পরিণত গণতন্ত্র, নাবালক নাগরিক

পরিণত গণতন্ত্র, নাবালক নাগরিক -- আশিস নন্দী | ভাষান্তর: স্বাতী ভট্টাচার্য

আশিস নন্দী

 

ভাষান্তর: স্বাতী ভট্টাচার্য

দিকপাল চিন্তাবিদ আশিস নন্দীর এই বিশেষ প্রবন্ধটি বঙ্গানুবাদে প্রকাশিত হয় অনুষ্টুপ পত্রিকার ১৪১৯ শারদীয় সংখ্যায়। প্রবন্ধটি বঙ্গানুবাদ করেছিলেন স্বাতী ভট্টাচার্য। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এবারের রিজার্ভ বগির বিষয়— 'উপমহাদেশে গণতন্ত্র কোন পথে'। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গণতন্ত্র বিষয়ক এই মূল্যবান প্রবন্ধটির পুনঃপ্রকাশ করা হল।

প্রশাসনের যে সব কৌশল দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে, তার মধ্যে একটা হল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ‘শিশু’ বলে দেখা। ব্যক্তির নির্মাণের এই প্রকরণকে এক কথায় বলা চলে ‘নাবালকায়ন’ (infantilisation)। আধুনিক যুগে নাবালকায়নকে বিশেষ মান্যতা দিয়েছে অতলান্তিক মহাসাগরের দাস ব্যবসা, আর ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা। এ দুটোই ঘটেছে প্রধানত ইউরোপের উদ্যোগে। মহাসাগরের দাস ব্যবসা, আর নীতির চোখে, বিজ্ঞানের চোখে, দাসপ্রথা ঔপনিবেশিকতাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কাজে নগরায়নকে ইউরোপীয়রা ব্যবহার করেছে। একে কাজে লাগানো হয়েছে ইউরোপীয় মননের জগতে, আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, এই দুইয়ের জন্য জমি তৈরি করতে। আধুনিক জ্ঞানের যত প্রসার হয়েছে, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ (যার মধ্যে সামাজিক বিবর্তনের নানা ধারণাও জড়িত ছিল) বিষয়ে ধারণা ছড়িয়েছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে ততই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে নাবালকায়নের প্রকরণ।

আর ঘটনা তো এটাই যে দাসপ্রথা আর ঔপনিবেশিকতা দিয়েই বিশ্বায়নের গোড়াপত্তনটা হয়েছিল। এ নিয়ে কেউ তর্ক জুড়তেই পারেন। কিন্তু একদিকে নানা মহাদেশের মধ্যে বাণিজ্য, তার মধ্যে আবার জ্যান্ত মানুষ কেনা-বেচার ব্যবসা, আর অন্যদিকে চার চারটে মহাদেশে ছড়ানো অর্থনীতি, যেখানে সূর্য কোনোদিন অস্ত যেত না— একে যদি বিশ্বায়ন না বলা যায়, তবে আর বলব কাকে? ঔপনিবেশিকতার শেষ টানতে, আর দাসপ্রথা থেকে সঞ্জাত উত্তর আমেরিকার প্রকট বর্ণবিদ্বেষকে মুছে ফেলতে যে একখানা বিশ্বযুদ্ধ লড়তে হল, সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল।

ভুলে গেলে চলবে না, যখন দাসপ্রথা আর ঔপনিবেশিকতা বিশ্বজোড়া প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে, তার আগেই ইউরোপে ঘটে গিয়েছে যুক্তিবাদের অভ্যুত্থান, মধ্যযুগের অবসানের ‘আলোকপ্রাপ্তি’। ইউরোপের সমাজের গভীরে তা প্রবেশ করেছে। প্রজাতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, আর মানবসভ্যতার অগ্রগতির কথা পশ্চিমের প্রতিদিনের ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সত্যি বলতে কী, ওই যুক্তিবাদই আধুনিক ঔপনিবেশিকতাকে তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল। এর আগে অন্য দেশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার মানে ছিল নির্বিচারে শোষণ চালানো, আর ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই অন্যায়ের দায় এড়িয়ে যাওয়া। নতুন ঔপনিবেশিকতা কিন্তু নিজেকে দেখল মানবজাতির অগ্রগতির ধারক বলে। ইতিহাসের প্রয়োজনে, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের তাগিদে, মানবজাতিকে ‘সভ্য’ করে তোলা শ্বেতাঙ্গদের এক গুরুভার কর্তব্য হয়ে দেখা দিল।

