শীতল অণুবীক্ষণ ও জৈব বিজ্ঞানে বিপ্লব

শীতল অণুবীক্ষণ

ড.কঙ্কণ ভট্টাচার্য্য

 

ওয়র্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর TWAS পুরস্কার ও শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. কঙ্কণ ভট্টাচার্য্য দীর্ঘদিন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এ অধ্যাপনা করে অধুনা ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ভূপালে অধ্যাপনারত। অধ্যাপক ভট্টাচার্য্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির সহ-সভাপতি ও জার্নাল অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির বরিষ্ঠ সম্পাদক। ড. ভট্টাচার্য্য ওয়র্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি এবং ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর ফেলো-পদে অধিষ্ঠিত।

 

২০১৭ র রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন জন — সুইজারল্যান্ডের লসান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাক দুবোশে, আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক এবং ইংল্যান্ডের এমআরসি ল্যাবরেটরির রিচার্ড হেন্ডারসন। এঁরা পুরস্কৃত হলেন কোনও দ্রবণে মিশে থাকা জৈব অণুর সহজতর উপায়ে উন্নততর ছবি পাবার জন্য সফলভাবে ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতি তৈরী ও প্রয়োগ করে। এই পদ্ধতির উদ্ভব ও প্রয়োগ জৈব রসায়নে নতুন যুগের সূচনা করবে -– এমন বিশেষজ্ঞদের মত। ২০১৪ সাল আন্তর্জাতিক ক্রিস্টালোগ্রাফি বর্ষ হিসেবে পালিত হল। তার তিন বছরের মধ্যেই “শীতল অণুবীক্ষণ” আবিষ্কারের জন্য এই তিন বিজ্ঞানীর নোবেলজয় নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

এই তিন রসায়নবিদের চেষ্টার শুরু ১৯৭৫ সাল থেকে। এঁরা চেষ্টা করছিলেন কিভাবে স্বাভাবিক সক্রিয় অবস্থায় প্রোটিন বা অন্য জটিল জৈব অণুর গঠন জানা যায়। এতদিন পর্যন্ত প্রোটিন বা ডিএনএর মতো জটিল অণুগুলির গঠন জানতে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্য নেওয়া হত। এই ক্রিস্টালোগ্রাফি পদ্ধতিতে প্রোটিন বা অন্য জৈব অণুকে কোনও মিশ্রণে দ্রবীভূত করে স্ফটিক বা ক্রিস্টালে রূপান্তরিত করা হয়। অতঃপর এক্স-রে বিকিরণের সাহায্যে সেই প্রোটিন বা জৈব অণুর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

এই তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন কী?

প্রোটিনকে বলা চলে আণবিক মঞ্চে জীবননাটকের মূল কুশীলব। প্রাণীর জৈবিক ক্রিয়ার প্রকাশ হয় প্রোটিনের মাধ্যমে। আমাদের ও সমগ্র প্রাণীজগতের প্রতিটি কোষের ভিত গড়ে দেয় প্রোটিন। জীবনে চলার পথ ডি.এন.এ-তে লেখা হয়ে থাকলেও তার যাপন আর রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব থাকে প্রোটিনের হাতে।

সমস্ত প্রোটিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার গঠনের ওপর। আর গঠন নির্ভর করে ভৌত ও রাসায়নিক স্থিতিমাপের ওপর। আমাদের শরীরে প্রোটিনের আকার বা গঠন একটু আধটু পালটালেই নানারকম অসুখে ধরতে পারে।

