রাজনীতির নতুন সমীকরণ এবং ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’

সৌভিক ঘোষাল

 

২০১০ সালে প্রকাশিত হল দেবেশ রায়ের সুবৃহৎ উপন্যাস বরিশালের যোগেন মণ্ডল। নিকট ইতিহাসকে অবলম্বন করে লেখা এই উপন্যাসের কালপর্ব মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার আগের কয়েকটি দশক। সময়টা একদিকে যেমন ঘটনাবহুল, তেমনি নানা বিতর্কের আধার। যোগেন মণ্ডল বাংলার রাজনীতি বা ইতিহাসের আলোচনায় মাঝে পরিণত হয়েছিলেন এক বিস্মৃত মানুষে। খুব সম্প্রতি তাকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। আর সেই চর্চায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাধারার একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরব।

স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময়কালে যোগেন মণ্ডল ছিলেন দুই বাংলার রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য ও প্রভাব সঞ্চারকারী ব্যক্তিত্ব। তারপর তিনি ক্রমশ আলোচনার বাইরে চলে যান। প্রবল প্রভাব থেকে বিস্মৃতির কারণ দেবেশ রায় এই মহা আখ্যানে খুঁজতে চেয়েছেন। যোগেন মণ্ডলের যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ– তার চেহারা কী, তা কীভাবে গড়ে উঠেছিল, একসময়ে প্রবল সাড়া ফেলেছিল– এই উপন্যাসে আমরা তা বিস্তারিতভাবেই পাব।

কিন্তু উপন্যাসটির সমাপ্তি ১৯৪৭ এর দেশভাগের এক নাটকীয় মুহূর্তে। তখনও যোগেন মণ্ডল এক নতুন উদ্যমে উদ্দীপিত। তখনও তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক সমীকরণ পুরোপুরি ধ্বসে পড়েনি। যদিও তাতে ক্রমাগত আঘাত আসতে শুরু করেছে। সেই আঘাতে পুরোপুরি ভেঙে পড়া যোগেন মণ্ডলের একাকিত্বের ছবিটা এই উপন্যাসে পাব না। তার জন্য উপমহাদেশের পরবর্তী ইতিহাসের দিকে ও যোগেন মণ্ডলের জীবন ইতিহাসের দিকে আমাদের তাকাতে হবে। এ প্রসঙ্গটি নিয়েও আমরা পরে আলোচনা করব।

দেবেশ রায় গোটা আখ্যান জুড়ে অনুপুঙ্খ বিস্তারে দেখাতে থাকেন যোগেন মণ্ডল বরিশালের মাটি থেকে উঠে এসে কীভাবে গোটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে বড়সড় প্রভাব ফেলছেন। বিশেষত বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন কীভাবে তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ১৯০৪ এ তাঁর জন্ম। কৈশোর ও প্রথম যৌবনের একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল পর্বে তিনি প্রত্যক্ষ করছেন অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনের দিনগুলি। কিন্তু সেই আন্দোলন বা সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকদিন পর্যন্ত যথেষ্ট দূরেই থাকছেন। কলকাতা থেকে আইন পাশ করে তখন তিনি বরিশালের এক প্রভাবশালী উকিল। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের সময়ে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তখন যোগেন মণ্ডলের বয়েস ৩৩।
এই নির্বাচনে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং কংগ্রেসি প্রার্থী জমিদার সরল দত্তকে পরাস্ত করেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে আসন থেকে তিনি বিজয়ী হন সেটি (তপশিলী) সংরক্ষিত আসন ছিল না, একটি সাধারণ আসন ছিল।

নির্বাচনের এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে যোগেন্দ্রনাথকে বলেন এই বিজয়ের পেছনে আছে এক নতুন সামাজিক উত্থান। বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। তপশিলীরা ছাড়াও মুসলমানরা তাকে বিশেষভাবে সমর্থন করাতেই এই সাফল্য এসেছে। এই সমীকরণটি হয়তো যোগেন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে থাকবে এবং তাঁর সারা জীবনের রাজনৈতিক অবস্থানে এই সমীকরণ ভাবনা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।

