‘মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?’

আইরিন শবনম

 


পরিসংখ্যান বলছে চাকুরিরত ছেলেদের তুলনায় গৃহবধূরা অনেক বেশি কাজ করে। অথচ দিনের শেষে তাদের হাতে থাকে শূন্য। কারণ সে তো তার নিজের কাজ করছে, তার জন্য কি পারিশ্রমিক হয় নাকি! শ্রম বিক্রি করলে তবে তো তার দাম পাওয়া যায়। সে কার কাছে তার শ্রম বিক্রি করবে? নিজের স্বামীর কাছে? তাহলে তো স্বামী হবে প্রভু এবং সে হবে দাসী!  যদিও বাস্তবত সে তাই (বেশিরভাগ নারী)। সংসারের কটা ব্যাপারে সে কথা বলতে পারে? যে সন্তানকে প্রাণপাত করে মানুষ করে তার ব্যাপারেই বা সে কটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

 

…নতুন যন্ত্রের যারা মাস মাইনের কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিক গৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে
ঘর মোছে, খাবার বানায়
হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয়! আপনি বলুন মার্ক্স, শ্রম কাকে বলে?

গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন মল্লিকা। আসলে প্রশ্নটা শুধু মল্লিকার নয়, হাজার হাজার নারীর— যারা ‘গৃহবধূ’ নামের আড়ালে কিংবা তাকে আরও একটু মহিমান্বিত করে ‘হোমমেকার’ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। দিতে বাধ্য হয় কারণ গালভরা নাম ছাড়া তাদের হাতে আর কিছুই থাকে না। অথচ পরিসংখ্যান বলছে চাকুরিরত ছেলেদের তুলনায় গৃহবধূরা অনেক বেশি কাজ করে। অথচ দিনের শেষে তাদের হাতে থাকে শূন্য। কারণ সে তো তার নিজের কাজ করছে, তার জন্য কি পারিশ্রমিক হয় নাকি! শ্রম বিক্রি করলে তবে তো তার দাম পাওয়া যায়। সে কার কাছে তার শ্রম বিক্রি করবে? নিজের স্বামীর কাছে? তাহলে তো স্বামী হবে প্রভু এবং সে হবে দাসী!  যদিও বাস্তবত সে তাই (বেশিরভাগ নারী)। সংসারের কটা ব্যাপারে সে কথা বলতে পারে? যে সন্তানকে প্রাণপাত করে মানুষ করে তার ব্যাপারেই বা সে কটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তাকে তো প্রায়ই শুনতে হয়— ‘যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না’ গোছের কথা। দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনির পরও পরিবারে তার মর্যাদা সবচেয়ে কম। পান থেকে চুন খসলেই, অফিস ফেরত স্বামীর কাছে গঞ্জনা শুনতে হয়— ‘কী করো সারাদিন? কাজ বলতে তো ওই টিভি দেখা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কর্মরতা মহিলাদেরও কিন্তু এর থেকে পুরো ছাড় নেই, অফিসফেরত স্বামী যখন চায়ের কাপ হাতে সোফায় এলিয়ে বসেন তখন অফিসফেরত স্ত্রীকেই চায়ের কাপটি হাতে তুলে দিতে হয়। শ্রমিক পরিবার হলে আরও বেশি শ্রম, সঙ্গে জুটবে মদ্যপ স্বামীর গালাগালি ও মার।

কিন্তু তবু স্বীকৃতভাবে দাসী কি কেউ হতে চায়? চায় না, কারণ তাদের ধারণা এরকম ব্যবস্থা হলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। তারা বাইরের লোক হয়ে যাবে; সুতরাং মেয়েরা গৃহশ্রমের মূল্য চাইতে পারে না। গৃহশ্রমের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই, সপ্তাহান্তে ছুটি নেই, কোনও কাজে না বলার অধিকার নেই। এমনকি অসুস্থ হওয়ারও অধিকার নেই। মেয়েরা এখানে নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। যদিও নৈরাজের অধিকার তাদের নেই, কারণ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। তাই কোভিড হলেও সেফহোমে পাঠানো হয় না এই অজুহাতে যে, রান্না কে করবে! অনেক সময় চিকিৎসার খরচ বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে বলা হয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও গৃহশ্রমের মূল্য দাবি করে আসছে বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন। ইদানিং খুব চাপা স্বরে হলেও স্বামীর রোজগারে গৃহবধূ স্ত্রীরা একটা দাবি জানাচ্ছে, অন্তত মনে করছে এই রোজগারে তাদেরও একটা অধিকার আছে, কারণ সংসার ও সন্তান পালন করে সে। কিন্তু কার কাছে দাবি করবে সে এই অর্থ? স্বামীর কাছে? সে কি তা দিতে বাধ্য থাকবে? না-কি তার মর্জির উপর তা নির্ভর করবে? এই সমাজে নারীর কোনও বিষয় যদি পুরুষের মর্জির উপর নির্ভর করে, তবে তার অর্থ কী হয় তা আমরা ভালভাবেই জানি। আইনের নির্দেশ সত্ত্বেও ডিভোর্সি স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মূল্য বুঝে নিতে কালঘাম ছোটাতে হয়। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন স্বামীটি বাধ্য থাকবে স্ত্রীকে তার বেতনের একটা অংশ দিতে। না দিলে তা স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে সরাসরি চলে যাবে। কিন্তু এ নিয়ম কতজনের জন্য প্রযোজ্য হবে? কতজন মানুষ সরকারি বেসরকারি বা সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে? অধিকাংশই (৯০ শতাংশের ওপর) তো অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে, তারা নিজেরাই ভীষণ বঞ্চিত। নিজেদের শ্রমের নির্ধারিত মূল্যই তারা পায় না, স্ত্রীকে মূল্য চোকানো তো দূরের কথা। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জন্য যা প্রযোজ্য হয় না, তা কখনও সমাজের সাধারণ নিয়ম বলে মান্য হয় না। মধ্যবিত্তদের জন্য কিছুটা সুরাহা হতে পারে, যদি এই নিয়ম কার্যকর করা যায়।

