এঁদের আক্রমণের লক্ষ্য সেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদের সমাজবিজ্ঞান পড়ানোর ক্ষেত্রে সুনাম আছে

রোমিলা থাপার

 

সাক্ষাৎকার : করন থাপার

আপফ্রন্টের পক্ষ থেকে করন থাপার রোমিলা থাপারের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কিছুদিন আগে। গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করে তার বাংলা অনুবাদ আমরা প্রকাশ করছি। পুরো সাক্ষাৎকারের ইউটিউব লিঙ্ক লেখার শেষে দেওয়া হল।

আপফ্রন্ট দেখার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। মোদি সরকারের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে ও নতুন সাধারণ নির্বাচনের প্রচার চলছে। সরকার ও তার কাজকর্ম নিয়ে ভারতের মুখ্য চিন্তকদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারের এই সিরিজের অন্তর্গত আজকের সাক্ষাৎকারে উপস্থিত রয়েছেন আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার।

আমরা মোদি সরকারের বিগত পাঁচ বছরের কাজের দিকে চেয়ে আলোচনা শুরু করি। সরকারের গত পাঁচ বছরের কাজকর্মের সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ন কীরকম?

বেশ। তবে আমি আরেকটু আগের থেকে শুরু করতে চাই এই বলে, যে এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। যদিও এই কথা প্রায় সমস্ত নির্বাচনের সম্বন্ধেই বলা হয়ে থাকে, কিন্তু আমার মতে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে দু’টি কী তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। এক নম্বর, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন। দ্বিতীয়, ১৯৭৭ সালের নির্বাচন যেখানে ভারতের সাধারণ মানুষ একনায়কতন্ত্রের একটা সম্ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আর আমার মতে এই নির্বাচন হল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। আজ চারদিকে যা ঘটতে দেখছি, গত পাঁচ বছর ধরে যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, তার থেকে ভবিষ্যতের জন্য খোলা থাকছে মাত্র দুটো পথ— হয় হিন্দুরাষ্ট্র-ধরনের সরকার, নয়তো ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার। আমার মতে ব্যাপারটা অত্যন্ত পরিষ্কার, এবং এই কারণে, এই বেছে নেওয়ার প্রশ্নেই এই নির্বাচন এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো পথে ভাগ হয়ে যাওয়া— এটা হয়েছে গত পাঁচ বছরের জন্য।

গত পাঁচ বছরকে কীভাবে দেখেন?

কীভাবে দেখি? বেশ। আমার মনে হয়, তিন ধরনের কাজের হিসাবে গত পাঁচ বছরকে ভাগ করা যেতে পারে। মানে আমি অন্তত সেইভাবে দেখছি। প্রথম অবশ্যই সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, যেমন ডিমনিটাইজেশন, কৃষকদের ও গ্রামীণ অর্থনীতির দুরবস্থা— এই ধরনের বিষয়গুলো যেগুলো একেবারে সঠিক কারণেই বহুল চর্চার মধ্যে আছে।

কর্মসংস্থান…

হ্যাঁ। অবশ্যই কর্মসংস্থান। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবের মধ্যেকার দুস্তর ব্যবধান অবশ্যই অন্যতম ব্যর্থতা।

আপনি বলছেন অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি পালন করা হয়নি।

পালন করা হয়নি। তবে লক্ষ করার মতন বিষয় হল, ওঁদের নির্বাচনী বক্তৃতায় এসবের উল্লেখ প্রায় নেই বললে চলে। জগৎসংসারের বাকি সবকিছু, মায় ব্যক্তি-আক্রমণ, সব আছে। কিন্তু এই জরুরি বিষয়গুলো নেই। বিজেপি, কংগ্রেস আর অন্যান্য দলের মধ্যে নানান বিষয়ে আকচাআকচি হচ্ছে, কিন্তু এই বিষয়গুলো…

আর দু’নম্বর?

