ভারত-এর ধারণা

রোমিলা থাপার এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

 

হিস্ট্রি ফর পিস কনফারেন্সের তৃতীয় বার্ষিকীর বিষয় ছিল ‘ভারত-এর ধারণা’। তারই অংশ এই কথোপকথনটি। হয়েছিল কলকাতায় আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে, ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট। ২০১৯-এর ১৫ এপ্রিল এই কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপশন হিস্ট্রি ফর পিস-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। আমরা সেটিরই বঙ্গানুবাদ কয়েকটি পর্বে প্রকাশ করছি। এ মাসে প্রথম পর্ব

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: যদিও এই স্টেজে আমরা দুজনেই গেস্ট, কিন্তু আমার একটা হোস্টদুলভ অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আমার এক বহু পুরনো বন্ধুকে কলকাতায় স্বাগত জানাচ্ছি, কারণ কলকাতায় তাঁর সঙ্গে এটাই আমার প্রথম দেখা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ও এই অবসরে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। তা এই আলাপচারিতার শুরু আসলে বহু দিন আগে…

রোমিলা থাপার: বহু বহু বছর আগে…

আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন রোমিলার সঙ্গে এক মঞ্চে আসতে পেরে আমি কীরকম উত্তেজিত! যা বলছিলাম, এই আলাপচারিতা শুরু হয়েছে বহু আগে… বহু বহু বছর আগে। কখনও আমরা দুজনেই শুধু কথা বলেছি, কখনও দর্শক-শ্রোতাদের সামনে কথা হয়েছে। কখনও নিউ ইয়র্কে কথা হয়েছে— এই নিউ ইয়র্কেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম রোমিলার অসংখ্য কাজের মধ্যে মানবিক কল্পনার কী অবিশ্বাস্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আজ আমি কেবলই প্রশ্নকর্তা। কারণ আলোচনা হবে ইতিহাস পড়ানো নিয়ে, আর, ঈশ্বরের দোহাই, ইতিহাস পড়ানোর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তাহলে রোমিলাকে আমার প্রথম প্রশ্ন— ভারত-এর ধারণা, এই বিষয়টিকে কীভাবে পড়ানো যেতে পারে?

 

আমায় এরকম একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রথমেই সিগালকে ধন্যবাদ জানাই। হ্যাঁ, গায়ত্রী আর আমি একান্তে অনেক কথা বলেছি, আমাদের বাড়িতে, দিল্লিতে হোক বা নিউ ইয়র্কে। আমাদের মধ্যে লম্বা লম্বা আলাপ হয়েছে, আমরা পরস্পরের সঙ্গে খুনসুটি করেছি, মজা করেছি। কিন্তু, আমার যদ্দূর মনে পড়ছে, দর্শক-শ্রোতাদের সামনে এরকম কথা বলা এই আমাদের প্রথম। তাই আপনাদের প্রথমেই বলে রাখি— যদি আমরা হাসাহাসি বা ধরুন চেঁচামেচি শুরু করে দিই, আপনারা কিছু মনে করবেন না। এটাই আমাদের বন্ধুত্ব।

তুমি বেশ একটা কঠিন প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছ। ভারত-এর ধারণা বলতে আমরা কী বুঝি! একজন ঐতিহাসিক হিসেবে আমি প্রশ্নটাকে একটু ঘুরিয়ে নিচ্ছি— ঠিক কখন থেকে এই ভারত-এর ধারণাটা এল? নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অবশ্যই বলা যাবে না— কারণ, কোনও ধারণাকে নির্ভুলভাবে দিনক্ষণ দিয়ে মাপা শক্ত। ধারণারা ইতস্তত বিচরণ করে বেড়ায়, তাদের পিনপয়েন্ট করা যায় না। ফলে, এইভাবে শুরু করা যায় যে, এটা একটা আধুনিক ধারণা। আমার মতে এর উৎপত্তি ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে। আমরা মাঝেমাঝেই শুনে থাকি ভারত-এর ধারণা নাকি বৈদিক যুগে ছিল, গুপ্ত যুগে ছিল, মুঘল যুগে ছিল…। কিন্তু আমার তা একদমই মনে হয় না। আমরা সত্যিই জানি না মানুষ এই প্রশ্নগুলির সঙ্গে কীভাবে নিজেদের সম্পর্কিত করে— ‘আমি কি রাষ্ট্র? আমি কি জাতি? আমি কি দেশ?’ এমনকি তারা প্রত্যেকে যে কী নাম ব্যবহার করে আমরা সেটাও জানি না। যেমন, উদারহরণ হিসেবে সুমেরীয়দের কথা বলা যায়— আমি কিন্তু এবার সত্যিই অতীতে যাচ্ছি, অনেকটা অতীতে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে— তারা পূর্বদিকের দেশের কথা বলত। যে দেশগুলির সঙ্গে তাদের বাণিজ্য হত, এবং যে জিনিসগুলি তারা কেনাবেচা করত সেগুলি সিন্ধু উপত্যকা থেকে আসত। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি তারা সিন্ধু সভ্যতার কথাই বলত। তারা একে বলত মেলুহা— যেটা আমাদের ধারণা অনুযায়ী প্রাকৃত মেলুখখা/মিলাখখা বা মিলাখখু-র সুমেরীয় রূপ।

