আলাদা হওয়ার নীল নকশা

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় 

 

 


লেখক চলচ্চিত্রবেত্তা, শিক্ষক, গদ্যকার, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার

 

 

 

২০১৯ পার করে আমরা এলাম কোভিড-১৯-এ। আমরা মন্বন্তর দেখিনি, দাঙ্গা-দেশভাগ দেখিনি, কিন্তু আমরা করোনা দেখলাম। আমরা মৃত্যুর ধাতব পদধ্বনি শুনলাম। আমি বৃহত্তর পৃথিবীর কথা বলতে পারব না, কারণ তা আমার পরোক্ষ অভিজ্ঞতা। তা পড়ে জানছি। আমি গরিব চাষি বা মজুরের কথাও বলতে পারব না। কারণ পরিসংখ্যানের মধ্যে তো লাবণ্য থাকে না৷ মানুষের অস্তিত্বের পদপাত শোনা যায় না। ফলে, অধীত অভিজ্ঞতা থেকে তাদের কথা বলা আমার সাজে না। কিন্তু আমি আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে পরিণতি দেখেছি, তাতে সত্যিই আমার মনে হচ্ছে, মানুষের অমরতা বা অনশ্বরতার দিকে চলে যাওয়ার আর কোনও প্রয়োজন নেই। যদি প্রকৃতই সে মহাপ্রস্থানের পথে যেতে পারত, তাহলে এই সমকালীন ভাঁড়ামি সে কোথায় খুঁজে পেত? এই জীবাণু সংক্রমণ যখন ভারতবর্ষে আসছে, মৃদু হেমন্তের শেষে শীতের মতো, তখন আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা, যারা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এক প্রজন্মের বড়লোক, সাতশো আশি স্কোয়ার ফিট ছেড়ে চোদ্দশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে থাকে এবং ইএমআই দেয়, তারা হঠাৎ বলতে শুরু করল, ওরা গম খেতে পাচ্ছে না? কেক খাক– মারি আতোঁয়ানেত যেমনভাবে বলেছিলেন ছোটবেলার ইতিহাস বইতে। তেমনিভাবে আজকের নব্য ধনীরা বলছেন– ওরা ট্রেন লাইনে শুয়ে থাকে কেন? যেখানে দিয়ে ট্রেন যাওয়ার, সেখান দিয়ে ট্রেন তো যাবেই। ঠিক তারপর আমরা দেখলাম, পয়লা বৈশাখ/পঁচিশে বৈশাখ অতিভোজনের পর এলিট পারাবতকুল ছাদে যেভাবে নৃত্যনাট্য ও আবৃত্তি পরিবেশন করছেন, তা যেকোনও ইস্পাত কোম্পানি তাদের ঢালাইয়ের টিএমটি বারের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারবে। তাদের শরীরের ভঙ্গিমা, স্তন, নিতম্ব ও শ্মশ্রু চোঙার মতো উঁচিয়ে রেখে, তারা চিত্রাঙ্গদা, অর্জুন ও রবীন্দ্রনাথকে হতবাক করে দিলেন।

এই যে মধ্যবিত্ত, যারা নিরন্তর কথা বলে যাচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে, সেই কথার কোনও ভূমিকা নেই। তারা গুড়ের জালায় মাছির মতো এসে বসছে। সম্প্রতি কোথায় যেন পড়ছিলাম মনস্বী উমবের্তো একো বলেছেন যে আগে মানুষের কথা বলার সীমা-পরিসীমা ছিল। বড়জোর তারা দেবদাসের প্ররোচক চুনীলালের মতো কিছু কথা বলত, এবং তাদের থামিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আজ আর তাদের থামানো যাচ্ছে না। অতিমারি উপলক্ষে সকলেই অতিজ্ঞানী। চারিধারে এত নির্বোধ বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে এবং এত বেশি উল্লাস যে আমার কেবলই মনে হয় যে সহস্র চোখ না যোনি এতদিন পরে আজ কলকাতায় ইন্দ্রের শরীরে।

