![prasanto](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/06/prasanto.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
লেখক সাংবাদিক, কবি ও প্রাবন্ধিক
আমাদের যৌবনবেলায় একটা গান খুব শুনতাম। গানের প্রথম দিকের পাঠটি ছিল, ‘চিন চিন করি তবু চিনতে না পারি…।’ পরে, ছয়ের দশকের উগ্র জাতীয়তাবাদের ঋতুতে সেই গানের কথা ঈষৎ বদলে গিয়ে হল, ‘চিনি চিনি করি তবু চিনিতে না পারি…।’ গানটির ইতিবৃত্তান্ত যা-ই হোক, একটা কথা সম্ভবত ঠিক। চিনকে আমরা চিনতে পারিনি। আমিও না, মোদিও না।
চিনের শীর্ষনেতা শি জিনপিঙের সঙ্গে গত ছ’ বছরে ন’বার ছবি তুলে, দোলনায় দুলেও মোদি চিনকে চিনতে পারেননি। পারেননি তাদের মন জয় করতে। তাই লাদাখ নিয়ে এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সসেমিরা অবস্থা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বৈঠকে যা বললেন, তাতেই তা পরিষ্কার – সায়েবদের ভাষা ধার করে বলতে গেলে, ‘utterly confused statement’। চিন তো প্রথম থেকেই বলে আসছে, তারা নয়, চিনে ঢুকে হামলা চালিয়েছে ভারতই। এখন তো প্রধানমন্ত্রী কার্যত সেই বয়ানেই সিলমোহর দিয়ে বসলেন! অন্তত সংবাদমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর যে ভাষ্য ছাপা হয়েছে, তা তো তাই বলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “চিন ভারতের জমিতে এক ইঞ্চিও ঢোকেনি।” গত ১৯ জুন, শুক্রবারের সেই সর্বদল বৈঠকে ওই মন্তব্যে অবশ্য সরাসরি ‘স্থান’ এবং ‘পাত্রের’ নাম করেননি মোদি। নরেন্দ্র উবাচ, “ওখানে কেউ আমাদের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে আসেনি। ওখানে আমাদের এলাকায় কেউ ঢুকেও বসে নেই। আমাদের কোনও পোস্ট অন্য কারও দখলেও নেই।” আর তাতেই স্তম্ভিত-হতভম্ব দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক মহল।
অমনিই শুরু হয়ে যায় শোরগোল। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে এসে চিনের এই আগ্রাসী কাণ্ড নিয়ে যখন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়, তখন দেশের খোদ প্রধানমন্ত্রী কী করে এমন মন্তব্য করে বসলেন! তাহলে কি ভারতীয় সেনাই রাতের অন্ধকারে চিনের ভূখণ্ডে ঢুকে গণমুক্তি ফৌজের সেনাতাঁবুতে আগুন লাগিয়েছে, যার প্রত্যাঘাতে এক কর্নেল-সহ ২০ জন ভারতীয় সেনার প্রাণহানি? আর যদি তাই হয়, তবে এই দুঃখজনক মৃত্যুর দায় কাদের? যে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী ফায়দার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ইন্ধনের অভিযোগ উঠেছে বারবার, সেই তিনি চিনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে চলতি সংঘাতের আবহে কী করে এমন মন্তব্য করে বসলেন, তা নিয়ে বিস্মিত রাজনৈতিক মহলও।
অস্বস্তি তাঁর সরকারের অন্দরেও। শুরু হয়েছে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই খাস প্রধানমন্ত্রীর দফতর তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি জারি করেছে। এই অবস্থায়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যতই রাহুল গান্ধিকে দুচ্ছাই করুন বা জেপি নাড্ডা যতই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে কটাক্ষ করুন, এর জবাব তো একদিন প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, প্রতিরক্ষা ও বিদেশমন্ত্রককে দিতেই হবে! কেননা, ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, চিনের মতো একদলীয় শাসনতন্ত্র নয়। চিন বিশ্বের কাছে কোনও কথাই খুলে বলে না। করোনা থেকে লাদাখ – চিনের গোপনীয়তা নীতি অক্ষুণ্ণ। এইবারেও মৃতের সংখ্যা নিয়ে চিনের তরফে এ-পর্যন্ত কোনও উচ্চবাচ্য নেই। প্রাক্তন সেনাপ্রধান তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ভিকে সিং যথার্থই বলেছেন, “চিন বরাবরই হতাহতের সংখ্যা গোপন করে। ’৬২-র যুদ্ধের সময়ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা স্বীকার করেনি বেজিং।”
