ইসলামোফোবিয়া নানা রূপে…

ইসলামোফোবিয়া নানা রূপে… -- দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

 

এবছর ঈদের দিন দেখলাম অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেকেলে অক্ষয় তৃতীয়া এবং আনকোরা নতুন উপলব্ধ উৎসব পরশুরাম জয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। একদল, তথাকথিত উদারপন্থী আবার দাবী তুলেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে উৎসব পালন বন্ধ হোক। বলা বাহুল্য এরা সবাই হিন্দু উচ্চবর্ণের, মানে আমাদের গোষ্ঠীর, মানুষজন। অবাক লাগে। যে বছর ঈদের দিন অক্ষয় তৃতীয়া হয় না, সেবছর আমাদের অক্ষয় তৃতীয়া মনেও পড়ে না, আর পরশুরাম জয়ন্তীর আবির্ভাব তো সবেমাত্র হল। আরও অবাক লাগে এই ভেবে, যে উদারপন্থীরা হঠাৎ ঈদের দিনেই উপলব্ধি করলেন যে, উৎসব হওয়া উচিত ঋতু কিম্বা মনীষীদের জন্মদিন মেনে, তারা এবছর সরস্বতী পুজো, গেলবারের দুর্গাপুজোতেও তাদের অভিধান অনুসারে ‘অন্যরকম’ পার্বণ উদযাপন করেছেন। আর এই ‘অন্যরকম’ পুজোগুলি করকম? ব্রাহ্মণ পুরোহিত, মূর্তি পূজা সবই আছে, শুধু বাজারি জৌলুসের পরিবর্তে সেখানে নান্দনিকতা, একটু গান, কবিতা, বাচ্চাদের নাটক, ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব। অসুবিধে নেই। নিজের নিজের ইচ্ছানুসারে ধর্মীয় উৎসব পালনের অধিকার আমাদের সংবিধান স্বীকৃ্ত। কিন্তু শুধুমাত্র মুসলমানদের উৎসবের দিনই কেন তাদের এত অভিনব আইডিয়া মাথায় আসে, সেকথা ভেবেই আশ্চর্য লাগে!

আসলে আমাদের দেশে ইসলাম-বিদ্বেষের নানা রূপ। আমাদের, অর্থাৎ হিন্দু উচ্চবর্ণ সমাজের, মনে এত গভীর এ বিদ্বেষের প্রভাব যে অনেকসময়ই আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে সচেতন থাকি না। ইসলাম ধর্মের উৎসবের দিনে হিন্দু ধর্মের কোনও অখ্যাত বিশেষদিনকে তুলে ধরা অথবা আচম্বিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হ’য়ে পড়া, এসব প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দুত্ববাদী চিন্তার প্রতিফলন। স্বীকার করা দরকার, এই চিন্তা আমাদের মধ্যে ছিলই, বিজেপি-আরএসএস সেই চিন্তা প্রসারের এবং প্রকাশকে মান্যতা দিয়েছে মাত্র।

প্রসঙ্গত বলি, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়য়েও আমাদের চিন্তাভাবনায় মাঝেমধ্যেই গোলযোগ দেখা যায়। যেমন, আমাদের দেশে এই মুহূর্তে ‘মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা’-র ধারণাটি অর্থহীন। যারা বর্তমান ভারতবর্ষে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভূত দেখেন, হিন্দু মৌলবাদের সঙ্গে মুসলমান মৌলবাদকে একাসনে বসান, তারা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দর্শনে বিশ্বাসী। আবার শুনতে পাই, একদল ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মানুষ মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু মানুষের সমান অধিকার, সমান সুযোগ। ইউটোপিয়ান সমাজে হয়তো ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সংজ্ঞা প্রযোজ্য। কিন্তু আজকের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যা অতিসরলীকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে রাষ্ট্রের এবং সংখ্যাগুরু সমাজের দ্বারা বিশেষভাবে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষা। যেখানে রাষ্ট্র স্বয়ং সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার হরণে ব্যস্ত, সেদেশে সংখ্যালঘু সমাজের জন্য বাড়তি সুযোগ তৈরি করাই ধর্মনিরপেক্ষতা। আজকের ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান দুই সাম্প্রদায়িকতার কথা সমানভাবে উচ্চারণ করা আসলে হিন্দুত্ববাদী দর্শনকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়া।

ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে আরেক ধরনের মতবাদ আছে। তাদেরও বেশ দাপট। তাদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সব ধর্মকেই অস্বীকার করো। “ধর্ম আফিম সদৃশ” ইত্যাদি তাদের বক্তব্য। যৌবনে আমিও এই দলভুক্ত ছিলাম। এখনও আমি ধর্মকে, বিশেষত হিন্দুধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে, ব্যক্তিগত পরিসরে যতখানি সম্ভব দূরে রাখি। কিন্তু এই বয়সে পৌঁছে জীবন আমাকে ধর্ম বিষয়ে অন্য এক শিক্ষাও দিয়েছে। ব্যাক্তিগত জীবনে যা-ই বিশ্বাস থাক না কেন, ধর্মকে সামাজিক জীবন থেকে দূরে রাখতে পারা বেশিরভাগ সময় চরম সুবিধেপ্রাপ্তদের পক্ষেই সম্ভব। ধর্মাচরণের সঙ্গে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতির যে যোগ, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব শুধু নয়, অন্যায়।

পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি আমরা ঈদের পর লকডাউন ঘোষণাকে ঘিরে একদল মানুষের রোষ দেখছি। তাদের বক্তব্য, এটা নাকি মুসলিম ‘তোষণ’। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মতে, এ যদি ‘তোষণ’ হয়, তবে সে তোষণটুকু মেনে নেওয়াই ভালো। যে দেশে পান থেকে চুন খসলে মুসলমানের দোষ দেখা হয়, যে দেশে করোনা সংক্রমণে তবলিঘির যত দোষ আর কুম্ভমেলার সাত খুন মাফ, যে দেশে মায়ের হাতের রান্না করা গোমাংস নিয়ে ট্রেনে উঠলে ট্রেব থেকে ফেলে পিটিয়ে মারার ভয়ে তটস্থ থাকেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষজন, যে দেশে ১৩ বছরের মুসলিম বালক মন্দিরে ঢুকে জল খেলে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে মারা হয়, সে দেশে এই তথাকথিত ‘তোষণ’টুকু নাহয় থাক। অন্তত আমার আপনার গ্লানি মুক্তির জন্য ঐ ‘তোষণ’টুকু দরকার নয় কি?

ফেরত আসা যাক ঈদের কথায়। গত দুবছর আমাদের দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ ঈদে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যে পরিমাণ সচেতনতা ও পরিমিতি দেখিয়েছেন, আমরা, এদেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উচ্চবর্ণের মানুষজন নিজেদের পুজো-পার্বণে, দুর্গাপুজো, কালী অথবা সরস্বতীপুজোয় সেই পরিমিতি দেখাতে পেরেছি কিনা একটু ভেবে দেখি বরং। নিজেদের দিকে না তাকিয়ে ‘বাহির পানে’ (পড়ুন মুসলমান পানে) তাকানো এবার একটু বন্ধ করলে হয় না? সোজা কথাটি হল, ঈদের দিন সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ঈদ মুবারক’ দেখলে যাদের মনের ভ্রু কুঞ্চিত হয় এবং ঈদকে নস্যাৎ করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির খুঁজে বার করেন, তারা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল বৈ আর কিছু নন। ঈদ ধর্মীয় উৎসব আর দুর্গাপুজো শারদোৎসব, সরস্বতীপুজো বিদ্যার আরাধনা, এইসব আঁতলামো এবার আমাদের বন্ধ করা দরকার। সেই মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ যিনি সরস্বতীপুজোর ফল কাটেন আর সেই মুসলমান ধর্মান্ধ যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, এই চিন্তা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী নয়, এই চিন্তা একটি সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী।

একটা কথা আমাদের বোঝা বিশেষ জরুরি বলে মনে হয়। ভোটবাক্সে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করলেই আমাদের কাজ শেষ নয়। যদি হিন্দুরাষ্ট্রকে ঠেকাতে চাই তাহলে বাইরে লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজের নিজের অন্তরে তাকানো দরকার। সত্যিই যদি আমরা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা আরএসএস-এর দর্শনকে আমাদের জীবন থেকে তাড়াতে চাই, তাহলে ‘Externalisation of cause’ বন্ধ করে, নিজেদের বিশ্বাস ও যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা মূল্যবোধগুলিকে ঘেঁটে দেখা দরকার, প্রয়োজনে আত্মসমালোচনাও করা দরকার। যে মুসলমানবিদ্বেষের শিক্ষা নিয়ে আমরা বড় হই, তার শিকড় অনেক গভীরে। এত গভীরে যে তার তল সবসময় আমরাও পাই না। আর সেইজন্যই, হয়তোবা ভাল মনেই, আমরা “ঈদ তৃতীয়া”-র শুভেচ্ছা পাঠাই অথবা ঈদের দিন সকালে ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছাবার্তা বন্ধ করার আবেদন জানাই। আমরা ভুলে যাই, ঈদ আমাদের সহনাগরিকদের অন্যতম প্রধান উৎসব। সেই উৎসবকে একটি হিন্দু উৎসব দ্বারা আত্মসাৎ করা অথবা সেই উৎসবকে অগ্রাহ্য করা অন্যায়। ঈদকে ঈদ বলেই স্বীকৃতি দেওয়া এবং সম্মান প্রদর্শন প্রয়োজন। ঈদের দিন আমাদের ইসলাম ধর্মাবলম্বী স্বজন-বান্ধবের বাড়িতে গিয়ে হাতে হাত লাগিয়ে সেমুই বানানোর দিন।

 

২৩.৫.২০২১

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এত স্পষ্ট! এত বলিষ্ঠ! এত সহজ করেও অনুচ্চারিত শব্দগুলিকে লিখে ফেলা যায়!

Leave a Reply to Anonymous Cancel reply