আমি আগেও এই পত্রিকার পাতাতেই বলেছিলাম যে আমরা কী করে যেন পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম৷ আগে আমরা জানতাম যে একটা বিপদকে প্রতিরোধ করার জন্য সমবেত শক্তির প্রয়োজন। এই প্রথম আমাদের জানতে হল বিপদের সামনে আলাদা হওয়া জরুরি, একা হওয়ার প্রয়োজন। এমনকি একটি ভুল ইংরেজি শব্দবন্ধের একইরকম ভুল বাংলা করা হল। অপ-অনুবাদ। যা হওয়া উচিত ছিল physical distancing, তা হল social distancing বা সামাজিক দূরত্ব। এর থেকে আদর্শ পতন আর কী হতে পারে? এ তো নরকযাত্রার উৎসমুখ খুলে দেওয়া হল। কার্ল মার্ক্স ১৮৪৪ সালে ‘দর্শন ও অর্থনীতির খসড়া’-তে যে অ্যালিয়েনেশন শব্দটির কথা বলেছিলেন, যার মানে আমরা এতদিন ভালো করে বুঝতাম না, দার্শনিক অর্থে আমরা ভাবতাম যে মানুষ অসাড় হয়ে গেছে, মানুষ তার ছায়ার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এসব আমরা আন্তনিওনি-র ছবিতে দেখতাম। ফ্রানজ কাফকার শব্দাবলিকে পড়তাম। আর আজ আমরা এমন একটি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, যা অন্তত ভারতবর্ষের মেট্রোপলিটন শহরগুলির ক্ষেত্রে সত্য, যে আজ সত্যিই আমরা নিজেদের থেকেই আলাদা হয়ে গেছি। আমরা বুঝতে পারছি না রেললাইনগুলোতে রক্ত লেগে আছে। আমরা তা নিয়ে গান লেখার চেষ্টা করছি। আমরা ভাবছি আমাদের গান কেন বিক্রি হয় না? আমরা ভাবছি, আমরা ক্রিয়েটিভ কেন হচ্ছি না এই অবকাশে? প্রত্যেকে গান লিখছি, কবিতা লিখছি, যেন গান লিখে এই সর্বনাশকে আটকে দেওয়া যাবে! যেন সহজীবীর অন্ত্যেষ্টিতে গান ছাড়া অন্য কিছু আমাদের উপহার দেওয়ার নেই।

এই চারটি মাস সারা পৃথিবীর কাছেই প্রমাণ করে দিল যে আমরা জ্ঞানের নামে শবযাত্রার যে অন্তহীন মিছিলে দাঁড়িয়ে আছি, তা কত ব্যর্থ, কত সত্য-পরান্মুখ। রেনেসাঁর পর থেকে আমরা ভেবেছিলাম, এবং যুক্তিবাদ আমাদের এই ধারণাটাকে উসকে দিয়েছিল, যে জ্ঞানের মাধ্যমে, যুক্তির পথে আমরা বোধহয় একদিন সত্যকে জানতে পারব! কিন্তু এই যুক্তিটা যে আসলে কী, কোন ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে— সেটা আমরা ভাবিনি। আমরা যে শুধুমাত্র যন্ত্রের উন্নতি দেখে ভেবেছি যে মানুষের বিজ্ঞানেরও উন্নতি হচ্ছে। শুধু যদি চিকিৎসাবিদ্যার কথাই ভাবি, চিকিৎসাবিদ্যায় চিকিৎসকদের এই যে সমূহ ব্যর্থতা সারা পৃথিবী জুড়ে, তা বলে দেয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিকেও যথার্থ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ওষুধ দিয়েছি, কিন্তু উৎসের দিকে তাকাইনি। আমরা শুধু প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে কিছু রিপোর্ট, কিছু যান্ত্রিক ফলাফল তৈরি করালাম। আমরা আগে নাড়ি টিপে যা জানতাম, তার মধ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল ঠিকই, আজ তা আমরা যন্ত্রের মাধ্যমে জানছি। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যেমন অঙ্ক বা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাকে কম গুরুত্ব দিলাম, কারণ তা লাভের কড়ি ঘরে জমায় না, শুধু জোর পড়ল প্রযুক্তিবিদ্যা ও অস্ত্র গবেষণায়। ঠিক তেমনি কলকাতা শহরে ইমিউনোলজি বা ভাইরোলজির দিকে কজন এমবিবিএস ডাক্তারকে আমরা যেতে দেখেছি? ভালো ছেলে মানে সে কার্ডিওলজিতে যাবে, নেফ্রোলজি শিখবে, যেখানে হাতে হাতে পয়সা। সে ওইসব মূল তত্ত্ব বা বিশুদ্ধ চর্চার দিকে যাবে কেন? সে কেন খোঁজ করবে মন ও শরীর কীভাবে যুক্ত, স্নায়ুতন্ত্রের প্রকৃত আচরণ কীরকম? অথচ এই শহরে বসেই একজন চিকিৎসক একদিন ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু আজ আমাদের জানার উপায় নেই, শুধু আমাদের কেন, আজ টরন্টো বা নিউইয়র্ক, আমস্টারডাম বা দার-এস-সালাম-এ বসেও জানার উপায় নেই, আমরা আগামী দিনে কী করব বা কোথায় যাব? আট-দশ বছর আগে থেকে এমন ভাইরাস হানার পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের তাবড় জৈববিজ্ঞানী-চিকিৎসককুল কোনও অগ্রিম পদক্ষেপ নিতে পারলেন না কেন? কারণ এই মুহূর্তে আমাদের বিজ্ঞানচর্চার দিশাটাও ভুল, তা শুধু উপার্জনমুখী।