কিন্তু বৈদিক যুগে আমরা লিখিত নথি পেতে শুরু করলাম। আর্যাবর্ত নামটিও। এখন এই আর্যাবর্ত একটা মজার টার্ম। কারণ, এটা নড়াচড়া করে— স্থির নয়। বৈদিক যুগের লেখাপত্রে দোয়াব থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্যভাগ পর্যন্ত এর নাম দেখা যায়। বৌদ্ধ রচনায় এটি আবার কিছুটা পূর্বদিকে সরে আসে। জৈন রচনায় এটা আরও পূর্বদিকে সরে গেল। এবারে মনু তাঁর ‘মানব-ধর্মশাস্ত্রে’ বলছেন আর্যাবর্ত হল হিমালয় এবং বিন্ধ্যর মধ্যবর্তী ভূভাগ— অর্থাৎ দুই সাগরের মধ্যবর্তী যে ভূখণ্ড, তার উত্তরভাগ। ফলে, আমরা আজ যে ভারতের কথা বলছি, এগুলির কোনওটাই কিন্তু সেটা নয়। একই কথা প্রযোজ্য অশোকের শিলালিপিতে ব্যবহৃত জম্বুদীপ সম্বন্ধেও। আমরা জানি না এটা কোথায় ছিল, এর সীমানা কী ছিল। ভারতবর্ষ। আল-হিন্দ নামটা ব্যবহার করা হয় দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ থেকে। পশ্চিম এশিয়া থেকে দেখলে সিন্ধুর পারে যা ভূখণ্ড দেখা যেত সবটাকেই এই নাম দিয়ে বোঝানো হত। তারপরে এল ব্রিটিশরা, এবং ওরাই প্রথম ইন্ডিয়া নামটা ব্যবহার করা শুরু করল। গ্রিক ইন্ডোস— যার অর্থ ইন্দাস (সিন্ধু)— থেকে ইন্ডিয়া। (বৈদিক লিপিতে সপ্ত-সিন্ধু নামটাও পাওয়া যায়, যেটা পার্সি উচ্চারণে ‘স’ আর ‘হ’ পালটে গিয়ে হপ্তা-হিন্দু হয়েছে)।

এখন, ব্রিটিশরা কী বোঝাতে চেয়েছিল? ওরা যখন ভারত (ইন্ডিয়া) বলতে শুরু করল, তখন পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চল খালি তাদের কব্জায় ছিল। এরপর ওরা আস্তে আস্তে বাকি উপদ্বীপটাও জয় করতে থাকল। তারপর ওরা গেল উত্তরে। এই প্রতিটা যুদ্ধজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সীমানা পাল্টাতে থাকছে। শেষ পর্যন্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এসে গোটা উপমহাদেশের রং লাল হল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে এটাই ছিল ভারত।

তাহলে এটাই কি সেই সময় যখন থেকে ভারত-এর ধারণাটা একটা মূর্ত রূপ পেতে শুরু করল? সম্ভবত। কিন্তু এটা নিতান্তই একটা ভৌগোলিক ধারণা। প্রকৃতপক্ষে ভারত-এর ধারণা শুধু তো ভূগোলে সীমাবদ্ধ নয়—এর সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম… সবই ধরা হয়। সেইটা কবে থেকে শুরু হল? আমার মনে হয়— তবে এখানে বলে রাখা ভালো, আমি আধুনিক ভারতের ইতিহাসবিদ নই, এবং এক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ ভুলও হতে পারি— আমাদের সময়কালে ১৯২০-র দশকটা একটা উল্লেখযোগ্য দশক। কেন? কী হয়েছিল তখন? প্রথমত তো আমরা কংগ্রেসকে পেলাম। সেখানে পেলাম গান্ধিকে, যিনি আন্দোলনটাকে একটা গণ-আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন, এবং তাতে সফলও হচ্ছেন। না, আমি সেই সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের প্রেক্ষিত দিয়ে এই আন্দোলন যে কতটা প্রকৃত অর্থে গণ-আন্দোলন ছিল তা বিচার করতে যাচ্ছি না। টেকনিকালি এটা স্বীকার করতেই হবে, যে তাঁরা এক বিপুল সংখ্যক জনতাকে সমবেত করতে পেরেছিলেন। তখন থেকেই ভারত-এর ধারণা গঠিত হতে শুরু করে, কারণ শেষ বিচারে এই জমায়েতের লক্ষ্য ছিল এই যে দেশটা তৈরি হয়েছে তার স্বাধীনতা অর্জন।