ধর্মনির্দিষ্ট কর্তব্যের জগৎ থেকে সরে আসায় ঔপনিবেশিকতার জন্য আবার নতুন করে নীতির ভিত্তি, ধার্মিকতার ভিত্তি খুঁজতে হল। সেই প্রয়োজন মেটালো নাবালকায়ন, যারা ইউরোপিয় নয়, তাদের ‘শিশু’ বলে দেখলে তাদের নিয়ে দাস ব্যবসা, কিংবা তাদের দেশকে উপনিবেশে পরিণত করে তাদের অবাধে শাসন চালিয়ে গেলেও বিবেকের দংশনের প্রশ্ন নেই। বিদ্বজন আর চার্চ মিলে এই নতুন জগৎ-জোড়া ব্যবস্থার সমর্থনে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ, কিছু দৈবনির্দিষ্ট যুক্তি সাজিয়ে ফেলল, যেগুলোর মিলিত শক্তি বড় কম নয়। ফলে পিছিয়ে পড়া, বিচারবুদ্ধিহীন, মূর্খ মানুষদের তত্ত্বাবধান করা ইতিহাসের দাবি হয়ে দাঁড়াল। সে বিচারিদের উন্নত ভবিষ্যতের পথ দেখানো খ্রিস্টানদের পবিত্র কর্তব্য হয়ে দেখা দিল।

তবে এইসব নতুন বিধিব্যবস্থাকে ন্যায়ের বিচারে প্রতিষ্ঠিত করতে সেই সময়ে যা বিশেষ করে কাজে এসেছিল, তা হল মানবদেহ সম্পর্কে এক নতুন বৈজ্ঞানিক ভাষা, আর তার ঘাড়ে-বসা এক নতুন জীবনচক্রের রাজনীতি। এই ভাষায় শাসিত-শাসকের সম্পর্ক বোঝাতে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সাথে যোগ হল শিশু-অভিভাবকের রূপক। প্রথমত, মানবজীবনে শৈশব তার স্বকীয় মূল্য হারিয়ে ফেলল, শিশু হয়ে উঠল প্রাপ্তবয়স্কের অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ সংস্করণ। শৈশব মানে দাঁড়াল এমন একটা সময় যখন ‘শিশুর মতো’ হওয়া মানে বাইবেলের পবিত্রতা, সরলতার প্রকাশ, কিন্তু ‘শিশুসুলভ আচরণ’ মানে সেইসব লক্ষণ, যেগুলোকে শক্ত হাতে এমনকী নির্দয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একবার যখন এই রূপকগুলো চালু হয়ে গেল, তখন সেসিল রোডসের মতো লোকেরা স্বচ্ছন্দে বলতে পারলেন, আফ্রিকার লোকেরা ‘আধা-বুনো আধা-বালক’ যাদের কড়া নজরদারি দরকার, সামাজিক আচার আচরণে নতুন করে শিক্ষিত করে তোলা দরকার যাতে সুদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন তারা বড় হয়ে উঠে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারে। এই ‘বড় হয়ে ওঠা’ প্রক্রিয়াটি পরে নানা আকর্ষণীয় নাম পেয়েছে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল আধুনিকতা, উন্নয়ন, আর অগ্রগতি।

দ্বিতীয়ত, চিন বা ভারতের মতো পুরনো সমাজকে বিশ্বায়নের খোপে পুরে ফেলার জন্য বলতে হল, এই সব প্রাচীন সভ্যতাগুলো আগে উন্নত ছিল ঠিকই। কিন্তু, এখন তারা ভেঙে পড়েছে, পতন ঘটেছে এই মানুষদের। স্বাভাবিকভাবেই এদের চালনা করার দায়িত্ব নিতে হবে নবীন রাষ্ট্রগুলোকে, যারা পূর্ণ পৌরুষের পেশিশক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন উৎপাদনের আদর্শ তুলে ধরেছে। চিন-ভারতের সংস্কৃতি হয়ে উঠল জাদুঘরের সামগ্রী, ছুটির দিন তা দেখে তাজ্জব হওয়া চলে, কখনো ভাল লাগতেও পারে, তা বলে তাকে আর কাজের জিনিস বলে ভাবা চলে না।

উনিশ শতকে পৌরুষের ধারণা কেমন করে জনসমাজে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তা সবাই জানে। যা অল্প লোকেই জানে তা হল, ভিক্টোরিয় যুগে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, তাদের শোষণ, কঠোর নিয়ন্ত্রণে তাদের পালন। ফিলিপ আরিয়েস এবং লয়েড ডিমস সেই বিভৎসতার কাহিনী সবিস্তারে শুনিয়েছেন।