আজ যে আমরা পরস্পর আলাদা হতে আরম্ভ করেছি, আমরা যখন বলছি যে এই সেই পরিস্থিতি যখন ‘An individual dares to individuate himself’। আমরা এই আলাদা হওয়াটাকে, এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে এত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায়, এবং এই গুরুত্বের প্রতিফলিত আলোকে আমরা ভারতবর্ষে বা তাইওয়ানে বসেও এতটাই পুলকিত হচ্ছিলাম যে আমরা বুঝতেই পারিনি একটা সঙ্ঘশক্তি, যা রাষ্ট্র না হতে পারে, কিন্তু যা মানুষকে ধরে রাখে সেই ধরে রাখার জায়গাটাই আর নেই। আমরা নিরালম্ব, বায়ুভূত। আমরা ইওরোপের দিকে তাকালেই দেখতে পাব রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। আজকে যুক্তরাজ্য অর্থাৎ ইংল্যান্ডে, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, সেখানে আমাদের দেশে তো স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে কিছু নেই-ই৷ বরং খবরের কাগজ খুললে আমরা বুঝি, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্ত আলোচনা আসলে কাগজে যারা বড় বড় বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, শুধুমাত্র তাদের জন্যই সুরক্ষিত। কোভিড থেকে বাঁচানোর চিকিৎসা আজকাল অনলাইন পরিষেবাতেও চালু হয়েছে৷ আগের লেখাতেও আমি বলেছিলাম, ভারতবর্ষের কটা লোকের কম্পিউটার ব্যবহার করার ক্ষমতা আছে? মাথা পিছু গড় আয় কতটুকু যে সে স্মার্টফোন ব্যবহার করবে? সারা দেশে নেটওয়ার্কের অবস্থাটি কীরকম? যে দেশে সাক্ষরতার হার এত কম, সেখানে ‘অনলাইন’ কথাটার অর্থ কী? অনলাইন পেমেন্ট, ভিডিও কলিং, স্কাইপ— এসব শুনে আমাদের দেশের গরিব মানুষেরা কী ভাবেন? তারা কি এগুলো কী তা বুঝতে পারছেন? আমি Alain Resnais-এর  ‘Night and Fog’ ছবিটা বহুবার দেখেছি। যেদিন আউসভিৎস মুক্ত হচ্ছে, সেদিন কাঁটাতারের ওপারে বসে বন্দিরা ভাবছিলেন, সত্যিই কি তারা মুক্ত হচ্ছেন? তাদের কি কথা বলার ভাষা আছে? এই ভাষাবন্ধন তো কোনওদিন যাওয়ার নয়। সমাজের বৈষম্য আগেও ছিল। কিন্তু এই বৈষম্য যে দুস্তর পারাবার তৈরি করেছে এবং আমরা যে এই বৈষম্য নিয়ে প্রকাশ্যে গর্ব করতে শুরু করেছি, সেটাই আমরা এতদিন নজরে রাখিনি। আমাদের শেষতম বস্ত্রখণ্ড নিয়ে পাখি চলে গেছে মহাভারতের উপাখ্যানের নলের মতো। আমরা যে উলঙ্গ হয়ে একাকী রাস্তায় ঘুরছি, এই বোধও আর আমাদের নেই।

