লকডাউনের গল্প

সমীর ঘোষ

 

দারুন হাত চলে নকুলের। একটা প্রমাণ সাইজের মাছ আঁশ ছাড়িয়ে কেটে-কুটে পিস পিস করে ফেলল মাত্র মিনিট সাতেকের মধ্যে। মাছ কাটা দেখতে দেখতেই কী মাছ নেওয়া যায় তাই ভাবছিলেন শ্যামলেন্দু। লকডাউন চলছে, তাড়াতাড়ি কেনাকাটি সেরে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এখন সারাদিনে এই একটাই কাজ। বাকি দিন অখন্ড অবসর। মুখে এন নাইন্টিফাইভ মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে একটু দূরে দাড়িয়ে ব্যানার্জ্জিবাবু। সরকারি চাকুরে। শ্যামলেন্দুদের ফ্ল্যাটের পাশেই সিলভার লাইন কমপ্লেক্সে থাকেন। পাড়ার সবাই ব্যানার্জ্জিদা বলেই ডাকে। এই বাজার দোকান করতে করতেই আলাপ। মাছ কাটা শেষ হতেই নকুলকে আরও বড় বড় চার পিস পেটির মাছ দিতে বলে শ্যামলেন্দুর দিকে তাকিয়ে সম্মতি আদায়ের লক্ষ্যে বললেন – আর কী খাব বলুন না? একটু মাছ না হলে কী ভাত খাওয়া যায়? আরে করোনার সময়, শরীরে প্রোটেকশন পাওয়ারটা তো রাখতে হবে… দু দিন মুরগি খেয়েছি, আর ভাল লাগছে না।

সেই তো … ঠিকই বলেছেন… শ্যামলেন্দু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তিনি নির্বিবাদী মানুষ। কারও কোনও দর্শনের খুব একটা প্রতিবাদ করেন না। এটাই তার স্বভাব। এক সময় ইউনিয়ন করতেন। নানা বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়তেন। এখন সেসব থেকে শতহস্ত দূরে থেকে পুরোপুরি ফ্যামিলি ম্যান। তার বাড়িতেও আবার মাছ ছাড়া চলে না। এখন আবার একটু বেশীই কেনাকাটি করতে হচ্ছে। গিন্নিরও অফিস বন্ধ, নিরন্তর অবকাশ। তাই ইউটিউব দেখে নানা রান্নার প্র্যাকটিস চলছে। সেগুলো ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে পোস্ট করে বন্ধুমহলে বেশ বাহবাও জুটছে। এই তো পরশু দিন মিষ্টির দোকানে ২ ঘন্টা ‘ধনুক ভাঙা পণ’ করে লম্বা লাইন দিয়ে পনির কেনা হল। দুপুর থেকে নানা গবেষণা করে রাতে তৈরি হল পনির পরোটা আর পনির পকোড়া। একটা সুদৃশ্য ট্রেতে সাজিয়ে ফেসবুকে ছবি দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ১১১টা লাইক আর ৩৫টা কমেন্ট। লকডাউন মিটে গেলে চার-পাঁচটা নেমতন্ন করে খাওয়ানোর আবদারও এসে গেছে ইতিমধ্যে। এভাবেই বিশামের পর বিশ্রাম, টিভিতে সিনেমা আর নিত্য নতুন আইটেমের স্বাদবদলে কেটে যাচ্ছে লকডাউনের দিনগুলো। সঙ্গে যে দিনে-রাতে কিঞ্চিৎ করোনা আতঙ্ক তাড়া করছে না সেকথা বলা যাবে না। আজ ছেলে বলে দিয়েছে পমফ্রেটের কথা। অনেক দিন কেনা হয়নি। আজ পেলে একটু নিতেই হবে। মেয়ের আবার কাটাপোনা ছাড়া চলে না। নকুলের কাছে দামটা একটু বেশী পড়লেও জিনিসটা ভাল মেলে।

কত দেব রে? – নকুলকে জানতে চাইলেন ব্যানার্জ্জিবাবু

দিন না, সব মিলিয়ে আপনার হল ৩৭০ টাকা …

৩৭০? বলিস কী রে! শুধু মাছেই এত হলে এই লকডাউনের বাজারে তো মাঠে মারা পড়ব!

আপনার তো একটু কম করেই ধরলাম, ঠিক আছে ১০ টাকা কম দিন … ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল নকুল। ওর মুখের মাস্ক এখন গলায় ঝুলছে।

টাকা মিটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ব্যানার্জ্জিবাবু শ্যামলেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলেন খবরটা দেখেছেন ?

কোন খবরটা? শ্যামলেন্দু অবাক হয়ে বললেন।

আরে ওই যে শ্রমিকগুলো ফিরছিল, মালগাড়িতে কাটা পড়েছে,কি প্যাথেটিক ঘটনা। টিভিতে দেখাচ্ছে তো…

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঔরঙ্গাবাদ। আরে এক সময় তো পোস্টিং ছিলাম ওখানে। ভেরি স্যাড নিউজ। রেল লাইন ধরে হাঁটছিল ২০ জন শ্রমিক। ঔরঙ্গাবাদ তো পৌঁছোতেই পারে নি। কারনাড ও বদনাপুরের মাঝেই ৩৬ কিলোমিটার হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোররাতে মালগাড়ি পিষে দেয় ১৬ জনকে…
সঙ্গের রুটি গুলো কীভাবে রেললাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেখেছেন? কাগজে ছবি দিয়েছে – শ্যামলেন্দুদের কথা শুনতে শুনতেই মন্তব্য করলেন পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক।

আরে বাবা তোদের কী দরকার ছিল এভাবে আসার? এত বাড়ি ফেরার তারা ? কটা দিন থেকে যা, সরকার কী করে দেখ? আমার ছেলে তো মুম্বইতে, লকডাউনে ফেঁসে গেছে। কোম্পানির গেস্ট হাউসে দিব্যি আছে। আমি বলেছি ফ্লাইট না ছাড়া পর্যন্ত আসবি না … কথাগুলো বলতে বলতে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ব্যানার্জ্জিবাবু।

শ্যামলেন্দু দিব্যি বুঝতে পারলেন কোথাও একটা তাল কাটছে। খবরের কাগজেই কোথায় যেন পড়ছিলেন ভারতের হাজার হাজার শ্রমিক কেন পেটে পাথর বেঁধে কয়েকশো মাইল হাঁটছে তা বোঝার সাধ্য ইন্ডিয়ার নেই। এ এক অদ্ভূত সময়। চরম এই সঙ্কটের দিনেও ইউটিউব,ফেসবুক জুড়ে দিনভড় সাড়ে তেত্রিশ ভাজার আয়োজন। এই সময়ের অংশীদার তিনি নিজেও। এক এক সময় একটা বিরাট অস্বস্তি তাড়া করে তাঁকে। ভাবছিলেন দু-কথা বলবেন। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।

ব্যানার্জ্জিবাবু চলেই যাচ্ছিলেন। দু হাতে ব্যাগ নিয়ে ফের ফিরে এসে বললেন জানেন তো আজকের খবরের কাগজে হেডলাইন লিখেছে ‘কাল হল ক্লান্তির ঘুম’। এই থিমটা কিন্তু কালকেই আমার মাথায় এসে গেছিল। কাল রবিঠাকুরের জন্মদিনে জাগরণ ক্লাবের ফেসবুক লাইভে আমার মেয়ের গান গাওয়া ছিল। আমিই বললাম – ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ এই গানটা গা – আজকের দিনে অ্যাপ্রোপিয়েট হবে।

 

1 Comment

Leave a Reply to upopaddo Cancel reply