কিন্তু, আবার এই ১৯২০-র দশকেই এই ভারত-এর ধারণায় দুটি ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়ে গেছিল। মুসলিম লিগও হল এই সময়— যা পরবর্তীতে গিয়ে পাকিস্তানের দাবি জানাবে। ভারত-এর ধারণায় এর অভিঘাত ঋণাত্মক। কারণ, আমরা যা পাচ্ছি তা আর ভারত রইল না— হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি কর্তিত রূপ। ফলে প্রথমেই কিন্তু বিরোধ চলে এল। এর বিপরীতেই আমরা পাচ্ছি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা— সেই ১৯২০-র দশকেই। যাদের সূত্র ধরেই আরএসএসের আগমন, যাদের কাছে ভারত-এর ধারণা খুবই সুস্পষ্টভাবে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা।

তাহলে এর মধ্যেই আমরা তিন-তিনটে— হ্যাঁ, একটা নয়, তিনটে— ধারণা পেয়ে গেলাম। আর তারপরই আমরা পাচ্ছি ১৯২০ সালেই প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে। যাদের ভারত-এর ধারণা একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা। ফলে আমি মনে করি ১৯২০-র দশকই হল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেখান থেকে আমরা এই আলোচনাটা শুরু করতে পারি। আর আলোচনাটা অবশ্যই কোনও একটি একক ধারণাকে কেন্দ্র করে হবে না— বরং হবে এই যে ধারণাগুলির কথা বললাম এগুলিকে আমরা সম্ভাব্য কী কী উপায়ে দেখতে পারি, সেই মর্মে। কেন এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল, এবং এদের পরিণতিই বা কী হয়েছিল? তারপরে আমরা পেয়েছি দুটি দেশের সৃষ্টি, যার মধ্যে পাকিস্তান আবার দুভাগে ভাগ হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এর সঙ্গেই যুক্ত স্বাধীনতা-র ধারণা, যার অর্থ খোঁজা হয়েছিল স্বাধীনতার সময়ে। সেই সময়ের যা সবচেয়ে বড় আন্দোলন— উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন— সেই আন্দোলনের কাছে এই ভারত-এর ধারণাটা ঠিক কীরকম ছিল? কেমন দৃষ্টিতে তারা এই ভারত-এর ধারণাটা দেখেছিল? কোথা থেকে স্বাধীনতা শুরু হবে সে সম্পর্কে তাদের বোধ কী ছিল?

