সুন্দরবন এখন একটা হান্স চায়

তিষ্য দাশগুপ্ত

 



সমাজকর্মী

 

 

 

সেই কোন ছোটবেলায় পড়া হান্সের গল্প মনে আছে? সমুদ্রঘেরা নিচু জমির দেশ নেদারল্যান্ডসে দরিদ্র মৎস্যজীবী বালক হান্স কীভাবে চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বাঁধকে বাচিয়েছিল? এই গল্প আমি আপনি ছোটবেলায় কমবেশি সবাই পড়েছি। ছোট্ট হান্স ছিল বলে তার শহর হারলেম সেদিন ভয়াল ভীষণ সমুদ্রের হাত থেকে কোনওমতে রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু দয়াপুরের সঞ্জীব অথবা পাখিরালার হাফেজ অতটা ভাগ্য করে জন্মায়নি, প্রতি বছর বাড়ির গাছে ছাওয়া বনবিবির মন্দিরের ছাদ সমান জল আর নতুন লাগে না তাদের। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, কোন অঞ্চলের কথা বলছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার আপনার বাড়ি থেকে সাকুল্যে শ-খানেক কিলোমিটার দূরের পারফেক্ট উইকেন্ড ডেস্টিনেশন, সুন্দরবন।

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ব-দ্বীপ সুন্দরবনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে কল্লোলিনী কলকাতা। লোনা জলের রাজ্যে সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঘে-মানুষে-ম্যানগ্রোভে জড়াজড়ি করে টিঁকে রয়েছে। সেই কোন কালে মক্কার বেটি বনবিবি স্থাপিত হয়েছিলেন সুন্দরবনে, কিছু মানুষ তার আগেও হয়ত ছিলেন— কিন্তু তা নামমাত্র। অতঃপর বেহুলা-লখাইয়ের ভেলায় ভেসে মানুষের আগমন, আর ব্রিটিশ আমলে সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়াল লাখের ওপরে। সায়েবরা শেয়ালদা অবধি বিস্তৃত সুন্দরবন কেটে রেললাইন বসালেন, রাত্রিবেলা লাইনের কাজ করার লোক পাওয়া যায় না— এখন যেখানে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন, ইতিউতি বাঘ বেরোয় সেখানে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া “রাস্তার মোড়ে মোড়ে উন্নয়নের” ঠেলায় জঙ্গল গিয়ে ঠেকল প্রায় এক তৃতীয়াংশে, লর্ড ক্যানিংয়ের নামাঙ্কিত টাউন শহর নির্ধারিত হল সুন্দরবনের প্রবেশপথ হিসেবে।

এহেন অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই সাগর বেয়ে আসা যাবতীয় ঘূর্ণাবর্তের ঝড়ঝাপটা সুন্দরবনের গায়ে এসে পড়ে। কিন্তু সে তো ব্যতিক্রম নয়, আগেও হত, এ আর এমনকি নতুন কথা। নতুন কথা যেটা, সেটা হচ্ছে আজ দ্বীপভূমির জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ঠেকেছে কুড়ি লক্ষের ওপরে। মানুষ নামক দুপেয়ে জীবটিকে স্থান করে দিতে নুয়ে পড়েছে একের পর এক গরান, গেওয়া, হেতাল, সুন্দরী গাছের সারি— প্রকৃতি যাদের পরম মমতায় সাজিয়ে রেখেছিল ঝড়ঝাপটার হাত থেকে মূল ভূখণ্ডকে রক্ষা করার জন্য। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল লোনা মাটির সঙ্গে তার অদ্ভুত সখ্য— কবি চিত্তপ্রিয় (শঙ্খ) ঘোষ জীবনের ইনিংস থেকে অবসর নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কবিতা “আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি”-কেই জীবনের ধ্রুবসত্য মেনে মাটিকে বুকের কাছে জাপটে বন্দি করে রাখে এই গাছগুলি। কিন্তু মানুষ নামের নির্বোধ প্রাণীটির চিরকালীন স্বভাব খোদার ওপর খোদকারি করে বেড়ানো। ফলে আপনি যদি আজ গদখালি থেকে নৌকো বেয়ে পাখিরালার দিকে এগোতে থাকেন, দেখবেন একফালি বিচ্ছিন্ন জমিতেও কীভাবে যেন একটা জেসিবি ঢুকে পড়েছে, জঙ্গল কেটে খোদাই চলেছে সর্বত্র! এহেন আহাম্মুকির মাশুল তো চোকাতেই হয়— কী সেই মাশুল?