দু’নম্বরে বলব ‘হিন্দুত্ব’ প্রকল্পের কথা। হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবার একটা পরিষ্কার চেষ্টা। এর মধ্যে কিছু উদ্দেশ্য অবশ্য তেমন সফল হয়নি, যেমন ঘর ওয়াপসি, লাভ জিহাদ। এগুলো একটা স্তর অবধি গিয়ে বন্ধ হয়েছে। আপনি কাউকে হিন্দু বানাতে পারেন, কিন্তু তার জাত কী হবে? এমন কিছু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সবথেকে ভয়ঙ্কর যে ব্যাপারটা, সেটা গো-রক্ষার। গোমাংস ভক্ষণ আর গোহত্যার ব্যাপারে এঁদের তৈরি করা আতঙ্ক অনেকাংশে সফল হয়েছে। সংখ্যালঘুদের অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া গেছে।

তিন?

তিন নম্বরের বিষয়টা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না, যদিও আমার মতন অনেকের কাছেই সেটা চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। সেটা হল সমালোচকের কণ্ঠরোধ। সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, আইনজীবী, কবি, লেখক— এঁদের দোষী সাব্যস্ত করে, কোনও আইনি প্রক্রিয়ার পরোয়া না-করে, এঁদের অপরাধের কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা দিক। এছাড়া বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সিনেমার ওপর সেন্সরশিপ। সবচেয়ে নিন্দনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেষ করে ফেলবার চেষ্টা।

ওই বিষয়ে আমি আরও বিশদে আলোচনা করতে চাই। তবে একটু পরে। তার আগে আপনার সামনে কিছু বিষয় রাখতে চাই, যে ক্ষেত্রগুলোতে মোদি সরকার চূড়ান্ত সফলতা দাবি করেন। এক, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সরকার। রাফেল ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন আছে জানি, তবু টুজি, বা কোলগেট, বা অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড বা কমনওয়েলথ গেমসের মতো তেমন কোনও কেলেঙ্কারির কথা এখনও শোনা যায়নি যাতে একেবারে ‘স্মোকিং গান’ ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আপনার কি মনে হয় না এই সরকার বিগত সরকারের তুলনায় পরিচ্ছন্ন?

এইসমস্ত কেলেঙ্কারির কথা বলতে পারি না। আজ কিছুই নেই, হয়ত কাল দেখা গেল নতুন প্রমাণ-টমান নিয়ে সে একেবারে সব চেনা ছক উল্টেপাল্টে দিল। তবে এই পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে আমার একটা প্রশ্ন আছে। ডিমনিটাইজেশনের সময় বলা হল সব দুর্নীতি এইবারে শেষ হয়ে যাবে।

হল না।

একেবারেই হল না। এই ধরনের দাবি একেবার হাতে চাঁদ ধরতে চাইবার মতো আসলে। কর্পোরেটদের মধ্যেকার দুর্নীতি এবং তাদের এই দুষ্কর্মে এক শ্রেণির রাজনীতিকদের সমর্থন— চিরকাল দেখে আসছি, আর মনে হয় চিরকাল দেখে যেতেও হবে।

বিগ-টিকেট করাপশন।

হ্যাঁ, তাই। আমার ভাবনার কারণ হল, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতি তো যায়ইনি, বরং বেড়েছে। সরকারি দফতরে, থানায়, নিত্যনৈমিত্তিক নানান কাজে— দুর্নীতি বেড়েছে বই নয়। যে কোনও কাজ করাতে গেলেই কিছু বেশি পয়সা খরচ।

আম আদমির জন্য দুর্নীতির দুর্গতি বেড়েছে।

অবশ্যই।

মোদি সরকারের দ্বিতীয় দাবি— দেশকে দৃঢ় নেতৃত্বদানের প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে উনি কি সত্যিই দৃঢ় নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন বলে আপনি মনে করেন, নাকি দৃঢ় হবার বদলে উনি একপ্রকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন?