১৯৪৮ সালে আমেরিকার রসায়নবিদ লাইনাস পাউলিং প্রথম দেখান — সিকল সেল অ্যানিমিয়া হয় হিমোগ্লোবিনের সামান্য পরিবর্তনে। উনি নিজের গবেষণাপত্রের নাম দিয়েছিলেন “sickle cell anaemia — a molecular disease.” “সিকল সেল এনিমিয়া একটি আণবিক অসুখ।” এই পাউলিং-ই প্রথম -– ১৯৫২ সালে — এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে প্রোটিনের গঠন ব্যাখ্যা করেন। এর এক বছর পর, ১৯৫৩ সালে ডি.এন.এ-র ডবল হেলিক্স আবিষ্কার করেন ওয়াটসন এবং ক্রিক। আরও এক বছর পর, ১৯৫৪-তে আমাদের জি এন রামচন্দ্রন কোলাজেন প্রোটিনের গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ট্রিপল হেলিক্স আবিষ্কার করেন।

দ্রবণে বা কোষে জটিল জৈব অণুর আকার ব্যাখ্যা করার small angle x-ray বিচ্ছুরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন সি ভি রামন -– ১৯২৯ সালে। কিন্তু রামনের জীবদ্দশায় অত্যধিক জটিলতার কারণে এই পদ্ধতি খুব একটা জনপ্রিয় হতে পারেনি।

প্রসঙ্গান্তরে যাবার আগে পাউলিং সম্বন্ধে দু-এক কথা না-বললেই নয়।

পাউলিং-কে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা রসায়নবিদ। মারী ক্যুরির পর পাউলিং-ই প্রথম বিদ্বান যিনি দু’বার নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন। ১৯৫৪ সালে রসায়নে, এবং ১৯৬২ সালে শান্তির জন্য। নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা পাউলিং-কে রেখেছে তাদের সর্বকালের সেরা কুড়িজন বিজ্ঞানীর তালিকায় -– নিউটন, ডারউইন ও আইনস্টাইনের পাশে। পারমাণবিক বোমার ফল দেখে ১৯৪৬ সালে পিস অ্যাকটিভিস্ট হয়ে যান পাউলিং, আর ১৯৫২ সালে আইনস্টাইনের নেতৃত্বে এমারজেন্সি কমিটি অফ অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট-নামক সংগঠনে যোগ দেন। দেশের চোখে কম্যুনিস্ট বলে চিহ্নিত হন, এবং ওই বছরেই তাঁর পাসপোর্ট অগ্রাহ্য করা হয়। ১৯৬২-তে দ্বিতীয় নোবেল পাওয়া সত্ত্বেও পাউলিং ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিট্যুট অফ টেকনলজি বা ক্যালটেক ছাড়তে বাধ্য হন। জীবনের শেষ ত্রিশ বছর নিজের বাড়িতেই গবেষণা চালিয়ে যান পাউলিং -– কোনওরকম সরকারী অনুদান ছাড়াই।

এবার প্রোটিনে ফেরা যাক। প্রোটিনের আকার নির্ণয় করতে গিয়ে রসায়নবিদেরা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হন। সব প্রোটিনকে কেলাসিত বা স্ফটিকে পরিণত করা যায় না। আবার কোনও প্রোটিন একা থাকলে তার যেমন গঠন থাকে, কোনও পর্দা (মেমব্রেন) বা কোনকিছুর সঙ্গে যুক্ত হলে তার আকার ও গঠন পাল্টে যেতে পারে। সে-কারণেই তরল দ্রবণ বা কোষের মধ্যে রেখে এদের আকার জানবার চেষ্টা করা হয়। এর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স স্পেক্ট্রোস্কোপি (এন.এম.আর) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এন.এম.আর খুব জটিল অণুর আকার বুঝতে পারে না।

ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ-এ আলোর পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। লুই দ্য ব্রগলী প্রথম বলেছিলেন ইলেকট্রন একাধারে কণা এবং তরঙ্গ দুইই। ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক অ্যাংস্ট্রমের কাছাকাছি। অণুর আকার জানতে এই তরঙ্গ খুবই কার্যকরী। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ আবিষ্কারের জন্য এর আগে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে।