ফিরে আসি মল্লিকা সেনগুপ্তের প্রশ্নে— বলুন মার্ক্‌স, শ্রম কাকে বলে? আসলে  এর মধ্যে যে প্রশ্নটা লুকিয়ে আছে, তা হল— সেই শ্রমের সংজ্ঞা কী, যার আর্থিক মূল্য নেই? অর্থাৎ মজুরী নেই? এখানেই ইঙ্গিত রয়েছে গৃহশ্রমের শিকলে জড়ানো নারীর দুরাবস্থার কথা।  কিন্তু এই যে নারীর অবস্থা, সে নিয়ম তো মার্ক্‌স করেননি, তিনি কেবল পুঁজিবাদী সমাজের শোষণের নিয়মগুলিকে সূত্রায়িত করেছেন এবং সেগুলো থেকে সমাজের মুক্তির পথনির্দেশ করেছেন। এ-বিষয়ে অবশ্য গোড়ার কাজটি করেছেন এঙ্গেল্‌স। তিনি তাঁর ‘পরিবার-ব্যাক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থে মেয়েদের পরাভবের ইতিহাসকে সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। তিনি পিতৃপ্রধান পরিবারের প্রতিষ্ঠাকে ‘নারীর বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’ বলে সূচিত করেছেন। পিতৃপ্রধান পরিবার আসার ফলে, বিশেষ করে স্বতন্ত্র এক পতি-পত্নী পরিবার আসার ফলে পরিবারের সামাজিক বৈশিষ্ট্য চলে গেল, কারণ আগে অনেকগুলি করে পরিবার একসঙ্গে থাকত, ব্যক্তিগত বলে কিছু ছিল না, সবই ছিল সামাজিক। তাই পরিবারের কাজও সামাজিক কাজ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু এক পতি-পত্নী পরিবারের কাজ হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তিগত সেবা। এভাবেই ‘সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্ত্রী হয়ে দাঁড়াল প্রথম ঘরোয়া ঝি।’ পুরুষ হল তার মালিক।

শ্রম যতক্ষণ না সামাজিক হচ্ছে অর্থাৎ বিক্রয়যোগ্য হচ্ছে ততক্ষণ তার আর্থিক মূল্য নেই। একজন নারী যখন তার পরিবারের জন্য রান্না করছে বা সেবা করছে তখন তার আর্থিক মূল্য নেই, তা ব্যক্তিগত। কিন্তু সেই রান্না যখন বাজারজাত করা হয় বা সেবা (নার্সিং)-কে বিক্রি করা হয়, তখন তা আর ব্যক্তিগত থাকে না, সামাজিক হয়ে যায়, তাই তার আর্থিক মূল্য পাওয়া যায়।

তাহলে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারী কি শুধু বেগার খেটে যাবে সংসারে? কোনওই কি উপায় নেই? একটা নাটকের কথা মনে পড়ছে, যা ১৯৮০-র দশকে ইংল্যান্ডে প্রদর্শিত হয়েছিল। আমরা জানি, ইংল্যান্ডে নারীবাদী আন্দোলন শুরু থেকেই শ্রমিকশ্রেণি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তারা নিজেদের বক্তব্য জোরদারভাবে প্রকাশ করার জন্য নাটকের সাহায্য নিয়েছে। তাদের একটি নাটক ‘স্ট্রাইক’। এই নাটকে দেখানো হয়েছে যে নারীর গৃহশ্রম আসলে সমাজ-অস্বীকৃত মজুরি শ্রম। পুরুষ কর্মচারীর শ্রমে মুনাফা অর্জন ছাড়াও মালিকেরা নারীর গৃহশ্রম থেকেও মুনাফা করে। কারণ নারীর শ্রমই পুরুষ শ্রমিককে রক্ষা ও সেবা করে, পরিভাষায় বলা হয় শ্রমের পুনরুৎপাদন করে, যার ফলে সে সর্বাধিক উৎপাদন করতে পারে। এই নাটকের চরিত্র হেলেন একসময় তার স্বামীকে বলে— ‘আমি তাহলে তিনটি লোকের জন্য খেটে মরি। তোমার বস, আমার বস এবং তুমি।’ একথা শুনে তার স্বামী একটু বোকা বনে যায়, বলে— ঠিক আছে আমরা দেখব সমবেতনের জন্য কী করতে পারি! তুমি কি গৃহবধূদের জন্য ইউনিয়ন চাও? তুমি কি চাও তোমাকে রাঁধুনি বা ধোপা হিসেবে, সেবিকা বা কাজের লোক হিসেবে  বেতন দেওয়া হোক? তখন সে বলে— ‘আমি বলি তুমি আমার পুরো কথাটা আগে শোনো— তুমি যদি ঘরের কাজের তোমার অংশটা করো, আমি লড়বার কিছু সময় পেতে পারি, যা আমার নিজের লড়াই।’

