পটাশপুর কত দূর?

খালিদা খানুম

 

চৈত্রের চাঁদিফাটা রোদ। কোথাও একটুকু কোনও বিরাম নেই। ভোরের আজানের পর সেই যে সূর্য তাপ দেওয়া শুরু করেছে, মানুষজন তো কোন ছার, পাখপাখালি জীবজন্তুও হন্যে হয়ে ছায়ার দিকে ছুটছে। এখন ছায়া কোথায়! পিচরাস্তার দুদিকে বড় গাছ তো দূর অস্ত, ছোটখাটো ঝোপঝাড়ও বিদায় নিয়েছে। তার পরিবর্তে ইটের সারি। সেই সারিতে বিশেষত্ব তেমন কিছু নেই, ছোট দোকানঘরের সারি। মডার্ন বস্ত্রালয়ের পাশে খান ইলেট্রনিকস। তারপর মা তারা শু, কল্পনা ভ্যারাইটি, আব্বাস ফার্নিচার, পিঙ্কি টেলর-এর পাশাপাশি নামহীন চা-এর দোকান, ফলের দোকান। সবচেয়ে পুরাতন হল মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারটি। মিষ্টির দোকানে লাল-সাদা-কালো মিষ্টি সাজানো। গুজিয়া-জিলাপির থালাতে মাছি উড়ছে। কাচের দরজাওয়ালা ফ্রিজে ঠান্ডা পানীয় সাজানো। দেখেও শান্তি আসে। দোকানি দীননাথ ঝিমাচ্ছে। রোদ পড়ে এলে জেগে উঠবে। দোকানের কাজের ছোকরা দুটোকে হেঁকেডেকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। ইফতারের আগে জিলাপি আর শিঙারা গরম গরম ভেজে তুলতে হবে। কিন্তু এখন সে-সবের দেরি। এখন এই রোদের দুপুরে খদ্দের কই! তবু দীননাথের তন্দ্রা চটকে গেল হাঁকাহাঁকিতে।

—পটাশপুর আর কতক্ষণ?
—লাগবে আর কিছুক্ষণ। এই রাস্তাটা ধরে সোজা গ্যালেই হবে।

প্রশ্নকর্তা কিছু বলে না। তার ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়াটি মাথা নাড়ায় জোর। গলার ঘন্টার টুং টুং সুর ছড়িয়ে পড়ে।

—তা আসছেন কুনখানে? কারও বাড়ি যাবেন নাকি? দীননাথ বলে।
—আমরা মিসকিন মানুষ। কার বাড়ি আর যাব। শুননু পটাশপুরে মোহজিদে আজ মিলাদ আছে। মিলাদ দিবে কাজীবাড়ির বড় ব্যাটা। মা মরেছে কদিন আগে, তাই খয়রাতিও করবে ম্যালা। তাই যাছিনু, যদি কিছু খয়রাত পাওয়া মিলে।
—তাই বল্যো। তাই ভাবছিনু ঘোড়ার গাড়ি কুনখান থাক্যে এল। এদিকে তো এসবের চল উঠে গেছে। কতদিন বাদে ঘোড়া দেখনু। তা, বেশ ঘোড়া তোমার।

তাদের কথাবার্তার মাঝে ঘোড়াটা আবার মাথা নাড়াল জোরে। মনোযোগ চায়। ঘোড়াগাড়ির চালক তৎপর হয়ে ওঠে।

—দাঁড়া বাপ। আরেকটু সবুর কর। তোর লেগে পানির ব্যবস্থা করছি। আল্লা কী রোদখান দিয়েছে! রোজা রমজানের মাস। একটুক রহম দেখি না।

দীননাথ বলে— রোদ বলে রোদ! এতো রোদে বার হয়্যাছ কেনে? সামনে একটু হাঁটি যাও গাঁয়ের পায়মারি স্কুলের কাছে জলের কল আছে। অবলা জানোয়ার!