আইনসভায় প্রবেশের পর যোগেন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেন। বিভিন্ন দলের (বা নির্দল) প্রতিনিধি হিসেবে মোট ৩১ জন তপশিলী প্রার্থী আইনসভায় বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন। দলনিরপেক্ষভাবে তপশিলী প্রতিনিধিদের একটি মঞ্চে যোগেন মণ্ডল সমন্বিত করেন। বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের জাতের স্বার্থে যেন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন-– এটাই ছিল এই সমন্বয়ের মূল লক্ষ্য। তাঁর ঘোষণা ছিল নমঃশূদ্রদের স্বার্থে কাজ হলে তাঁরা সরকারকে রাখবেন, নচেৎ তার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার ফেলে দেবার চেষ্টা করবেন। বস্তুত বাংলার আইনসভায় নমঃশূদ্র ব্লকের এটাই ছিল প্রথম স্বাধীন আত্মঘোষণা।
ইংরেজরা যে বর্ণহিন্দু আন্দোলনের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্রদের উত্থানকে ব্যবহার করে নিতে চাইছে এবং সেজন্য তাদের কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলছে— এ কথা যোগেন মণ্ডল বুঝেছিলেন। কিন্তু এই সুযোগ গ্রহণ নিয়ে তাঁর কোনও দ্বিধা ছিল না। তিনি মনে করতেন একসময়ে ব্রিটিশের দাক্ষিণ্যে জমিদারী বা চাকরী পেয়েই বর্ণহিন্দু বাবুসমাজের উত্থান হয়েছিল। নিজেদের জাতের উত্থানের জন্য ব্রিটিশ রাজের দাক্ষিণ্যগুলিকে ব্যবহার করে নেওয়ার পক্ষেই ছিলেন তিনি।

বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে তপশিলীদের নির্দিষ্ট অবস্থান তিনি সবসময়ে বজায় রাখতে চেয়েছেন। তিনি বলতেন এই দেশ হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়নি, তপশিলীদের আলাদা অবস্থান রয়েছে এবং তারা হিন্দুসমাজের অংশ নন। গান্ধীজীর হরিজন আন্দোলনের সূত্রে তপশিলীদের হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার রাজনীতির বিরোধী ছিলেন তিনি।
বঙ্গীয় রাজনীতিতে যোগেন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের অনুগামী হয়েছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রকেও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অবস্থান। জাতীয় কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্রের বিদায়ের পরও তিনি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গেই ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগের পর তিনি আম্বেদকরের শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৪৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ-হক মন্ত্রীসভার পতন হলে মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হয় এবং যোগেন মণ্ডল সেখানে মন্ত্রীপদ পান। ১৯৪৬ সালে সংবিধান সভার নির্বাচনে আম্বেদকর মহারাষ্ট্র থেকে জিততে ব্যর্থ হলে যোগেন মণ্ডল তাঁকে বাংলা থেকে জিতিয়ে সংবিধান সভায় পাঠান। ভারতীয় রাজনীতিতে এই ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত।

অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রীসভায় মুসলিম লীগ যখন যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয় তখন যোগেন মণ্ডল সেখানে ভারতের আইনমন্ত্রী হন। কিন্তু দেশভাগের প্রসঙ্গ রাজনীতিতে যত সামনে আসতে থাকে ততই তপশিলী রাজনীতিতে যোগেন মণ্ডলের অবস্থানটি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। যোগেন মণ্ডল মনে করেছিলেন এদেশের বর্ণহিন্দুরাই তপশিলীদের প্রধান শত্রু। তপশিলীদের মতোই বাংলার মুসলিমরাও বর্ণহিন্দুদের দ্বারা শোষিত। বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে তপশিলী এবং মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। মুসলিমরা তপশিলীদের স্বাভাবিক মিত্র-– এটাই ছিল যোগেন মণ্ডলের রাজনৈতিক অবস্থানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যোগেন মণ্ডলের এই অবস্থান দেশভাগজনিত আবেগের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তপশিলী সম্প্রদায় একেবারেই গ্রহণ করেননি। যোগেন্দ্রনাথের ঐক্যবদ্ধ বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পক্ষে জোরদার প্রচার সত্ত্বেও বাংলার আইনসভার প্রায় সমস্ত তপশিলী সদস্য বাংলা বিভাজনের দিকে ঝোঁকেন। এই সময় থেকে তপশিলীদের মধ্যে হিন্দু মহাসভার প্রভাব অনেকটা বেড়ে যায়।