যা বলছিলাম, আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা, দেশের দশটা কি পনেরোটা বড় শহরের উচ্চবিত্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষিত, আমার-আপনার জন্য, আমরা যারা ইংরেজি বলি, আমরা যারা কিবোর্ড চিনি এবং আমরা যারা অনলাইন পেমেন্ট করতে পারি। সেটা কজন ভারতীয় পারে? আসলে ভারত সরকার বা ভারত রাষ্ট্র আজ তার সাংবিধানিক দায়িত্ব অস্বীকার করছে। ভারতের সমস্ত অধিবাসীরা আজকে আর সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকারী নন। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা বিত্তবান, অন্তত একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বিত্তের অধিকারী, একমাত্র তারাই এই সুবিধা পাবেন। এটা এর আগের কোনও সরকার এতটা নগ্নভাবে ঘোষণা করতে পারেনি। অন্তত একটু চোখের চামড়া ছিল আমাদের। অন্তত কোথায় একটা ভীতি, তা ঈশ্বরভীতিই হোক, বা মনুষ্যত্বের তাড়নাই হোক, কিছু একটা অবশিষ্ট ছিল। আজকে সমস্ত ভাগফল মিলে গেছে। নিও নর্মাল আমাদের সবই আজ অ-স্বাভাবিক।

আমরা সবকিছু জেনেও মুখোশের আড়ালে লজ্জাহীন বাচাল হয়ে সময় কাটাচ্ছি। সোশাল মিডিয়াতে প্রতিনিয়ত আতঙ্কের সচিত্র উদযাপন চলছে, গোয়েন্দা গল্পের অবতারণা করছি। আমরা বুঝছি না, উল্লাস করতে গিয়ে আসলে আমরা আমাদেরই সহনাগরিকদের রক্তপান করে চলেছি। একথা মানতেই হবে যে আমাদের ডাক্তারবাবুরা, আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা সম্বন্ধে তাদের সীমিত জ্ঞানের মধ্যেও প্রাণপাত করে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। যে চিকিৎসা নিয়ে সারা পৃথিবীতে কারও কাছেই কোনও সমাধান নেই এখনও, সে জ্ঞান এঁদের কাছে আমরা আশা করব কী করে! তা সত্ত্বেও, এঁরা যথাসাধ্য করছেন। গাফিলতি বা অকর্মণ্যতার দায় সবসময় তাদেরও নয়, যে সর্বগ্রাসী ও ব্যর্থ চিকিৎসা শিল্প বা হেলথ ইন্ডাস্ট্রির হয়ে তারা চাকরি করেন, সেই সিস্টেমের এঁরা একেকটি সামান্য নাট বা বল্টুমাত্র। একটা নার্সিংহোম ডাক্তাররা পরিচালনা করেন না, ব্যবসায়ীরা করেন। এহেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি ফেরা, বাড়ি ভাড়া সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে হাত পেতে ওষুধ নেব, উপদেশ নেব, অথচ তাকে তার বাড়িতে ঢুকতে দেব না। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত সেই রসিকতার কথা মনে পড়ছে, ‘শোওয়ার সময় আমাদের জাত যাবে না, কিন্তু এক হাতে খেতে গেলে আমাদের যাবে।’ আজ প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর্মীরা বিপন্ন হচ্ছেন। ‘করোনা রোগী ধরা পড়েছে’ এই শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ধরা পড়া’ মানে কি? করোনা আক্রান্ত রোগী কি বাঘ না চোর, যে তারা ধরা পড়বেন? একজন মানুষের একটি রোগ হয়েছে, এই পর্যন্ত। বিদ্যাসাগরের দুশো বছর পার করে এই শহর ‘অস্পৃশ্যতা’-র নতুন পাঠ নিল। আজ ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের অ্যাম্বুলেন্স আটকে রেখে হাউসিং কম্পলেক্সের একদল বাসিন্দা অকুতোভয়ে বীরত্ব দেখাতে পারেন। এই আমরাই রবীন্দ্রনাথের গান গাইতাম, ‘আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ অন্ধ করা, তোমার পরশ থাকুক হৃদয় ভরা’। অন্তরের সেই স্পর্শ কোথায়?