আমার মনে হয়, উনি সুশাসনের জন্য যেসব বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরি, সেগুলো বাদ দিয়ে যে বিষয়গুলোতে উনি প্রচার পেতে পারেন তাতেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন।

প্রচারসর্বস্বতা।

প্রচারসর্বস্বতা।

মানে আত্মপ্রচার।

তেমনই মনে হয়। দেখুন, প্রায় সমস্ত রাজনীতিবিদই প্রচার পছন্দ করেন। এ-কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। কথা হল, পরিমিতিবোধ। যেটা বলতে চাইছিলাম, ধরুন আমাদের বিদেশনীতি। আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনও বিদেশনীতি আদৌ আছে কি? হ্যাঁ, আমাদের কাছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ওঁর আলিঙ্গনের অজস্র ছবি আছে। কিন্তু এই সমস্ত আলিঙ্গনের ফলটা কোথায়? বিদেশনীতির নিরিখে? আমাদের চারপাশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদানগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কেমন হওয়া উচিত? এগুলো নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই।

আপনি মনে করছেন ওঁর বিদেশনীতি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কৌশলগত অনুধ্যান নয়, আদতে আত্মপ্রচার।

ঠিক।

এবারে এমন একটা বিষয়ে আসি যেখানে আপনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শিক্ষাক্ষেত্রে মোদি সরকারের নীতিসমূহের প্রভাব। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিকাল রিসার্চ বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ— এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকারের মনোভাব দেখে অনেকেই বেশ উদ্বিগ্ন। এ-বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

আমিও। আমিও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। একজন সাধারণ শিক্ষাবিদের থেকে আমার উদ্বেগ বরং কিছুটা বেশিই, কারণ আমি নিজের চোখে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেখেছি। দেখেছি কিছু মানুষ— যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে এই সার্থক প্রতিষ্ঠানগুলো তিলে তিলে গড়ে উঠেছে— কীভাবে তাঁদের একে একে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হল— কেন এভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে? কেন অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে?

কী মনে হয় আপনার?

আমার মনে হয় এই সব কাজের আড়ালে যে কারণ, তা বিজেপি ও আরএসএসের চূড়ান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই লক্ষ্য হল— এই দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রের চেহারা দেওয়া। এঁরা তো খোলাখুলিই বলছেন যে এই দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তুলতে হবে।

সুতরাং এঁরা এইসব প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের অধিকারকে খর্ব করে নিজেদের অভীষ্ট সিদ্ধ করতে চাইছেন।

একেবারেই তাই। এই হিন্দুরাষ্ট্রের ব্যাপারটাকে আমি কীভাবে দেখি সেটাও একটু বলে দেওয়া দরকার। নইলে কেন আমার এই উদ্বেগ এটা বোঝানো সম্ভব হবে না।

এই তত্ত্বের প্রচার শুরু হয় গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। এই তত্ত্বের শিকড় রয়েছে দুটো ব্যাপারের মধ্যে। প্রথমটা হল ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে ভারতকে দেখা এবং বোঝা— ১৮১৮ সালে জেমস মিল-প্রণীত বইতে আপনি যেমন পাবেন। সেখানে ভারতের ইতিহাসকে উনি হিন্দু, মুসলিম ও বৃটিশ এই তিনভাগে ভাগ করলেন। বললেন— ভারত চিরকালই হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সদা-যুযুধান জাতিতে বিভক্ত। বুঝতেই পারছেন, এই বইতেই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ। এবং এই দ্বিজাতিতত্ত্বের থেকেই হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তি।

আর আপনার মতে এটাই বিজেপি দলটারও আদর্শগত ভিত্তি?

হ্যাঁ। আরএসএসের ওপর দ্বিতীয় প্রভাব ফেলে ইউরোপের ফ্যাশিজম। আরএসএসের নেতারা বলেছেন, এবং লিখেছেনও, যে ওঁরা মুসোলিনি এবং ইতালীয় ফ্যাশিস্তদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এবং আরএসএসকে ওঁদের দেখানো পথেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। হয়তো সেই কারণেই আরএসএস এতটা সুসংগঠিত।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইব, এই যে স্কুলের পাঠ্যবইতে বদল আনা হচ্ছে, এবং এ-নিয়ে আপনার মতো শিক্ষাবিদেরা যে এতটা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, তার কারণ কী? কেনই বা আপনারা এর বিরোধিতা করছেন?