ঘোড়ার গলার লাগামে ইশারা পড়ে। ঘোড়া চলতে থাকে। ঠুং ঠুং শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ে চৈত্রের আগুন-রোদে। ঘোড়ার মালিক জয়নুল। কেবল ঘোড়া নয়, ঘোড়া-সহ গাড়িটির মালিক সে। ঘোড়ার গাড়িটি গরুর গাড়ির মতো ছই দেওয়া। ছইয়ের ভেতরে যে নারী শুয়ে আছে তার মালিকও জয়নুল। ছইয়ের ভেতরে একটা করে হাঁড়ি কড়া, দুটো থালা, একটা বদনা। আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস যেগুলো কাপড়ের পোঁটলায় বাঁধা।

—ঘুমিয়া পড়লা নাকি!

জয়নুলের কথায় হাসিনা চোখ খোলে।

—চোখখান একটু লেগে গিয়েছিল। কতদূর এলা। ওতদূরে না গিয়ে মোড়ের মুখে দাঁড়ালে পারতা।

জয়নুলের মুখে একটা খারাপ শব্দ আসছিল। কিন্তু রোজার মাস বলে সামলে নিল। বলল—

—মোড়ে আর ইনকাম হয় কই। গাঁয়ে ঘরে ঘুরলে মানুষ তবু কিছুটা দেয়। মানুষের কলিজা সব পাথর হয়ে গেলছে। আগকার মতো আছে নাকি! দোকানি বলল, গাঁয়ের দিকে পানির কল আছে, ঘোড়াটাকেও পানি দিতে হবে।

আগের মতো কী কিছু আছে আর! জয়নুলের মতো জোয়ান ছেলে, যে ছেলে কাঠবেড়ালির মতো জলের পাইপ বেয়ে পাঁচতলায় উঠে যেতে পারত, তার এখন দাঁড়াতে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হয়।

মোড় থেকে একটা ঢালাই রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেঁকে। রাস্তার দুপাশে টুনিবালব লাগানো। ঈদের সপ্তাহ শুরু হয়েছে সবে। তার আগেই তোড়জোড়। রাস্তার দু-ধারে পাকাবাড়ি। এখন মাটির বাড়ি আর দেখা যায় না। বেশিরভাগ বাড়িই পুরানো নয়। খুব জোর দশ-বারো বছরের পুরাতন। প্লাস্টার-রং করা নয় বেশিরভাগ বাড়িতে। একটু উঁকি দিয়েই বাঁশের বেড়ার সদর দরজা দিয়ে ভেতরের জীবন দেখা যায়। জয়নুল রেকর্ডিংটা চালিয়ে দেয়। মুসলিম পাড়ার রোজার মাসে ইনকাম হয় ভাল। বাড়ির মেয়েমানুষরা সত্তর হাজার গুণ বেশি নেকি অর্জনের সুযোগ ছাড়ে না।

—মা-বোনেরা আমি ল্যাংড়া-খোঁড়া অক্ষম মানুষ। আমি চলতে পারি না। আমার পা নেই। আল্লাহ রহমে, আপনাদের দানে কোনওভাবে আমার দিন চলে, মা-বোনেরা আপনারা এই অক্ষম জাতি-ভাইকে সাহায্য করে আপনার নেকির ভাণ্ডার ভরে তুলুন। আপনাদের দান বিফলে যাবে না। আল্লা কেয়ামতের মাঠে এই দানের বদলে জান্নাতুল ফেরদৌস দাখিল করবেন।

রেকর্ডিং-এর একটা নিজস্ব সুর আছে। রেকর্ডিং বাজানোর নিয়ম আছে, একবার রেকর্ড বাজানোর পর একটা গজল বা সুরা বাজাতে হয়। একটানা রেকর্ড বাজালে লোকে বিরক্ত হয়।