যোগেন মণ্ডল দেশভাগের সময় ঐক্যবদ্ধ বাংলার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সুরাবর্দি-শরৎ বসুর ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রস্তাব বাংলার হিন্দুপ্রধান জেলাগুলির বাঙালিরা গ্রহণ করেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল প্রথমে পৃথক ঐক্যবদ্ধ বাংলা গঠিত হলেও মুসলিমপ্রধান এই অঞ্চল একসময়ে পাকিস্তানে যোগ দেবে। তাই হিন্দুপ্রধান জেলাগুলির বাঙালিরা বঙ্গবিভাজনের পক্ষে সোচ্চারে সায় দিয়েছিলেন। বাংলার সে সময়ের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীরাও সে সময় লন্ডনে যৌথভাবে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে বঙ্গবিভাজনের অনুরোধ জানান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মেঘনাদ সাহা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতিমান বিদ্বজ্জন।

তপশিলী রাজনীতির ভেতর থেকে যোগেন মণ্ডলের সম্পূর্ণ উল্টোমত নিয়ে উঠে আসেন লন্ডনফেরত তরুণ ব্যারিস্টার প্রসন্ন ঠাকুর। তিনি ছিলেন হরিচাঁদ গুরুচাঁদ বংশের সন্তান, যারা নমঃশূদ্রদের কাছে পরম গুরু হিসেবে বন্দিত। দেশভাগ সংক্রান্ত নতুন পরিস্থিতিতে তপশিলীদের বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক সংক্রান্ত যোগেন মণ্ডলের তাত্ত্বিক লাইনটি বাস্তবে তেমন কোনও সমর্থন খুঁজে পায়নি। তারা মুসলিমদের বিপরীতে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেছে।

১৯৪৬ এর নির্বাচনের আগে সব তপশিলী নেতাদের ডাকা এক সভায় প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এবং যোগেন মণ্ডলের এক নাটকীয় বিবাদের ছবি আমরা এই উপন্যাসে পাই। প্রসন্ন কুমার ঠাকুর যখন বলেন জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাব দেশের সামনে এক বিরাট বিপদ নিয়ে এসেছে, তখন যোগেন মণ্ডলের প্রশ্ন– “কোন দ্যাশ? কার বিপদ? আপনি কোন দ্যাশের বিপদের কথা বলতে চান?” “মিস্টার জিন্নার পাকিস্তান যদি আপনার দ্যাশের বিপদ হয়, তাইলে মিস্টার গান্ধীর হরিজনও আমার দ্যাশের পক্ষে আরও বড় বিপদ।”

ফজলুল হক মন্ত্রীসভার পতনের পর খাজা নিজামুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের সরকার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১ জন তপশিলী সদস্য নিয়ে গঠিত বিধায়ক দলের নেতা হিসেবে যোগেন মণ্ডল এই সরকারকে সহযোগিতা করতে সম্মত হন। সমর্থনের ভিত্তি ছিল কিছু নির্দিষ্ট বিবেচনা ও শর্ত। তপশিলী ও মুসলিমদের মধ্যে যোগেন মণ্ডল অনেক মিল দেখতে পান। উভয় সম্প্রদায়ই ছিল মূলত কৃষক ও ক্ষেতমজুর। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই ছিল অনেক জেলে এবং শিক্ষার দিক থেকে উভয় সম্প্রদায়ই তুলনামূলক বিচারে ছিল অনেক পিছিয়ে পড়া। (যদিও হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এর সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মতুয়াদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটছিল)। নিজামুদ্দিনের মুসলীম লীগ মন্ত্রীসভাকে সমর্থনের বিনিময়ে তপশিলীদের জন্য বেশ কিছু আইনী ও প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধে হস্তগত করার সম্ভাবনা যোগেন মণ্ডল দেখেছিলেন। মন্ত্রীসভায় তিনজন তপশিলী সম্প্রদায়ের মানুষকে জায়গা দেওয়া, তপশিলীদের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ব্যয় বরাদ্দ পাঁচ লক্ষ টাকা করা এবং সরকারী চাকরীতে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংরক্ষণের বিষয়টি তপশিলীদের দাবি হিসেবে সামনে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম দাবিটি বাস্তবায়িত হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর সুরাবর্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় আসে। যোগেন মণ্ডল ছিলেন অন্যতম ক্যাবিনেট মন্ত্রী। মন্ত্রীসভা কাজ শুরু করার অনতি পরেই ১৬ অগস্ট সুরাবর্দী ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ডাক দেন। দাঙ্গায় প্রথমে কলকাতা ও তারপর নোয়াখালি বিধ্বস্ত হল। হিন্দুরা যোগেন মণ্ডলের পদত্যাগ দাবি করল মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা থেকে। তার তপশিলী সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষকে দাঙ্গার বলি হতে হল। মহিলারা ধর্ষিতা হলেন নির্বিচারে। এতদসত্ত্বেও যোগেন মণ্ডল সুরাবর্দী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করা দূরে থাক, সেই মন্ত্রীসভাকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগী হলেন। মুসলিম লীগ সরকারকে বাংলায় বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে তার কাছে কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রী হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব আসে সুরাবর্দীর তরফ থেকে। যোগেন মণ্ডল এক ঘণ্টার চিন্তাভাবনার মধ্যেই যোগদানে সম্মতি দেন ও লন্ডনে টেলিগ্রাম করে আম্বেদকরের কাছে এর অনুমতি চান। আম্বেদকরের অনুমতি এসে যায়। যোগেন মণ্ডল ভারতের আইনমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যোগ দেন।