কারণ এগুলো মৌলবাদ ছাড়া কিছু নয়। এভাবে ইতিহাস বদলের চেষ্টা দেখে আমি সত্যিই আতঙ্কিত। আপনি যদি ইতিহাসের পাঠ্যবইকে নিজের সুবিধামতন বদল করে নিতে পারেন, তবে হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বটাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। হিন্দুরাষ্ট্রে হিন্দুরাই প্রাথমিকভাবে নাগরিক, কারণ হিন্দুদের পূর্বপুরুষেরা এ-দেশেই জন্মেছেন, হিন্দুধর্মেরও সূত্রপাত হয়েছে এ-দেশেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে স্বাভাবিকভাবে ক্রিশ্চান, মুসলমান, পার্সি এঁরা সকলেই বাদ পড়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারলে এ-সবই প্রমাণ করে দেওয়া সম্ভব।

আপনি বলছেন পাঠ্যবইয়ে বদল আনার চেষ্টাটা আসলে হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্যই।

কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়।

প্লিজ…

বেশ। প্রথমে ধরা যাক ‘আর্য’দের কথা। ইতিহাসবিদেরা আর্য শব্দটিকে জাতিগত অর্থে ব্যবহার করেন না। সংস্কৃতি— বা ভাষাগত অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যাই হোক, এঁদের, মানে হিন্দুত্ববাদীদের, বক্তব্য হল যেহেতু বৈদিক ধর্মই হিন্দুধর্মের ভিত, সেহেতু ‘আর্যেরা’ আদতে ভারতের আদি বাসিন্দা। এঁরা কোনওমতেই এ-দেশে বহিরাগত নন। এবারে, যা সমস্ত ভাষাগত, প্রত্নতাত্ত্বিক এমন কী জিনগত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে এই ধারণা একেবারেই ভুল, ভিত্তিহীন। তবু এঁরা অনড়। মানবেন না।

তার কারণ এঁরা বিশ্বকে, বা হয়তো নিজেদেরই, বোঝাতে চান যে আর্যদের জন্ম ভারতেই। তাঁরা বহিরাগত নন। এবং সেই তত্ত্বকে জমি দেবার লক্ষ্যে এঁরা প্রমাণিত সত্যগুলোকে বদলে দিতে চান, যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় প্রমাণিত সত্যের উপরেই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা পাবার কথা।

আরেকটা উদাহরণ কুতব মিনারের। এঁদের বক্তব্য কুতব মিনার তৈরি করেছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। এখন, সমুদ্রগুপ্ত কুতব মিনার তৈরির সময়ের থেকে সাত কী আটশো বছর আগের মানুষ। কুতব যেখানে তৈরি, তার নীচে কোনও মন্দির থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। আশপাশের মন্দিরগুলোও বড়জোর মধ্যযুগে তৈরি।

তার মানে এই তত্ত্ব একেবারেই ভিত্তিহীন।

একেবারে ভিত্তিহীন।

আপনাকে আর উদাহরণ দিতে বলছি না কারণ আপনি যা বলতে চেয়েছেন তা আমি বুঝতে পারছি। এই একই সমস্যার বরং অন্য আরেকটা দিক নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করি। সেটা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এই সরকারের আক্রমণের দিক। এই বিশ্ববিদ্যালয় আপনার অত্যন্ত কাছের। এখানে আপনি পড়িয়েছেন। আপনি দেখছেন কীভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিদ্বেষ উগরে দেওয়া হচ্ছে। কানহাইয়া কুমার আর উমর খালিদের মতন ছাত্রদের ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ বলে অভিহিত করছেন খোদ নরেন্দ্র মোদি এবং অরুণ জেটলির মতো নেতারা। সরকারের চোখে জেএনইউ এখন বামপন্থী চরমপন্থা চর্চার দুর্গবিশেষ। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে জেএনইউকে আপনি চেনেন। এই প্রতিষ্ঠানকে এভাবে ভূষিত করা— এ-বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

এই ধরনের কথা আমি একেবারেই মানি না। এগুলো একেবারে রাজনৈতিক মন্তব্য, এবং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে আমি মনে করি। জেএনইউয়ের প্রতি এই আক্রমণের একটা প্রেক্ষাপট আছে…

