ইউজিসি-র নয়া রেগুলেশন: আক্রান্ত শিক্ষার স্বাধিকার, বিপন্ন সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিধি

শুভোদয় দাশগুপ্ত

 


আসল অ্যাজেন্ডা হল পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশনকে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত করে শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ। আর এই অভিসন্ধিকে চরিতার্থ করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিগত দশক ধরে বেতনক্রমের অনুসঙ্গে প্রকাশ করা রেগুলেশনে শুধুই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানিয়েছে। এতে শিক্ষা তলিয়ে যাবে যেমন যাওয়ার, যেমনটা চেয়ে আসছেন শিক্ষা বেসরকারিকরণের অভিসন্ধিতে সক্রিয় সরকারি নীতিনির্ধারকরা

 

সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপর আক্রমণ চলছেই। উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় সংস্থা। এই সংস্থার নির্ধারিত নীতি এবং সেই সঙ্গে আর্থিক অনুদানের উপর নির্ভর করে দেশের উচ্চশিক্ষার স্বাস্থ্য। আর এই সংস্থাটি উচ্চশিক্ষার প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিতে সমৃদ্ধ এবং সদা তৎপর উচ্চশিক্ষায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখায়। এই সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা সবসময় যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থাটা সম্যক অনুধাবন করেন অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত দুর্বল জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে বা সেইসব দুর্বলতার প্রতি সচেতন থেকে নীতি নির্ধারণ করেন তা কখনওই বলা যাবে না।

প্রথাগতভাবে স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন গঠনের পর প্রতি দশ বছর অন্তর কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বেতন কমিশন গঠন করে এবং সেই কমিশনের আনুপূর্বিক বিচারবিশ্লেষণের পর তাদের প্রদত্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারীদের বেতনকাঠামো পরিবর্তন হয়। আর এই সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সুপারিশ অনুযায়ী অধ্যাপকের নতুন বেতনক্রম চালু করে। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি ইউজিসি উচ্চশিক্ষার মান, শিক্ষক, আধিকারিক নিয়োগের নতুন মাপকাঠি নির্ধারণ করে তা রেগুলেশন আকারে প্রকাশ করে। ফলত কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও আধিকারিকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির নতুন নতুন শর্তাবলি আরোপিত হয়। আর এইখানেই আসে নানাবিধ অসঙ্গতি, আমলাতান্ত্রিক পীড়ন এবং উচ্চশিক্ষার স্বাধিকার হরণের সক্রিয়তা।

 

দুই.

প্রতি দশ বছর অন্তর যখনই বেতন কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক ইউজিসি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধি করেছে তখনই অধ্যাপকদের পদোন্নতি ও চাকরিতে নিয়োগের নতুন নতুন শর্তাবলি আরোপ করেছে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে দশ বছর পরপর এই রেগুলেশনে কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই। গত রেগুলেশনে আরোপিত নিয়মাবলির থেকে পরবর্তী রেগুলেশনে যা কিছু নতুন তার সঙ্গে খুব একটা সাযুজ্য মিলবে না পূর্ববর্তী রেগুলেশনের। যেন মানসিকতাটা এই যে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক— তাঁদের আরও বেতন বৃদ্ধি— অতএব দাও নিয়োগ ও পদোন্নতির শর্তাবলি আরও কঠিন করে।

এই শিক্ষককুলের লক্ষ্মীলাভেই যেন সমাজের সমূহ আপত্তি। থেকে থেকে শিক্ষকদের উপার্জন নিয়ে নজরদারি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও তার ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষকদের একটু জাতে উঠবার সম্ভাবনা হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে আমলারা।

এইভাবেই দশ বছর অন্তর অধ্যাপকদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইউজিসি নানাবিধ টার্ম ডিক্টেট করে গেছে। নিয়োগের যোগ্যতা নিয়ে, পদোন্নতি নিয়ে। আমলা ও নীতিনির্ধারকদের কাছে অধ্যাপকরা হলেন সফট টার্গেট। অধ্যাপকরা বিপাকে পড়লেই যেন তাঁরা খুশি। উচ্চশিক্ষার মান, সিলেবাস, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জাহান্নমে যাক।

 

তিন.