আচ্ছা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। তুমি যেটা বললে, আমি একটু চেষ্টা করছি তার উত্তর দেওয়ার। এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে গত নভেম্বরে তোমার বাড়িতে করেছিলাম। প্রথমেই বলে দিই ধারণা (আইডিয়া)-র ব্যাপারে আমি একটু সন্দিগ্ধ মানুষ। আমরা আইডিয়া ছাড়া এগোতে পারি না— এটা খুবই উপকারী এবং দরকারি— কিন্তু এটা আবার খুবই বিপজ্জনকও বটে। অনেকটা একটা কিছু ফুটন্ত পাত্রের ওপর ঢাকা দেওয়ার মতো। ওই ঢাকার তলায় যা যা সেদ্ধ হচ্ছে এটা তার পুরোটাকেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। প্রায় একটা গোটা জীবন বইপত্রের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার পর আজ আমি আইডিয়া সম্পর্কে একটু ভীতই বলা যায়। আমার অনেক সময়েই মনে হয়েছে একমাত্র যখন ‘আমি ভারতীয় নই’, তখনই আমি ভারতীয় হিসেবে কথা বলতে পারি। এটা সত্যি। এতে তুমি আমায় বকতে পারো, বকেওছ আগে, আমাকে বলেছিলে মনে আছে— “তোমার ছাত্ররা তো কিছুই জানে না! তাহলে অনর্থক দক্ষিণ এশিয়ায় পড়াও কেন তুমি?” ব্যস, আমি থেমে গেছিলাম। আসলে এই পৃথিবীতে এরকম হাতে গোনা কয়েকজন আছে যাদের থেকে আমি এই ধরনের পরামর্শ নিতে পারি। তারপর, আমি যখন বলেছিলাম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর আমি একটা জীবনী লিখব, তখন তুমি বলেছিলে, ‘সব কিছুকে ঐতিহাসিকভাবে গবেষণা করার চেষ্টা করবে না। তোমার নিজের জীবন যাপনের জন্য যদি মনে হয় কিছু জিনিস সত্য এবং সঠিক, সেগুলিকে যত্ন করে রেখে দাও।’ সেই দ্বিতীয় পরামর্শটাই আমি এখন মানতে চলেছি। আমার মনে হয়, এই যে ভারত-এর ধারণা, অনুভব— এটা আমরা পেয়েছি। আমার ১৯৪২-এ জন্ম, আর আমি বেশ এঁচোড়েপাকা বাচ্চা ছিলাম— ফলে আমার জিনিসগুলো ভালোই মনে আছে। হ্যাঁ এটা ঠিক, যে তার বেশিটাই দুর্ভিক্ষের বোধ, দাঙ্গার বোধ… ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিছু একটা ছিল। তার পরে আমরা যেটা পেলাম, সে নিয়ে শুধু আমি না, আমি আর আমার বন্ধু এডওয়ার্ড সাইদও যত ভেবেছি, মনে হয়েছে এটা যেন কিছুটা ভারতের একটা প্রাচ্যবাদী (ওরিয়েন্টালিস্ট) রূপ আবিষ্কারের মতো। এটা এমন একটা আবিষ্কার যেটা দেখলে ভ্লাদিমির ইলিচ হয়তো প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের বলতেন যে তারা ভারত সম্পর্কে ভাবুক যে তারা কতটা জনমুখী হতে চায়। এই কারণেই সেই প্রথমের ধারণাটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যেতে শুরু করল। এটা কিন্তু নিখাদ একজন ভারতীয় মানুষের মতামত— এমন একজন ভারতীয় মানুষ যে কখনও বই পড়ে ভারতের অর্থ শেখেনি। আমার অনুভবটা এমনই। আর সেই জন্যই আমি তোমাকে এই প্রশ্নটা করতে চাইছি। বস্তুত, প্রশ্নটা আমি লিখেও রেখে দিয়েছিলাম। গত নভেম্বরে আমরা যখন তোমার বাড়িতে কথা বলছিলাম তখন তুমি বলেছিলে “আমরা তখন যৌবনে, সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিচ্ছি, তখন কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে গভীর সমস্যাগুলি আসবে সেগুলো আমরা আশাও করছি না।” আমার প্রশ্নটা মোটের ওপর এই বিষয়টা নিয়েই। আমি তোমার থেকে এইটাই বিশদে শুনতে আগ্রহী। আর এর সঙ্গেই প্রথম স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতা-উদ্ভূত নির্দিষ্ট কিছু আকাঙ্খা যেগুলি আর পূরণ হয়নি, সেগুলি। আমি এগুলো অন্যদের থেকে শুনেছি— যেমন এক্ষুনি আমার বাংলাদেশ যুদ্ধের কথা মনে পড়ছে— যেটার সম্পর্কে আমার বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সঙ্গে ভালো রকম জড়িত আমার দুই প্রিয় বন্ধু জাফারুল্লা চৌধুরী আর সন্ধ্যা রায় (১৫ বছর বয়সে নিজের পড়াশোনা ছেড়ে জাফারুল্লার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল) সেরকমটাই বলে। সন্ধ্যা বলে “আমরা ভেবেছিলাম স্বাধীনতা চলে আসার পর আমি আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে যাব,” কিন্তু তারপর “আমরা বুঝতেই পারিনি যে তার আর কোনও অর্থই থাকবে না।” অবশেষে আমরা পাই এই সব কিছুর পেছনে মুক্ত ফ্রেডরিক ডগলাস ঘোষণা করছেন “এখন থেকে সমস্যা শুরু হল।” তুমি তো নিজেও নিশ্চয়ই এ নিয়ে খুব সমস্যায় আছ। আমি সত্যিসত্যিই এটা তোমার থেকে বেশি করে শুনতে চাই। যে তাগিদটা তোমাকে এটা বলতে প্ররোচনা দেবে সেটা শোনা আমার মনে হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমেই স্বীকার করে নিই যে আমি তোমার সঙ্গে একমত। ধারণাদের নিয়ে আমি নিজেও যথেষ্টই সন্দিগ্ধ। এর মূল কারণ, ধারণাদের একটা বদভ্যাস আছে যে তারা প্রায়শই নিজেদের প্রকৃত অর্থ থেকে সরে যায়। এটা খুবই বিরক্তিকর। ভেবে দেখো, তুমি সেটার একটা অর্থ ভাবলে, সেই অনুযায়ী তাকে একটা জায়গা দিলে, আর তারপর দেখলে যে সেটার মানে পুরোপুরি আলাদা! খুব মুশকিল হয়। তোমাকে বরং আমার স্কুলজীবনের একটা গল্প শোনাই। এটা পুনের ঘটনা। তোমাকে এই গল্পটা বলছি সেই ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে আমাদের টিন-এজ কালের একটা ছবি দেওয়ার জন্য। বাবা আর্মিতে ছিলেন। বদলির চাকরি। আমরা পেশোয়ার থেকে রাওয়ালপিন্ডি হয়ে এই পুনেতে এসেছিলাম। এখানে আমাদের আসা ১৯৪০-এর দশকে। গান্ধিজি তখন এই জেলের ভেতরে, এই বাইরে। আমরা ক্যান্টনমেন্ট কালচারের অংশ ছিলাম। ভারতের এই ক্যান্টনমেন্ট কালচারটা কিন্তু একটা বিশেষ ধরনের কালচার, পুরোপুরিই আলাদা, আমার মনে হয় কোনও সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদের এই নিয়ে কাজ করা উচিত। নাগরিক সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন, এখানে ভারতীয় এবং ব্রিটিশরা একসঙ্গে থাকে, কিন্তু সামাজিকভাবে পুরোপুরি মিশে যায় না। লোকজন যেভাবে বাড়িতে আসত— এটা আমার তখনও দারুণ লাগত— এই লোকজনের বাড়ি যাওয়াটা সন্ধের সময় একটা খুবই আকর্ষক কাজ ছিল। এর চেয়ে ভালো আর কিছু করারই নেই। বন্ধুদের বাড়ি যাও আর গজল্লা করো। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয়রাই আসত, আর তারা সবাই বাইরে কী চলছে সে সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল, কারণ সময়টা ১৯৪০-এর দশক। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, বড়দের চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। আর বাবা প্রায়ই সাবধান করে দিতেন— “সবকিছু শুনছ, শোনো। কিন্তু এসব ভুলেও স্কুলে গিয়ে গল্প কোরো না। কারণ— এটা বুঝে নাও— এখানে আমরা যা আলোচনা করছি, তা শুধু আমাদের ভারতীয়দের জন্যই।” ফলে সচেতনতা খুবই তীব্র মাত্রায় ছিল।

