কয়েকটি কবিতা

কার্ল স্যান্ডবার্গ

 

ভূমিকা ও অনুবাদ : জিললুর রহমান

কার্ল স্যান্ডবার্গ (জন্ম : ৬ জানুয়ারি, ১৮৭৮, মৃত্যু : ২২ জুলাই, ১৯৬৭) মোট তিনবার তিনি পুলিত্জার পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে দু’বার কবিতার জন্য, একবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী রচনার জন্য।

খ্যাতিমান মার্কিন কবি, লেখক, সম্পাদক কার্ল স্যান্ডবার্গ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি ইলিনয়ের গলসবার্গে জন্ম গ্রহণ করেন। তার সুইডিশ বংশোদ্ভূত বাবা অগাস্ট ও মা ক্লার্ক জনসন সুইডেনের উত্তরাংশ থেকে আমেরিকার অভিবাসী হয়েছিলেন। রেলরোডে চাকুরির সন্ধানে গিয়ে বেশ ক’জন অগাস্ট জনসনের সম্মুখীন হয়ে তিনি পরিবারের নতুন নামকরণ করেন ‘স্যান্ডবার্গ’। তারা খুব দরিদ্র ছিলেন। ১৩ বছর বয়সেই কার্ল স্কুল ছেড়ে দেন বেমানান কাজের উদ্দেশ্যে এবং পরিবারকে সহায়তা করার জন্যে দুধ বহনের গাড়ি চালনার কাজ শুরু করেন। টেলসবার্গের ইউনিয়ন হোটেল ও নাপিতের দোকানে মুটের কাজ করেন বছর চারেক। পরে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। হোটেল পরিচারকের কাজও করতে হয়েছিল তাকে। ১৭ বছর বয়সে তিনি ভবঘুরে হিসেবে পশ্চিম ক্যানসাসে ভ্রমণ করেন।

পুয়ের্তো-রিকোতে ৬ষ্ঠ ইনফেন্ট্রিতে তিনি স্বেচ্ছাসেবক সৈনিক হিসেবে স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধে ৮ মাস কাজ করেন। এ সময়ে তাঁর সাথে দেখা হয় ল্যামবার্ড কলেজের এক ছাত্রের সাথে। ছোট্ট স্কুলটি স্যান্ডবার্গদের শহরেই অবস্থিত। এই যুবক কার্ল স্যান্ডবার্গকে যুদ্ধ থেকে ফিরলে ল্যামবার্ডে পড়ার জন্যে নাম লেখাতে উৎসাহিত করেন। এখানে পড়ার সময় স্যান্ডবার্গ প্রফেসর ফিলিপ গ্রিন রাইটের চোখে পড়েন এবং তিনি তাঁকে কেবল উৎসাহিতই করেননি বরং তার প্রথম কবিতার বইয়ের অর্থের যোগানও দিয়েছিলেন, যা ১৯০৪ সালে ‘সীমাহীন পরমানন্দ’ (Endless Ecstasy) নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। ল্যামবার্ডে ৪ বছর পড়লেও তিনি কোনো ডিপ্লোমা ডিগ্রি পাননি। (তবে পরে যদিও তিনি ল্যামবার্ড, নক্স কলেজ এবং নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন।) কলেজের পাট চুকিয়ে স্যান্ডবার্গ মিলওয়াউকিতে চলে যান, যেখানে তিনি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন লেখক ও পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। এখানেই তিনি এক ফটোগ্রাফারের বোন লিলিয়ানকে বিয়ে করেন, যাকে তিনি ভালোবেসে পাউলা নামে ডাকতেন। এমন সময়ে সামাজিক সংবেদনশীলতার কারণে তিনি উইসকনসিনে সোস্যাল ডেমোক্রেট পার্টির জন্যে কাজ করতে থাকেন। পরে তিনি মিলাওয়াউকির ১ম সোস্যালিস্ট মেয়রে সেক্রেটারি হিসেবে ১৯১০ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

তবে, তার পরপরই তিনি শিকাগো চলে যান। শিকাগো ডেইলি নিউজে কাজ করার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখির প্রসার। ডেইল নিউজে তিনি সম্পাদকীয় লেখক হিসেবে কাজ করেন।