আমাদের হাতে আর মিনিট দশ সময় আছে…

হ্যাঁ, ছোট করে বলার চেষ্টা করছি। জেএনইউয়ের সূচনাকালে আমি ছিলাম ছ’জন অধ্যাপকের একজন। শুরু থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জেএনইউকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে একেবারে প্রথম সারির করে তুলতে হবে। এমন মানের, যা হবে সারা বিশ্বের কাছে গ্রাহ্য। এই কাজে আমরা সফল হয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম— এই প্রতিষ্ঠান এমনভাবে গড়ে উঠুক যেখানে সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। তর্ক, আলোচনা, সমালোচনা করা যাবে। সে ক্লাসের ভেতরে হোক কী বাইরে, ধাবায় খেতে খেতে। আর তিন নম্বর হল, সমাজের সমস্ত স্তর থেকে যেন ছাত্র আসে, এই বিষয়ে আমরা যত্নবান হয়েছিলাম। কারণ শিক্ষাতত্ত্ব থেকে আমরা জানতাম— উৎসস্থল যত প্রসারিত হবে, তত বেশি সংখ্যায় মেধাবী ছাত্র পাওয়া সম্ভব হবে। প্রথম এনডিএ সরকারের থেকে আক্রমণের সূচনা হল। আমাদের বলা হল আমরা ভারতবিদ্বেষী, হিন্দুবিদ্বেষী। আমাদের পাঠ্যবইগুলোও তুমুলভাবে সমালোচিত হল। আমাকে বলা হল আমি একজন ‘অ্যাকাডেমিক সন্ত্রাসী’! এমন একটা অভিধা পেয়ে খুবই মজা পেলাম বলাই বাহুল্য। দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের ক্ষেত্রে দেখলাম— এঁরা অনেক বেশি গোছানো, আঁটঘাট বাঁধা। এঁরা কেবলমাত্র জেএনইউকেই আক্রমণ করছেন না। এঁদের আক্রমণের লক্ষ্য সেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদের সমাজবিজ্ঞান পড়ানোর ক্ষেত্রে সুনাম আছে। কেন? কারণ সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার এমন একটা ধারা যেখানে সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা হয়, কাঁটাছেঁড়া করা হয় এবং সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা হয়।

এবং সেটা সরকারের অস্বস্তির কারণ।

কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী এমন যে কোনও সরকারের অস্বস্তির কারণ যাঁদের উদ্দেশ্য দেশের প্রকৃতিকে আমূল বদলে দেওয়া।

সরকারের হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে যাবার চেষ্টাগুলোকে ক্রমাগত খাটো করে দেখে বলে এই ধরনের প্রশ্ন সরকারের কাছে সম্ভবত মূলগতভাবে অস্বস্তিকর।

হ্যাঁ। হিন্দুরাষ্ট্রের বিরোধী হিসাবে আমাদের ভূমিকা খুবই সদর্থক।

মোদি সরকার সম্ভবত বলবেন যে তাঁরা জেএনইউ বা আইসিএইচআরের ঠিক তা-ই করেছেন যা আগের অন্য সরকারেরাও করেছেন। অর্থাৎ সরকারের সমর্থক ও সহযাত্রীদের এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে দেওয়া। পার্থক্য সম্ভবত একটা জায়গায়। এই ক্ষেত্রে এই সমর্থকরা আদর্শগতভাবে আগের জনেদের থেকে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে রয়েছেন। সেই কারণে আপনার মতো মানুষেরা নিজেদের অবহেলিত মনে করছেন, এবং এঁদের সমালোচনা করছেন।

একেবারেই ঠিক নয়। আমি, বা আমার মতো অন্য যাঁরা আছেন, আমরা কোনওদিনই কোনও সরকারি কমিটিকে স্থান পাবার জন্য লালায়িত ছিলাম না। সারা জীবনে কখনওই এইসব নিয়ে আমরা ভাবিনি। বরং চেয়ে এসেছি, বলেওছি, যে শিক্ষাক্ষেত্রের মহিমা নির্ভর করে কার্যনির্বাহী সদস্যদের হাতে প্রদত্ত ক্ষমতার ওপর। জেএনইউ শুরু হলে এই বিশ্ববিদ্যালয় এমন একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত হয়, যেখানে উদারবাদ ও মার্ক্সবাদ এই দুই বিষয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা যায়।

এমন বিষয় যেগুলো এই সরকার দেশদ্রোহী বলে মনে করতে পারেন?

