করোনা কুয়াশার আড়ালে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে ভারতে

শঙ্কর সান্যাল

 




লেখক অর্থনীতির ছাত্র। পেশায় সাংবাদিক

 

 

করোনা দুর্বিপাকজাত লকডাউনে আমার চারপাশটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক চেনামুখ। বন্ধ হয়ে যাওয়া রেমিংটন কারখানার শ্রমিক ওসমানভাই পুরনো খবরের কাগজ আর ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনাবেচা করতেন কাঁধে ঝোলা নিয়ে। একদম দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। লকডাউনের পর থেকে ওসমানভায়ের দেখা নেই। কেমন আছে সেই চারজনের পরিবার? সাইকেলভ্যানের ওপরে উনুন বসিয়ে চাটুতে খুন্তির ঠকঠক শব্দ তুলে ইডলি-ধোসা বেচতে পাড়ায় আসতেন বেঙ্কট। তাঁরও দেখা নেই। কোথায় গেলেন পিঠে তুলোর বোঝা আর ধুনুরিতে ব্যাং ব্যাং শব্দ তুলে ফেরি করতে আসা গফুর মিঞা? কী খাচ্ছেন এঁরা? কেমন আছে কাচের বাক্সে চুড়ি, টিপের পাতা, সেফটিপিন ফিরি করতে আসা সহদেব?

করোনার কালো মেঘ প্রাকৃতিকভাবেই একদিন সরে যাবে। কিন্তু এই মেঘের কুণ্ডলীর আড়ালে ক্রমশই অতিকায় হয়ে উঠছে আর এক দৈত্য। তার নাম খিদে। খিদে বাড়ছে, গোটা ভারতজুড়ে। ক্রমে অতিকায় হয়ে উঠছে। খবর আসছে, মালদার হরিশচন্দ্রপুরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কচুপাতা সিদ্ধ করে খাওয়ার। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে উত্তর প্রদেশের হতভাগ্য মায়ের পাঁচ সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার খবর। পরিযায়ী শ্রমিকরা এখনও পথে। টিভিতে যখন করোনার স্কোরবোর্ড দেখে আঁতকে উঠতে উঠতে লকডাউনে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ করছে এক ভারত, তখন ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হেঁটে চলেছে অন্য এক ভারত। অভুক্ত, কপর্দকহীন। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়ছে, আর উঠছে না। পরিযায়ী শ্রমিক কতজন কেবল অভুক্ত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে একদম নিশ্চল হয়ে গিয়েছেন? না, সঠিক হিসাবটা কারও কাছেই নেই। হরিয়ানার হিসার থেকে ফোন করেছিলেন সাংবাদিক বান্ধবী জগদীপ কাউর। তথ্য দিলেন যা, তা ভিরমি খাওয়ার জন্য যথেষ্ট। বললেন, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ থেকে শুরু করে গোটা হরিয়ানা আর পাঞ্জাবের মাইলের পর মাইল জমিতে পড়ে আছে গম। পাকা গম ঝরে পড়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। কাটার লোক নেই। রবিশস্য, ডাল এবং তৈলবীজ মিশে যাচ্ছে মাটিতে। অর্থাৎ আগামী মরশুমে গোটা ভারতের ডাল-রুটির জোগাড় আর রইল না। রাজ্যের বাইরে পাঠানোর উপায় নেই। বাংলার জমিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গরমের সবজি। অভাবী বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন চাষি। উৎপাদনের খরচই উঠছে না, লাভ তো দূর অস্ত্। ফড়েদের পোয়া বারো। মাজা ভেঙে যাচ্ছে চাষির। যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই সঙ্কটজনক হয়ে উঠছে।

বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার বলয়ের মধ্যে ভারতের ঢুকে পড়াটা ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। ২০১৬ সাল থেকেই অভূতপূর্ব আর্থিক মন্দার শিকার হতে শুরু করে ভারতীয় অর্থনীতি। গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো নোটবন্দি এবং জিএসটির সুদূরপ্রসারী প্রভাবে বিপর্যয়ের বেগ দ্রুততর হয়। বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা এবং ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের সমীক্ষা জানাচ্ছে কেবল নোটবন্দির ফলেই ভারতে কর্মহীন হয়ে যান ৫০ লক্ষ মানুষ। ২০১৮ সালে দেশে বেকারত্বের হার গিয়ে দাঁড়ায় গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। সাধারণ মানুষের হতে টাকা না থাকায় অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে। ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়ায় ৫.৬ শতাংশে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই সময়কালের মধ্যে মাথাপিছু ভোগব্যয় কমেছে তিন শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও কেনার ক্ষমতা হারিয়েছে ভারতীয়রা।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই হাতে চলে আসে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ২০১৯ সালের রিপোর্টটি। বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ নম্বরে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালেও ভারত ছিল ৯৫ নম্বরে। ক্ষুধা, চূড়ান্ত অপুষ্টি উদ্বেগের শেষতম গণ্ডিও ছাড়িয়ে গিয়েছে। ওই রিপোর্টে ভারতের ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল এবং এমনকি পাকিস্তানও। ভারতের নিচে রয়েছে নাইজার, ইয়েমেন, জিবুতি, বুরকিনা ফাসো, চাদ, মালি ইত্যাদি। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২০১৯ সালে জানিয়েছিল, ২০১৯-২০ সালের ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে ৪.৮ শতাংশে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে প্রথম ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১.৯৭ শতাংশে।

পরিস্থিতি যে চূড়ান্ত উদ্বেগের তা কিছুটা হলেও মেনে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। লকডাউনের পরেই ছোট এবং মাঝারি বাণিজ্যিক ও শিল্পসংস্থাগুলি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই লকডাউনের মধ্যেই দেউলিয়া আইন সংশোধনের চেষ্টা চালাচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেউলিয়া হতে বসা সংস্থাকে আরও ছ মাস সময় দেওয়া হবে। কিন্তু ছ মাসের মধ্যে দেউলিয়া হতে বসা সংস্থাগুলি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? কোনও তত্ত্বই এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতিকে যেরকম দ্রুতহারে মন্দা গ্রাস করছে, তাতে ভারতে কোনও ছোট এবং মাঝারি সংস্থা বাঁচতে পারবে না। বড় সংস্থাগুলি হয়তো টিকে যাবে। ফলে একদিকে আবার নতুন করে স্ফীত হতে থাকবে বেকার বাহিনী এবং অন্যদিকে যাবতীয় সম্পদ আবার নতুন করে কুক্ষিগত হবে স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে। এই চক্রে পড়ে ভোগব্যয় বিপুল পরিমাণে হ্রাস পেতে বাধ্য। ফলে বাজার আরও সঙ্কুচিত হবে। তার প্রভাব পড়বে উৎপাদনেও। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এখন আইএমএফ-এর উপদেষ্টা। লকডাউনের মধ্যেই একটি বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, লকডাউন পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতের ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারাবেন। একটি দেশের যদি ১০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যা কর্মহীন হয়ে যায় তাহলে সরকারের হাতে থাকে আক্ষরিক অর্থেই একটি শিসভাঙা পেন্সিল। আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক ক্ষুধার্ত জনতা। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদি সরকার পরিকাঠামো উন্নয়ন ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যয় হ্রাস করতে চাইছে। দেশের নির্মাণ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের। ভারতে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪৭ কোটি। এদের বেশিরভাগটাই নির্মাণ এবং কৃষি শ্রমিক। শ্রম আইনের যাবতীয় সামাজিক সুরক্ষা থেকে এঁরা বঞ্চিত। শেষ পর্যন্ত দৈনিক মজুরি আয়ের জন্য গতর খাটানোর সুযোগটাও যদি না জোটে তাহলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য।

এই বিপুল ক্ষুধা কি করে সামাল দেবে ভারত রাষ্ট্র? না, যে পথে কেন্দ্রীয় অর্থনীতি হাঁটছে, তাতে এই বিপুল ক্ষুধা সামাল দেওয়ার কোনও রাস্তা নেই। ভারতের বুকে আর একটি ৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল হয়ে উঠছে। চিত্তপ্রসাদ সাউ কিংবা জয়নুল আবেদিনের পেন্সিল স্কেচে মূর্ত হয়ে থাকা ক্ষুধার্ত ভারতের সেই ছবি বাস্তবেই হয়তো দেখতে পাবে এই প্রজন্ম।