এই সময়ে হ্যরিয়েট মনরো একটি কবিতা বিষয় ম্যাগাজিন প্রকাশনা শুরু করেছেন “Poetry : A Magazine if Verse” নামে। তিনি স্যান্ডবার্গের কবিতা ছাপতে থাকেন এবং মুক্তক বাক্যবিন্যাসে লিখতে তাকে উৎসাহিত করেন। হুইটম্যানের মতো এমন স্টাইল তিনি কলেজেই নিজের মধ্যে বপন করেছিলেন। মনরো এই কবির কবিতায় ঘরোয়া বক্তব্য পছন্দ করেন এবং এটাই স্যান্ডবার্গকে তার পূর্বসুরিদের কাছ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। এই সময়কালে স্যান্ডবার্গ শিকাগোর সাহিত্যিক রেনেসাঁর পথিকৃত হিসেবে প্রতিভাত হন। এসময়ে তাঁর সাথে এই কাব্যান্দোলনে সঙ্গী ছিলেন বেন হেশট, থিওডোর ড্রেইসার, শেরউড অ্যান্ডারসন এবং এডগার লি মাস্টারস।

তিনি তাঁর সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেন শিকাগোর কবিতা (Chicago poems, ১৯১৬) এবং তারপর ভূট্টাতুষকারী (Corn huskers, ১৯১৮) কবিতার বই দুটির মাধ্যমে; যার জন্যে তিনি ১৯১৯ সালে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯২০ সালে স্যান্ডবার্গ লেখেন ধোঁয়া ও ইস্পাত (Smoke and Steel), যা তার আধুনিক শিল্পায়নবাদের সৌন্দর্য অন্বেষণে প্রথম বিলম্বিত প্রচেষ্টা। এই তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমে স্যান্ডবার্গ মুক্তক বাক্যের কবিতার জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমেরিকাকে কবিতায় তুলে ধরেন।

বিশের দশকে তিনি কিছু উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্পের কাজে হাত দেন। তার মধ্যে ছিল আব্রাহাম লিংকন নিয়ে পড়ালেখা। আশৈশব তিনি ভালোবেসেছেন ও প্রশংসা করেছেন আব্রাহাম লিংকনের কিংবদন্তীকে। তিরিশ বছর ধরে তিনি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন এবং ধীরে ধীরে লিখেছেন ৬ খণ্ডে সমাপ্ত প্রাক্তন প্রেসিডন্ট লিংকনের জীবনপঞ্জি। বিশের দশক আরও অবলোকন করে স্যান্ডবার্গের লোকসাহিত্য সংগ্রহ — আমেরিকান গানভাণ্ডারের পালাগান, এবং নতুন আমেরিকান গানভাণ্ডার (১৯৫০) এবং শিশুদের জন্যে বই। শেষের বইগুলো স্যান্ডবার্গ ব্যাঞ্জো বা গিটার বাজিয়ে লোকগান গাইতে গাইতে এবং কবিতা আবৃত্তি করতে করতে, প্রতিবছর আমেরিকা জুড়ে ছোট ছোট ভ্রমণের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৩০-এ, কবি তার আমেরিকা উদযাপন চালিয়ে যান ম্যারি লিংকন, বউ ও বিধবা (১৯৩২), জনতা, হ্যাঁ (১৯৩৬); এবং তাঁর লিংকন জীবনীর ২য় অংশ, আব্রাহাম লিংকন : যুদ্ধ কালে (১৯৩৯)-র মধ্যে দিয়ে। এই কাজের জন্যে তিনি আবার পুলিৎজার পুরস্কার পান।

১৯৫০ সালে তিনি কবিতা সমগ্রের জন্যে আবারও পুলিৎজার পুরস্কার পান। তাঁর শেষ বয়সের কবিতার বইগুলো হল ফলের কবিতা, ১৯১০-১৯৬০ (১৯৬০) এবং মধু ও লবণ (১৯৬৩)। কার্ল স্যান্ডবার্গ ১৯৬৭ সালের ২২ জুলাই নর্থ ক্যারোলিনার ফ্ল্যাট রকে পরলোকগমন করেন।