অবশ্যই! সব বিষয়। ধরা যাক অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, আধুনিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি।

আপনার মতে এই বিষয়গুলোকে মোদি সরকার সবথেকে অপছন্দ করেন?

হ্যাঁ। এই বিষয়গুলো নিয়ে ওঁদের বোঝাশোনা কম। এমনকি কোনও উঁচুদরের পণ্ডিতও ওঁদের দলে নেই।

তাই ওঁরা ভয় পান?

তাই ভয় পান। আর সেই কারণেই জেএনইউ ছাড়াও হায়দরাবাদ, টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস— এসবই… সারা দেশেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখুন…

বেশ। আচ্ছা, ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের পাঁচ বছরের কাজকর্মের প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কী মনে করেন?

প্রভাব বলতে গেলে— এক নম্বর এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর নামিয়ে আনা আঘাত, তবে নতুন কায়দায়। অনুপ্রবেশ। পদ খালি হলেই নিজের লোককে সেখানে ঢোকানো। আর এই সমস্ত পদাধিকারীদের অধিকাংশই— আমার বলতে খারাপ লাগছে— নিম্নমানের। যে ধরনের মেধাচর্চার মধ্যে দিয়ে এলে এই সব পদের যোগ্য হয়ে ওঠা যায় তার কিছুই ওঁরা করেননি।

ওঁরা নিম্নমানের লোকজন আনছেন।

হ্যাঁ নিম্নমানের লোকজন।

শুধু সমর্থক বলেই আনছেন। এদিকে তাঁদের যোগ্যতাই নেই।

হ্যাঁ অযোগ্য। আর সেই কারণেই এই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান পড়তে শুরু করেছে।

এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান মেধাল্পতার রোগে ভুগতে শুরু করেছে।

এ-কথা ভেবে আজকাল ভয় হয়, যে জেএনইউয়ের মতো প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বৌদ্ধিক অধিকার বা শিক্ষক ও ছাত্রের অধিকার বজায় রাখার লড়াইটা না লড়তে পারে, তবে এর মান পড়তে বেশি সময় লাগবে না।

সুতরাং আপনার বক্তব্য জেএনইউয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ঘোর বিপদ।

হ্যাঁ, বিপদ তো বটেই।

আচ্ছা, যদিও এই নির্বাচনের ফল কী হবে আমরা জানি না, তবু আপনাকে প্রশ্ন করি— আরেকটা মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার অর্থ আপনার কাছে কী? আপনার কাছে, বা দেশের শিক্ষকদের কাছে।

চূড়ান্ত আঘাত নেমে আসবে। যেভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে— কোর্স নিয়ে, রিডিং লিস্ট নিয়ে, কনফারেন্স নিয়ে— কোথায় আপনি যেতে পারবেন আর কোথায় পারবেন না— এরপর হয়তো বাইরে থেকে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোই বন্ধ করে দেবে। অনুমতি চাইতে হবে, অনেক ক্ষেত্রেই যা পাওয়া যাবে না। জেএনইউতে কৃষ্ণ ভরদ্বাজ লেকচার সিরিজ চালু আছে। ভরদ্বাজ ছিলেন খুবই মান্যগণ্য অর্থনীতিবিদ এবং জেএনইউয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রতি বছর কোনও না কোনও হলে এই অনুষ্ঠানটা হত। এবার বলা হল অনুমতি লাগবে।

কার অনুমতি?

অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমতি। গেল বার এই অনুমতি মেলেনি। আমরা এই অনুষ্ঠান মাঠে, খোলা আকাশের নীচে করতে বাধ্য হয়েছি। যদিও লোক হয়েছিল প্রচুর।

আপনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কথা বললেও আমার মনে হচ্ছে সরকারের কারও অঙ্গুলিহেলনে উপাচার্য অনুমতি না-দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সেটা আমি বলতে পারব না। এটুকুই বলতে পারি— এই সমস্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পদাধিকারীরই সিদ্ধান্ত নিতে পারার কথা।

আগের কোনও সরকারের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে?

