“মানুষের ওপর ধর্ম যে প্রভাব ফেলতে পারে, থিয়েটারেরও সেই একই প্রভাব ফেলতে পারা উচিত ছিল”

সৌমিত দেব

 


অর্ণ মুখোপাধ্যায় একজন নিজের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ। এমন এক হেরে যাওয়া মানুষ যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিত ভেমুলার কথা বলেন। জীবনে তৈরি করা প্রথম সিনেমায় দেখাতে পারেন ডাইনি সন্দেহে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া মায়ের ছাইয়ের সামনে বসে আছে মেয়ে। প্রতিদিন শুনতে পান নিজের আশেপাশে ঘটে যাওয়া সুচতুর অপমানগুলো, ছোট করা-গুলো। আর একই সঙ্গে জন্মগত দায়বদ্ধতায় তাকে মুখোপাধ্যায় পদবির ভারখানা বয়ে যেতে হচ্ছে আজীবন

 

ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার দাম এক টাকা, ঠিক সময়ে চুপ করে থাকার দাম দু-টাকা।
—ভাস্কর চক্রবর্তী

‘অথৈ’, কলকাতা শহরের বর্তমান যা অবস্থা তাতে মাথা উঁচু করে আশেপাশে তাকালে এই নামটাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বিবিধ পোস্টারে। লেখক ও নির্দেশক অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নির্ভর করে প্রায় সাত-আট বছর আগে ‘অথৈ’ নাটকটি নির্মাণ করেন অর্ণ। নির্মাণের গুণে নাটক ‘সুপারহিট’। মূল নাটকে ওথেলো চরিত্রটি ছিল এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। অর্ণর অথৈ দলিত। মানে যে শ্রেণির দম্পতিকে তাদের বাচ্চা মেয়ের সামনে, ভরা বাজারে, দিনের আলোয় বিবস্ত্র করা হয় তেমন একজন মানুষ। মাথা নিচু করে থাকা মানুষ। অথৈ কুমার লোধা। নাটকের একদম প্রথম ভাগেই অথৈ চরিত্রটির এই দলিত পরিচয় ভীষণভাবে গুরুত্ব পেলেও নাটক যত এগোয় ততই হারিয়ে যেতে থাকে পরিচয়ের রাজনীতি। হারাতে হারাতে শেষে গোটা বিষয়টাই একটা ব্যক্তিগত জটিলতার রাজনীতিতে এসে শেষে হয় নাটকে। কিন্তু ছবিতে তা হয় না। সেটার কারণ অবশ্য দুটো।

প্রথমত অর্ণ বিশ্বাস করেন তাকে দিয়ে সবচাইতে বেশি লিখিয়ে নেয় যে ‘সময়’ তিনি বেঁচে রয়েছেন সেই সময়টাতে।

আমার টাইমের কল ছিল বলেই আমি লকডাউনে ‘অথৈ’-এর চিত্রনাট্য লিখেছি। কারণ প্রথম যখন আমি নাটকটা লিখি তখনও আমার তিরিশ পেরোয়নি। তার প্রায় আট বছর পর এখন আমার বয়স বেড়েছে, নিজের মতো করে একটা পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে, সময়টা আরও বিচ্ছিরি নোংরা হয়েছে। আর হ্যাঁ আমি এটাই বিশ্বাস করি যে সময় লিখিয়ে নেয় অনেক কিছু! আর সময়ই লিখিয়ে নেয়! আর তাই নাটকের চেয়ে ছবিতে এই পরিচয়ের রাজনীতি আমি কনসাশলি অনেক বেশি রেখেছি। ইচ্ছে করে লিখেছি ভাত-কলমিশাক খাওয়ার অংশটা, মুড়ি খাওয়ার অংশটা। এগুলো কিন্তু নাটকে ছিল না। কারণ এখানে সিনেমা মাধ্যমটার সাহায্য পাওয়া যাবে। যেটার কালমিশেন হচ্ছে শেষে গিয়ে যখন গোগো বলছে— গায়ে পেচ্ছাপ করে দিলে চুপ করে থেকেছিস, পুড়িয়ে দিলে জাস্ট পুড়ে গেছিস।