এই নাটকে একদিকে যেমন বলতে চাওয়া হয়েছে— স্বামীটি যে রোজগার করে তার মধ্যে কেবল তারই শ্রম থাকে না, স্ত্রীর শ্রমও লুকিয়ে থাকে। কারণ স্ত্রী-ই তাকে পরের দিনের কাজের জন্য উপযোগী করে তোলে। দ্বিতীয় দাবী— নারী পুরুষের সমবেতন। তৃতীয় বক্তব্য— কর্মক্ষেত্র এবং গৃহ উভয় জায়গাতেই নারীশ্রমের অবমূল্যায়ন ঘটে, যা হওয়া উচিত তা হল, খানিক ভাল মজুরি নয়, লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের অবসান।

এবারে আসি নিবন্ধটির শিরোনামে। কবি যখন প্রশ্নটি সরাসরি মার্ক্সকে করেছেন, তখন উত্তরটাও মার্ক্সবাদ থেকেই হওয়া উচিত। বিশেষত বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় যখন এই প্রশ্নটিকে তাদের (লেনিন) মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাশিয়ার বিপ্লবের পর ১৯১৯-এর জুনে লেনিন এক বক্তৃতায় বলছেন—

নারীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য সবরকমের আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও তারা পারিবারিক দাসীই থেকে যায়, কারণ তুচ্ছ ঘরকন্নার কাজ তাদের নিষ্পিষ্ট করে টুঁটি চেপে রাখে, বোকা বানিয়ে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয় এবং তাদের শুধু নিকৃষ্ট পীড়াদায়ক, বুদ্ধিনাশা একঘেয়ে কাজে— যা স্নায়ুগুলিকে গুঁড়িয়ে দেয়— অত্যন্ত বর্বরভাবে নষ্ট করা হয়। তাই তাদের খাটুনি ফলপ্রসূ কাজেই আসে না।

তিনি আরও বলেছেন—

নারীর মুক্তি, প্রকৃত কমিউনিজম কেবল তখনই শুরু হবে যখন এই ক্ষুদ্র পারিবারিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরূদ্ধে এক বিরাট সংগ্রাম শুরু হবে। অর্থাৎ যখন এই ব্যবস্থা ব্যাপক আকারে পরিবর্তিত হয়ে বৃহৎ সমাজতন্ত্রী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হবে।

এই লক্ষ্যে রাশিয়ায় সাধারণ ভোজনালয়, ক্রেশ, শিশুদের বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থাপন শুরু হয়। যদিও প্রথম দিকে তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই কম। এই নতুন ক্ষেত্রগুলিতে মেয়েদেরই নিয়োগ করা হত, কারণ এই ব্যাপারে তাদের দক্ষতা ছিল। এখনও তারা সেইসব কাজ করে, কিন্তু সেগুলো আর ব্যক্তিগত নয়। তাদের শ্রমের সামাজিকীকরণ ঘটেছে, তারা তাদের শ্রমের জন্য মজুরি পাচ্ছে। কিন্তু এটা সবে শুরু। লেনিন বলেছেন—

প্রকৃতপক্ষে সাম্যবাদী সমাজের গঠন তখনই শুরু হবে যখন নারীরা সম্পূর্ণ সমানাধিকার পেয়ে এই নিকৃষ্ট বুদ্ধিনাশা নিষ্ফল কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন কাজে যোগ দেবে।

সুতরাং বিপ্লবের সেবাদাসী হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু সেই বিপ্লবটাই যে অধরা। তাহলে?

পুঁজিবাদী সমাজেও জেনারেল ক্যান্টিন, ক্রেশ, গৃহপরিচারিকা, লন্ড্রি ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর মালিকানা সরকারি নয়, ব্যক্তিগত। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, চাকুরিরত মহিলারাই কেবল এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। সাধারণের জন্য এই ব্যবস্থা নয়। ব্যবস্থা যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় হচ্ছে, ততক্ষণ তার উপযোগিতা সকলে গ্রহণ করতে পারবে না।

অতএব, ব্যক্তিগত শ্রম থেকে সমাজের মোট শ্রমের যতদিন না সামাজিকীকরণ হচ্ছে, ততদিন নারীর মুক্তি নেই, পুরুষেরও নেই। তাই নারী-পুরুষকে একসঙ্গেই মুক্তি পেতে হবে।


ঋণ: গৌতম চৌধুরী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...