বঙ্গে ইয়াস নামক ঝড়ের পারফরম্যান্স তার নেমসেক নায়কের ফিল্মি কেরিয়ারের মত ফ্লপ হলেও ভরা কোটালের সঙ্গে যুগলবন্দিতে দ্বীপভূমির প্রায় অধিকাংশ গ্রাম আজ জলের তলায়। মাটির বাঁধের আগল খুলে হু হু করে ঢুকেছে জল, বসতবাটি চাষের জমি মায় খাবার জলটুকু পর্যন্ত নেই অনেক জায়গায়। গোসাবা আইল্যান্ড থেকে কুমিরমারি সর্বত্র মানুষের হাহাকার, নিজের ঘরবাড়ি জমিজিরেত ছেড়ে ফ্লাড শেল্টারে অসহায় মানুষের দিনযাপন। তা মানুষের অসহায়তায় মানুষই তো “মানুষ” হয়ে পাশে দাঁড়ায়, খুব স্বাভাবিক। আগেও দাঁড়াতেন, বছর বছর সুন্দরবন ঝড়ঝাপটার আঁচড়ে বিপন্ন হলে কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ পাশে দাঁড়াতেন দূরদ্বীপবাসীদের, হাতে তুলে দিতেন শুকনো খাবার, জল, ওষুধ, ত্রিপল প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ২০২০ সাল, অতিমারির বছর— মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির তাল ঠোকাঠুকি চরম পর্যায়ে। লকডাউনে কাজহারা প্রান্তিক মানুষ, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত আমফান ঝড়ের খোঁচা। এহেন সময় সুন্দরবনের মানুষের জীবনে দেখা দিল এক নতুন উপদ্রব।