দ্বিতীয়ত অর্ণ মুখোপাধ্যায় মনে করেন তিনি একজন হেরে যাওয়া মানুষ।

নাটক করার অভ্যাসে আমি নাটক করি না। ডিরেকশন তো দিই-ই না, অভিনয়ও করি না। আমার আর্জ না হলে আমি কিছুই করতে পারি না।

আমার জীবনের প্রথম ডিরেকশনের নাটক ‘এবং সক্রেটিস’। এটা আমার মধ্যে আছে। এই নিহিলিজমটা আমার মধ্যে আছে। আমি ‘তুঘলক’ থেকে যা যা নাটক করেছি সেখানে আমি এটা রেখেছি। আমি প্রেমের নাটক করেছি ‘শেষ রক্ষা’ কিন্তু সেখানেও আমি একটা ডার্ক থিম এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করেছি। আমি প্রতিদিনই ফিল করেছি যে ভেতরে যেটা আছে সেটা আসলে মানুষের ব্যর্থতার ইতিহাসই আছে। জানি না আমি হয়তো লাইফে ফেলিওরড বলে।

আর এই জন্যই তো অথৈ-তে এতগুলো কথাবার্তা এসেছে। ২০১৫-তে যেটা সারফেস লেভেলে ছিল, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সেটা এতটা ডিটেইলড হয়েছে। ২০১৪-১৫-র পর থেকে তো ভারতবর্ষ র‍্যাপিডলি চেঞ্জ হতে শুরু করেছে, এখন হয়তো একটু থমকে, কিন্তু চেঞ্জটা চলতেই থাকবে। ব্রেনওয়াশের ট্রিকসগুলো বদলাচ্ছে। এই সময় সবচেয়ে বেশি দায় ছিল আমাদের, সংস্কৃতিকর্মীদের। আমরা পারিনি। প্রতিদিন ফেল করেছি। আমাদের নির্দিষ্ট কোনও ভাষা নেই, বাংলার শিল্প বলতে কিছু নেই, কিছুই নেই। শিল্পের কাজ ছিল গ্রাসরুটকে অ্যাড্রেস করা। আমাদের মেধা আমাদের মনন আমাদের বুদ্ধি সেই সমস্ত জায়গায় আমরা এতটাই খর্ব, এতটাই ভীত, সন্ত্রস্ত এবং রিল্যাকটেন্ট, আমাদের যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, যেটা আমাদের পূর্বজরা অনেকটাই পেরেছেন বা তাদের পূর্বজরাও পেরেছেন, আমরা পারিনি।

সুমন মুখোপাধ্যায় ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ করতে পেরেছেন, ব্রাত্য বসু ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ লিখতে পেরেছেন, আমরা সেরকম কিছু করতে পারিনি। আমি আমাকেও বলছি যে আমরা এত ইন্ডিভিজুয়াল, এত আত্মমেহনে মত্ত, আমি আমার ছবি নিয়েই এত অবসেসড। ১৯২৫ থেকে যে বীজ তৈরি হয়েছে তার শিরা-উপশিরা এখন যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সেটার সমানে সমানে চলার জন্যে যতটা অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার কথা, আমরা কি আদৌ তা পারছি? আমার সবচাইতে বেশি রাগ আমার নিজের জাতির প্রতি, নিজের ক্ল্যানের প্রতি। আমরা যে প্রভাব রাখতে পারতাম তার বিন্দুমাত্রও পারিনি এবং এর মূল কারণ আত্মমেহন। আমি পারিনি কারণ আমি কনফিউজড। আমি নিজেও জানি না যে আমি কি একটা ইন্ডিভিজুয়াল, নাকি থিয়েটার কম্যুনিটিতে আমি নিজে নিজেকে নিয়োগ করেছি? আমি জানি না। পাপস্খালনের মতো হয়তো কিছু একটা লিখে দিলাম।

