সাহসের অন্য নাম আরজিকর-আন্দোলন

বহ্নিশিখা গুপ্ত

 

আপাতত আশা একটাই। কিছুদিন আগেও ‘জীবনে কী হতে চাও’ শীর্ষক স্কুলের রচনায় যে মেয়েটি ‘দেশের কাজ করতে চাই’ লিখেছিল বলে সবাই হেসেছিল, আরজিকরের অভয়া-আন্দোলনের পর মেয়েটি সাহস পেয়েছে গর্বের সঙ্গে সেই রচনাটা শেষ করার

 

আমরা কি এসব অভিযোগ জানতাম?

জয়েন্ট এন্ট্রান্স না দিয়েও এ রাজ্যের কোনও সরকারি মেডিকেল কলেজে কেউ ভর্তি হয় এখনও? মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে কাউকে পয়সা দিতে হয়? হাসপাতালের মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসা হয়? হাসপাতালের বর্জ্য নিয়ে ব্যবসা হয়? এইসব দুর্নীতির অভিযোগে বারেবারে উঠে আসে কলেজের খোদ প্রিন্সিপালের নাম? হাসপাতালের কোনও স্টাফ ছাড়াও বাইরের কেউ হাসপাতালের যে-কোনও জায়গায় এমনকি ডাক্তারদের বিশ্রামকক্ষ বা সেমিনার রুমে মাঝরাত্তিরেও অবলীলায় ঢুকে পড়তে পারে?

না, জানতাম না। অন্তত সেভাবে জানতাম না। আমরা, মানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অন্তত আগস্ট ২০২৪-এর আগে এসব অভিযোগ তেমনভাবে জানতাম না। খবরের কাগজে কোনও সময় খবর বেরোলেও তা চোখ এড়িয়ে গেছে। এমনকি এসব নিয়ে এক ডাক্তার যখন অভিযোগ করে নিজেই ট্রান্সফার হয়ে গেছিলেন, তখনও তেমনভাবে কেউ জানতে পারেনি।

 

আমরা কি জানতে পারব?

আরজিকর মেডিকেল কলেজের পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের ছাত্রী ও ডাক্তারের হত্যাকারী একজন না বহুজন? ডাক্তার ছাত্রীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কলেজ ও হাসপাতালের বল্গাহীন দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠে এসেছে তার আদৌ যোগাযোগ আছে কিনা বা থাকলে তা কতটা গভীর ও কতদূর বিস্তৃত? প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত(রা) ছাড়া পেয়ে যাবে কি শেষমেশ?

না। এখন তো জানি না বটেই, পরেও জানতে পারব কিনা, তাও জানি না।

 

তবে কী জানি?

শুধু জানি আরজিকরের ডাক্তার ছাত্রীর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে একটা প্রকাণ্ড আন্দোলন গড়ে উঠেছে যা সর্বার্থে ঐতিহাসিক এবং অতুলনীয়। আর সে আন্দোলন গড়ে তুলেছে মানুষ। সেই আন্দোলন সুনামির মতো তোলপাড় করে দিয়েছে কলকাতা, রাজ্য, সারা দেশ, বিশ্ব। যেখানে যত প্রবাসী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আছেন ও  যাঁরাই এই হত্যাকাণ্ডের বিহিত চেয়েছেন তাঁরাই নেমে এসেছেন রাস্তায়। সবার হিসেবনিকেশ গুলিয়ে দিয়ে সেই আন্দোলন কিছুতেই সাড়ে তিনদিনে নিভে যায়নি। চলতেই থাকে। শাসক-বিরোধী দল-নেতা সবাই সামিল হতে চেয়েছেন সে আন্দোলনে। কিন্তু মানুষ সেসব তেমন পাত্তা দেয়নি। এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল ও নেতারা আন্দোলনের ডাক দিতেন আর মানুষ তাতে যোগ দিত। ১৪ আগস্ট, ২০২৪-এর রাত থেকে সারা পৃথিবী একটা উলটো ছবি দেখতে শুরু করল। দেখা গেল, যে যেখানে পারছে যেমনভাবে পারছে প্রতিবাদ করছে। অফিস করে ব্যবসা শেষে কলেজ থেকে বেরিয়ে নিজেদের কাজের-পড়াশোনার-পাড়ার নানা বৃত্তে একজোট হয়ে দলে দলে মিছিল বের করল, আন্দোলন করল, দিন-রাত-ভোর-দুপুর-পুজো-উৎসব-ঘরের কাজ নিজের লাভ-লোকসানের হিসেব ফেলে রেখে অচেনা অজানা একটা মেয়ের খুনের বিচার চেয়ে মা-ছেলে-মেয়ে-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-যুবক-তরুণ-মধ্যবয়সি সব্বাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে এবং গানে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে ফেলল। আর নেতাহীন দলহীন গোত্রহীন এই দুর্নিবার আন্দোলনে নিজের গরজে যোগ দিলেন রাজনৈতিক দল ও নেতারা।