যাই হোক, মাঝখান থেকে চিন ও ভারতের সীমান্তদ্বন্দ্বে গালওয়ান-এর মতো একটি স্বল্পখ্যাত উপত্যকা বিশ্ববাজারে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেল। অনেকেই মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন গালওয়ান খুঁজতে, আর গুগল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা জিপিএস খুলে বসে পড়েছেন। ভারত ও চিনের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। ইদানীং সেই সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টেই দু’দেশের সেনার মধ্যে চাপানউতোর তৈরি হয়েছে। অতীতেও বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। এই তো গত ১১ মার্চ দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে বিদেশমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, লাদাখের আটত্রিশ হাজার বর্গকিলোমিটার জমি চিনের দখলে আছে। অথচ আজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়েছে, লাদাখের তেতাল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার জমি চিনের দখলে আছে। সোজা হিসাবে তার মানে, চিন বর্তমানে ভারতের পাঁচহাজার বর্গকিলোমিটার বাড়তি জমি দখল করে নিয়েছে।
বলা বাহুল্য, সংঘপরিবার ও সরকারের স্বঘোষিত ধ্বজাবাহক মিডিয়াগোষ্ঠীর লোকজনেরা সবাই চুপ। যাঁরা এবেলা-ওবেলা পাকিস্তান, বাংলাদেশকে চোখ রাঙান, তাঁদের এখন একগাল মাছি! বাংলাদেশের সঙ্গে আইনসঙ্গতভাবে ছিটমহল হস্তান্তরের সময় যে বিজেপি দল দেশের মাটি অন্য রাষ্ট্রকে দিয়ে দেওয়ার গল্প ফেঁদে দেশপ্রেমের নাটক করেছিল, সেই বিজেপি শাসনেই দেশের লাদাখ অঞ্চলের পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার জমি কি না লাল চিন দখল করে নিল! এ হেন লজ্জা থেকে মুখ বাঁচাতে দিলীপ ঘোষ ও তাঁর অনুগামীরা যে চিনা পণ্য বয়কটের জন্য লম্ফঝম্প করবেনই, তাতে তাই অপ্রত্যাশিত কিছু নেই। তাঁদের প্রধান পথপ্রদর্শক যিনি, তিনি এই ক’দিন আগে পর্যন্তও ছুটে বেড়িয়েছেন দেশে দেশান্তরে, পাকিস্তানকে আজ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তো কাল গলা জড়িয়ে ধরেছেন পশ্চিমের কোনও রাষ্ট্রনেতার। হাতে তালি ঠুকে বলছেন ‘ঘর মেঁ ঘুসকর মারেঙ্গে’। মানে, পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে পাকিস্তানকে তিনি উত্তমমধ্যম দিয়ে আসবেন। মেঘবৃষ্টির আড়ালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে আসবেন। সেনাপ্রধানকে রণকৌশল বোঝাবেন। এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীর এখন এমন মুক্তকচ্ছ দশা? বোঝা যাচ্ছে, চোটপাট তাঁকে ভোট এনে দিতে পারে, আইটি সেল এনে দিতে পারে লাখো লাখো ভক্ত, কিন্তু সত্যিকারের সঙ্কটে সেসব বিশেষ কাজে আসে না। রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠতে ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি লাগে না, লাগে একটি বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ও একটি সংবেদনশীল হৃদয়।
মনে পড়ছে, ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে অটলবিহারী বাজপেয়ির কথা। ১৯৭৫ সালেই আমাদের সঙ্গে চিনের সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে তুলুং লা। তারপরেই বাজপেয়ি কী অসাধারণ সহনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার মধ্য দিয়ে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ বাজপেয়ী বা সুষমা স্বরাজের তুলনায় বিদেশনীতির প্রশ্নে নয়াদিল্লি কয়েক যোজন পিছিয়ে। বাগ্মিতায় নরেন্দ্র মোদির দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে ‘বিশ্বগুরু’ সাজতে গিয়ে লঘু–গুরু জ্ঞান লোপ? তাই কি সংঘের ওজনে চিনকে ওজন করতে গিয়ে বিস্ময়কর বিভ্রান্তি?