অপরিমিত হিংসা এবং নিপীড়ন থেকে কেউই অক্ষত বেরোতে পারে না, নিপীড়ন-কর্তারা তো নয়ই। যে নির্যাতন করে, যে নির্যাতিত হয়, উভয় পক্ষই সমান আক্রান্ত হয়। নির্যাতন যখন একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে ওঠে, নিয়ম হিসেবে চালু হয়ে যায়, তখন অহংবোধ, ব্যক্তিসাপেক্ষতাও সেই ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে, তাদের মতো করেই নিজেকে মানিয়ে নেয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই নারী পুরুষ বা শিশু অভিভাবক বিভেদের উপর আধিপত্যের যে নকশা তৈরি হয়েছিল তা ইউরোপীয় সভ্যতার আধিপত্যের রূপক হয়েই থাকল না, ইউরোপ ও আমেরিকায় তা শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধদের সামাজিক অবস্থানকে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ করে আনল। তৃতীয় বিশ্বের নানা এলাকায় কোনো কোনো বেয়াড়া লোক অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে ইউরোপীয়দের ফেঁদে-বসা কাহিনী আসলে ইতিসাসের পাতায় পাতায় ইঁদুর-ধরার কল। কিন্তু অমন দু’চারজন আজেবাজে লোক থাকবে তা ধরেই নেওয়া যায়, কেউ তাদের তেমন আমলও দেয় না।

ঔপনিবেশিক যুগের এই যে দীর্ঘ যাত্রাপথ, যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে আমাদের মানসিকতা, আমাদের সংস্কৃতি, তার ফলেই নাবালকায়ন আজও আমাদের মন টানে, মন ভোলায়। নাবালকায়নের ধারনাই অন্তরালে থেকে রূপ দিয়েছে আধুনিক নাগরিকত্বের ধারণাকে। যে সব দেশ কোনো দিন তৃতীয় বিশ্বে গণতান্ত্রিক অধিকারকে মান্যতা দেয়নি, তারাই আজ গণতন্ত্রের হয়ে সওয়াল করছে। কিন্তু শাসক আর শাসিত, দুই শ্রেণির মধ্যে কাজ করে চলেছে হিংসা, নিষ্পেষণের ইতিহাস। শাসকদের কাছে ‘ইতিহাস’ হল আবেগবর্জিত, নিপাট একখানা পাঠ্যপুস্তক। তাদের ভাবখানা এমন যে, অতীতের কেউ একজন কোনও আরেক জনের প্রতি। কিন্তু যে জগতে বাস করে শাসিতেরা, যেখানে পূর্বাপর নেই বলে ইতিহাসও নেই, সেই অবচেতনের অনালোকিত জগতে তাদের সম্মিলিত স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে তাদের উপর হিংসার ইতিবৃত্ত। সেই স্মৃতি কাজ করে চলে বলে শাসকদের প্রতি তাদের এমন আস্থাহীনতা, নিজেদের বিপরীত অবস্থান নেবার পুনঃপুনঃ প্রচেষ্টায়। তা কাজ করে এক বিশাল ব্যাপৃত চেতনার মধ্যে। তা এখনও সঙ্গীত, শিল্প ও সাহিত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারেনি।

গণতন্ত্র বলতে সচরাচর যা বোঝা হয়, তার মধ্যে চারটি স্পষ্ট ধারা লক্ষ্য করা যায়। এক, আশির দশকের শেষে ‘শীতল যুদ্ধে’ যে বিপুল জয় হয়েছিল বিজেতাদের, তার ফলে তারা এখন আরও বেশি প্রত্যয়ী যে বিশ্বের ইতিহাস লেখা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই গণতান্ত্রিক প্রশাসন আর দৈনন্দিন কাজ করার প্রক্রিয়ায় যে নিয়মিত কিছু ‘মাপসই’ নাগরিক তৈরি করবে, তা নিয়ে তারা আগের মতো অত সন্দেহ প্রকাশ করছে না। গোটা বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ‘সামাজিক বিবর্তনের’ যেসব আবছা ধারণা তারা দিয়েছিল, তা নিজেদের উপর প্রয়োগ করতে তারা আর ইতস্তত করবে না। সত্যি বলতে কী, তারা নিজেদের দেশের ‘অপরিণত’ নাগরিকদের উপর তারা ক্রমশ সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ছে। ভয় পাচ্ছে যে, আম-জনতাকে তাদের মতো করে ছেড়ে দিলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো হয়তো তারা ঠিকমতো নিতে পারবে না।