সারাদিন একটানা বাড়িতে থেকে কাজ, সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক খিটিমিটি, বাচ্চাদের ক্যাচরম্যাচর— এমনকি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উল্লাসের মুহূর্তগুলোও ভাবলে মনে হয় যেন গতজন্মের কথা। এমন সময় আমফান ঝড় শহরবাসীর জীবনে আনল টাটকা খুশির ঝিলিক, নতুন সম্ভাবনার ছোঁয়া। পাঠক আমায় মাফ করবেন, সরকার যখন একাধারে রাস্তায় গোল্লা কাটতে আর অন্যদিকে সাদা দাঁড়ির পরিচর্যায় ব্যস্ত, তখন বহু নাম জানা বা না-জানা সহযোদ্ধা নিজের কাজকর্ম সরিয়ে রেখে এমনকি নিজের জীবন বিপন্ন করে আর্তের সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন— তাঁরাই প্রকৃত “খতরোঁ কে খিলারি”, কুর্নিশ জানাই তাঁদের। কিন্তু মুদ্রার একটা উল্টো পিঠও হয়, যখন আমোদপ্রমোদের সমস্ত দরজা বন্ধ, তখন কিছু ক্রাউড ফান্ডিং করে টাকাপয়সা তুলে কয়েক বস্তা চাল, ডাল, আলু কিনে একটা উইকেন্ড সুন্দরবনে কাটিয়ে আসাই যায়— অতএব গাড়ির ডিকিতে মদ বোঝাই করে চালাও পানসি গদখালি। আমি এক বর্ণও বাড়িয়ে-চড়িয়ে বলছি না, বা মানুষের সৎ উদ্দেশ্যকে কালিমালিপ্ত করার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় আমার নেই। দুই দিন আগেই এই পর্যটকদের সম্পর্কে ঢালাও খবর করেছে কলকাতার এক প্রথম সারির সংবাদপত্র, কেজি খানেক ত্রাণ সঙ্গে পেটি খানেক মদ! এদের দৌলতে আমরা একটি নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলাম, ত্রাণ পর্যটন। অতিমারি পরবর্তী সময়ে কলকাতা থেকে গদখালি অবধি ত্রাণবাহী গাড়ির লাইন দেখলে তাক লেগে যায়! আর দ্বীপে দ্বীপে কয়েকশো মিটার দূরে দূরে যেন ত্রাণ কাউন্টার বসেছে, সর্বত্র একটা ফিল গুড ব্যাপার— সানগ্লাস পরা হাসি হাসি মুখে পার্লে জি বিতরণকারীর সেলফি কিংবা ত্রাণফি, “মানুষের সেবায় রুদ্রনীল ফিলিং মাদার টেরিজা উইথ সিক্সটি এইট আদার্স”! এই সেবাব্রতীদের এইটুকু ধারণা পর্যন্ত নেই যে মানুষটার মাথার ছাদ নেই, খাবার জলটুকু নেই তাকে এই মুহূর্তে দু কেজি চাল, বিস্কুটের প্যাকেট আর স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর জন্য ত্রিপলের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় ওষুধ আর শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা। এবং এই পর্যটকেরা অনেকেই ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের মেজ শালির ছোটবোনের দেওর কিংবা ফুলপিসির খুড়শ্বশুরের ছোটভায়রাভাই— ফলে এই করোনা পরিস্থিতিতে এদের “দেশপ্রেমের ঠেলায়” পুলিশ প্রশাসন বনদপ্তর থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা পর্যন্ত সকলেই বিরক্ত। তাহলে উপায়? অতিমারির পরে ত্রাণ পর্যটকের সংখ্যা হয়ত কমবে কিন্তু দ্বীপবাসীদের ফি বছরের ভোগান্তি রোধের উপায়টা কী?

না, সুন্দরবনের মানুষ আপনার দু কেজি চাল আর এক কেজি আলু চায় না, তারা নোনা মাটিতেও রক্ত ঝরিয়ে ফসল ফলাতে জানে— সেই কারণেই ত্রাণের লাইনে গ্রামবাসীরা গলায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসেন, “ত্রাণ চাই না, আমরা কংক্রিটের পাকা বাঁধ চাই”। জঙ্গলের যা ক্ষতি করার মানুষ তা করে ফেলেছে, ৫ কোটি চারা পুঁতলেই রাতারাতি জঙ্গল গজিয়ে উঠবে না একদিন সকালে— সুতরাং এখন সময়ের দাবি কংক্রিটের পাকা বাঁধের এবং যেটুকু জঙ্গল অবশিষ্ট আছে সেইটুকু বুকে আগলে রক্ষার। পাথরপ্রতিমার জি প্লট রক্ষা পেয়েছে পাকা বাঁধের জন্য, বছরের বাকি সময়টা ফেসবুকে এর তার ত্রাণের ছবি চুরি না করে আপনিও দ্বীপবাসীদের সঙ্গে সরকারকে প্রশ্ন করুন, কেন আয়লার বারো বছর পরেও গোটা দ্বীপপুঞ্জে পাকা বাঁধ তৈরি হল না— দেখবেন বনবিবি দু হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন আপনাকে। আসলে সুন্দরবনের একটা হান্সের প্রয়োজন, এবার আপনি কত শতাংশ হান্স হয়ে উঠতে পারছেন সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ আপনারই হাতে।


*ছবি সৌজন্য: মৈনাক সেনগুপ্ত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সোজাসাপ্টা কথা মুখের ওপর বলা। লেখকের সব মতামতের সঙ্গে সহমত।

Leave a Reply to Kingshuk Cancel reply