এমনিতেই আমরা করোনাভাইরাসে জর্জরিত। জনতা কার্ফু, লকডাউন পর্ব পার হয়ে দেশ আপাতত আনলক পর্যায়ে। এর মধ্যেই অতিমারিতে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতবাসী আক্রান্ত। এরই মধ্যে গালওয়ান উপত্যকা বিস্ফোটকের মতো বিষিয়ে নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে দেশবাসীর মধ্যে। সমস্যা তৈরি করেছে রাজন্যবর্গের মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে চিনা পণ্য বয়কটের কথা শোনা যাচ্ছে মন্ত্রী থেকে পাড়ার কার্যকর্তাদের মুখেও। ভিকে সিং তো বলেই দিলেন, অর্থনৈতিক নাগপাশে বেঁধে চিনকে ভাতে মারতে হবে। ওঁদের মতো বিশিষ্টজন এ-কথা বললে পাড়ায়-পাড়ায় তো চিনা পণ্যের ইন্তেকাল পালনের জন্য বহ্ন্যুৎসব চলবেই। চলছেও। আমার মতো আনপঢ়-এর বিনীত প্রশ্ন, এতে কি পিএলএ-কে এক ইঞ্চিও সরানো যাবে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে করোনা পর্বে মোদির ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আবেদনটিতে খুব খুশি। আমাদের সেই ধুঁধুলের ছোবড়া দিয়ে সফেন দেহ ঘষার দিন যদি ফিরে আসে তো লা জবাব। কিন্তু মোদির ভক্তরা কি গুটখা খাওয়া ছেড়ে তাম্বুল চিবোবেন? ডিজিটাল ভারতবাসী হওয়ার আকাঙ্খা বর্জন করে হাতে-হাতে লেনদেন সারবেন? তা না হলে তো চিনা পণ্য বর্জন করা যাবে না। এই যে ভক্তরা চিনা পণ্য বর্জনের হাওয়া তুলছেন, প্রচার করছেন, সেসব কীসে করছেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় তো? তা, সেখানে পৌঁছনোর জন্য আপনার যন্ত্রটি কি? মুঠোফোন তো? মানে, রেডমি, ওপ্পো, ভিভো বা অন্য কিছু। কিন্তু, সেসব তো চিনেরই পণ্য। এ কি ভ্রান্তিবিলাস, নাকি অবিমৃষ্যকারিতা? চিনা পণ্য পোড়ানোর ছবি তুলছেন চিনা কোম্পানির মোবাইল ফোনে! আর সেই ভিডিও ছড়াচ্ছেন চৈনিক টিকটক ভিডিওতে! ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর দেশজোড়া নোটবন্দি করে জিনিসপত্র কেনাবেচায় টাকা লেনদেনের জন্য পেটিএম-পথ বাতলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই পেটিএম কোথাকার প্রতিষ্ঠান, ভক্তবৃন্দের স্মরণে আছে কি?
এই পেটিএম কোম্পানির প্রধান অংশীদার চিনের আলিবাবা গ্রুপ। ভক্তরা মনে রাখবেন, এলইডি লাইট, টুনি চেন, টর্চ, লাইটার, ব্যাটারি, মোবাইল বা আতসবাজিতেই চিনা পণ্যতালিকা শেষ নয়, ওগুলো স্রেফ খেলনা। জীবনদায়ী যাবতীয় ওষুধের কাঁচামাল আসে চিনের উহান প্রদেশ থেকে। তা যদি বয়কট করা হয়, আমাদের ওষুধ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। এরই মধ্যে আবার মোদির মন্ত্রী রামদাস অঠাওয়ালে চিনা খাবার বয়কটের ডাক দিয়ে বসে আছেন। ওঁকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, আমাদের দেশে ‘চিনে খাবার’ বলে যা আমরা খাই, স্বাদে-গন্ধে-রন্ধনবৈশিষ্ট্যে তার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক ঠিক ততটুকুই, যতটুকু আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের। যাঁরা এই চৈনিক খাদ্য প্রস্তুত করেন, সেই ব্যবসায়ীরা তো নিখাদ ভারতীয়। ওগুলো বয়কট করা তাই এক ধরনের বালখিল্যতা।
স্বদেশি যুগে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের কট্টর সমালোচক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওঁর মেধাবী পাঠে বাঙালি একটু ভেবে দেখতে পারেন, বয়কট-রাজনীতিতে আসলে মরে কার। যাঁরা আমদানি-রফতানি বাজারের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, কোথায় কার টিকি কার জুতোর ফিতের সঙ্গে বাঁধা। এই যে গোটা লকডাউন-পর্ব বা এখন আনলক-পর্বে প্রধানমন্ত্রী যে সব রাজ্যের মুখন্ত্রীদের সঙ্গে ঘন-ঘন বৈঠক করলেন, ভিডিও কনফারেন্সে, তার অ্যাপ মানে জুম অ্যাপটির মালিক এক চিনা, এরিক ইউয়ান। কিংবা এই যে ৯ জুন কয়েকশো কোটি টাকা ব্যয়ে অমিত শাহ বাংলার ভোটপ্রচারের প্রাথমিক সূচনা করলেন ভার্চুয়াল জনসভা করে, তার কারিগরি টিকিও তো চিনের সঙ্গে বাঁধা। ওই যে সোশ্যাল ডিসট্যান্স রক্ষা করতে ঘরে বসে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন, তার বাহক, জ্যোম্যাটো বা সুইগি কোম্পানিরও সিংহভাগ শেয়ার চিনের।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনিচ্ছায় বা আশকারায় গত ছ’বছর ধরে দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত অনেক পুরনো বন্ধুকে হারিয়েছে। মুসলিম দুনিয়ার কেউ আজ ভারতের হয়ে গলা ফাটাতে রাজি নয়। সমর্থন হারিয়েছে নেপালের। নাগরিকত্ব আইন করে চটিয়েছে বাংলাদেশকেও। তৈলমর্দন চলছে শুধু হোয়াইট হাউসের বাসিন্দার। ফলে, এমন পরিস্থিতিতে চিনের গুঁতো খেয়েও বন্ধুহীন মোদি তেমন করে সরব হতে পারছেন না। তবু ভক্তদের চিৎকারে গগন ফাটার অবস্থা।