এই যে দশ বছর অন্তর রেগুলেশন পাল্টায়— সেই রেগুলেশনেও আবার অন্তবর্তীকালীন অ্যামেন্ডমেন্ট আসে। তবে তা সবসময় খুব ঘনঘন বা বড়সর নয়। কিন্তু ২০২৫ সালে (২০১৮-র রেগুলেশনের মডিফিকেশনে) ইউজিসি কিছু নতুন পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। এই নিয়ে সম্প্রতি গেল গেল রব তুলেছেন অনেকেই। ২০২৫ সালের ইউজিসি রেগুলেশনের এই নতুন নিয়মাবলিতে মুখ্যত দুটি দিক। এক, শিক্ষাজগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন এমন ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য হওয়ার ছাড়পত্র। আর দুই, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক পোস্ট পূরণের ও পদোন্নতির নিয়মাবলির পরিবর্তন।

এই যে ফি-রেগুলেশন নতুন নতুন নিয়মাবলি প্রবর্তন— তার অভিমুখ একেবারেই নির্দিষ্ট। শিক্ষকদের নিয়োগ পদোন্নতিকে জটিল করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে সুচারু হস্তক্ষেপ, শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণের পথ সুগম করা আর ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের প্রতি আমলাদের জাতক্রোধকে চরিতার্থ করা। এই সব আমলাদের কোনও ভাবনা নেই, কোনও মাথাব্যাথা নেই ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে, গবেষণার ক্ষেত্রকে ছাত্রদের জন্য সুগম করা নিয়ে। ইচ্ছেমতো সিলেবাস বদল হয়েছে। খেয়ালখুশিতে স্নাতক স্তরে কখনও চার বছর কখনও তিন বছর। পরে আবার তিন বছরের কোর্স এমনকি মালটিপল এন্ট্রি মালটিপল এক্সিট অ্যাকাডেমি ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট চালু করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে এই মালটিপল এক্সিটে ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি-ও দিয়ে দেওয়া হবে। এবং এই পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে সম্পূর্ণ পরিকল্পনাবিহীনভাবে, যখন ইচ্ছে তখন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরনো ব্যবস্থার ছাত্রছাত্রীদের কোর্স সম্পূর্ণ হওয়া এক-দু বছর বাকি থাকতেই নতুন ব্যবস্থা নতুন সিলেবাস চালু করা হয়েছে। ফলত দু-তিন বছর ধরে নতুন এবং পুরনো ব্যবস্থা সমান্তরালভাবে চালিয়ে যেতে হয়েছে। শিক্ষকরা যেমন, ছাত্রছাত্রীরাও বিভ্রান্ত হয়েছে, হিমশিম খেয়েছে। কখনও তিন বছরের স্নাতকক্রম কখনও চার বছরের। কখনও টু প্লাস ওয়ান কখনও থ্রি প্লাস ওয়ান। কখনও পার্ট ওয়ান, টু, থ্রি, কখনও সেমিস্টার। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছেলেখেলা চলেই আসছে। একবার চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম আবার সেই সিস্টেম বদলে দেওয়া।

বস্তুত ইউজিসির এই তুঘলকি আচরণে ঘনঘন সিস্টেম বদল-এ সামগ্রিকভাবে গোটা উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাই প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন বেতনক্রম চালুর পর যতবার ইউজিসি নতুন রেগুলেশন কার্যকর করে অধ্যাপকদের কলেজে যাওয়া-আসা, ক্লাস নেওয়া, প্রোমোশনের শর্তাবলি আরোপ করা বা অধ্যাপনায় নিয়োগের নিয়মাবলি বদলাতে থেকেছে, নিয়মাবলিকে কঠোর থেকে কঠোরতর করেছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষার মানের তত অবনমন ঘটেছে, অধ্যাপকদের পাঠদানের পরিসর ও গুণমান তত হ্রাস পেয়েছে। অধ্যাপকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতিবিধিতে এবং আচরণবিধিতে ইউজিসি যত নজরদারি বাড়িয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠনে তত শিথিলতা এসেছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তত পরীক্ষায় বসবার নাম লেখানোর সেন্টার হয়ে উঠেছে— সমান্তরাল শিক্ষা, গৃহশিক্ষকতার রমরমা হয়েছে। ইউজিসি নির্দেশে অধ্যাপকরা ঘণ্টা ধরে কলেজে বসে আছেন— ছাত্রছাত্রীরা কলেজ ছুঁয়ে প্রাইভেট টিউটরের বাড়ি ছুটেছে।