দুই, শীতল যুদ্ধের দীর্ঘ বছরগুলোতে কোনও কোনও গণতন্ত্র বুঝতে পারছিল যে, কমিউনিস্ট দেশগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের নিজেদের নাগরিকদের স্বাধীনতা আর অধিকার। গণতন্ত্রের মধ্যেই তারা গণ্ডিবদ্ধ, ছিদ্রহীন ব্যবস্থার পত্তন করেন। রবার্ট জুং বহু আগে বলেছিলেন যে সমাজে গণতন্ত্র থাক আর একনায়কতন্ত্র থাক, তাদের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঘিরে সবসময়ই থাকে গোপনীয়তা, নজরদারি আর সেন্সরশিপের একটা অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। উদার সমাজে এমন দেওয়াল-ঘেরা প্রতিষ্ঠান এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিধির বাইরে থেকে জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উচ্চপ্রযুক্তির গবেষণা। এই বিষয়গুলো ক্রমশ রাজনৈতিক বিতর্ক বা আইনসভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের বৃত্তে চলে আসছে – যেন বিশেষজ্ঞরা রাজনীতির উর্ধ্বে, সমালোচনার বাইরে। রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠানের নিপীড়নের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যা করতে পারেনি, শীতল যুদ্ধের বিজেতারা তা বিনা আয়াসেই করে ফেলেছেন, এবং তা করেছেন নাগরিকদের সম্মতিতেই। সেই নাগরিক, যাদের অতি যত্নে ক্রমশ নিষ্ক্রিয়, অরাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়েছে। এ থেকে যদি কিছু শেখার থাকে তা এই যে, বন্ধু নির্বাচনের সময়ে কোনও রাষ্ট্র বেখেয়ালে তা করে ফেলতে পারে, কিন্তু শত্রু নির্বাচন করতে হলে কোনও সতর্কতাই যথেষ্ট নয়।

তিন, মিডিয়ার বৃদ্ধি আর সেই সঙ্গে সীমাহীন আমোদ-প্রমোদের ধারণা প্রায় বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে গিয়েছে। তাই প্রশাসনও ‘বিনোদন শিল্প’-এর মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। রাজনীতি একটা সুপরিকল্পিত প্রদর্শনী হয়ে উঠেছে, টিভির পর্দায় যা মানুষের বসার ঘরে হাজির হয়। নাগরিকরা হয়ে ওঠে রাজনীতির এক ‘ভার্চুয়াল’ বিশ্বের স্বেচ্ছাবন্দি, রাজনৈতিক বক্তব্যের শ্রোতা। রাজনীতির এই সংযোগ তাই একমুখী। সেই রাজনীতি থেকে মুছে গিয়েছে দুঃখ-কষ্ট-মৃত্যু। যারা প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উঠে আসছেন, তাদের চাইতে বিনোদন শিল্পের লোকেদের কাছে রাজনীতি এখন অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে, কারণ বিনোদনের লোকেরাই ভোট পাওয়ার প্রকরণটা আরও ভাল বোঝেন।

বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় এখন নাগরিকরা প্রধানত রাজনীতির দর্শক, চার কি পাঁচ বছরে এক বার তাঁরা ভোটের অধিকারটি প্রয়োগ করে দেখেন কেবল। বাকি সময়ে তাঁরা খেলার দর্শকের মতো টিভিতে রাজনীতি দেখেন, সক্রিয় অংশগ্রহণের একটা ছদ্ম-উত্তেজনা উপভোগ করেন। ‘পরিণত’ গণতন্ত্রগুলোতে রাজনীতির ‘অরাজনীতিকরণ’ আর কেবল কথার কথা নেই, তার প্রতিফলন স্পষ্ট ধরা পড়ে ভোটের দিনে অতি সামান্য ভোটারের উপস্থিতিতে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত যত নাগরিক ভোট দিতে যায় তার অনুপাত ভারতের অর্ধেক। রাজনীতির যেগুলো কেন্দ্রীয় বিষয়, যেমন ব্যাপক দারিদ্র, সমাজের নিচু স্তরে নিরাপত্তার অভাব, পরিবেশ-সহ জীবনযাত্রার নানা সহায়কের ক্ষয়, জীবিকা হারানো, সেই বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে ঠেলে বার করে দেওয়া হচ্ছে বহু দেশে। অক্ষম, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ক্ষোভ-বেদনা থেকে বহু মানুষ বাধ্য হচ্ছেন এমন কোনও আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে যা ব্যক্তিকে তার কর্তৃত্বের বোধ ফিরিয়ে দেয়। তা যদি দায়িত্বশীল, আত্মসচেতন, স্বনিয়ন্ত্রিত নাগরিকের আদর্শ না হতে পারে, তা হলে অন্তত একটা নৈতিক জগতে কোনও এক মহাজাগতিক শক্তির প্রতিনিধিই না হয় হল।