ঘোড়া চলছে ধীরে। একটু আগে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে এখন আর নেই। সে হয়তো জানে, যখন এই রেকর্ডের শব্দ চলে তখন ধীরে চলতে হয়। অভ্যাস এক অদ্ভুত জিনিস। কোনও কিছু অভ্যাস করে নিলে সেটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যেমন রোজা-মাসে উপোস করাটা, মানুষ অভ্যাস করে নেয় বলেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।

ঘোড়াটা ধীর লয়ে চলতে শুরু করতে হাসিনা বিরক্ত হয়। ভেতর থেকে বলে—

—এখানে আবার কি লটপট করছ, একটা কুনো ছায়াতল দেখে দাঁড়াও, অবলা জানোয়ার। দানাপানি কিছু মুখে দেয়নি। আমরা না হয় দিতে পারব না, কিন্তু জানোয়ারটাকে রোজাতে রাখছ কেনে?

কথাটা সত্যি। তারা নাহয় রোজা করেছে, ঘোড়া তো রোজা করেনি। ইনসানের রোজা আছে, সংযমের শিক্ষা আছে। কিন্তু জানোয়ারের রোজা নেই, সংযমের শিক্ষা নেই। কারণ জানোয়াররা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করে না। জমিয়ে রাখা তো দূর অস্ত। মানুষ যখন বনে ছিল, তখন তাদেরও সঞ্চয় ছিল না। এখন মানুষ সভ্য হয়েছে। সঞ্চয় করতে শিখেছে। সঞ্চয় করতে করতে শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এখন জয়নুলের সঞ্চয় বলতে ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি আর বিবি। ইচ্ছে আছে, সঞ্চয়ের ঝুলি ভরে উঠুক। তাই সে ভিক্ষায় পাওয়া টাকা খরচ করে না। একটা ভিটেমাটি আছে, কিন্তু সে ভিটেমাটিতে ঘরটিতে তালা বন্ধ থাকে, সেটি পাকা হবে সঞ্চয়ের টাকাতে। কিন্তু এসব দিন জয়নুলের ছিল না। জয়নুল তখন ল্যাংড়া-খোঁড়া ছিল না। অবশ্য তখনও সঞ্চয় কম করেনি, কিন্তু শত্রু পা-খানা, সেই সঞ্চয় খেয়ে নিয়েছে ছয় মাসে।

গ্রাম ছাড়িয়ে ঘোড়াগাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছিল মাঠের মধ্যে দিয়ে। দুপাশে চাষের মাঠ। শীতের ফসলের সময় চলে গেছে। সবুজ ধানের চাদর মোড়ানোর সময় আসেনি। তবু মাটির ছুটি নেই। স্যালো মেশিন দিয়ে ভসভস করে মাটি ভিজিয়ে চলছে চাষ। শাকসবজির চাষ। এত চাষ তবু চালের দাম বাড়ে, সবজি কেনা দায়। জয়নুল সবজি কেনে না, হাটবারে সে হাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কানা বেগুন, শুকনো শাকপাতা, না বিক্রি হওয়া আনাজে তার ঝুলি ভরে যায়। পা চলে যাওয়ার পর সবজি কিনতে হয় না। হাটের সামনে গেলে পাওয়া যায় সবজি ভিক্ষা। হারিয়ে যাওয়া পা তখন তার বন্ধু হয়ে ওঠে। কিন্তু মাছ-মাংস খেতে ইচ্ছা করলে কিনতে হয়, বা কোনও দাওয়াতের অপেক্ষা করতে হয়।

হারিয়ে যাওয়া পা যতই ইনকামের রাস্তা হয়ে উঠুক না কেন, বাদ পড়া পায়ের অংশটা দেখলেই জয়নুলের ভেতরটা বিদ্রোহ করে উঠে। কোনও এক অদৃশ্য ব্যক্তিকে গালাগালি দেয়। ব্যক্তিটিকে চিনতে পারে না সে। পুরাতন কাজের মালিকও হতে পারে, সে নিজেও হতে পারে আবার অদৃশ্য আল্লা হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। সে ছিল রাজমিস্ত্রি। বাইরে খাটতে যাওয়া নির্মাণশ্রমিক। যা কাজ পেত তাই করত। তখন হচ্ছিল রাজমিস্ত্রির কাজ।  উঁচু বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। পনেরো তলায় ছিল সে। পা ফসকে গেল। রাস্তার ধারে উদ্ধার হল রক্তাক্ত দেহ। কেউ ভাবেনি, বাঁচবে!