এইভাবে চলতে চলতে শিক্ষাব্যবস্থার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল কোভিড অতিমারিতে, লকডাউনের পর সেটুকুও লোপ পেতে বসেছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিসর আরও কমে এসেছে। উচ্চশিক্ষা থেকে ড্রপআউট হয়ে গেল লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রী। অফলাইন টিচিং আরও তাৎপর্যহীন হয়ে গেল অনলাইন টিচিং-এর দাপটে। আরও শতগুণ কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজড হল শিক্ষার।

আর এই আবহেই, অতিমারিকালেই, ঘোর লকডাউনের মধ্যেই, সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকা এনইপি (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০) কার্যকর হয়ে গেল ভারতবর্ষে। এই ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ নিয়ে বহু চর্চা এই নীতির আত্মপ্রকাশলগ্ন থেকে হয়ে এসেছে। কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা এখন মালুম পাচ্ছি মর্মে মর্মে। শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে আজ এক অভূতপূর্ব সঙ্কটে নিমজ্জিত। এ চিত্রনাট্য রচনা করাই ছিল। ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষায়। কোভিড অতিমারি সেই কাঙ্ক্ষিত সময় এনে দিল। হাতে রইল পেন্সিল— অর্থাৎ পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন আরও বিলীন হয়ে শিক্ষার বেসরকারিকরণের বর্ণাঢ্য জয়যাত্রাকে সুনিশ্চিত করল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কার্যকর হওয়ার পর।

শিক্ষাব্যবস্থায় অ্যাকাডেমিক কন্টেন্টের লঘুকরণ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক ধারাবাহিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত শিক্ষণ অথবা তাদের সুবিধা-অসুবিধাও উপেক্ষিতই থেকে গেছে। উচ্চশিক্ষায় আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ শিক্ষার মান অবনমনের কারণ হয়েছে। সরাসরি যারা ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে এসেছেন এবং সেই সুবাদে উচ্চশিক্ষার আমলা হয়েছেন তাঁদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার কাঠামো, পরিকাঠামো, পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর অভিমুখ সম্পর্কে অবহিত না থেকেই উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ করছেন। শুধুমাত্র স্নাতক ডিগ্রি নিয়েই অনেকে ইউপিএসসিতে দারুণ র‍্যাঙ্ক করে সর্বোচ্চ স্তরে আমলা হতে পারেন। এই সব আমলাদের মেধা প্রশ্নাতীত কিন্তু উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো-পরিকাঠামো তাঁদের অজানা থাকে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার প্রশ্নে। এ-বিষয়ে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে সিভিল সার্ভিসে যাঁরা যান তাঁরা অ্যাকাডেমিয়ায় থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রথিতযশা শিক্ষক হতে পারতেন অনেকে। কিন্তু অন্য পথ বেছে নেওয়ায় তাঁদের অনেকেরই উচ্চশিক্ষার জগৎটা অজানা থেকে যায়। অথচ তাঁদের হাতেই চলে যায় উচ্চশিক্ষার নীতি নির্ধারণের নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা। এমন একটা চর্চা এবং বিতর্ক বেশ কিছুকাল চলে আসছে যে অধ্যাপকদের বেতনক্রম অধ্যাপক ফেডারেশনের ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে যখন আইএএস অফিসারদের সমতুল হয়ে গেল সেই সময় থেকে এই সব আমলারা অধ্যাপকদের নিয়োগের যোগ্যতা এবং পদোন্নতির শর্তাবলি কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

 

চার.

রেগুলেশন প্রকাশিত হওয়ার পরও পরবর্তী বেতনক্রম পর্যন্ত পরের পর সংশোধনী আনে ইউজিসি। ২০১৬-র বেতনক্রম কার্যকর হওয়ার পর ২০১৮ সালে ইউজিসি যে রেগুলেশন প্রকাশ করে তারপরও অনেক পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনের শেষতম সংযোজন ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক কর্তৃক প্রস্তাবিত নয়া ইউজিসি রেগুলেশন খসড়া।

