ছবি নিজে বলে, আমি শুনি

সর্বজিৎ সরকার

 


কবি, গল্পকার, অনুবাদক এবং চিত্রশিল্পী

 

 

 

সাদা পাতাদের একরকমের হিংস্রতা থাকে। এটা আমার বরাবরই মনে হয়। এই হিংস্রতা ঠিক প্রবৃত্তিগত নয়। প্রবৃত্তির হিংস্রতা থাকে মানুষের। সাদা পাতা বা সাদা ক্যানভাসের হিংস্রতার থেকে সেটা আলাদা। মানুষের হিংস্রতা, নির্মমতা বা নৃশংসতা, তাদের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকে। তুলনায় সাদা ক্যানভাসের যে হিংস্রতা থাকে, সেটাকে, আমার বারবার মনে হয়েছে, যেন আহত প্রাণীর বা মুছে দেওয়া স্মৃতির ক্ষতস্থান। সাদা হয়ে আছে, কেননা, তাকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই। হঠাৎ দেখলে তাকে সাদা চাদরে ঢাকা শবদেহ মনে হতে পারে। প্রাণ নেই। আর প্রাণ নেই বলেই, সে, একথাও আমার বরাবর মনে হয়েছে, আমাকে তার কাহিনি শোনাতে চাইছে। প্ররোচিত করছে। ওসকাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ করছে আমাকে। এবং ভয় দেখাচ্ছে। এই ভয় ব্যাপারটাও অদ্ভুত। সেটা হয় আমাকে ক্রিপল করে দেবে, যাতে আমি নড়তে চড়তে না পারি। অথবা সেই ভয় আমাকে চেষ্টা করবে, আমাকে ধাক্কা মেরে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিতে। এই দুই অবস্থাতেই নিজেকে অসহায় লাগে। নার্ভাস লাগে। মনে হয় আমিও ওই সব সাদা পাতাদের আর সাদা ক্যানভাসের মতই। ক্ষতকে আড়াল করে জীবনে বেঁচে আছি। এও আরেক ধরনের প্রাণহীনতা। প্রাণের প্রমাণ হয়, প্রাণের প্রকাশে। সে প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত। অরগ্যানিক। গাছের, উদ্ভিদের, জন্ম ও বেড়ে ওঠার মতো সহজ আলোর দিকে তার জন্মগত অভিমুখ। যেদিকে আলো সেদিকেই তার বেড়ে ওঠা। এসব সময়ে গাছের শেকড় আর তার শাখাপ্রশাখার কথা মনে আসে। কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই। আলো যেদিকে তাকে টানছে, রস যেখানে তাকে রসদ যোগান দিচ্ছে, সেদিকেই সে নিজেকে প্রসারিত করছে।

প্রাণ প্রাণকে টানে। মৃতের পৃথিবী টানে মৃত্যুর সাদা ক্যানভাসের দিকে। ছবির প্রথম আঁচড়টা, তুলির বা স্প্যাচুলার টান, বা আঙুলের নখের প্রথম দাগটা সেই নিহিত নিস্পন্দ মৃত বা অর্ধমৃতের বন্ধ দরজায় প্রথম কড়া নাড়া। প্রথম ধাক্কা। প্রথম আঘাত। দরজা না খোলা অবধি, দেয়াল না ভেঙে ফেলা অবধি, তখন আর কিছুতেই অস্থিরতা কাটে না। প্রবল এক উন্মত্ততা কাজ করতে থাকে নিজের ভেতরে। বোবা, সাদা ক্যানভাসের হিংস্রতাকে ছিন্নভিন্ন করবার জন্যে এ হল কোনও আর্টিস্টের পাল্টা হিংস্রতা। প্রতিস্পর্ধা। প্রতিআক্রমণ।

নিথর পাহাড়ে ডাইনামাইট ফাটিয়ে যেন বহুদিনের রুদ্ধ জলধারা বার করে আনতে হবে। এতকাল সে বয়েছে ওই সাদা নির্বাকের নিথরতার ভেতরে। বাহিরের আলোয় তাকে উদ্ভাসিত করা মানে যেন আর্টিস্টের নিজের নিথরতায় প্রাণের স্ফূরণকে টেনে ছিঁড়ে বাইরে নিয়ে আসা। কী জমে আছে সেই অন্তঃস্থলে? মিশে আছে তার, আর্টিস্টের, হারানো স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, টানাপোড়েন, আতঙ্ক, ভয়, ঘৃণা, প্রতিবাদের যাবতীয় কথা, অপমানের ক্ষত, বহু অ্যাডভেঞ্চার, বহু পতন আর বহুবার ফের উঠে দাঁড়ানোর কথাও। আর্টিস্টের প্রথম ও শেষ টান, সাদা ক্যানভাসের বুকে তার তুলির, স্প্যাচুলার, চারকোলের, আঙুলের প্রতিটি আঁচড় তাই হয়ে ওঠে তার প্রবল, তীব্র, প্রেমের, ভালবাসবার আততির, ওভারড্রাইভ। অনেকটা অচেতন, অবচেতন, আর কিছুটা সচেতনতাকে সঙ্গে নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসা এক প্রাকৃত প্রাণের উন্মোচন।