চার, সুখী নাগরিকের সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে আজকের গণতন্ত্রে। নাগরিক তারাই যাদের স্বাধীনতা রয়েছে ভোট দেওয়ার, অঢেল ভোগ্যপণ্য উপভোগের, ইচ্ছেমতো প্রমোদ-ভ্রমণের আর সীমাহীন আমোদ-বিনোদনে আকণ্ঠ ডুবে থাকার। সক্রিয়, দায়িত্বশীল ও সুখী নাগরিক হল সে, যে এই সব কাজে ব্যস্ত থাকে। এত স্বাধীনতা সত্ত্বেও যারা অসুখী, ধরে নেওয়া হয় তারা বেখাপ্পা, বেমানান। খুঁতখুঁত করার কারণ খুঁজে-বেড়ানো বেয়ারা লোক। সোভিয়েত রাশিয়ায় এদের মনোচিকিৎসকের সার্টিফিকেট দিয়ে পাঠানো হত পাগলা গারদে৷ একটি আদর্শ সমাজেও যারা অসুখী, তারা তো শাস্তিযোগ্য বটেই। উদার সমাজে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয় মনোবিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে অবসাদ কমানোর ওষুধ খেতে।

বিশ্বের নানা প্রান্তে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য, কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য যেসব গণতান্ত্রিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোকেও এই খোপে ভরে ফেলা হয়েছে। তার ফলে এক একটা গোটা জনগোষ্ঠীর ‘নাবালকায়ন’ ঘটে গিয়েছে। সাহারার নীচের আফ্রিকার দেশে খাদ্যের অভাবই হোক, আর দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুনামি-বিপন্নরাই হোক, একই মডেল চাপানো হয়েছে সবার উপর। এমনকী গণহত্যার সাক্ষীদেরও চট করে ফেলে দেওয়া হয় ‘আতঙ্কগ্রস্ত’ ‘অসমর্থ’ শ্রেণিতে৷ সেই কাজে একটা মস্ত সুবিধে করে দিয়েছে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সিনড্রোম’ লক্ষণটি, যা ত্রাস- বিপর্যস্ত মানুষের থেকে স্বাধীন সিদ্ধান্তের, আত্মকর্তৃত্বের সমস্ত ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়, আর তা ন্যস্ত করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের উপর।

নাবালকায়ন যখন আমাদের সমকালীন হিংসা, নিপীড়নের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে বলে স্পষ্ট হচ্ছে, তখন কি তার একটা ইতিহাসের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। তার দিকেই এগোচ্ছি আমরা। আলোকপ্রাপ্তির যুগ, আর ঐতিহ্য আমরা আজও বহন করে চলেছি, তা যখন কলমকে চালিত করবে, তখন ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঘটনাস্রোতের ব্যক্তিসাপেক্ষতা (‘subjectibity’) স্রেফ খড়কুটো বলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আর পেশাদার ইতিহাসদের মনপসন্দ আর্কাইভসে বেঁধে ফেলা হবে ইতিহাসকে। এমন নিকোনো-নিড়ানো ইতিহাস তৈরির চেষ্টা বানচাল করতে বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও কোনও সাইকোঅ্যানালিস্ট চেষ্টা করেছিলেন ইতিহাসচর্চায় ঢুকে পড়তে। কিন্তু তাতে ইতিহাসের বিস্তার হওয়ার চেয়ে সাইকোঅ্যানালিসিসের বিস্তার হয়েছে বেশি। নাবালকায়নের সেই ‘যথার্থ ইতিহাসে আলোকপ্রাপ্তি-উত্তর যুগের সব রকম হিংসার কথা লেখা  হবে হিংসার শিকার মানুষের মনোজগতকে বাদ দিয়ে, তাদের বোধ-অনুভূতির নকশাকে বাদ দিয়ে। কয়েক কোটি মানুষের যন্ত্রনাবোধ বেঁচে থাকবে কেবল মানবচেতনার সীমান্তে। তাই-তো সাধারণত হয়ে থাকে- এক অলিখিত মহাকাব্যের টুকরো-টাকরা অংশের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে আসে ঝাপসা হতে-থাকা স্মৃতি। লোকায়ত সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, কখনও কখনও যার ছায়া দেখা যায়।

 

বানান অপরিবর্তিত

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...