ডিসেম্বর ২০২৪, জানুয়ারি ৩ ২০২৫-এর নোটিফিকেশন এবং জানুয়ারি ৬, ২০২৫ তারিখের খসড়া রেগুলেশন— এ সবই ইউজিসি ২০১৮-র রেগুলেশনের পরিবর্ত হিসেবে সামনে আনছে। কখনও নোটিস ইস্যু করে, আর সর্বশেষ (এখনও পর্যন্ত) এই জানুয়ারি ৬ ইউজিসি পুনরায় এক রেগুলেশনের খসড়া প্রকাশ করে। এই খসড়া রেগুলেশনের সারমর্মটা বুঝতে হবে। ২০১৮-র রেগুলেশনের এত পরিমার্জন, পরিবর্ধন নিয়ে ইউজিসির এই যে বাড়তি তৎপরতা— তার নেপথ্যে আছে কোভিড অতিমারিকালে সংসদে খসড়া আকারে পেশ না করে বিনা আলোচনায় সরাসরি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কার্যকর করে দেওয়া। এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ যা কিনা শিক্ষানীতি মাত্র নয়, শাসকদলের সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নেওয়া এক রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার যথার্থ রূপায়ণ, তারই মান্যতা দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালের রেগুলেশনের এই ঘন ঘন সংশোধনী।

যে নতুন সংশোধনী খসড়া (সর্বশেষ) আনা হয়েছে তার অন্যতম অভিমুখ সংবিধানে যৌথ তালিকায় থাকা শিক্ষাকে রাজ্যের এক্তিয়ার থেকে ছিনিয়ে আনা। বলা বাহুল্য কেন্দ্রের সরকার শুধু শিক্ষা নয়, সার্বিকভাবেই ভারতীয় সংবিধানের উপর আঘাত হানায় সদা তৎপর। সংবিধান অবমাননা এই সরকারের অন্যতম অ্যাজেন্ডা। ঈর্ষণীয় সহাবস্থান এই দেশে বিবিধ আঞ্চলিক ভাষার, পরিধানের, ধর্মের, সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয়, সেই অতুলান কৃষ্টিরই মূলে কুঠারঘাত করতে চাইছে আরএসএস-নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার। সেই লক্ষ্যেই প্রতি সাধারণ নির্বাচনে তারা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চেষ্টা করছে যা দিয়ে আইনসম্মতভাবে ভারতীয় সংবিধানের খোলনলচে পালটে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়। দেশের নির্বাচকমণ্ডলীকে অশেষ ধন্যবাদ তারা বিগত সাধারণ নির্বাচনে শাসকদলের এই কদর্য অভিসন্ধিতে বাধ সেধেছে। কিন্তু দুর্জনের ছলের অভাব নেই। ঘুরপথে সংবিধানের উপর মুহুর্মুহু আঘাত হেনে চলেছে শাসকদল। গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ব্যবহার করেই গণতন্ত্রকে প্রতিনিয়ত প্রহসনে পরিণত করছে। সবাই মনে করছে গণতন্ত্র সুরক্ষিত— কিন্তু কর্পোরেটের সঙ্গে বোঝাপড়া করে, বিপুল টাকার খেলায় গণতন্ত্রকে এক প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতায় আসীন থাকা শুধু নয় গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে দেশ বিক্রিও করে দেওয়া হচ্ছে— সরকারি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর বেচে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে।