এই করোনা সম্বন্ধে মানুষের যে ধারণা তৈরি হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে মিডিয়া দায়ী। মিডিয়া যেভাবে আতঙ্কের সঙ্গে ছেদচিহ্নহীন বাক্য বলে চলে, তাতে মনে হয় যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত সমাগত। আমরা শুধু মৃত্যুর জন্য সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে আছি। আশ্বাসের বদলে, যুক্তির উদবোধনের বদলে, যে ধরনের ভয়ভীতি জাগ্রত করা হচ্ছে, যে কল্পোপন্যাস লেখা হচ্ছে, তা আগে কখনও হয়নি। পরাধীন ভারতবর্ষে প্লেগ ছিল। ‘গোরা’ বা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই, যুবকেরা রাস্তায় নেমে রোগপ্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। অথচ আজ যেন আমরা এটাকে নির্দ্বিধায় মেনে নিলাম। ‘নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ/স্বদেশের তরে যে করেই হোক রাখিবে সে জীবন।’ আমরা দেখছি, পরস্পরের থেকে আলাদা হওয়ার দর্শনটাকে এমনভাবে গৌরবান্বিত করা হল, যেন মনে হল চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে খিল আটকে ঘরে বসে থাকার নামান্তর। যেকোনও কিছুর একটা বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত আছে ও একটি দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত আছে। দুটোর মধ্যে গুলিয়ে দেওয়া হল। এক শ্রেণির কিছু মানুষ ভাবলেন যদি তারা নিজের বাড়িতে বসে দূরসংযোগের মাধ্যমে কিছু জিনিস ক্রয় করে বাড়ি নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে তার আর কোনও চিন্তা নেই, তাতেই রোগটিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। আর আমাদের মতো মুষ্টিমেয় কিছু সরকারি কর্মী, যারা বাড়িতে বসে মাইনে বা পেনশন পান, তারা ছাড়া গোটা ভারতবর্ষ যে অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের কপালে ভাঁজ পড়ল না। আমাদের মধ্যেই কেউ উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে বলছে, লকডাউন বাড়াও। সে আদৌ জানে না লকডাউন বাড়লে কী হবে, কমালেই বা কী হতে পারে। একটা উন্মাদের প্রবাহ চলেছে।

রুশো একটা জায়গায় বলেছিলেন, ‘Everything is absurd, but nothing is shocking. Everyone is accustomed to everything’। এই লাইনটার মানে আমি আগে কখনও বুঝতে পারিনি। আজকের কলকাতায় বসে হাড়ে হাড়ে  টের পাচ্ছি কোনও জিনিসই অপ্রত্যাশিত নয়। কোনও ঘটনাই আর আমাদের চমকপ্রদ মনে হয় না। আমাদের সঙ্গে সবকিছুই ঘটতে পারে, এবং সেই ঘটাটাকেই আমরা মনে করছি স্বাভাবিকতার সম্প্রসারিত অংশ৷ কেননা আমরা তো এর বাইরে আর কিছু চাইনি। আমরা শুধু চেয়েছিলাম একটু নিশ্চিন্তভাবে বড়লোক হতে। সেই বড়লোক হওয়ার পরিণামে আমরা আলাদা হয়ে গেছি, আমরা একটা separate category। করোনা এসে আমাদের সেই ক্ষতস্থান উন্মুক্ত করে দিল। একটা দিকে গরিব ভারতবর্ষ, অথবা গরিব পৃথিবী৷ আরেকটা দিকে আমরা, যারা এখনও বিশ্বাস করি টাকার ভেলায় ভেসে আমরা নোয়ার মতো কোনও সার্থকতার চূড়ায় যেতে পারব। মানুষকে এত নির্মম, নিষ্ঠুর, এত হৃদয়হীন হতে আগে কখনও দেখিনি। জীবনানন্দ দাশ চল্লিশ দশকের মৃত্যু দেখে বলেছিলেন, ‘তবুও আতঙ্কে হিম/ হয়তো দ্বিতীয় কোনও মরণের কাছে’। মধ্যবিত্তের এই যে মরণ আজ আমরা দেখছি, তা দ্বিতীয় মরণকে বহুদিন আগে ছাড়িয়ে গেছে। তা আমাদের তৃতীয় বা চতুর্থ মরণ। প্রত্যেকেই তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলছেন, কিন্তু তার পেছনে কোনও ভাবনাচিন্তা নেই, গবেষণা নেই, কোনও ভালোবাসা নেই। প্রেমের বিহনে কোনও জ্ঞান নেই। ‘সন্ন্যাসী উপগুপ্ত/ মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে/ একদা ছিলেন সুপ্ত’— এই যে ‘অভিসার’ কবিতাটি আমরা পড়েছিলাম, তাতে শেষ লাইনটি ছিল, ‘আজি রজনীতে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা’। আজ আমাদের এমনই এক রজনী, যে এই রজনীতে আমাদের জন্য কোথাও কেউ আসবে না। আমরা শুধু নীরবে, নিভৃতে, আরামে এবং ভয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণে যাব। কারণ আমরা জীবিত থাকলেও বস্তুত আমরা মৃত। এই মৃত্যু থেকে কবে যে আমরা জীবনে উন্নীত হব, তা আমি জানি না।