শালা, মরে গেলেই ভাল হতোক! ল্যাংড়া-খোঁড়ার জীবন চালাতে হতোক না। মনে মনে আজও ভাবে জয়নুল। হাসপাতালে কতদিন ছিল মনে নেই, মাসখানেক তো হবেই। হাসিনা ছিল সঙ্গে। এত বছরের পুরাতন বৌটাকে খুব দরকারি বলে মনে হয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে পা কাটা গেল একটা। অন্য পা ব্যান্ডেজে মোড়া। হাসিনা লোকের বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে ফিরে খাওয়াত, হাগা-মুতা করাত। জয়নুলের তেজটাও তখন থেকে কমে আসছিল। ভাঙা পা নিয়ে কার তেজ থাকে বেশিদিন! হাসিনাকে ভাল লাগছিল নতুন করে। হাসিনা চলে গেলে সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকত, কখন ফিরবে। পাশে বসিয়ে সোহাগের কথা বলত। হাসিনা সোহাগের কথাতে হাসত। মনে মনে জানত, এ সোহাগ কিসের জন্য। যখন কাজের ক্ষমতা ছিল তখন অন্য রূপ। জয়নুল চাইত, হাসিনা শুধু তার জন্যই থাক। কোন বাড়িতে কী যে কাজ করতে হয় কে জানে! জয়নুল জানে লোকের বাড়িতে কতরকমের কাজ করতে হয়! কেবল জয়নুল না, সকলেই জানে।

শ্রমিকদের জড়াজড়ি করে থাকা জীবন। কোনও আন্ডার-কন্সট্রাকশনের বিন্ডিং পাওয়া গেলে কয়েক মাস নিশ্চিত। না হলে গ্যারেজ, ফুটপাত, স্টেশন। এর মধ্যেও মেয়েরা পোয়াতি হয়। জয়নুলের ভয় করে। সে পড়ে থাকে হাসপাতালে। রাতে হাসিনা পুরুষ ওয়ার্ডের ভেতরে থাকতে পারে না। হাসপাতালের বাইরে গাছতলায় থাকে। যদি হাসিনা কারও সঙ্গে কিছু লাফড়া করে!

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জয়নুল বলে— চলো গাঁয়ে ফিরি।

হাসিনা বলে, পাগলের পারা বুল্যো না। গাঁয়ে ফিরে হবেক কী? প্যাটে দিব কী? কে খাওয়াবে তুমাকে?

—আল্লা রুজির মালিক। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চলো গাঁয়ে ফিরি।

ফিরি বললে আর আর তো ফেরা হয় না। হাসিনারও মন নেই ফিরতে। ফিরলে সেই হদ্দ গাঁয়ের ঘর। একবার কারেন্ট গেলে সারা রাত আসে না। এখন তবু বছর পাঁচেক কারেন্ট এসেছে, আগে হুকিং করে চলত। হাতে নগদ পয়সা নেই, রেশনের চাল, আটা আর শাক-পাতার জীবন। কখনও হাঁস-মুরগি বেচে বা ঠিকে কাজে দু-পয়সা এলেও, সে আর ক টাকা। দেরি করে নানান বাহানায়। জয়নুলের মন বিগড়ায়। রাগ ওঠে, সন্দেহ জাগে হাসিনার উপর, সাদেকুলের উপর, কামালের উপর, নিয়ামতের উপর। যাকে হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে দেখে, তার উপর সন্দেহ হয়। সাদেকুলের সঙ্গে হাসিনা হাসির বহর কাটে, জয়নুল খিঁচিয়ে ওঠে। হাসিনা বলে, রাগ দেখিও না। বিদ্যেশে কাহুকে তো হাতে রাখতে হবে। তুমি ল্যাংড়া লুলা, এখানে ভালমন্দ হলে দেখবে কে শুনি। গাঁয়ে ফিরব, গাঁয়ে ফিরব বলে হুজুগ তুলে আছ, পকেটে আছে কিছু?