ইউজিসি-র আলোচ্য যে সর্বশেষ খসড়া শর্তাবলি ২০১৮ সালের রেগুলেশনের সংশোধনী হিসেবে প্রকাশ করেছে তারও হিডেন অ্যাজেন্ডা ভারতীয় সংবিধান অবমাননা করে যৌথ তালিকায় থাকা শিক্ষাকে প্রত্যক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তামিলনাডু, কেরল ও কর্নাটক সরকার ইতিমধ্যে এই প্রস্তাবিত রেগুলেশনের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এই রেগুলেশনে উপাচার্য নিয়োগে প্রত্যক্ষভাবে অধ্যাপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার রাস্তা খুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিয়ার বাইরের ব্যক্তিদেরও ছাড়পত্র দিতে চায় নতুন রেগুলেশন। শুধু তাই নয়, উপাচার্য নিয়োগের সার্চ কমিটিতেও কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য রাখতে চাওয়া হচ্ছে এই রেগুলেশনে। উপাচার্য পদে আবেদনের যোগ্যতায় আগে ছিল প্রফেসর পদে ন্যূনতম দশ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে ইউজিসি একটি নতুন মাত্রা যোগ করছে— “ten years’ experience at a senior level in industry, public administration, public policy and/or public sector undertaking.” উপাচার্য নিয়োগের সার্চ কমিটি গঠনেও ইউজিসি নতুন নীতি প্রবর্তন করতে উদ্যত। কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকারের আইনসভায় অনুমোদিত রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়— সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য নিয়োগের সার্চ কমিটিতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য রাখতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। নতুন প্রস্তাবে সার্চ কমিটিতে একজন আচার্যের নমিনি, যিনি কিনা কমিটির চেয়ারপার্সন, দ্বিতীয়ত ইউজিসি চেয়ারম্যানের একজন নমিনি, আর সেই সঙ্গে যে ইউনিভার্সিটির উপাচার্য নিয়োগ হবে সেই ইউনিভার্সিটির কোনও অ্যাপেক্স বডির (সেনেট/সিন্ডিকেট/এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল) একজন মনোনীত সদস্য। আর এটাই হল শিক্ষার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর কেন্দ্রীয় সরকারের চরম হস্তক্ষেপ।

ইউজিসি রেগুলেশনের শেষতম খসড়া সংশোধনীটিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতেও নতুন কিছু শর্তাবলি আনার তোড়জোড় চলছে যা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র উদ্দেশ্য ও অভিমুখ সহায়ক হবে। নিয়োগ এবং পদোন্নতির এই নতুন শর্তাবলিতে প্রার্থীদের ইউজিসি তালিকাভুক্ত নয়টি নোটেবেল ক্রাইটেরিয়ার অন্তত চারটি ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করবার কথা বলা হছে। তার মধ্যে আসছে আইকেএস বা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের মান্যতাপ্রাপ্ত টিচিং লার্নিং ও রিসার্চ। পাশাপাশি এই নোটেবল কন্ট্রিবিউশনে রাখা হবে গবেষণার জন্য ফান্ডিং আনা, পরিকাঠামো তৈরি, অনলাইন শিক্ষার সহায়ক পদক্ষেপ ইত্যাদি।[1] শিক্ষাবিদদের একাংশের মতে এই প্রস্তাবিত নীতি আদতে টিচিং এবং গবেষণার গুরুত্ব হ্রাস করে শিক্ষাবহির্ভুত কার্যকলাপের অনুপ্রবেশকে ছাড়পত্র দেবে।

 

পাঁচ.

এই খসড়া সংশোধনী এই লেখা তৈরি হওয়ার মুহূর্তে পাবলিক ডোমেইনে জনসাধারণ ও স্টেক হোল্ডারদের মতামতের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু বলাই বাহুল্য এই প্রস্তাবিত রেগুলেশনও অচিরেই বাধ্যতামূলক হবে যা কিনা শিক্ষাব্যবস্থার ফেডারেল স্ট্রাকচারে আঘাত হানবে সংবিধান অবমাননা করে। আর এই নিয়েই সরব অনেক রাজ্য যেখানে কেন্দ্রীয় শাসকদল ক্ষমতায় নেই। কেরল, কর্নাটক ও তামিলনাডুতে। তামিলনাডু বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ৯ জানুয়ারি ইউজিসির এই প্রস্তাবিত রেগুলেশনের তীব্র বিরোধিতা করে একটি প্রস্তাব পেশ করেন যা গৃহীত হয়।[2]

কেরলের মুখ্যুমন্ত্রী ১৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে তীব্র ভাষায় লিখেছেন যে উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য সরকারের মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করবার এই কেন্দ্রীয় সরকারি প্রচেষ্টাকে তিনি প্রতিবাদ করছেন সর্বতোভাবে। প্রসঙ্গত এই চিঠিতে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে কোনও উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা ছাড়াই দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন (১৯৭৫-৭৭) কীভাবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাকে যৌথ তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।[3]