অন্যায়ের বিচার চেয়ে সাধারণ মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ স্বাধীন ভারতে এর আগে কবে কোথায় দেখা গেছে কেউ তেমন মনে করতেও পারলেন না।

 

বাকিটুকু চেনা, গতে বাঁধা

ক্ষমতার মূল দুর্বলতাই হল সে একইসঙ্গে তোষামুদে ও জো-হুজুরদের লালন করে আর বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রী খোঁজে কারাগারে ঢোকানোর জন্য। প্রথমে অবশ্য লোভ দেখায়। পদ সম্মান অর্থ প্রতিপত্তি নেতৃত্ব কিংবা ক্ষমতার। না পারলে ভয় দেখায়। বহুস্তরীয় বিকেন্দ্রীকৃত ভয়! যে যেখানে ক্ষমতার পক্ষে সে সেখানে বিপক্ষ বেছে নিয়ে ভয় দেখায়।

কাজেই লড়াই শুরু হয় বেশ অনেকগুলো পথে। রাজনৈতিক স্তরে, প্রশাসনিক স্তরে, সোশাল মিডিয়ায়। তর্ক-বিতর্ক-আলোচনার ছদ্মবেশে চাপান-উতোর কুৎসিততম গালিগালাজ, বিপক্ষ ও বিদ্রোহী চিহ্নিতকরণ, হুমকি, কেস দেওয়া, আমি চোর, তুই বাটপার, আমার আমলে এতগুলো এই, তো তোমার আমলে অতগুলো ওই, তুমি ২০২৪ সাল দেখাচ্ছ, তোমার প্রপিতামহ হিটলারের সঙ্গে ছিলেন আমি প্রমাণ করে দিতে পারি, জানো?

Whataboutery-র সেই পরম্পরাগত ক্লিশে সংলাপ। এর আগেও মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া, ডাক্তারদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে। র‍্যাগিং ও অন্যান্য অভিযোগও উঠেছে। ২০০৩-৪ সালে দুই ডাক্তারের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে যে দুটি কেসে বেশ ঝড় উঠেছিল, তার একটা হল শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালের চিকিৎসক সুশীল পাল হত্যাকাণ্ড ও রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালের সার্জেন চন্দন সেনের অস্বাভাবিক মৃত্যু। দুটো ক্ষেত্রেই সে-সময়ের ডাক্তার-প্রশাসন-রাজনৈতিক নেতাদের নাম অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসে। বানতলার নৃশংস যৌন অত্যাচারের ঘটনা এতই মর্মান্তিক যে মানুষ মাঝে মাঝে ভুলে যায় যে সেখানেও মূলে ছিল স্বাস্থ্যক্ষেত্রের গোলযোগের অভিযোগ।

কিন্তু কেন এই সব whataboutery আবার শুনব আমরা? কুশাসন মানুষ মেনে নেয় না বলেই তো ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। হয়ে এসেছে। নিজের শাসনে হওয়া অপরাধ জাস্টিফাই করার জন্য এই আলোচনা অযৌক্তিক এবং অবান্তর।

 

আলো

তাহলে নতুনটা কী? নতুন হল, কনজিউমারিজম, মুঠোফোনে আর কেরিয়ারে মজে থাকা শুধুই নিজের কথা ও ‘অন্যায় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই’ ভাবা মানুষগুলোর হঠাৎ অন্তরের রসায়নে কী এমন ঘটে গেল একটা মৃত্যুতে যে দলে দলে যে যেখানে পারল অন্তত কিছুদিনের জন্যেও বিদ্রোহী হয়ে উঠল? এমন তো নয় নির্মম অপরাধের ঘটনা এই একটিই শুনল জনগণ? তবে?

কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে।

ডাক্তার মেয়েটির সঙ্গে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ নিজেদের রিলেট করতে পারল? একটি মেধাবী মেয়ে গরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের মতো পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল শুধু? যাদের মুরুব্বির জোর নেই। টাকা দিয়ে ডিগ্রি কেনার সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই?