ধরা যাক টালমাটাল সত্তরের দশক, শুধু ভারতবর্ষ নয়, বাংলা নয়, গোটা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটেও অসীম গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়ে যে আন্দোলন হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, থিয়েটার হচ্ছে, সেখানে কিন্তু আমিও আছি! আমি উডস্টকে আছি, আমি প্রেসিডেন্সিতে আছি, আমি প্যান্থার আন্দোলনের লেখা ছড়িয়ে দিচ্ছি! সেই আমিটা, সেই সত্তর দশকের আমিটা ওগুলো পারত। ২০২৪ এর আমিটা পারবে না। কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও বড় বিপ্লব ঘটবে না, কোনও রেভলিউশন ঘটবে না, ছোট ছোট কিছু মুভমেন্ট হতে পারে। যদিও তিনি বলে গেছেন যে ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত মুভমেন্ট থেকেই বড় আন্দোলন জন্মায়, কিন্তু আমার মনে হয় যে এটা একটা ইউটোপিয়াই হয়ে গেছে। যে সমস্ত মানুষরা ফ্রন্ট লাইনার্স ছিল এসব আন্দোলনের, বর্তমান সময় তাদের এত ইনডিভিজুয়াল করে দিচ্ছে, এত ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে দিচ্ছে, বাধ্য করে দিচ্ছে, আমিত্বের সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে, সত্তরের দশকে আমি যেটা করতাম এখন আমি সেটা করব না। আমার মনটা হয়তো থাকবে যে— আহা রে এরম একটা হলে ভাল হত, আমি হয়তো একটা কবিতা লিখে ফেলব, কিন্তু আমি আর ওই আন্দোলন করতে পারব না। আমার এটা মনে হয়, সমাজতাত্ত্বিকরা হয়তো আরও ভাল বলতে পারবেন কিন্তু যেহেতু আমার প্রতিদিন মনে হচ্ছে যে সমাজটা একটা এক্সটিঙ্কশনের দিকে এগোচ্ছে, শো-অফ করতে করতে একটা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, সেহেতু আমার মনে হয় একটা কোভিড ঘটতে পারে, কিন্তু বিপ্লব হবে না।

আসলে ব্যক্তি হিসেবে আমরা প্রত্যেকে এত লেস-ইম্প্যাক্টফুল সমাজে যে কারণে আজ এই অবস্থায়। আমাদের কাজের বিন্দুমাত্র ইমপ্যাক্ট সমাজে নেই। ওই এন্টারটেনমেন্ট। আমি এখন একটা জিনিসই চাই আমি যে কাজগুলো করতে চাইব সেই কাজের যেন একটা অভিঘাত, ইম্প্যাক্ট থাকে এন্টারটেনমেন্ট ভ্যালুর সাথে সাথে।

কে জানে হয়তো এই ‘হেরে যাওয়া’ মানসিকতা থেকেই অর্ণ দেখতে পান, তাঁর চোখে পড়ে এমন অনেক অনেক ঘটনা, অনেক অনেক দৃশ্যকল্প যা আমাদের চোখে এড়িয়ে যায়। ঠিক যেভাবে ডাক্তারের পদবির ভার দেখে তারপর তার কাছে যায় ‘ভদ্রবাড়ির’ মানুষেরা, ঠিক যেভাবে সোশাল মিডিয়ায় অনরবত গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলে চলা মানুষটার বাড়িতে ব্রাহ্মণ ছাড়া বিয়ে দেওয়া হয় না বলে নিজের প্রেমিক অথবা প্রেমিকাকে ছেড় দিতে বাধ্য হয়েছে সে, ঠিক যেভাবে ‘সভ্য, শিক্ষিত’ মানুষের মুখে শোনা যায় ‘ওদের গায়ের রং একটু চাপাই হয়’, ইত্যাদি। আমরা দেখতেই পাই না। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অভ্যাসে, কখনও অস্বীকারে।

অথৈকে ডাক্তার তৈরি করার পেছনে একটা লিটারাল তাড়না ছিল। কারণ ওথেলো ছিল সৈনিক। একজন সৈনিককে রক্তমাংস ঘাঁটতে হয়, ডাক্তারকেও হয়। তবে আরেকটা কারণ তো অবশ্যই ওটা ছিল।

আমাদের এখানে হয়তো এটা হয় না যে জল খেলেও রাস্তায় পিটিয়ে মেরে দিল। কিন্তু এক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকেও, প্রতিপদে অপমানিত হতে হয় পদবিটা ‘মুর্মু’ বলে। আমি যদি খুব ভুল না হই তাহলে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহিলা প্রফেসর, তাঁর পদবি ছিল সম্ভবত ‘কেরকেট্টা’, কার্যত উনি যেটা বলেন সেটা হল ভিজুয়াল মলেস্টেশন। উনি বুঝতে পারছেন ওটা হচ্ছে। মৃণাল বলে একটা সংস্থা এই সব নিয়ে কাজ করে। তার কারণ এই অদৃশ্যকরণের রাজনীতির প্রতি একটা প্রশ্রয় আছে। পাথর দিয়ে থেঁতলে মেরে ফেলাটা হয়তো হচ্ছে না কিন্তু যেটা হচ্ছে সেটাও ভয়ঙ্কর। চুনি কোটাল কিছু করেনি তো, তাহলে আত্মহত্যা করল কেন?