অন্যদিকে কর্নাটকের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী এমসি সুধাকর ইউজিসির এই প্রস্তাবিত রেগুলেশন যা ইউজিসির আধিকারিক নয়, স্বয়ং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর নামাঙ্কিত, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কর্নাটকের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন এই বলে যে প্রস্তাবিত রেগুলেশন সংবিধানের ফেডারেল স্ট্রাকচারের উপর এক প্রত্যক্ষ আঘাত। আর এই আবহেই নড়েচড়ে বসেছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অনুভব করেছে একটা প্রতিবাদ অনতিবিলম্বে না জানালে জাত যাবে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রক একটি বিশেষজ্ঞ নিয়ন্ত্রিত রিপোর্ট তৈরি করেছে ইউজিসির এই নয়া রেগুলেশনের প্রতিবাদ জানিয়ে। এ রাজ্যে অবশ্য রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর দ্বৈরথ চলে আসছে বহুকাল যাবৎ। এই দ্বৈরথে কার্যত এক অচলাবস্থা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে।

আসলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকার আর কেন্দ্রের সরকারের শিক্ষায় একে অন্যের ডোমেইনে ঢুকে পড়া পারস্পরিকভাবে চলছেই। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালের বর্ধিত বেতনক্রমের রাজ্য সরকারি আদেশনামায় ইউজিসি কথাটাই বেমালুম তুলে দিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য রিভিশন অফ পে অ্যান্ড অ্যালাউন্স (ROPA) শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ-রাজ্যে বর্ধিত বেতনক্রমে ইউজিসি স্কেল আর না দেওয়ারই বন্দোবস্ত পাকা করছে রাজ্য সরকার।

আর অন্যদিকে এই খসড়া রেগুলেশনে ফেডারেল কাঠামোকে সরাসরি লঙ্ঘন করবার যাবতীয় ব্যবস্থা প্রস্তুত। কেরল, কর্নাটক এবং তামিলনাডু সরকারের গুঁতো খেয়ে প্রস্তাবিত রেগুলেশন (জানুয়ারি ২০২৫)-এর প্রতিবাদ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা ডকুমেন্ট এতদিন হয়তো পৌঁছেও গেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে। প্রস্তাবিত রেগুলেশনের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই পর্যবেক্ষণে নিশ্চয়ই আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির (কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সরকারের অধীন) উপাচার্য নিয়োগে ভারতীয় সংবিধানে মান্যতাপ্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যৌথ তালিকায় থাকা শিক্ষার উপর নির্দয় আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আছে পিএইচডি-কে অধ্যাপকদের পদোন্নতির অধিকাংশ স্তরে বাধ্যতামূলক যোগ্যতা হিসেবে রাখবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। থাকার কথা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে একই বিষয়ে ডিগ্রি না থেকেও স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরের বহির্ভুত বিষয়ে পিএইচডি অথবা নেট ক্লিয়ার করে সেই বিষয়ে অধ্যাপনার চাকরিতে ছাড়পত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিবাদপত্রে নিশ্চয়ই থাকবে রেগুলেশনের প্রস্তাবিত নটি নোটেবেল কনট্রিবিউশন যার চারটি পূরণ করা বাধ্যতামূলক অধ্যাপকদের নিয়োগ অথবা পদোন্নতি ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা।