এবার শোনো আমার সঙ্গে স্কুলে কী হল। ১৯৪৭ হল কনভেন্ট স্কুলে আমার শেষ বছর। আমরা কনভেন্ট স্কুলে পড়তাম কারণ আমাদের আর্মি ছেলেমেদের এমন স্কুলেই পড়তে হত যেখানে সব জায়গায় মোটামুটি একই রকম পড়ানো হয়। এই যেমন কনভেন্ট স্কুলগুলি সিনিয়র কেমব্রিজ এক্সামকে লক্ষ রেখে পড়শোনা করাত। ১৫ আগস্টের এক মাস মত আগে সিস্টার সুপিরিয়রকে আমার জন্য পাঠানো হল। আমি তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আর ‘আমি আবার কী করলাম এখন?’ ভাবতে ভাবতে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, “পনেরোই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস আসছে। যেহেতু তুমি ঠিকঠাকদের মধ্যে একজন তাই আমরা তোমার জন্য একটা কাজ ভেবেছি। তুমি ইউনিয়ন জ্যাকটা নামিয়ে ভারতের পতাকাটা তুলবে, একটা গাছের চারা লাগাবে, আর স্বাধীনতা মানে তোমার কাছে কী সেই বিষয়ে পনেরো মিনিটের একটা বক্তব্য রাখবে।” আমি তো শুনে পুরো আতঙ্কিত! শুধু বলতে পারলাম— “আপনি বলছেন আমি?” উনি বললেন— “হ্যাঁ, আমি বলছি, তুমি। আমাদের নিরাশ কোরো না। কাজটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করো। এটা তোমাকেই করতে হবে।”

তাঁর ঘর থেকে বেরনোর পর কয়েক রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। খালি মাথার মধ্যে ঘুরছিল— ‘কী বলব আমি? প-নে-রো মিনিট— আমি কী বলব? আমার মনে আছে আমি আমার প্রিয় শিক্ষক, যিনি ইতিহাস আর সাহিত্য পড়াতেন, তাঁর কাছে গিয়েও জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমি কী বলব?” তিনি বললেন, “তুমি তো বন্ধুদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলো—কী বলো? এই যে স্বাধীনতা আসছে সে নিয়ে তুমি কী ভাবো? দাঁড়িয়ে সেগুলোই বলবে।” তো শেষমেশ আমি কী বলেছিলাম? আমি বলেছিলাম: ‘আমাদের এখন ভারতীয় হওয়ার একটা পরিচিতি খুঁজতে হবে।’ এটা সত্যিই আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই সময়ে। নিজেদের ভারতীয় বলে পরিচয় দিয়ে আমরা ঠিক কী বোঝাতে চাই? ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রেক্ষিতে আমরা ভারতীয়— সেটা একরকম; কিন্তু এখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ছাড়া আমরা ভারতীয়— এর অর্থ ঠিক কীরকম?

দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনিঃশেষ চর্চা চলতে থাকল সেটা হল: উপনিবেশবাদ তো চলে গেল, ফলে ‘এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না’ বা ‘ এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না’-গুলো বন্ধ হবে এখন। তাহলে আমাদের সমাজের চেহারাটা ঠিক কীরকম হবে? আমরা যে এটা নিয়ে খুব পরিশীলিত ভঙ্গিতে আলোচনা করছিলাম, তা না। সাধারণ কথোপকথনেই ঘুরেফিরে আসছিল এই জিজ্ঞাসাটা। এক অর্থে, এই প্রশ্নগুলো অনেক বছর ধরে আমার মধ্যে রয়ে গেছিল। আমি স্পষ্ট কোনও উত্তরও পাইনি। আর এখন তো প্রশ্নগুলো আরও বেশি করে সজীব হয়ে উঠেছে যেন। এখনও আমি এই উত্তরগুলো খুঁজছি। ভারতীয় পরিচয় দিয়ে আমরা আসলে কী বোঝাতে চাই? আর— যেটা আরও বেশি করে ভাবাচ্ছে— কী ধরনের সমাজ আমাদের পাওয়া উচিত ছিল?