কবির গ্রন্থতালিকা :

কবিতা–

  • Chicago Poems (1916)
  • Complete Poems (1950)
  • Cornhuskers (1918)
  • Good Morning, America (1928)
  • Harvest Poems (1950)
  • Honey and Salt (1963)
  • In Reckless Ecstasy (1904)
  • Selected Poems (1926)
  • Slabs of the Sunburnt West (1922)
  • Smoke and Steel (1920)
  • The People, Yes (1936)

গদ্য—

  • Abraham Lincoln : The Prairie Years (1926)
  • Abraham Lincoln : The War Years (1939)
  • Mary Lincoln : Wife and Widow (1932)
  • Steichen the Photographer (1929)
  • The American Songbag (1927)
  • The New American Songbag (1950)

 

কার্ল স্যান্ডবার্গের কবিতা

১। একটি মুদ্রা

তোমার পশ্চিমা মাথা এখানে টাকায় বিকোয়,
তোমরা দুজন কুয়াশায় একত্রে ম্লান হয়ে আসা দোসর।

ষাঁড়ের কাঁধে খুঁচিয়ে,
কৃশকায় ভারতীয় মুখ,
আমরা যারা এসেছি পরে যেখানে গিয়েছ তোমরা
তোমাদের নতুন নিকেলে গড়া মুরতিরে স্যালুট জানাই।

আমাদের কাছে
তোমরা:
অতীত।

প্রেইরির
দৌড়বিদগণ:
বিদায়।

২। একটি বেড়া

এখন লেকের সামনে পাথরের বাড়িটির কাজ শেষ হল
আর শ্রমিকেরা শুরু করে বেড়া বানানোর কাজ।
বেড়ার খোঁটা লোহার বারের সাথে
ইস্পাত পয়েন্ট দিয়ে গড়া
যা মানুষের জীবনকে ছুরিকাহত করতে পারে যারা তার উপর পড়বে।
বেড়া হিসেবে এটা মাস্টারপিস, আর থামিয়ে দেবে জনতাকে,
আর যত ভবঘুরে এবং বুভুক্ষু মানুষ এবং খেলার জায়গা খুঁজে ফেরা শিশুদের।
লোহার বারগুলো পেরিয়ে চোখা ইস্পাত ডিঙিয়ে কিছুই যাবে না
কেবল মৃত্যু ছাড়া, বৃষ্টি ও আগামী দিন ছাড়া।

৩। সারাদিনমান

সারাদিনমান কুয়াশা এবং ঝোড়ো হাওয়ায়,
তরঙ্গগুলো মারমুখী ঝাপটা মারে
অদম্যদের সারির বিপরীতে।
বাছা আমার, সে সাগরে গিয়েছে অনেক অনেকদিন আগে,
তার বাদামী কোঁকড়া চুল টুপির নিচে গলে বেরিয়ে আসে,
সে আমাকে দেখে নীল আর ইস্পাতের চোখে;
ছিমছাম, সোজা এবং সত্য, সে দূরে সরে যায়,
বাছা আমার, সে সাগরে গিয়েছে।
সারাদিনমান কুয়াশা এবং ঝোড়ো হাওয়ায়,
তরঙ্গগুলো মারমুখী ঝাপটা মারে
অদম্যদের সারির বিপরীতে।

৪। কুয়াশা

কুয়াশা নেমে আসে
ছোট্ট বিড়ালের পায়ের উপর।

হারবার ও শহরের উপর দিয়ে
নীরব নিতম্বের দিকে তাকিয়ে
বসে পড়ে,
আর তারপর সরে যায়।

৫। আর তারা মেনে চলে

শহরগুলো ধ্বংস করো।
দেওয়ালগুলিকে টুকরো টুকরো করো।
ভেঙে দাও কারখানা ও ক্যাথেড্রালগুলো,
গুদাম এবং ঘরবাড়ি
টুকরো পাথরখণ্ড, চেরাই কাঠ
আর কালো
পোড়া কাষ্ঠখণ্ড:
তোমরা হলে সৈন্য আর
আমরা তোমাদের আদেশ করি।

