মেধার করাত

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

শুধু তুমি সুস্থ হবে।
আমি দিয়ে দেব আমার কোজাগরীর চাঁদ,
শাদা দেয়ালের ময়ূরকণ্ঠী আলো,
দিয়ে দেব বিগত বছরের মরা পাখির মমতা,
আর আগামী বছরের কলাগাছটির স্বপ্ন।

(আরোগ্য, নবনীতা দেবসেন)

একটি উজ্জ্বল প্রাণবন্ত হাসি ও দুই মেধাবী চক্ষুর ছবিটি রয়ে গেল পাঠকের চিত্তে। এই লেখা যখন লিখছি তার ঠিক ঘণ্টাতিনেক আগে জেনেছি উনি নেই। উনি যে অসুস্থ সে কথাটা তার আগে থেকেই জানি। গত রবিবার, মানে ঠিক পাঁচ দিন আগে, এক পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, আক্রামক কর্কটরোগকে নিয়ে, আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি, জানিস আমি স্যান্ডো করি! সে লেখা সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তে ভাইরাল। এতটা প্রাণশক্তি নিয়ে, মৃত্যুকে এতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আর কারওকে লিখতে দেখিনি আমরা। না সাম্প্রতিক কালে, না অতীতে। জীবনকে একশো দশ শতাংশ বেঁচে নেবার কারিকুরি তিনি জানতেন, আমাদের শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। একজন কর্কটরোগীর মুখে এতটা জীবনকে ভালবাসার কথা শুনলে জীবনের প্রতি নতুন করে বিশ্বাস ফিরে আসে। এই অ্যাটিচিউডই নবনীতা দেবসেন।

হ্যাঁ অ্যাটিচিউডই ঠিক কথা। আজ যাঁরা তাঁর প্রয়াণে আত্মীয়বিয়োগের বেদনা পেলেন তাঁদের অধিকাংশের সঙ্গেই ওঁর পরিচিতি হয়ত বা কেবল ওঁর আখরগুলির মাধ্যমে। ব্যক্তিগত চেনার গণ্ডি কতটুকুই বা। আমি হয়ত ওঁকে ব্যক্তিগত চিনতাম, আজ মনে হচ্ছে তা নিয়ে বড়াই করার আছেই বা কী। তারও বহু আগে থেকে আমি যে ওঁর পাঠক। আর এই সম্পর্কই যে চিরস্থায়ী, অমোঘ। কেননা তিনি তো অক্ষরযাত্রী।

আমি কি আজও ভুলতে পারি ইশকুল জীবনে আমার আর আমার দিদির কাড়াকাড়ি করে পড়া ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে? ভুলতে পারি না আনন্দবাজারের পাতায় পড়া সেই আশ্চর্য জাদুকরী কাহিনি, ওঁদের বাড়ির কোনও কার্নিশে বেড়াল চড়ে বসার পর দমকল ডেকে তাকে নামানোর কাহিনি। মধ্যরাতে পাড়ার পথে সাইকেল চালাতে শিখছেন নবনীতা, সে কাহিনিতে ফুলে ফুলে হেসে উঠিনি আমরা অনেকেই?

সরসতায় ভরা আত্মজৈবনিক গদ্যের এক অন্য ঘরানা তৈরি করেছিলেন নবনীতা। মুহূর্তে আত্মীয়তা সৃষ্টি হত পাঠকের সঙ্গে। এত রসিক, এত জ্যান্ত গদ্য ছিল তাঁর। জনপ্রিয়তার শীর্ষে তিনি তো প্রথমত এই গদ্যের জন্যই। পরে তাঁকে নিয়মিত পেয়েছেন পাঠক ‘ভালবাসার বারান্দা’ নামের কলমে। সংবাদ প্রতিদিন রোববারের পাতায়। সেই এক সুর, স্বর। ব্যক্তি আর সমাজের গণ্ডিকে তোয়াক্কা না করা লেখা। অথচ কত সংবেদী আর তন্নিষ্ঠ। অবজেক্টিভ থেকে সাবজেক্টিভ অনায়াস যাত্রা তাঁর। রসে টইটুম্বুর। যখন মজা করছেন, মজা। সে এক আশ্চর্য উইট। উইট তো আসে বুদ্ধির দেদীপ্যমানতা থেকেই। তাই পরের লাইনেই যখন কঠিন বিষয়ে ঢুকবেন, সেখানেও যুক্তির যথাযথতা পাব আমরা। তখন জরুরি কঠোর প্রতিবাদ নেমে আসছে ক্ষুরধার ভাষায়। ভোলা যায় না অসামান্য অনুবাদে লাল্লার কবিতা নিয়ে একটি লেখাকে। দরদের সঙ্গে মেধার যে যোগ ছিল সেখানে তা অনিবার্য ও মোক্ষম। সঙ্গে প্রাঞ্জল অনুবাদ।

বাঙালির আবেগপ্রবণতার যে দুর্নাম আছে তা মিথ্যে করেন নবনীতা। মেয়েদের আবেগপ্রবণতার যে দুর্নাম আছে তাকে তো বহু আগেই ফুৎকারে উড়িয়েছেন। শি অলসো র‍্যান, মেয়েদের লেখা নিয়ে যে নীরবতার রাজনীতি থেকে যায়, তার মূর্তিমতী প্রতিবাদ তিনি। তাই তাঁর লেখা সর্বদা প্রখর বুদ্ধিদীপ্ততার আলোয় ভরা। সেটিকে মেয়েলি বা পুরুষালি বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবে না। এক মুক্তমনার লেখা, এটুকুই বলা যায় শুধু। এক মানুষের লেখা, এটুকুই ভাবা যায়। সেখানে নরেন্দ্র দেব রাধারাণী দেবীর আলোকপ্রাপ্ত লিবারাল মনস্কতার সম্পূর্ণ উত্তরাধিকারী তিনি। তবু, জেন্ডার নিয়ে স্পষ্ট মত তাঁর, কোথাও কোনও ছায়া বা অস্পষ্টতা কখনও দেখা যেত না। নারীজন্মকে নিয়ে কোনও হাহাকার নয়। বরং সম্পূর্ণ সচেতন স্বীকৃতির পর যে লড়াই আসে, সেই লড়াকু অস্বীকার।