১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের সময়ও নয়া জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে চিন সম্পর্কিত নাড়ি ছেঁড়ার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও তখন চিনা পণ্য এই হারে উৎপাদন হত না, দেশে-দেশে রফতানিও হত না। তখন চিন-বিদ্বেষে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল কমিউনিস্টদের একাংশের ওপর। এমনকী, ‘চিনা বাদাম’-এর নামোচ্চারণেও নাকি আপত্তি ছিল তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের। শুনেছি, তখনকার বাম ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফের নেতা দীনেশ মজুমদারকে, ‘চীনেশ মজুমদার’ বলে সম্বোধন করতেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতারা। কিন্তু সেই পর্ব অনেকদিন পার হয়ে গিয়েছে। এখন ঘরে ঘরে চিন। হাতে হাতে চিন।
ভক্তরা মনে রাখবেন, বাণিজ্য চলে তার নিজস্ব নিয়মে। কোনও দেশ আমদানি-রফতানি করে নিজের স্বার্থেই। কাউকে পাইয়ে দিতে নয়। চিনের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্য বহুগুণিত হয়েছে, তা কারও দয়ায় নয়, বাজারের দায়ে ও চাহিদায়। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বলে শোর তুললে তাই গলার ব্যায়াম যতটা হবে, কাজের কাজ ততটা হবে না। ‘মেক’-টা করবে কে? আর কিনবেই বা কে? চিনা পণ্য সস্তা, আর সস্তা বলেই মানুষ কিনছে, তাই আমদানিও হচ্ছে। আমদানি ঠেকাবার একমাত্র উপায় ওই পণ্যের স্বদেশে উৎপাদন আর আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা।
অনেক মহাজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতদের বক্তব্য দেখছি, এটাই নাকি মাহেন্দ্রক্ষণ, চিনের সঙ্গে আমাদের সবরকম আমদানি-রফতানি বন্ধ করা হোক। অর্বাচীনরা বললে তবু মানা যায়, কিন্তু প্রাজ্ঞরা! ডব্লুটিও-তে সই করার পর, তা কি আর সম্ভব! বিশ্বায়নের মধুচন্দ্রিমায় তা করা যায় না এখন। আটকে দেবে ডব্লুটিও। বিশ্বব্যাপী বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা— যা সব দেশের হয়ে নজরদারি করে— আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো বা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা বরদাস্ত করে না। আর তাছাড়া, চিনা লগ্নি যে এখন কার-কার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে, তা বাছতে গেলে কম্বলের লোম বাছার জোগাড় হবে। তবে, এরই মধ্যে মনে রাখতে হবে, চিনা লগ্নি আসার বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে ভারতে একটা মহল থেকে চাপ তৈরি হয়েছে। রাহুল গান্ধিও লকডাউনের সুযোগে দেশে অবাধ চিনা লগ্নি ঢুকে পড়া নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। সম্প্রতি ভারত সরকারও কয়েকটি পদক্ষেপ করেছে। চাপিয়েছে কিছু বাধানিষেধ। আর ঝোঁক বাড়ছে মার্কিন লগ্নির আপ্যায়নে।
এ হেন জটিলতার মধ্যেই সংবাদের শিরোনামে গালওয়ান উপত্যকা। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ভক্তরা না বুঝুন, পাঠক একটু ভেবে দেখবেন, আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতিতে পণ্য ও পুঁজির চলাচল এমন জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে সম্পর্ক ছিন্ন করব বললেই করা যায় না। এ সব ভেবেই কি না জানি না, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘আত্মনির্ভরতা’র কথা, যেখানে আগে বলেছিলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। সেসব হয়তো একদিন হবে। কিন্তু যতদিন না হয়, ভারতের ভক্তদের এইসব নালায়েক কাণ্ডকারখানা দেখে শি জিনপিং হয়তো জনান্তিকে বলবেন, “ওরে, মেড ইন চায়না-র কাঁচামাল দিয়ে মেক ইন ইন্ডিয়া করবি? আমরা যদি হাত উল্টে দিই, খাবি কী, পরবিই বা কী!”