যোগেন মণ্ডল জানিয়েছেন ৩ জুন ১৯৪৭-এ ব্রিটিশরা যখন দেশভাগের কথা ঘোষণা করল, তিনি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল বাস্তবে দেশভাগ হবে না এবং এটা মুসলিম লীগের তরফে একটি দর কষাকষির অস্ত্র। বাস্তবে যখন পাকিস্তান-এর ঘোষণা হল ১৪ অগস্ট ১৯৪৭-এ, লিয়াকত আলি খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যোগেন মণ্ডল অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী। বাংলা প্রদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) মন্ত্রীসভা গঠিত হয় খাজা নিজামুদ্দিনের নেতৃত্বে। খাজা নিজামুদ্দিন ও লিয়াকত আলি খানের কাছে যোগেন মণ্ডল দাবী রেখেছিলেন যাতে দুজন তপশিলী পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় জায়গা পান। দেশভাগের আগে তপশিলী জাতির মন জয়ের জন্য সুরাবর্দী প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন যে তপশিলীরা যে সমস্ত অধিকার ভোগ করেন, পাকিস্তানে এলে তাদের সেই অধিকারের কিছুমাত্র কমানো তো হবেই না, বরং তারা আরও অনেক অধিকার পাবেন। এটা শুধু সুরাবর্দীর ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি ছিল না, ছিল মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার প্রতিশ্রুতি। এসবের নিরিখে যোগেন মণ্ডল তপশিলী রাজনীতিতে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকাই মনস্থ করেন।

কিন্তু জিন্নার মৃত্যুর পরে তিনি সেখানে কোনঠাসা হয়ে পড়েন এবং ১৯৫০-এ পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র করার দাবি জোরালো হলে এবং সেখানে কেন হিন্দু যোগেন মণ্ডল মন্ত্রী থাকবেন এই প্রশ্ন উঠলে শারীরিক আক্রমণের আশঙ্কায় ভগ্নমনোরথ হয়ে তিনি আইনমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থাকবে– জিন্নার এই আশ্বাসের মরীচিকা তত দিনে তাঁর সামনে লুপ্ত হয়ে গেছে, তপশিলী সম্প্রদায়ও কোনওভাবেই বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধতায় নিজেদের মুসলিমদের স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করেনি। ফলে দেশভাগ পরবর্তী দিনগুলিতে তপশিলী রাজনীতির মূল ধারা থেকে তিনি ভীষণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ১৯৬৮-তে মৃত্যু পর্যন্ত এই রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তাঁর সঙ্গী ছিল।
দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে এই পর্বটিকে আলোচনায় আনেননি। কিন্তু যোগেন মণ্ডলকে বুঝতে গেলে, আর এখন কেন তাঁকে নিয়ে নতুন করে এক চর্চা শুরু হচ্ছে, তা বুঝতে গেলে এই পর্বটিকে বিস্তারিতভাবে বোঝা জরুরী। এটা না বুঝলে আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে যোগেন মণ্ডলের তোলা সমীকরণটি যখন নতুন করে উঠে আসছে, তার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাকে আমরা বিচার করে উঠতে পারব না।