আমার বয়স ষাট পেরিয়েছে। আমি দেখছি এক ক্রমঅবসন্নতা আমার সঙ্গী হয়ে উঠেছে এবং আমাকে একটা ভয় শাসন করছে। সেই ভয়টা আসলে নাগরিককে রাষ্ট্রের দেওয়া উপহার। একটি বিষয় এই মুহূর্তে লক্ষ করার মতো, প্রত্যেকটি বড় রাষ্ট্র আজ সংবিধান-বহির্ভূতভাবে শাসন শুরু করেছে। আজকে আমাদের আদালত বলে কিছু নেই, সংসদ নেই, অথচ যেকোনও সিদ্ধান্ত যেকোনও সময় নেওয়া যেতে পারে। গুপ্তযুগেও মহারাজ বিক্রমাদিত্য এইভাবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ফলত, এই লকডাউন কার জন্য এবং কী সমস্যার সমাধান করছে— তা একটি বহুস্তরীয় প্রশ্ন। তার অর্থ খুঁজে বের করব— আমার বিদ্যার দৌড় এতটা নয়। আমি যে তাও এত কথা বলার সুযোগ পেলাম, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার নিজেকে এত শূন্য শ্রান্ত আগে কখনও মনে হয়নি। এর আগে অন্তত আমরা বলতে পারতাম, ‘অন্ধকারে আর রেখো না ভয়/ আমার হাতে রেখো তোমার মুখ’। এখন তো আমাদের সকলের হাত দূষিত। এই হাতে হয় স্যানিটাইজার, নয়তো সাবান। কে আজ কোন হাতের মধ্যে মুখ ঢাকবে, আমি সত্যিই জানি না। আমি পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. ভালই লাগলো পড়তে, কিন্তু সে ও তো কথামালা ই।আমাদের বাঁচাতে পারে কার্যমালা – দিকচিহ্নহীন।
    একটি ক্ষমার্হ উদাহরণ : সেদিন সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে(নতুবা উদর বায়ুতে সারা নিশি জাগ্রত যাপন নিশ্চিত) দেখি একটি আবসনের সামনে বড়ো এক ডেকচি খিচুড়ি নিয়ে কয়েকজন বাসিন্দা পথচলতি গ্রহণেচ্ছু মানুষকে খিচুড়ি পরিবেশন করছেন। খুব ইচ্ছে করছিল তবু গ্রহীতাকূলের একজন হতে পারি নি।

    এইরকম, খুব ক্রিটিক্যালি না ভেবেও, কাজে নেমে পড়া চাই।
    তাত্ত্বিক আলোচনা পাশাপাশি চলুক না – তার ও প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে।

1 Trackback / Pingback

  1. মরণ মহোৎসবে: কোভিড-উত্তর বিপন্নতা — চতুর্থ বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা | ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Leave a Reply to আশিস কুমার মুখোপাধ্যায় Cancel reply