শহরগুলো গড়ে তোলো।
দেওয়ালগুলো আবার বানাও।
আবারও কারখানা এবং ক্যাথেড্রালগুলো
একসাথে বসাও,
গুদাম ও ঘরবাড়ি
দালান বানাও জীবন ও শ্রমের জন্যে:
তোমরা কর্মী এবং নাগরিক সকল:
আমরা তোমাদের আদেশ করি।

৬। এক স্ফিঙ্কস

মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছ পাঁচ হাজারটি বছর এবং কখনও একটু ফিসফিসও করোনি। মিছিলগুলি পাশে আসে, মিছিল প্রশ্ন করে, উত্তরে কখনও ধূসর চোখ নাড়াওনি, কুলুপ আঁটা মুখে কখনও বলোনি কথা। একটুও অসন্তোষ দেখাওনি কোনওকিছুর প্রতি,
যা তোমার জ্ঞাতসারে আসে, বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুদীর্ঘ বয়সে। আমি তাদের একজন
যে তোমার সকল জ্ঞান সম্পর্কে জানে এবং আমি আমার প্রশ্নগুলো নিজের মধ্যেই রাখি :
আমি তোমার জবাবটুকু জানি।

৭। অ্যাজটেক

তুমি অ্যাজটেক থেকে এসেছ
অগ্রবাহুতে একটি তাম্রসহ
সূর্যাস্তের চেয়ে কৃষ্ণকায়
এমনকি নদীকে বিদায় জানিয়ে।

আর আমি বলেছি, তুমি স্মরণ করো,
তোমার সেসব অগ্রবাহু
ব্রোঞ্জের চেয়েও সূক্ষ্ম
আর তুমি ছিলে আনন্দিত।

এ ছিল অশ্রু
আর পশ্চিমের পথ
এবং গৃহমুখী
যখন জিজ্ঞেস করি
কেন সেথা অলঙ্কারের দাগ
যেখানে একজন মানুষের আংটি বসানো ছিল
তোমার মধ্যমায়।
আর আমি তোমাকে
ফিরে আসতে বলি
দিবসগুলো দীর্ঘতর হবার আগেই।

৮। পায়ের ছোট আঙুলগুলো

জ্যানেট, ওইখানে নীল তারা,
আমাদের এখান থেকে পনেরো বছরের যাত্রাপথ,
যদি আমরা ঘণ্টায় শত মাইল যাই।

ওদিকে এক শাদা তারা, জ্যানেট,
চল্লিশ বছরের পথ,
যদি ঘণ্টায় শত মাইল যাই।

আমরা যাব কি
নীল তারকার দিকে
কিংবা শাদা তারার উদ্দেশ্যে?

৯। লাল বন্দুকের মাঝে

লাল বন্দুকের মাঝে
সৈন্যদের হৃদপিণ্ডে
মুক্ত রক্ত দৌড়ে যায়
দীর্ঘ, সুদীর্ঘ মিছিলে:
স্বপ্নেরা প্রবহমান।

চামড়ার ঘোড়ার জিনে
সৈন্যদের মাথায়
সকল সম্মুখ যুদ্ধের
প্রচণ্ড উত্তেজনায় এবং মৃত্যুতে:
স্বপ্নেরা প্রবহমান।

তপ্ত মাজলগুলোতে
সৈন্যদের হাতে
নারীর মাংসের ভাঁজ থেকে আনা—
নরম মধ্যভাগে রক্ত আর কান্না—
তোমাদের সকল হৃদয়ে এবং হাতে
বন্দুক, ঘোড়ার জিন আর মাজলের মধ্যে:

স্বপ্ন,
স্বপ্নেরা প্রবহমান,
তাদের পেছনের মৃত্যু থেকে জেগে ওঠা,
ভাঙা এবং আর কোনও কাজেই লাগবে না:
পথের ও সমাপ্তির স্বপ্নেরা প্রবহমান।

১০। ঝুড়ি

কথা বলেন স্যার, আর বিজ্ঞ হউন
আপনার শব্দ বেছে নিতে কথা বলেন, স্যার,
আপেলের বস্তার ওপর উবু হওয়া এক বুড়ির মতো।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

Leave a Reply to জিললুর রহমান Cancel reply