এখন প্রশ্নটা হল যখন আশেপাশে ভিনগ্রহী থাকবার খবরে সমাজদুনিয়া উত্তাল হয়ে পড়েছে তখন আশেপাশে ক্রমাগত ঘটে চলা এই ঘটনাগুলো চোখে পড়ছে না কেন? কানে আসছে না কেন?

এটা পলিটিক্যালি একটা অদৃশ্যকরণের প্রক্রিয়া। আমি যবে থেকে সমাজ বিষয়টাকে আমার মতো করে ব্যাখ্যা করতে শিখেছি আমার মনে হয়েছে, যারা  উচ্চবর্ণ, এগিয়ে থাকা সোসাইটি, তারা চিরকালই বিষয়টা রাজনীতির নাম করে, সম্পর্কের নাম করে, ক্লাসিক্সের নাম করে এড়িয়ে গিয়েছে। এখানে পুরোটাই একটা অদৃশ্যকরণের খেলা ছিল, এবং সেটা কতটা সুদূরপ্রসারী— যে কারণে আমাকে ইউটিউব রিভিউয়ার বলেন বাংলায় জাতপাত নেই! এটা অনেক বছর ধরে, আমি যখন অথৈ লিখছি তার আগে থেকেও রিয়েলাইজ করেছি, যে কেন নেই। অন্যান্য রাজ্যে যখন বছরে ১৩ হাজার, ১৪ হাজার রেজিস্টার্ড দলিত অত্যাচারের ঘটনা আমাদের এখানে সেটা ৯৮। ওই যে দুটো শ্রেণিতে ভেঙে দেওয়া হল ধনী এবং গরিব। আর যেন কিছু নেই! এই যে মানুষকে দুটো শ্রেণিতে ভাগ করে দেওয়া এটা আসলে একটা পলিটিক্যাল খেলা। এই খেলাটার মধ্যে আমরা সবাই পার্ট হয়ে গেছি সেই কবেই। এই কারণে আমি খুব সোচ্চার এবং আমি জীবনে প্রথম নাটক করেছি একটা পলিটিক্যাল নাটক। কিন্তু কখনও কোনও প্রোপাগান্ডিস ডায়লগ লিখিনি। আমি প্রথম অথৈ-তে আচ্ছে দিন আয়েঙ্গে লিখতে বাধ্য হয়েছি। এইটা হচ্ছে বক্তব্য।

আসলে অথৈ তৈরি করবার পেছনে একটা লং প্রসেস ছিল। আমি বিশ্বাস করি যে কোনও আর্ট প্রসেসের ক্ষেত্রেই একটা অর্গানিক ব্যাপার স্যাপার হয়। যেমন খুব কনসাসলি আমি অথৈ-তে ক্রিকেটের চ্যাপ্টার লিখিনি। এটা এসে গেছে আমার ক্রিকেটের ভালবাসার কারণে। এতে অনেকে বলেছেন বিষয়টা লঘু হয়ে যাচ্ছে, ট্রাজেডির ভাবটা লঘু হয়ে যাচ্ছে যখন স্লগওভার জায়গাটা আসছে। বলতে পারে, কিন্তু অর্গানিকালি আমি মানুষটা এরকম। আমি সেটাই আমার শিল্পে কনভার্ট করার চেষ্টা করেছি।

একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির লোককে কয়েকটা নির্দিষ্ট কাজ করতে দেব না। ও একটা নির্দিষ্ট নদীর জল স্পর্শ করতে পারবে না। ওর হাতে জলও খাওয়া যাবে না। ও আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে না। ওর সংস্পর্শ মানে মহাপাপ। আমি ভুল করে ওর ছায়া মাড়িয়ে ফেললে ওকেই মারতাম আর এখন ও চেয়ারে বসে ‘অপরাধ’ করেছিল বলে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। কারণ আমি এটা করতে পারি। আমার কাছে নানা ধরনের লাইসেন্স আছে।