যোগেন মণ্ডলের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাকে বোঝা এবং দলিত-মুসলিম ঐক্যের সমস্যাগুলিকে বোঝার জন্য আমাদের বিশেষ সহায়ক হতে পারে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ভারতে ফেরার সময় লেখা যোগেন মণ্ডলের দীর্ঘ পদত্যাগ পত্রটি। এই পদত্যাগ পত্রটি বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে দেখিয়েছে আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও দলিত-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা কেন কীভাবে বিনষ্ট হল।

স্বয়ং জিন্না ১৯৪৭-এর ১১ই আগস্ট ঘোষণা করেন পাকিস্তানে হিন্দু ও মুসলিম নাগরিকদের সমান অধিকার থাকবে। পরে অবশ্য যোগেন মণ্ডল এই প্রতিশ্রুতির অন্তঃসারশূন্যতা আবিষ্কার করেন এবং লক্ষ করেন পাকিস্তানে আসলে যা চলছে তা হল, “dividing the people on the basis of religion into full-fledged Muslim citizens and zimmies being under the perpetual custody of the Islamic State and its Muslims citizens.”
সেই পাকিস্তানের চেহারা দেখার আগে জিন্নার সম-অধিকারের কথায় আশ্বস্ত যোগেন মণ্ডল বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেন এবং অখণ্ড বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেবার কথা বলেন। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময় যদি যোগেন মণ্ডলের তপশিলী সমাজের চিন্তাভাবনা থেকে বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়, তবে তা আরও পাকাপাকি চেহারা পায় ঐক্যবদ্ধ বাংলা নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেবার পক্ষে প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে। যোগেন মণ্ডলের নিজের ভাষায়, “In launching a campaign in this regard I had to face not only tremendous resistance from all quarters but also unspeakable abuse, insult and dishonour. With great regret, I recollect those days when 32 crores of Hindus of this Indo-Pakistan Sub-continent turned their back against me and dubbed me as the enemy of Hindus and Hinduism, but I remained undaunted and unmoved in my loyalty to Pakistan.”

যোগেন মণ্ডল তাঁর পদত্যাগপত্রে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বিশ্বাসঘাতকতার কথা সবিস্তারে বলেছিলেন। লিয়াকত আলিকে লেখা পদত্যাগ পত্রে যোগেন মণ্ডল নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন, “after the death of Qaid-e-Azam, the Scheduled Castes have not received a fair deal in any matter. You will recollect that from time to time I brought the grievances of the Scheduled Castes to your notice. I explained to you on several occasions the nature of inefficient administration in East Bengal. I made serious charges against the police administration. I brought to your notice incidents of barbarous atrocities perpetrated by the police on frivolous grounds. I did not hesitate to bring to your notice the anti-Hindu policy pursued by the East Bengal Government especially the police administration and a section of Muslim League leaders.”

এই হিন্দুবিরোধী অবস্থান, হিন্দুদের ওপর আক্রমণের অসংখ্য ঘটনা, তাতে পুলিশ প্রশাসনের পরিকল্পিত নিস্ক্রিয়তা ও এগুলির পেছনে সক্রিয় উস্কানির একের পর এক ঘটনা পদত্যাগপত্রটির ১১ থেকে ৩৫ সংখ্যক অধ্যায়ে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন। এগুলির মধ্যে তপশিলী সহ সমস্ত হিন্দুদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তান কীভাবে নরক ও বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল, তার জীবন্ত দলিল উপস্থিত। নমঃশূদ্রদের ওপর চাপানো মিথ্যা মামলা, সশস্ত্র বাহিনীর তপশিলীদের ঘর তল্লাশির নামে লুঠপাট ও অত্যাচার, নাচোলে কমিউনিস্ট দমনের নামে সার্বিকভাবে হিন্দুদের ওপর নামিয়ে আনা অকথ্য অত্যাচার ক্রমাগত চলছিল। এর ওপরেই আসে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫০-এ শুরু হওয়া দাঙ্গার আঘাত, যা ঢাকা থেকে পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে অচিরেই ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে হাজার হাজার হিন্দুকে আক্রান্ত হতে হয়। উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের চোখের সামনেই হিন্দু বাড়িগুলিতে লুঠপাট চালানো হয়, সেগুলিতে আগুন লাগানো হয়। সব মিলিয়ে দশ হাজার হিন্দুকে এই দাঙ্গায় হত্যা করা হয়। এই সময়েই পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজারে হাজারে তপশিলী উদ্বাস্তুসহ ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে পালাতে থাকেন। যোগেন মণ্ডল এই ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েও শেষবারের মতো তার তাত্ত্বিক অবস্থানকে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি তপশিলীদের সাহস দিতে থাকেন ও তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছাড়তে নিষেধ করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ৮ই মার্চ-এর দিল্লি চুক্তির ধারাগুলি কঠোরভাবে কার্যকর করার দরকার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার, প্রশাসন ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া দূরে থাক, সম্পূর্ণভাবেই উলটো কাজ করছিলেন। দিল্লি চুক্তির পর সাহস করে যেসব হিন্দু ঘরে ফিরেছিলেন তাদের বাড়ি বা সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। খাজা নিজামুদ্দিনের পর নুরুল আমিন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেও অবস্থা পাল্টায়নি। সংখ্যালঘু হিন্দুদের আস্থা অর্জনের কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ করা হয়নি। প্রশাসন ও শাসক দলের দিক থেকে যে আচরণ চলতে থাকে, তা থেকে যোগেন মণ্ডলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্থান থেকে হিন্দু বিতাড়নই প্রকৃত লক্ষ্য-– “I would like to reiterate in this connection my firm conviction that East Bengal Govt. is still following the well-planned policy of squeezing Hindus out of the Province.”