প্রতিবাদ থাকবার কথা এই নোটেবল কন্ট্রিবিউশনে যেভাবে ইউজিসি-নির্ধারিত তথাকথিত ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমকে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে উস্কে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে তার বিরুদ্ধেও। কিন্তু এ-রাজ্যর এই সব বিপ্লবী প্রতিবাদই অন্তসারশূন্য এবং দ্বিচারিতায় দুষ্ট। বলা বাহুল্য ২০১৮-র ইউজিসি রেগুলেশনকে সুপারসিড করে যে একের পর এক নোটিফিকেশন ও খসড়া রেগুলেশন ইউজিসি প্রকাশ করছে তার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতির ইমপ্লিমেন্টশনকে সুচারু করে তোলা। আর এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০— যা কিনা শিক্ষার অবধারিত মৃত্যুর ধারাবিবরণী তা নিয়ে নিশ্চুপ থেকেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রত্যাখ্যানের বার্তা দিয়ে দফায় দফায় বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়নে কমিটি গড়ে মাসের পর মাস অন্তত দু-দফায় রিপোর্ট না পেশ করে— জাতীয় শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ইমপ্লিমেন্ট করে ফেলবার পর যে বিকল্প শিক্ষানীতি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার প্রকাশ করেছে তা কার্যত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-কে বিনা বিরোধে এ-রাজ্যে চালু করবারই পথকে সুগম করেছে। এই আবহেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নড়েচড়ে বসা। কিন্তু বাস্তবে এ-রাজ্যে শিক্ষা গত পনেরো বছরে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্ষেত্র। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাঙ্গনগুলি বহিরাগতদের মুক্তাঞ্চল। এই রাজ্যে শিক্ষাঙ্গনে চলে অবাধ সন্ত্রাস। টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি হয় শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক পদে। এই রাজ্যে পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর প্যানেলভুক্ত হয়েও চাকরি মেলে না। সেই চাকরিগুলো টাকার বিনিময়ে কিনে নেয় অযোগ্য প্রার্থীরা। আজ টানা আড়াই বছর এই বঞ্চিত প্রার্থীরা রাস্তায়, আদালতে। বিগত পনেরো বছরে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত, নিপীড়িত। এমনকী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষিয়িত্রী, শিক্ষাকর্মীরা। শিক্ষক আন্দোলনের উপর এই সময়কালে অকথ্য দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। এই রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে পাঠরতা চিকিৎসককে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয় কর্মরত অবস্থায়। আজও খুনিরা অধরা— বিচার পাননি ‘অভয়া’র বাবা-মা। এই আরজিকর সংবাদের শিরোনামে আজ ছয় মাস ধরে। তদন্তে উঠে আসছে বছর বছর ধরে চলে আসা হুমকি সংস্কৃতির ইতিহাস। এই থ্রেট কালচার নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু শুধু রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলোতে নয় আজ এক দশকের বেশি সময় ধরে এই হুমকি সংস্কৃতি চলে এসেছে রাজ্যের অসংখ্য স্কুল ও কলেজে। আসলে এই থ্রেট কালচার তৈরি করা হয়েছে রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় যে লাগামহীন দুর্নীতি চলে আসছে তাকে আড়াল করতে। অথচ এই থ্রেট কালচার নিয়ে আরজিকর-কাণ্ডের আগে সেই অর্থে কোনও নাগরিক প্রতিবাদ সঙ্ঘটিত হয়নি। ক্রমশ দেখা গেছে রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই দুর্নীতিতে ভরা। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নামিয়ে আনবার উদ্দেশ্য আসলে যে ছিল অবাধে দুর্নীতি করা তা বোঝা গেছে অনেক দেরিতে যখন দুর্নীতির দায়ে শিক্ষামন্ত্রী-সহ বড় বড় আমলা ও কর্তাব্যক্তিদের জেলে যেতে হয়েছে। তখন এই হুমকি সংস্কৃতির আড়ালে কী চলেছে তা আজ রাজ্যবাসী বুঝতে পেরেছে।

 

ছয়.

কোথায় পৌঁছাল উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা এই জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকরী হওয়ার পর? জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ খসড়া আকারে আসবার পর এবং কার্যকর হওয়ার পরও এই শিক্ষানীতি নিয়ে সমালোচনামুখর থেকেছেন এক বড় অংশের শিক্ষাবিদ। এই শিক্ষানীতি অনুয়ায়ী শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন কী ভয়াবহ পরিণামের ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উচ্চশিক্ষায় ওয়ান প্লাস ওয়ান প্লাস ওয়ান কাঠামো পিছনে ফেলে চার বছরের এনইপি-র প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার পরই সিলেবাস, কাঠামো, পরিকাঠামো এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের মধ্যে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়বার পর এই উদ্বেগ আরও ঘনীভূত হয়েছে। দিকে দিকে উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের এনরোলমেন্ট অবিশ্বাস্য হারে কমছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিসর আরও শোচনীয়ভাবে তাৎপর্যহীন হয়ে উঠেছে। বস্তুত শ্রেণিকক্ষের পাঠের চেয়ে অনেক বেশি সময় খেয়ে যাচ্ছে ইন্টার্নাল অ্যাসেসমেন্ট-সহ চূড়ান্ত মূল্যায়নে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কার্যকরী হওয়ার পর এই দু-বছরেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক বিলীয়মান অস্তিত হয়ে উঠেছে। এই ভয়াবহতা আজ হঠাৎ করে আসেনি।