যেমন, উচ্চবর্ণের লাইসেন্স।

অস্পৃশ্যতার রাজনীতি যারা করে বা যারা জৈবিকভাবে বিশ্বাস করে যে অমুকরা অস্পৃশ্য, এবং আমরা উচ্চবর্ণের তারা চিরকালই সুবিধাভোগী শ্রেণি। এটা অ্যাবসলিউটলি একটা সুবিধাভোগের রাজনীতি যেটার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিনের বাবু কালচার জড়িয়ে আছে, বামুনবাদ জড়িয়ে আছে, আমরা উচ্চবর্ণের ফলে এটা আমাদের অধিকার, ওরা আমাদের শ্রম দেবে। আমরা ঠাকুরঘর মোছাব, কিন্তু গঙ্গাজল ধরতে দেব না। ‘অথৈ’ রেফারেন্সে বলতে পারি যেমন, দেখো একটা লোক আশ্রয় দিয়েছে, সে তাকে ভগবান বলছে, কিন্তু ছেলেটা নিচেই শোয়। মা ছেলেকে বলছে যে— এই জামাটা তুমি আর পোরো না, কাঁধের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে, ওকে হাসিমুখে দিয়ে এসো। এবং সেই ছেলে যখন জামাটা দিচ্ছে সে আরেকটু ছিঁড়ে দিচ্ছে। এটা আছে আমাদের মধ্যে। এটা আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে আছে। আমরা জিনগতভাবে স্বার্থপর, আমরা জিনগতভাবে সুবিধাভোগী, এবং আমরা কম শ্রম করতে ভালবাসি।

যেমন ধর্মের লাইসেন্স।

আমার মনে হয় সব ধর্মের গোড়ার কথাটাই কোথাও গিয়ে এক সুরে বাজে, সেটা হল পিছিয়ে পড়া মানুষ বা হিউম্যানিটেরিয়ান জায়গা থেকে সব ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। সেটা যে ধর্মই হোক না কেন। বেসিকটা হচ্ছে আমি মানুষের কথা বলব। মরালিটির কথা বলব। কিন্তু সেটার জার্নি এবং সেটার বিকৃতিকরণ হতে হতে হতে আজকে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

রোমে একটা সময় তো পাদ্রিরা থিয়েটারকে ব্যবহার করেছেন। থিয়েটারের ইতিহাসটা দেখলে দেখতে পাবে রিচুয়াল টু রিপ্রেজেন্টেশন। এটা হচ্ছে থিয়েটারের বেসিক হিস্ট্রি। আমি ‘কালা পাত্থর’ ছবিটার কথা বলব, সেই সময় দাঁড়িয়ে যখন ওইরকম শ্রমিকশ্রেণির মানুষের কথা বলা হয় একটা বলিউডের মেনস্ট্রিম ছবিতে। একটা ভীষণ দরকারি ছবি। সেখানেও অমিতাভ বচ্চন যখন খনিতে নেমে শ্রমিকদের বাঁচাচ্ছে, তখনও সেখানে ট্রাকে একটা ভগবানের ছবি। পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা বলবার জন্য সারা ভারতে মেইনস্ট্রিম আর্টে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। তার পরেও কিন্তু কালা পাত্থর-এ কিন্তু অমিতাভ অ্যাংরি ইয়ংম্যানের কোড ব্রেক করেছে।

হ্যাঁ মানুষের ওপর ধর্ম যে প্রভাব ফেলতে পারে, আমি থিয়েটারের কথা বলতে পারি, হ্যাঁ, থিয়েটারেরও সেই একই প্রভাব ফেলতে পারা উচিত ছিল। কিন্তু এখন পারবে না। এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে পারবে না। থিয়েটারের জনমত তৈরি করতে পারার কথা ছিল, কিন্তু সেই জনমত তৈরি করতে পারছে না। আগামীতেও তৈরি করতে পারবে কিনা সে কথা আমি বলতে পারব না, এই মুহূর্তে পারছে না, বা ধর্মের যে জোর শিল্পমাধ্যমে সেই জোর নেই।

 

চণ্ডালোপী দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণ
হরিভক্তি বিহীনশ্চ বিপ্রহপি শপচাধম।