এই প্রেম, এই তীব্র ভালোবাসার প্রকাশ ছুঁয়ে যেতে চেষ্টা করে, মানুষ মানুষী, জীবজগত, জড় ও অজড় এই চারপাশের প্রকৃতি, আর অদেখা ওই মহাকাশলোককে। যার যেখানে প্রাণ নিগড়ে আটকে স্তব্ধ নীরব মূক হয়ে আছে, সেই সব সবটুকু প্রাণের কথা ওই সাদা পাতা সাদা ক্যানভাসের বুক চিরে বের করে নিয়ে আসার আগে অবধি, আর্টিস্টের ছুটি নেই। ওই সমস্ত প্রাণের স্ফূর্তিই তার, আর্টিস্টের, সব কাজের একমাত্র সার্থকতা।

আমি নিজে যখন এমন সাদা ক্যানভাস বা কাগজের সামনে এসে দাঁড়াই, শুরুর ওই হিংস্রতা আমাকে অবশ করে দিতে চেষ্টা করে। অসহায়, নার্ভাস লাগে। আতঙ্কের আবহ গ্রাস করে সে সময়ে। তখন চোখ বুজে ফেলি। হাত রাখি ওই সাদা কাগজের ওপর৷ ক্যানভাসের সাদা শরীরে। চোখ বুজে হাত বোলাতে থাকি তার গায়ে। তারপর? তারপর কোনও এক অপার্থিব তীব্র মুহূর্তে যে কোনও একটা রঙের টিউব টেনে নিয়ে রং লেপে দিই তার শরীরে। কোথায় সে রং দেব তার কোনও পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা বেশিরভাগ সময়ে থাকে না। বাইরের কিছুকে তো আমি রূপ দিতে চাইছি না। তাই পরিকল্পনার প্রয়োজনও কিছু নেই। শুধু এই বোধ কাজ করে যে এটাই সেই মুহূর্ত যখন কাগজের সাদা স্পেস আমার ভেতরের অন্তরালে থাকা স্পেসের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এই ছবি এক অর্থে তাই দুটি স্পেসের মধ্যে এক সংলাপ। এক সেতুর নির্মাণ শুরু হবে এখন, এইবারে। ছবির বাকি কথা এক উন্মাদ উপচে পড়া তীব্র আবহমান জার্নি। সেখানে আলো ছায়া আর অন্ধকার নিজেদের মত খেলা করে। আমি তুলি বা স্প্যাচুলার টান দিই। আলোর রাস্তা ফুটে ওঠে। রঙের ভেতরের সেই রঙের অন্য আরও স্তর ফুটে ওঠে। আবছা বাঁক, স্পষ্ট টান, দাগ, সকলে মিলে কিছু চেনা কিছু অচেনা শরীরী রূপ বা ফর্ম নিয়ে ধরা দেয়। পরতে পরতে লাগানো রঙের মধ্যে দিয়ে নানারকম সুর খেলা করতে শুরু করেছে। সুর ছবির সারা শরীর জুড়ে খেলা করে। উত্তেজনা, অবগাহন, অবসাদ, ফিরে আসা প্রাণের স্ফুর্তি, এই সব অনুভবের প্রকাশ খুজে পাই তখন, ওই ছবির মধ্যে।

নকশা বা প্যাটার্ন যেখানে যেখানে তৈরি হয়ে উঠছে, উঠছে তাদের নিজস্ব আকাঙ্খা, কামনা, কার্যকারণের সূত্রে। আর্টিস্ট হিসেবে আমার শক্তি ও অধিকার শুধু ওই ডায়নামিক্স, ওই গতিপথকে, অনুভব করা, অনুসরণ করা। আর এভাবে অনুসরণ করতে করতেই কখন এক জায়গায় এসে ছবি নিজেই বলে, ‘আমি হয়ে গেছি। এবারে থামো।’

আমি থেমে যাই।

 

ওয়ান সামার আফটারনুন
টর্ন লেটারস ইনসাইড ইয়োর হার্ট
আফটারনুন জ্যাজ
আইজ অফ দ্য স্টর্ম
ডন
এমব্রেস
ইন দ্য ডিপ
অটাম লিভস
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. বেশ কিছুদিন আগে জাঁ ককতোর ‘দ্য হোয়াইট পেপার’ বইটা পড়েছিলাম। যতদূর জানি, স্তেফান মার্লামেও কিছু কথা বলেছিলেন সাদা পৃষ্ঠা ও শিল্পের (লেখা/আঁকা) পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। এই সবকিছুর পাশে সর্বজিৎদার এই ছোটো লেখাটাও আমি উল্লেখ ও প্রয়োগ করব যখন সুযোগ আসবে। এই লেখার দার্শনিক প্রস্থানভূমি খুব ভালো লেগেছে। ছবিগুলোও ভীষণ সুন্দর।

Leave a Reply to কুণাল বিশ্বাস Cancel reply