আর এই নিয়েই স্বাধীনতার পরে আমরা বেশি বেশি করে কথা বলতে শুরু করলাম— গোটা ১৯৫০-এর দশক এই নিয়েই কথা বলে গেলাম।

বিষয়গুলি কী ছিল? প্রথমত, আমাদের অবশ্যই আমাদের সমাজকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এ বিষয়ে সেই সময়ে একটা সমাজতান্ত্রিক আবহ সক্রিয় ছিল। এর জন্য কিছুটা দায়ী নেহেরুর কিছু বক্তব্য; আর কিছুটা দায়ী অন্য কিছু মানুষের কথা, যাঁরা বলতেন বৈষম্য ছাড়া কোনও সমাজ হতেই পারে না। ফলে আমরা এমন একটা সমাজের কথা ভাবতে শুরু করলাম যেটা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সমভাবাপন্ন হবে, যেখানে মানুষ একটা সমতা উপভোগ করবে। এই চিন্তাই— ৬০-এর দশকে অন্তত— অর্থনীতি নিয়ে একটা আচ্ছন্নতার দিকে চালিত করল। আমাদের অর্থনীতি কেমন হবে সে নিয়ে সেইসময় সব্বাই আলোচনা করছে। গোটা ৬০-এর দশক জুড়েই অর্থনৈতিক বৃদ্ধিই হচ্ছে বিষয়— অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, বেকারত্ব, গ্রামীণ উন্নয়ন এসব নিয়েই চর্চা চলছে। কণামাত্র বুদ্ধিমত্তা আছে এমন যে কোনও ছাত্রই অর্থনীতিবিদ হতে চাইছে। ঐতিহাসিক— বিশেষ করে যাঁরা প্রাচীন যুগের ইতিহাস চর্চা করেন— আর দার্শনিকরা পিরামিডের একেবারে নিচের স্তরে। এসবে তখন কারও আগ্রহ নেই। শুধু অর্থনীতিই নয়, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, পরিসংখ্যান, ডেমোগ্রাফি এসব নিয়ে লাগাতার গণনা চলছে। সবাই গর্ব করার মতো একটা সমাজ বানাতে চায়।

আমি মনে করতে পারি এর আগে, ধরা যাক ৫০-এর দশকেই, যখনও দিল্লিতে এইসব শুরু হয়নি আর আমি ইংল্যান্ডে পড়শোনা করি, তখনও আমরা এদিক সেদিক কথা বলে বেড়াতাম, ওয়ার্কার্স এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশনের মিটিঙে যেতাম। আমরা কী নিয়ে কথা বলতাম? কথা বলতাম ভারতে যে নতুন সমাজের উদয় হতে চলেছে সেই নিয়ে। আমরা ভারতে ফিরলাম কেন? কারণ সেখানে আমরা একটা নতুন সমাজ বানানোর সুযোগ পাব— এমন একটা সমাজ, যার অংশ হতে পেরে আমরা গর্ব বোধ করব। এইসব পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে স্বাধীনতা আমাদের মধ্যে এরকম একটা সরল বিশ্বাসেরই জন্ম দিয়েছিল। এটা সরল বিশ্বাসই ছিল, কারণ আমার ধারণা আমরা আমাদের সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করিনি। অর্থনীতি তথা আর্থনীতিক পরিবর্তনের মতো বিষয়টিতে এতটাই মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল যে জাতপাত এবং ধর্মের মতো বিষয়গুলিকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। ফলে সেগুলি যখন আত্মপ্রকাশ করল আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। ভাবলাম, কোথা থেকে এল এসব?

হ্যাঁ, আরেকটা বড় দাবি ছিল— স্বাধীনতা এলে আমরা নিজের ইচ্ছেমতো যেমনভাবে খুশি কথা বলতে পারব। আমরা যেভাবে যা বলতে চাই তাতে কেউ আমাদের বাধা দেবে না। এই ব্যাপারে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম পুনেতে কলেজে পড়ার সময়— নিজেই সেন্সরশিপের কারণ হলাম। আমার ভাই রমেশ থাপার বোম্বেতে ‘ক্রসরোডস’ নামে একটা পাক্ষিক কাগজ বের করত। খুবই বাম, খুবই বিপ্লবী এবং সমাজতন্ত্রী কাগজ। আমি ছুটিছাটায় বোম্বে গেলে তাকে প্রুফরিডিং-এ কিছু সাহায্য করে দিতাম। একবার একটা নিবন্ধের প্রুফ দেখছিলাম যার শিরোনামে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। আমি ওই ‘কাজ’-এর বিশেষণ হিসেবে অপরাধী (ক্রিমিনাল) শব্দটা যোগ করে দিয়েছিলাম। আর একদম অনিবার্যভাবেই একেবারে পরের সপ্তাহেই সেন্সরের খড়্গ নেমে এল—আমার ভাইকে জানানো হল যে ‘ক্রসরোডস’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল ব্যানটা আমার জন্যই হল। স্বাধীনতা যে বাকস্বাধীনতা এনে দেয়নি সে ব্যাপারে সেটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আর এই শিক্ষাটাও তখনই পাওয়া যে, বাকস্বাধীনতা বিষয়ে কৌশলী হওয়া আমাদের শিখতে হবে, সে নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। ঘটনাটা আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং আমার ভাই জেতে। এই মামলাটি এখনও নজির হয়ে রয়েছে। বাকস্বাধীনতার কথা এলেই সবাই রমেশ থাপার ভার্সেস স্টেট অফ ম্যাড্রাসের এই মামলাটির উল্লেখ করে।