এই কথাখানাও বলেছিলেন বাংলার আরেক ধর্মগুরু শ্রীচৈতন্য। শূদ্র, মুচি-মেথর বা হিন্দু-মুসলমান কোনও জাতবিচার ছিল না। তিনি স্বয়ং উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ হয়েও স্বর্ণকার, মালাকার, শঙ্খকার, গোয়ালা প্রভৃতি শূদ্র ও পেশাভিত্তিক জাতিসমূহের লোকদের সঙ্গে ব্যষ্টিগত সম্পর্ক করলেন। তাহলে কি কখনও কখনও ধর্মের জিতে যাওয়াটাও ভাল কথা নয়?

আমি আমার মতো করে যতটুকু চৈতন্যকে চিনেছি তাতে আমার মনে হয়েছে বাংলায় যুক্তিবাদের প্রবক্তা যদি কেউ থেকে থাকেন তবে সেটা চৈতন্য। আমার মনে হয় চৈতন্যকে নিয়ে অনেক গভীরে গিয়ে কাজ করবার কথা ছিল শুধুমাত্র তাঁকে ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে মনে না রেখে। যেমন গৌতম বুদ্ধ— গৌতম বুদ্ধ যেভাবে মার্গদর্শন চর্চা করেছেন তাতে তাঁকে ভগবান বানিয়ে দেওয়া হল। আমার একেবারেই এ বিষয়ে পড়াশোনা নেই, তবে, আমি বৈষ্ণব ধর্মকে ধর্ম হিসেবে দেখি না এবং চৈতন্যকে ধর্মগুরু হিসেবে দেখি না। আমার মনে হয় বাংলার যে প্রাচীন ইতিহাস সেখানে চৈতন্য একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার, এবং আমার কাছে উনি চিরকালই বাংলার প্রথম যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবেই রয়ে যাবেন।

অর্ণ মুখোপাধ্যায় একজন নিজের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ। এমন এক হেরে যাওয়া মানুষ যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিত ভেমুলার কথা বলেন। জীবনে তৈরি করা প্রথম সিনেমায় দেখাতে পারেন ডাইনি সন্দেহে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া মায়ের ছাইয়ের সামনে বসে আছে মেয়ে। প্রতিদিন শুনতে পান নিজের আশেপাশে ঘটে যাওয়া সুচতুর অপমানগুলো, ছোট করা-গুলো। আর একই সঙ্গে জন্মগত দায়বদ্ধতায় তাকে মুখোপাধ্যায় পদবির ভারখানা বয়ে যেতে হচ্ছে আজীবন।

আমি নিজেকে প্রতিদিন প্রশ্ন করি। আমাকে প্রতিদিন নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। আনকনশাসলি কিছু জিনিস তো রয়ে গেছে আমার মধ্যে। আমি এখনও নিজের সঙ্গে লড়ে এক গ্লাস জল খেয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে পারিনি। এটা কতটা ধর্ম থেকে, কতটা আমার অভ্যাস তা আমি জানি না। কিন্তু আমি পারিনি। আমার বাবা রেভেল্যুশনারি। আমি সেটা পারব না। এটা আমার দৌর্বল্য। আমি জানি একজন দলিত লেখক যেভাবে অথৈ লিখতে পারতেন বা বানাতে পারতেন, সেটা আমি পারব না। যাই ঘটে যাক, একটা পয়েন্টের পর গিয়ে হয়তো এটা একটা রাজনীতি, ও সমাজসচেতন লোকের কাজ হল করে যাওয়া। আমি এটা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করি। এটার মধ্যে একটা ডিপ অবজারভেশন আছে, একটা ডিপ অ্যানালিসিস আছে। কিন্তু যাপনটা তো নেই। তাই আমি পারিনি। এখানেও হেরে গেছি।

অর্ণর মতো হেরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলুক। অথৈ-এর মতো ছবির সংখ্যা আরও বেড়ে চলুক। যাতে অন্তত এই কথাগুলো বারবার বারবার করে বলা যায়।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5117 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আমি পড়তে ভালোবাসি। কিন্তু আজকাল বই পড়া হয়ে ওঠে না। এই চার নম্বর প্লাটফর্ম আমার সেই পড়ার খিদে কিছুটা হলেও মেটায়।

Leave a Reply to dipankarroy61 Cancel reply