কোনওদিনও নয়। আমরা হতেও দিইনি কখনও। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আমরা চিরকালই অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই স্বাধীন চিন্তার ভিত্তির ওপরেই জেএনইউয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

কখনও হতে দেননি বলছেন। এর মানে কি এই, যে আপনার মতন মানুষ, শিক্ষকেরা বা ছাত্রনেতারা— যাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস রাখেন, সরকারের চাপে জেএনইউতে এঁদের সংখ্যা কমে এসেছে?

কমে এসেছে এ-কথা বলা ঠিক নয়। এখনও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা এসব দেখে সত্যিই চিন্তিত। তবু তো পড়াতে পড়াতে, বা এখানে কাজ করতে করতে মনে হতেই পারে যে আর পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।

ক্লান্তি আসে।

ক্লান্তি আসে। ঠিক।

আরও পাঁচটা দায়দায়িত্বের চাপে হাল ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়।

ঠিক।

আমাদের হাতে আর পাঁচ-ছ মিনিট সময় আছে। নির্বাচনী প্রচার নিয়ে আলোচনায় আসতে চাই। অনেকেই মনে করছেন এই নির্বাচনে মোদিজি গত পাঁচ বছরে তাঁর কাজকর্মের ভিত্তিতে ভোট চাইছেন না। বরং পাকিস্তানের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে দুশ্চিন্তা তৈরি করে, হয়তো বা ভয় তৈরি করেও, আসন্ন বিপদে একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছেন। আপনি একমত?

সেরকমই তো মনে হচ্ছে সব দেখেশুনে। ওঁদের নির্বাচনী বক্তৃতা যদি শোনেন— একেবারে আজগুবি। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অমিত শাহ বলে বসলেন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন আর শিখ নাগরিকদের কথা। কেউ মনে হয় ওঁকে অন্যান্য নাগরিকদের কথাও মনে করালেন। তখন ওই ‘অন্যান্য’-টা জুড়ে দিলেন। এই ধরনের ভাবনার মূল নিহিত আছে ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায়। বৃটিশ শাসকেরা ‘হিন্দু’ সংজ্ঞায় হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদেরই ধরতেন। এই ব্যাপারগুলোই অত্যন্ত অস্বস্তিকর।

তো আমরা সেই ধরনের ভাবনার দিকে পিছিয়ে চলেছি। খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এই ধরনের ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা তো আমরা আর ফিরে পেতে চাইব না।

এই অবস্থায় আপনার কাছে দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য? বিজেপির তৈরি করা একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার না কি বিরোধী দলগুলোর তৈরি করা একটা কোয়ালিশন সরকার, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যার প্রধানমন্ত্রী কে হবেন আমরা জানতে পারব না? আজকের নিরিখে কোনটা চাইবেন?

নির্দ্বিধায় দ্বিতীয়টা। আমি মনে করি একটা কোয়ালিশন সরকার এই মুহূর্তে আমাদের দেশের ভাবনাচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে যোগ্যতর মাধ্যম হতে পারবে। খুবই দুশ্চিন্তার সঙ্গে এই কথা বলছি, কারণ সব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতির ধরনটা কেন্দ্র ও তার পরিধির মতো হয়ে উঠছে। কেন্দ্রের নিয়ামক কিছু সংখ্যক মানুষ যাদের চোখে দেশটা মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা বই কিছু নয়, যেখানকার মানুষেরা হিন্দিতে কথা বলে, হিন্দু দেবদেবীর পুজোআচ্চা করে। এইসব মানুষের প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই। কিন্তু এঁরাই পুরো দেশ নন এটা মাথায় রাখতে হবে। দেশের অন্যান্য অংশের মতো এঁরাও দেশের একটা অংশ। এই সমস্যাটা চিনে নিতে না-পারলে অন্যান্য বড় দেশের মতো আমরাও কেন্দ্র ও পরিধির মধ্যে চিরস্থায়ী সঙ্কটের আবর্তে পড়ে যাব। পরিধির আরও অনেক বেশি মনোযোগ প্রাপ্য, এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে।

সুতরাং ভারতের পক্ষে শক্তিশালী ২৭২ সিট জেতা দলের সরকারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের সরকার বেশি গ্রহণযোগ্য বলে আপনি মনে করছেন?