এই ভয়াবহতাকে পরিকল্পনা করে আনা হয়েছে দীর্ঘ পরিসরে। আসল অ্যাজেন্ডা ছিল পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশনকে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত করে শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ। আর এই অভিসন্ধিকে চরিতার্থ করতে, এই অভিসন্ধিকে বুঝতে না দিতে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিগত দশক ধরে বেতনক্রমের অনুসঙ্গে প্রকাশ করা রেগুলেশনে শুধুই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানিয়েছে। এখন কথা হল যেসব শিক্ষকরা এইসব বেড়াজাল পেরিয়ে শিক্ষক হলেন, সশরীরে নিয়ম মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলেন-এলেন, হয়তো বা যথাযথ ঘণ্টা ধরে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকলেন— বাস্তবে কটা ক্লাস নিতে পারলেন, বা রুটিন মোতাবেক ক্লাস নেওয়ার ছাত্রছাত্রী থাকল কিনা— এ সবই বিবেচনার বাইরে। নির্ধারিত সময়কালে শিক্ষক যে কটি ক্লাসে স্টুডেন্ট পাবেন ক্লাস করবেন— বাকি সময় বসে থাকবেন, গল্প অথবা পরনিন্দা/পরচর্চা করবেন, অফিসে শিক্ষাকর্মীদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করবেন, অথবা প্রশাসনের আস্থাভাজন হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অংশীদার হয়ে দিনান্তে প্রসন্ন মনে বাড়ি ফিরবেন। শিক্ষা তলিয়ে যাবে যেমন যাওয়ার, যেমনটা চেয়ে আসছেন শিক্ষা বেসরকারিকরণের অভিসন্ধিতে সক্রিয় সরকারি নীতিনির্ধারকরা।

 

সাত.

এ তো গেল বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পঠনপাঠনে শিক্ষকদের গুরুত্ব ছাত্রছাত্রীদের কাছে কমে আসা। পাশাপাশি একটা বিষয় আরও করুণ এবং ভয়াবহ। আমাদের দেশ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এমন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করেছে যে তাতে ছাত্রছাত্রীদের কোনও ভবিষ্যতের দিশা নেই। না আছে জ্ঞানের গভীরতা বাড়াবার পরিসর বা তাগিদ— না আছে বৃত্তি বা জীবিকার কোনও অভিমুখ। বস্তুত সময়ের আর অর্থের অপচয় উচ্চতর শিক্ষায় যুক্ত হওয়া বা সেই শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জীবন-জীবিকার কোনও দিশা দেখায় না বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রীদের সামনে কোনও স্বপ্ন থাকে না পড়াশোনাকে ঘিরে। শুধু একটা ডিগ্রি পাওয়া যে ডিগ্রির হয়তো কোনও মূল্য থাকবে না সেই ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে আর মাঝখান থেকে মূল্যবান অনেকগুলো বছর জীবন থেকে বেরিয়ে যাবে, অর্থব্যয় হয়ে যাবে অনর্থক যা সেই ছাত্র বা ছাত্রীর পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্যে অকুলান এবং ঋণ করতে বাধ্য হবেন অভিভাবকরা।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কার্যকর হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্বের সঙ্কট আরও তীব্রতর হচ্ছে। একদিকে দেশি-বিদেশি ভাবধারার এক বেমিশেল দিশাহীন মিশ্রপাঠ মিশ্রপাঠক্রম। অন্যদিকে চরম আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মডেলে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের (আইকেএস) শিক্ষাব্যবস্থাকে এক প্রহসনে পরিণত করছে এবং এটা সজ্ঞানে করা হচ্ছে পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশনকে সমূলে উৎখাত করতে।

এনইপি ২০২০ কার্যকর হওয়ার পর সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকরা আরওই বুঝতে শুরু করেছে যে এই শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রসমাজকে কোনও দিশা দেখাবে না। এই ব্যবস্থা শুধু ছাত্রসমাজকে হতাশার ঠেলে দিয়ে ড্রপ আউট হওয়ার দিকে ঠেলে দেবে। ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের জ্ঞান, এষণা ও প্রজ্ঞার জায়গাগুলোকে সামনে না এনে বিচিত্র এক মুক্তচিন্তার পরিপন্থী, বিজ্ঞানবিমুখ এবং পরাবাস্তব জগতে ছাত্রসমাজকে দীক্ষিত করবার চেষ্টা হচ্ছে।


[1] Assault on academic autonomy. Frontline. Feb 17, 2025. Page-48.
[2] পূর্বোক্ত।
[3] পূর্বোক্ত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...