“The present condition is not only unsatisfactory but absolutely hopeless and that the future completely dark and dismal”-– এই উপলব্ধি থেকে যোগেন মণ্ডল বাধ্য হন লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে। পাকিস্তান গঠনের আগে থেকেই তপশিলী ও মুসলিম মেলবন্ধনের যে আদর্শ সামনে রেখেছিলেন যোগেন মণ্ডল, যে আদর্শের ভিত্তিতে তাঁর যাবতীয় সক্রিয়তা, তাকে একের পর এক পর্যদুস্ত হতে দেখলেন তিনি এবং সরে গেলেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে। এই বিচ্ছিন্নতা শুধু তাঁর একক বিচ্ছিন্নতা ছিল না, ছিল বাংলার নিম্নবর্গের দুই প্রধান শরিক তপশিলী ও মুসলিমদের মধ্যে তৈরি হওয়া এক বিস্তর ব্যবধানও।

জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার তীক্ষ্ণ বিতর্কের পটভূমিতে তপশিলী ধারার নেতৃত্ব যোগেন মণ্ডল ও আম্বেদকরপন্থীদের হাত থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকে। যোগেন মণ্ডল পাকিস্তানের আইনমন্ত্রক থেকে পদত্যাগ করে এপার বাংলায় ফেরেন। কিন্তু তপশিলীদের নেতা হিসেবে তিনি আর নিজের জায়গা ফিরে পাননি। তপশিলীদের একাংশের নেতৃত্ব থাকে কংগ্রেসিদের হাতে এবং অন্য অংশটি কমিউনিস্ট আন্দোলন ও গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়, যার আলোড়ন তোলা সূত্রপাত হয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং কৃষক আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে দিয়ে তারা অচিরেই মূল স্রোতের রাজনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে যায়।

তবে যোগেন মণ্ডলের স্বপ্নের পরিকল্পনাটি খুব সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদের দেশজোড়া উত্থান ও আগ্রাসী চেহারার প্রত্যুত্তর হিসেবে আবার নতুন করে সামনে আসছে। অনেকেই দলিত-সংখ্যালঘু সমীকরণটিকে নতুন করে রাজনীতিতে প্রয়োগ করতে চাইছেন। বাবরি মসজিদের ভাঙন, রাম মন্দির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্ববাদের নয়া উত্থান ও রাজনৈতিক স্তরে তার ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে এই নতুন সমীকরণটি অনেক মহলে সাড়া ফেলছে। এ কারণেই গত সিকি শতাব্দীর মধ্যে (অর্থাৎ এদেশে নয়া উদারবাদের জমানা শুরুর পর থেকে) রচিত আখ্যানের মধ্যে দেবেশ রায়ের এই মহাগ্রন্থ বিশেষ তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে গেছে। শুধু সাহিত্য আলোচনার জগতেই নয়, রাজনীতি সমাজবিজ্ঞান চর্চার জগতেও এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয়।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...