দুর্বল আমি বলব না।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আরও অনেকটা শ্রদ্ধাশীল?

হ্যাঁ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার মুখের কথা কেড়ে নিলেন। এমন সরকার চাই যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বুঁদ হয়ে না-থাকা সমগ্র দেশটার প্রতি আরও নজর দেবেন।

আমাদের হাতে সময় মাত্র তিন মিনিট। বিরোধী দলগুলোর ব্যাপারে আপনার কাছে জানতে চাই— এঁদের প্রচার আপনাকে ভরসা দিয়েছে?

তেমন বলা যায় না। একজোট হবার প্রশ্নের এঁদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। এটা ঠিক যে শেষ পর্যন্ত একটা ম্যানিফেস্টো তৈরি হয়েছে। কিন্তু এসব আরও আগে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আরও ভালোভাবে, খুঁটিনাটির হিসাব দিয়ে। এই নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে আমার মনে হচ্ছে আমাদের দূরদৃষ্টির অভাব আছে।

সরকার ও বিরোধী দু’পক্ষেরই?

দু’পক্ষেরই। সরকারের দূরদৃষ্টিতে হিন্দুরাষ্ট্র আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সরকার হলে সেই দিকেই যাওয়া হবে।

বিরোধীদের কোনও দূরদৃষ্টি নেই?

নেই। আমাদের অল্প বয়েসে, ১৯৫০ কী ৬০-এর দশকে, যখন আমরা সদ্য নাগরিকত্ব অর্জন করেছি, খুব ভাবতাম আমাদের সমাজ কেমন হওয়া উচিত, তাতে আমাদের কী কী ভূমিকা পালন করা উচিত— এইসব। এখন নতুন করে এইসব প্রশ্নের মুখে আমরা আবার দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এমন কোনও ভাবনা বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমাদের আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। দেখা যাক, হয়তো এই নির্বাচনই এমন একটা অবস্থার জন্ম দেবে যা সাধারণ মানুষকে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বাধ্য করবে।

শেষ প্রশ্ন। রাহুল গান্ধিকে প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য বলে মনে হয়?

কাজ করতে শুরু না-করলে তো বলা মুশকিল।

এখনও পর্যন্ত ওঁকে যেমন দেখেছেন বা কথাবার্তা শুনে যা বুঝেছেন…

উনি কাদের কথা শুনে চলবেন, কোন কোন ধরনের পলিসি নেবেন তার ওপর নির্ভর করছে।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা।

হ্যাঁ খুবই।

অন্যদের চেয়ে বেশি করে ওঁর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

উনি অনভিজ্ঞ বলেই ওঁর পরামর্শদাতাদের একটা বড় ভূমিকা থাকবে।

খুবই বড় ভূমিকা থাকবে। শুধু ওঁর ক্ষেত্রেই নয়। বিরোধী দলগুলোর থেকে যে-ই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন— যেমন ধরা যাক মমতা…

মায়াবতী…

মায়াবতী…. যে কেউ। সমাজকে, দেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে হবে সেই সম্বন্ধে তাঁর একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকার খুব প্রয়োজন। এবং ধারণাকে বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতাদের।

আপনার মতে এই দূরদৃষ্টি এখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, আর একটা দিশা স্থির করে যা করণীয় তা করতে হবে যোগ্য পরামর্শদাতাদের সাহায্য নিয়ে।

ঠিক।

রোমিলা থাপার আপনাকে ধন্যবাদ।

খুব ভাল লাগল করন।

 

মূল সাক্ষাৎকার:

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাতকার প্রকাশের জন্য ৪ নম্বরপ্ল্যাটফর্ম-কে ধন্যবাদ।

  2. দুর্দান্ত কাজ…খুব প্রাসঙ্গিক, খুব দরকার….?????

Leave a Reply to সোহেল Cancel reply