তাহলে এই হচ্ছে ধারণাগুলি। আমরা ফরাসি বিপ্লব পড়েছি— সে সম্পর্কে যা যা বই পাওয়া যায় সবই পড়েছি। আমরা রুশ বিপ্লবও পড়েছি। ফলে ভারত কেমন করে একটা আদর্শ সমাজ হয়ে উঠবে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণার কোনও কমতি ছিল না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেভাবে কিছু হল না, এবং আস্তে আস্তে সমস্যাগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।

আমি এটাই চাইছি— তুমি সুনির্দিষ্টভাবে এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলো। অবশ্য আমিও আমার দু পয়সা যোগ করব। যেমন ভারতের সমাজ গড়ে ওঠা নিয়ে আমার ধ্যানধারণাগুলো কিছুটা দেরিতে তৈরি হয়েছিল… তুমি বলছিলে, তুমিও আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোও জানতে চাও। আসলে, দিল্লি ও কলকাতার পরিবেশ পরস্পরের থেকে খুবই আলাদা। আমার কাকা ছিলেন জ্ঞান মজুমদার, যে কারণে আমি বামপন্থার বৌদ্ধিক পরিসরের মধ্যে বেড়ে উঠছিলাম, যা একান্তভাবেই কলকাতার নিজস্ব। সে যাই হোক, আমি দেশ ছেড়েছিলাম কারণ তারক নাথ সেন আমাকে বলেছিলেন যে আমি এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাব না৷ বাবা ইতিমধ্যেই মৃত। আমার নিজেরটা নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হত, তাই আমাকে পালাতে হল। এটাই আমার দেশত্যাগের কারণ, বোঝাতে পারলাম?

সেই সময়, সত্যি বলতে আমরা সেই পিরামিডের একদম নিচের স্তরে, রোমিলা— তুমি যে বললে, সেই ইতিহাসবিদদের চেয়েও সাহিত্যিকদের স্থান তলায় ছিল। আমার মনে হয় যদি আমি বাংলায় পড়াশুনো করতাম, আমার অবস্থা আরও খারাপ হত। আমার চলে যাওয়ার ঠিক আগে অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল ‘গাইড’ ছবিতে দেব আনন্দের মতো, সেই যে ‘ইংরেজি হল বিশ্বের ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র ও অন্যতম, তাই আমরা যখন এই ভাষায় কথা বলি…।’ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। অন্যদিকে, আমাদের ভাবনা ছিল, ‘আমরা যখন বাংলায় কথা বলব, চমৎকার বাংলা বলব। আর যখন ইংরেজি বলব, সেটাও হবে নির্ভুল।’ এই হল প্রথম বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনো প্রজন্ম, উপনিবেশ-পরবর্তী, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফলে আমি যে-সময় ভারত ছেড়েছিলাম সে-সময় ভারতের ধারণাটা মোটেই কোনও মিছিলের ছবির সঙ্গে মিলত না। অ্যালেন গিনসবার্গ… আমি তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে গান গেয়েছিলাম… সেও এক চমকপ্রদ ঘটনা। আমাদের এইসব ধারণার মুখোমুখি হতে হয়েছিল যে ভারত… গাঁজা নিয়ে, বা এমনি যে কেউ এবং বজ্রযান বৌদ্ধরা এবং গ্যারি স্নাইডার এবং জেন… এই সবকিছুই কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। আবার অন্যদিকে, ১৯৬২ সালে, ম্যালকম এক্স কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি কথা বলতে শুরু করলেন (তিনি খুবই নম্র, মৃদুভাষী), আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার মাথার মধ্যে থাকা ভারতের ধারণা আমাকে দিয়ে ভাবিয়ে নিল, ‘আরে! এ তো পুরো কলকাতার মতো।’ ম্যালকম এক্স বলছেন, আমার ২০ বছর বয়স, শ্রোতাদের মধ্যে বসে আছি— সেই সময়ে ওইটাই মাথায় এল। আর না হলে, আমার চারপাশে এই অন্য ভারত তখন দানা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।