এই বিপুল ক্ষুধাকে সামাল দেওয়ার যে একমাত্র অস্ত্র সরকারের হাতে রয়েছে, সেটা দেশের গণবণ্টন ব্যবস্থা। নীতি আয়োগের যে সাম্প্রতিক রিপোর্ট তাতে ভারতের গণবণ্টন ব্যবস্থাটির চেহারা অনেকটা হরিপদ কেরানির জরিমানা দেওয়া ছাতার মতো, অসংখ্য ছিদ্র তাতে। নীতি আয়োগের রিপোর্ট কী বলছে? ভারতে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ রয়েছে মোট জনসংখ্যার ২৫.৭ শতাংশ। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সংখ্যাটা ৩৩ কোটি ৪১ লক্ষের কাছাকাছি। এই দারিদ্রসীমার মাপকাঠিটা কী? রাষ্ট্রসঙ্ঘ ভারতের জন্য মাপকাঠিটা নির্ধারণ করেছে দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এর নিচে যাঁরা দৈনিক আয় করেন, তাঁরা দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। ভারতীয় মুদ্রায় এই অঙ্কটা কত? এদিনের হিসাব অনুযায়ী, ১ মার্কিন ডলার হল ভারতীয় মুদ্রায় ৭৬ টাকা ৪১ পয়সা। সেই হিসাবে ১৫৩ টাকা দৈনিক আয়। এই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের ৩৯.৬ শতাংশের রেশন কার্ড আছে। দারিদ্রসীমার নিচে থাকা ৬০.৪ শতাংশের কোনও কার্ডই নেই। আর দারিদ্রসীমার ওপরে থাকা ২৬.৩ শতাংশ মানুষের রেশন কার্ড রয়েছে। অর্থনীতি যদি টালমাটাল হয়, তাহলে সবচেয়ে আগে আক্রান্ত হয় নিচুতলায় থাকা মানুষ। ভারতে এই মুহূর্তে রয়েছে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার ফেয়ার প্রাইস শপ বা সোজা কথায় রেশন দোকান।

কেবলমাত্র এই সংখ্যক রেশন দোকানের মাধ্যমে কি আদৌ ভারতের সমস্ত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব? না, কোনও অঙ্কেই এটা সম্ভব নয়। তাহলে খোদ নীতি আয়োগের ২০১৯ সালের রিপোর্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, প্রথমত দারিদ্রসীমার নিচে থাকা সিংহভাগ মানুষই বিপিএল তালিকায় নেই। দ্বিতীয়ত যাঁরা ওই তালিকায় রয়েছেন, তাঁদের কাছেও খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামো নিতান্তই অপ্রতুল। তৃতীয়ত যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তা হল, গণবণ্টন ব্যবস্থায় নিয়ে আসার মতো খাদ্যশস্য কি আদৌ সরকারের গুদামে আছে? উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ২৬ শতাংশের মতো নূন্যতম সহায়ক মূল্য দিয়ে সরকার সংগ্রহ করে থাকে। বাকিটা যায় খোলাবাজারে এবং রফতানিতে। লকডাউনের কারণে চলতি রবি মরশুমে রবিশস্যের উৎপাদন মার খাবে ভয়ঙ্করভাবে। পাশাপাশি বোরো চাষেও লকডাউনের সময়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রসঙ্গত ধানচাষের ক্ষেত্রে বোরো মরশুমেই উৎপাদন হয় সর্বাধিক। স্বাভাবিক কারণেই সরকারি সংগ্রহও মার খাবে ব্যাপকভাবেই। দ্বিতীয় উপায় আমদানি। কিন্তু করোনা দুর্বিপাকে ইওরোপ এবং আমেরিকার হাল ভয়াবহ। সেক্ষেত্রেও গভীর প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গিয়েছে।

বাজারে কোনও ফসলেরই দাম নেই। চাষির ঘরে উৎপাদন খরচই উঠছে না। ব্যাঙ্কর ঋণ শোধ করার অবস্থাও থাকবে না চাষির। তাতে অবশ্য রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। ভারতের কৃষককুল তো অভাবের তাড়নায় গলায় দড়ি দিতে কিংবা বিষ খেতেই অভ্যস্ত!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. নিবন্ধকারের সাথে সম্পুর্ন একমত। সামনের দিন ভয়াবহ।
    মধ্যবিত্ত শব্দটি হয়ত নিম্নবিত্তের সঙ্গে মিশে যাবে।

Leave a Reply to Asit Nanda Bhattacharya Cancel reply