মুশকিল হল, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ-এর জন্য নমুনাটিকে নিম্ন চাপে ভ্যাক্যুয়ামে রাখতে হয়। প্রোটিনকে ভ্যাক্যুয়ামে রাখলে তার গায়ে লেগে থাকা জল বাষ্পীভূত হয়ে যায়। এর ফলে প্রোটিনের আকার ও সক্রিয়তা বদলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

১৯৭৫ সালে রিচার্ড হেন্ডারসন প্রথম দেখান — ব্যাকটিরিওরডোপসিন নামের প্রোটিনকে মেমব্রেনে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে এবং গ্লুকোজ দ্রবণ ঢেলে খুব শীতল অবস্থায় ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যেতে পারে। এর জন্য এদের ঢালা হয় তরল নাইট্রোজেন, যার তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসের থেকে ১৯৬ ডিগ্রী কম।

এতে অসুবিধে হল, তরল নাইট্রোজেন ঢাললে প্রোটিনের গায়ের জল বরফের ক্রিস্টাল বা কেলাস তৈরী করে। এই কেলাসগুলি ইলেকট্রন রশ্মিকে এত জোরে বিচ্ছুরিত করে, যে প্রোটিনের থেকে আসা সিগনালও তাতে ঢেকে যায়। হেন্ডারসন যে গ্লুকোজ দ্রবণ ব্যবহার করেছিলেন তা সব — বিশেষ করে জলে দ্রাব্য — প্রোটিনের ক্ষেত্রে চলে না।

ট্রিভিয়া। হেন্ডারসন যে এম.আর.সি ল্যাবে কাজ করেন সেখানে কাজ করে নোবেল পুরস্কার পান ভেঙ্কট রামাকৃষ্ণন, ২০০৯ সালে, রাইবোজোমের গঠন ব্যাখ্যা করে।

হেন্ডারসনের সমস্যা দূর করলেন দুবোশে। হাইডেলবার্গের ইউরোপিয়ান মলিক্যুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে কাজ করবার সময় উনি আবিষ্কার করলেন — প্রোটিন ঠাণ্ডা করতে তরল নাইট্রোজেনের বদলে খুব ঠাণ্ডা ইথেন ব্যবহার করলে জল জমে বরফের বদলে কাচের মতো হয়ে যায়। এই পদ্ধতিকে ফলে ভিট্রিফিকেশন। এইভাবে কেলাসিত জলের ঝামেলা দূর হল।

ফ্র্যাঙ্কের কাজ হল এই সব জটিল ইমেজ এনালিসিসের জন্য নতুন কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা।

এই তিনজন মিলে সৃষ্টি করলেন ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতি। এখন আস্ত কোষ বা কোষের কোনও অংশ যাতে অনেক রকম জটিল অণু আছে তার আকার জানা যায় এই পদ্ধতিতে। সম্প্রতি জিকা ভাইরাস আর অ্যালজাইমার’স-এর কারণ যে প্রোটিন তাদেরও ভালো করে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে এই পদ্ধতিতে। আমাদের শরীরে কিভাবে অ্যান্টিবডিরা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমাদের বাঁচায়, তারও উন্নততর পরীক্ষা সম্ভব হয়েছে এর আবিষ্কারের ফলে। এর ফলে ভবিষ্যতের ওষুধ-পথ্য অতীতের থেকে আরও অনেক বেশী কার্যকরী হতে পারবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

 

(বন্ধুবর শ্রী নিরুপম চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণা ও নিরন্তর খোঁচা-ব্যতিরেকে এই লেখা সম্পূর্ণ হত না। তাঁকে সবিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।)

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4243 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সুন্দর, ঝরঝরে বাংলায় প্রোটিন ক্রিটাোগ্রাফি, সঙ্গে লাইনাস পাউলিং এর ইতিহাস । প্রোটিন কেলাসন জটিল কাজ ছিল একসময়। ম্যাক্স পেরুজ ও জন কেনড্রু প্রোটিন কেলাসন কাজ শুরু করে ছিলেন – জেডি বর্নালের সঙ্গে । আরো বাংলায় লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

আপনার মতামত...