ডায়াস্পোরিকরা এখন প্রকৃতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন ৮৭ সালে তুমি যখন প্রথম আমাকে পড়ানোর জন্য ডাকলে—মনে করে দেখো, আমাকে কিন্তু সাহিত্য বিভাগ থেকে ডাক দেওয়া হয়নি। কারণ, আমি ফরাসি তত্ত্ব নিয়ে কাজ করলেও আমি তো ফরাসি নই! ফলে, প্রোফেসর থাপার এই অ-ঐতিহাসিকটিকে ইতিহাস বিভাগে পড়ানোর জন্য ডাক দিলেন। এটা এমন একটা বিষয়, যেটা প্রকাশ্যে আসা উচিত। এতে বোঝা যাবে আমাদের মধ্যে বন্ধন কত পুরনো এবং দৃঢ়। যাই হোক, ৮৭তে ফিরি, আর ফিরি সেটাতেও যেটা থেকে এই তফাতটা আমি বেশি বেশি করে অনুভব করা শুরু করলাম। এখানে, বাগুইহাটিতে, আমি বাংলায় একটা ভাষণ দিয়েছিলাম, অনাবাসী আর প্রবাসী-র পার্থক্য নিয়ে। ‘অনাবাসী’ একটা তৈরি করা শব্দ। ভারতের ডায়াস্পোরাকে স্বীকৃতি না দেওয়াটা তখনই আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু— কখনও বেশ শ্বেতাঙ্গ-ঘেঁষা ভালো ইতিবাচক সংখ্যালঘু। এরা আবার কখনও ফ্রান্সের উপকূলবর্তী কোনও ছোট দ্বীপের সংখ্যালঘু। অন্যদিকে, এরা আবার সেই হিংসার নিদর্শন দেখাতে শুরু করে দেওয়া ৮৬ শতাংশ সংখ্যাগুরুর মতোও নয়। ফলে, সেই সময় থেকে আমার যেটা শুরু হল, আমি গ্রামীণ ভারতের ভূমিহীন নিরক্ষর মানুষগুলোর কথা ভাবতে শুরু করলাম। তাদের বাচ্চাদের আমি পড়াতাম, আর দেখতাম তারা দলিত শব্দটাই জানে না, কিন্তু নিজেদের এসসি/এসটি বলে। আমি দেখতে চাইতাম আমাদের এই বৃহত্তম নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে ভারত-এর ধারণাটা ঠিক কী। যাকগে, আমি এটা নিয়ে এখানে কথা বাড়াব না। কারণ, সমস্যাগুলি নিয়ে তোমার ধারণাগুলো শোনাই আজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এটা বলা থাকল।

কারণ, বস্তুতপক্ষে, এখন এর উত্থানের সময়। কারণ বিদেশে নতুন খিলাফত নিয়ে কিছু গণ্ডগোলে কাজ শুরু হয়েছে। এই খিলাফতের একটা ইতিহাস আছে যেটা কেউ জানে না। এগুলো জানা কথাই, কিন্তু আবার এখনকার তরুণ বিপ্লবীদের সেগুলো জানা নেই। ফ্রান্স সহ বাকি ইওরোপে দক্ষিণপন্থীরা উঠে আসছে। আমেরিকার কথা তো ছেড়েই দিলাম। যদিও এটা মানতে হবে যে, এই র‍্যাডিকাল ডায়াস্পোরিকদের মধ্যে একটা ঐক্য— যদিও অপরীক্ষিত— তৈরি হচ্ছে। ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত এই র‍্যাডিকাল ডায়াস্পোরিকরা এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের সংযোজন হিসেবে কাজ করছে। এর জন্যই আমরা যারা এটাকে নিরুৎসাহ করতে চাই না তাদের সেই পুরনো জাতিরাষ্ট্রের ধারণা— যেটাকে আমার বন্ধু বার্নার্ড হারকোর্ট ন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ বলেন— নিয়ে কথা বলার একটা তাগিদ তৈরি হচ্ছে। তাহলে একটা নিরাপদ ধারণা হিসেবে ভারত-এর ধারণাকে আমরা কীভাবে পুনর্বিবেচনা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগেই আমেরিকায় গেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম না সে সময়। ওখানে নিশ্চিতভাবেই একটা আঁতাত তৈরি হচ্ছে যেটা খুবই ভীতিজনক। তাই, আমি শুধুমাত্র বাহ্যিক সমস্যাগুলি দিয়েই বিষয়টির মধ্যে ঢুকতে চাইছি। এই সমস্যাগুলি শুধু যে দূরীভূত হচ্ছে না তাই নয়, বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন তুমি যেগুলিকে সমস্যা মনে করো, সেগুলি আমি একটু এক দুই তিন করে তোমার থেকে শুনতে চাই।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এ কথোপকথন “ভারত” এবং “ভারতীয়” এরকম বোধের গোড়া ধরে টান দিয়েছে পরিশীলিত, বৌদ্ধিক পরিসরে।
    এরকম কথোপকথনের চর্চা করা যাবে কিনা সেটাও আমাদের বর্তমান যাপিত সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ।

1 Trackback / Pingback

  1. ভারত-এর ধারণা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Leave a Reply to Jayanta Bhattacharya Cancel reply