাছছে কিংবা শাড়ি পেতে ‘ফলস’ লাগানোর কাজ। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে মাত্র কয়েক বছর হল। এলেও খুব প্রয়োজন ছাড়া তারা বিদ্যুতের অপচয় করে না। দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেশিরভাগ কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করে। লকডাউনের প্রভাব গ্রামজুড়ে ফুটে উঠেছে। ডোকরা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে, অন্য পেশায় জড়িয়ে থাকা অনেকেই কাজ হারিয়ে বেশ অভাবের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। তবু গ্রামে বাইরের মানুষ দেখে হাসিমুখে আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। গ্রামের পথে কোনও ছোট ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সেই প্রবল উৎসাহিত হয়ে ছোট্ট গ্রামটাকে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুরিয়ে দেখার দায়িত্ব নিয়ে নেবে।

গ্রামে ঘোরার সময়েই এক অভিজ্ঞ শিল্পীর সঙ্গে দেখা হল। ভদ্রলোক প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গেই যুক্ত। খুব ছোটবেলায় ঠাকুর্দা আর বাবার পাশে বসে কাজ করতেন। তারপর বাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতেন। আরও পরে নিজে তাঁর তিন ছেলেকে এই কাজ শিখিয়েছেন। এখন বড় ছেলের ঘরের নাতিকে নিয়ে ডোকরার কাজে বিভিন্ন ‘ইন্সট্রাকশন’ দিতে বসেন। এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দিচ্ছেন এই সূক্ষ্ম শিল্পকলা।

তিনিই বলেছিলেন যে, ডোকরা হল “হারানো মোম ঢালাই” পদ্ধতিতে তৈরি একটি শিল্পকর্ম, যা প্রায় ৪০০০ হাজার বছরের পুরনো। সিন্ধু সভ্যতার শহর মহেঞ্জদারোতে প্রাপ্ত “ড্যান্সিং গার্ল” বা “নৃত্যরত নারীমূর্তি” হল ডোকরা শিল্পের প্রাচীনতম নিদর্শন। ভারত ছাড়াও চিন, মালয়েশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে এই শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়।

মনে করা হয় ভারতে মধ্যপ্রদেশের বস্তার ও ছত্তিশগড়ে এই শিল্পের উদ্ভব হলেও পরে ঝাড়খণ্ড ও বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। আরও পরে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্যে এই শিল্পের প্রসার ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে ডোকরা শিল্পের আগমন ঘটে আজ থেকে কয়েকশো বছর পূর্বে। প্রধানত ঝাড়খণ্ড থেকে এই শিল্প পুরুলিয়া হয়ে রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের বিভিন্ন জেলায় (বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর) ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিকনা, খাতড়ার লক্ষীসাগর, লাদনা, ছাতনা, শববেড়িয়ার মানুষেরা ডোকরা শিল্পের কারিগর হলেও বর্ধমান-গুসকরার দরিয়াপুর ও পুরুলিয়ার নাডিহায় ডোকরা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলো অবস্থিত। এদের মধ্যে বাঁকুড়ার বিকনা ও বর্ধমানের দরিয়াপুর— এই দুই জায়গার ডোকরা শিল্পের প্রসিদ্ধি জগৎজোড়া।

ডোকরা শিল্প, মোল্ডিং চুল্লিভাটি, ডোকরা শিল্পীদের জীবনযাপন সবকিছু এত সামনে থেকে দেখে জানতে পারলাম এই সূক্ষ্ম শিল্প নির্মাণের জটিল পদ্ধতিও। প্রথমে শিল্পীরা পুকুর থেকে লাল বা সাদা মাটি সংগ্রহ করে ও মাটির মণ্ড তৈরি করেন। দ্বিতীয় ধাপে, মাটি দিয়ে হাতে করে একটি অবয়ব তৈরি করেন। তৃতীয় ধাপে, অবয়বটির উপর মোম, তেলের প্রলেপ দেওয়া হয়। শেষে নরম মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। চতুর্থ ধাপে, এটিকে পোড়ানো হয়। ফলে মোম গলে একটি ছিদ্র দিয়ে বাইড়ে বেরিয়ে আসে। পঞ্চম ধাপে, গলানো পিতল  ঐ ছিদ্র দিয়ে ঢালা হয় এবং শক্ত হলে মূর্তিটি সংগ্রহ করা হয়। মূর্তিটি এরপর শিরিষ কাগজ দ্বারা ঘষে উজ্জ্বল করা হয়। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব শিল্পকলা।

 

যাওয়া কঠিন কিছু নয়। হাওড়া থেকে বোলপুর বা রামপুরহাটগামী কোনও ট্রেন পেলে সেই ট্রেনে উঠে গুসকরা স্টেশনে নেমে পড়ুন। গুসকরা স্টেশন থেকে টোটোতে যেতে পারেন। ডিরেক্ট ট্রেন না পেলে বর্ধমান এসে এখান থেকে ট্রেন পাল্টেও গুসকরা যেতে পারেন। বাসে যেতে চাইলে বর্ধমানের নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে গুসকরার বেশ কিছু বাস পাবেন। এছাড়া তো রইলই নিজেদের পছন্দমতো বাহনে চড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। গুগল ম্যাপে দরিয়াপুর ডোকরা গ্রাম লিখে সার্চ করে যেভাবে খুশি যেতে পারেন।

যদি অনেক দূরের পথের যাত্রী হন, থাকার ব্যাপার থাকছেই। এখানে একটি অতিথিশালা আছে৷ গিয়ে বা আগে অনলাইনে বুক করার ব্যবস্থা আছে। তবে কেউ শুধু দরিয়াপুর দেখতে বহুদূর থেকে আসে না, তারাপীঠ কিংবা শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পথে দরিয়াপুরকে একটা ছোট্ট ঘোরার-কেনার জায়গা বানিয়ে নেয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লেখাটি এই দুঃস্থ সময়ের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, তবে এই শিল্পের নান্দনিকতা নিয়ে আলোচনা জরুরি ছিল। বিশেষত ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের অবদান। যদিও মীরা মুখোপাধ্যায় বস্তারের ঘাড়ুয়া শিল্পীদের কাছ থেকে এই শিল্পকর্ম শিখে কলকাতার দক্ষিণে বারুইপুরের দিকে তাঁর মুচি(ভাঁটি) বসিয়ে ছিলেন। তবে আজকের ডোকরা শিল্পের নান্দনিকতা, স্টাইল এসব তাঁর অবদান। ঠিক যেমন কালীঘাটের পট আলোচনায় আজ আমাদের যামিনী রায়ের অবদানের কথা বলতে হয়, ডোকরা শিল্পে তেমন মীরা মুখোপাধ্যায়। আশাকরি, আগামীদিনে এই শিল্পের সার্বিক আলোচনায় বিষয়টা উল্লেখ থাকবে

    দেবকুমার সোম

Leave a Reply to দেবকুমার সোম Cancel reply