পুরুষমানুষ ল্যাংড়া হোক আর কানা হোক, পকেটের কথা ওঠালে মনে লাগে। দু-ঘা লাগাতে ইচ্ছ করে। কিন্তু হাসিনাকে চটানো যাবে না, হাসিনাই এখন তার সম্বল। সাদেকুলের সঙ্গে হাসিনার মাখামাখি মেনে নিতে হয় মুখ বুজে।

ঘোড়াটা নিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়ায় জয়নুল। ঘোড়া মাথা ঝাঁকায়। খাবার চায়। দিছি বাপ, জয়নুল বলে।

ছানিভুষি মেখে দেয়। বালতিতে করে পানি আনে। হাসিনার মাথায় ঘোমটা টেনে বের হয় ছইয়ের ভেতর থেকে। বেলা পড়ে আসছে। রোজা রাখলে দিনের শেষবেলায় মুখে সাড় থাকে না। খিদে বোধটাই চলে যায়। শরীর তখন আপন নিয়মে চলে, চলতে থাকে। হাসিনা ছইয়ের ভেতরটা ঝাড়াঝাড়ি করে পরিষ্কার করে। এটাই এখন ঘর। এটাই এখন তার বাড়ি। ঘর, বারান্দা, উঠোন বলতে ঘোড়ার গাড়িটি। এখানেই দুখানা শাড়ি-ব্লাউজ, কাঁথা-বালিশ। একটা তোলা চুলা। হাঁড়ি কড়াই। সংগ্রহ করা আনাজ। আবার এর মাঝেই কোন দিন রাতের বেলা জয়নুল উঠে আসে হাসিনার উপর।

হাসিনার মাঝে মাঝে মনে হয় পালিয়ে যায়। এই ঘোড়ার গাড়ির ছইয়ের জীবনে দমবন্ধ লাগে। কিন্তু কোথায় যে পালাবে, সেই দিশা পায় না হাসিনা। লোকটা আগের মতো আর চেঁচামেচি করে না, মারধর করে না।

যখন হাসপাতালে পড়েছিল, তখন থেকেই তেজ নেই! তেজ দেখালে হাসিনা কবে চলে যেত, কিন্তু এখন পারে না। সাদেকুল ছিল বলে সে যাত্রা বেঁচেছে তারা। রোজগার নেই, তারপর আবার প্রতিদিনের হাসপাতালের খরচ। সাদেকুলদের সঙ্গে পরিচয় কাজ করতে এসেই। বাইরে কাজ করতে না এলে হাসিনা জানতে পারত না কতরকমের দেশ আছে। সাদেকুল হাসিনাকে তাদের দেশের গল্প করত। তাদের গাঁয়ের পাশে পাহাড়। ন্যাড়া পাহাড়, পাহাড়ের পর বন। বনে পলাশগাছে ফুল ধরলে মনে হত, এ যেন অন্য কোনও দেশ। সেই বনে গরু চরাতে যেত সে। চাষাবাদ নেই। গরু চরিয়ে দিন চলে। ভালই চলে। কিন্তু মানুষ বললে কতদিন আর এইভাবে, ইনকাম করতে হবে। হাসিনার এইসব গল্প শুনতে ভাল লাগত খুব। গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেন ভেসে যেত। আর ফিরতে ইচ্ছে করত না। পলাশফুল দেখেনি সে, কিন্তু সাদেকুলের বলা গল্প শুনে চোখের সামনে লাল পলাশফুলের সমুদ্র তৈরি হত। লাল ঢেউ আছড়ে পড়ত তার উপর। লাল আর লাল। হাসিনা ডুবে মরত সেই লালে।