পাশাপাশি অন্য সব ধরনের কুযুক্তি, ধর্মান্ধতা, পিছু হঠা, অন্ধকারকে তাঁর মেধা যুক্তির করাত দিয়ে ফালাফালা করতেন তিনি। আর সেখানেই তিনি ছিলেন আমাদের প্রহরী। অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা আচরণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিডোট, ঔষধসম।

একাশি বছর বয়স খুব কম নয়। গৌরীদেবী স্মৃতি পুরস্কার, মহাদেবী বর্মা পুরস্কার, ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি, পদ্মশ্রী, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, এই সমস্ত স্বীকৃতির পালক কখনও তাঁর সতেজ ভাবনাচঞ্চল মনকে ভারাক্রান্ত করেনি। কত কাজ করেছেন এই এত দীর্ঘ সময়ে। “আমি, অনুপম” অথবা “প্রবাসে দৈবের বশে”-র দীর্ঘ উপন্যাসের বিস্তৃতি থেকে “শীতসাহসিক হেমন্তলোক”, নিরীক্ষায় ভরা “বামাবোধিনী”, মেধা দিয়ে সময়কে ডকুমেন্ট করতে করতে তাঁর এগিয়ে যাওয়া। বিন্দুমাত্র আলস্য কোথাও ছিলনা যে, তা তাঁর সমস্ত লেখায় সমস্ত আচরণে অভ্যাসে উঠে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে। এত বড় রোল মডেল আর কোথায়। কাজের এক ক্ষেত্র হয়ত জেন্ডার বা লিঙ্গসচেতনতা। কিন্তু শুধুই নারী লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক ছাতের তলায় এনে ‘সই’ নামের গোষ্ঠী গঠন করাটা নয়। সেটা তাঁর বড় কাজ তো বটেই। সেখানেও প্রায় আন্তর্জাতিকভাবে ডালপালা মেলেছেন তিনি। ডাক দিলেই সারা ভারত থেকে কত যে নামী আলোচক-শিল্পী-লেখক ছুটে এসেছেন, যাঁদের নিজেদের কাজ জেন্ডার নিয়ে। কত মেধাবী সন্ধ্যা উপহার পেয়েছে কলকাতা তাঁর অনুপম আয়োজন সইমেলায়।

তবে তার বাইরেও অ্যাকাডেমিক নবনীতা, লেখক নবনীতা, কবি নবনীতা আরও কতভাবে ডালপালা ছড়িয়ে ছিলেন, কত মানুষের, ছাত্রের, পড়ুয়ার মেধার আশ্রয় হয়েছিলেন তার তো ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে দুঃখ করতেন, আমাকে কবি হিসেবে তোরা পাত্তাই দিস না। যাঁর এত্তগুলো পরিচয়, বাঘা গদ্যকার, তুখোড় রসরচনাকার, বিরাট আয়োজক-আহ্বায়ক, নারীবাদী, শিক্ষক, বিদ্বান, তাঁর কবি পরিচয়টি হয়তো সত্যি অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছিল। কিন্তু নবনীতাদির ভাষায়, “কবিতাই আমার প্রথম প্রত্যয়।” ১৯৫৯-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামও তাই ‘প্রথম প্রত্যয়’। কবিতাও কত যে অমোঘ, মন্ত্রোপম হয়ে উঠতে পারে, পুরনো আখর আবার আজকের অনুভবে তীব্রভাবে রিনরিনিয়ে উঠে জানান দেয় নিজেকে, তারই প্রমাণ থাক এখানে।

কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো
শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
স্বজন। এই হাত, এই নাও, হাত।
এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
কাছাকাছি আছ, অস্পৃষ্ট রেখো না।
ভয় করে। মনে হয় এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।
যেমন অসত্য ছিল, দীর্ঘ গতকাল
যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

(পাণিগ্রহণ, নবনীতা দেবসেন)

আবারও, বাঙালির আজ গুরুদশা। মাথার ওপর থেকে আরও একটা ছাত উড়ে গেল আমাদের। বাঙালি হিসেবে যা নিয়ে গর্ব, যে যে লক্ষণে বাঙালির নিজেকে চেনার অহঙ্কার, তা যে এক বিশেষ কালখণ্ডের ফসল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আলোকপ্রাপ্ত এক ধরনের মনস্কতার ফসল, সেই সময়টা দ্রুত অপসৃয়মান। আবারও আরেক প্রহরী সরে যাওয়াতে বড় স্পষ্ট হয়ে গেল তা। মেধাবী করাত সরে গেল। আমরা আবারও একটু নিরাপত্তাহীন হলাম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. হাসি ছিল সদা ই ওই মুখে
    আজ ব্যাথা হয়ে স্থান পেল সকল অনুরাগীর বুকে।

  2. হাসিটি ছিল প্রাণবন্ত সদাই তাঁর মুখে
    ব্যাথা হয়ে স্থান পেল সকল অনুরাগীর বুকে।

Leave a Reply to Ramaprasanna Bhattacharya Cancel reply