আসলে এখনও তো আমাদের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে শুধু নিজের মেধার জোরে সফল হতে চায়। উপার্জন করতে চায়। চায় না? মেধাই যাদের একমাত্র অবলম্বন। আর কোনও খুঁটির অন্যায় জোর যাদের নেই। মানুষের কি ভয় ধরল যে এই অবস্থা ও ব্যবস্থা চলতে থাকলে তাদের সন্তানরা কী করে লড়বে এরকম অসম অন্যায় লড়াই?

কিংবা, মানুষ কি মনে করল যে এটি একটি ঠান্ডা মাথার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা? এর সঙ্গে কলেজ-হাসপাতাল-সহ গোটা সিস্টেমটা কোথাও না কোথাও জড়িত? নিপুণ হাতে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপ? আদতে অনন্ত দুর্নীতির অঙ্গ এই হত্যা? আসল উদ্দেশ্য চেপে দেওয়ার অভিপ্রায়ে যৌন নির্যাতনের গল্পটি ঠিক সিনেমার মতো করে সাজানো?

কিংবা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কি এটাই, যে এইসব প্রশ্নের উত্তর আদৌ কোনওদিন পাওয়া যাবে কিনা?

 

হাতে রইল পেনসিল?

হ্যাঁ। সাময়িকভাবে এক ঝলকে সেটাই মনে হবে। কিন্তু ইতিহাসকে তো এমনি এমনি মহান শিক্ষক বলা হয় না। সেই ইতিহাস অন্য আরেকটা কথাও বলে। বলে, নথি প্রমাণ তর্ক বিশ্লেষণ পেরিয়ে যদি কিছু থাকে তা হল মানুষ আর তার ভেতরে তৈরি হওয়া বিশ্বাস। সমাজেরও একটা বিবেকবোধ আছে। কালেক্টিভ কনসেন্স। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভোটবাক্সে কিন্তু ওই বিশ্বাসটাই প্রতিফলিত হয়। ভয় দেখিয়ে কিছু বলানো যায়, চেপে দেওয়া যায়, সাময়িক যুদ্ধ জেতাও যায়, কিন্তু সামগ্রিক বিশ্বাস টলানো মুশকিল।

১৯৭৬। দক্ষিণ কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের পুত্রবধূর হত্যা মামলা। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের রসায়নের গবেষক ছাত্রী তখন তিনি। বাড়ি ফিরে লস্যি আর শসা খাওয়ার পরেই তুমুল বমি। হাসপাতালে মৃত্যু। ময়নাতদন্তে পাকস্থলীতে মারকিউরিক ক্লোরাইড নামক ভয়ঙ্কর বিষ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে বয়ান দিয়ে গেলেন, যে তিনি শুধুই ওই লস্যি আর শসা খেয়েছিলেন।

জানা যায়, গৃহভৃত্য লস্যি আর শসা এনে দিয়েছিলেন। মিডিয়ায় ঝড়। একের পর এক হেভিওয়েট সাক্ষীকে ডাকাডাকি, তদন্ত, বিচার। শেষ পর্যন্ত যে রায় বেরোল, তাতে বলা হল, যে কিছুতেই নির্দিষ্টভাবে এটা প্রমাণিত হয়নি যে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। অথচ অদ্ভুতভাবে প্রমাণ লোপাটের দায়ে মৃতার স্বামী দোষী সাব্যস্ত হন।

৪৭ বছর অতিক্রান্ত। আজও জিজ্ঞাসা করুন ষাট বা সত্তরোর্ধ্ব কাউকে বা আইনের একনিষ্ঠ কোনও ছাত্রকে। দেখবেন আদালতের রায় আর তাঁদের বিশ্বাস আজও এক নয়।

আরজিকরের ডাক্তারের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কী বেরোবে, আদালতের বিচার প্রক্রিয়া কবে সম্পন্ন হবে, রায় কবে বেরোবে ও আপামর মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে, আন্দোলনের প্রভাব কতটা থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা তা সময়ই বলবে।

আপাতত আশা একটাই। কিছুদিন আগেও ‘জীবনে কী হতে চাও’ শীর্ষক স্কুলের রচনায় যে মেয়েটি ‘দেশের কাজ করতে চাই’ লিখেছিল বলে সবাই হেসেছিল, আরজিকরের অভয়া-আন্দোলনের পর মেয়েটি সাহস পেয়েছে গর্বের সঙ্গে সেই রচনাটা শেষ করার।

সাহস ও গর্বের অন্য নাম আরজিকর-আন্দোলন।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4874 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...