সাদেকুলের সংসার নেই। বৌ ছিল, মরে গেছে। মেয়েটা দাদির কাছে মানুষ হয়। সাদেকুল মেয়েটার জন্য টাকা পাঠায়। সাদেকুলকে হাসিনা জিজ্ঞেস করেছিল, আর বিয়ে করেনি কেনে? সাদেকুল বলেছিল, বৌয়ের মতো আর মুনে লাগে না কুনো বিটিছেলাকে। সাদেকুলকে দেখে অবাক হয়েছিল হাসিনা, ব্যাটাছেলে মানুষও এমন হয়!

জয়নুল ভাল হয়ে গেলে সাদেকুল বলল, তোমরা তোমাদের দ্যাশে ফিরে যাও। এখানে আমাদের কেউ নেই। পাখির মতন আমাদের বাসা। আজ এই বাড়ির গ্যারাজে, কাল অন্য বাড়ির গ্যারাজে।

পাখির মতো জীবন, কিন্তু পাখির মতো মুক্ত না।

বাড়ি ফিরে ক-মাস শুধু বসে থাকা। হাতে যে কটা টাকা তাও ফুরিয়ে আসে। মোবাইল কেনার জন্য যে কটা টাকা গোপনে নিয়েছিল সাদেকুলের কাছে থেকে, সেও পেটে চলে গেল। একটা মোবাইলের বড় শখ হাসিনার, সবাই কী সুন্দর গান শোনে, ভিডিও দেখে। কিন্তু পেটের দায়ে শখের কবর হয়। এক পায়ে কী কাজ করবে জয়নুল! হাসিনা জয়নুলকে ফেলে কার বাড়ি কাজে যাবে? একদিন জয়নুল বলল, চলো ভিন গাঁয়ে ভিক্ষা করি। ভিক্ষার রাস্তা শুনে তেড়িবেড়ি করেনি হাসিনা। আর কী বা করতে পারবে তারা। একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ল তারা। পেটের ধান্দায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পেটটুকু না থাকলে কতই ভাল হত। ভাতের লেগে জীবন জেরবার হত না। জয়নুলের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি করে ভিক্ষার রাস্তা বাছতে হত না। জয়নুলের লেগে মায়া হয়।

—পটাশপুর আর কতক্ষণ?

জয়নুল কাউকে জিজ্ঞেস করছে। ঘোড়াটা ভুষি খাওয়া শেষ করেছে। একটুখানি ফাঁকা জমিন পেয়ে ঘাস খাচ্ছে। সবুজ ঘাস কোথায়! ধুলোর উপর যেটুকু ফ্যাকাসে আগাছা আছে তাই খাওয়ার চেষ্টা করছে। রোদের তেজ কমেছে অনেকটা। সন্ধ্যা হওয়ার সময় আসছে। পটাশপুর তাড়াতাড়ি না পৌঁছাতে পারলে ইফতারের সময় হয়ে যাবে। পেটে খিদে নিয়ে এতটা পথ তারা এসেছে।

পটাশপুরের রাস্তা খোঁজে দুজন, একজন পুরুষ একজন নারী। রাস্তা চলেছে মাঠের পেট চিরে। অন্ধকার নেমে আসছে। দূরে মাইকের শব্দ আসছে। মিলাদের সুর। জয়নুল চাবুক লাগায় ঘোড়াটাকে। ঘোড়াটা দৌড় লাগায়, গাড়ির ঝাঁকুনি সামাল দেয় হাসিনা। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে।

কত জনম ধরে তারা যে দৌড়ে যাচ্ছে তার হিসেব কে রাখে!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...