
অনিতা অগ্নিহোত্রী
…এবারের বইমেলা অনেকটা বদলেছে। এবং সে বদল ভালর দিকে নয়। মুক্তমঞ্চ নেই। প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইলচেয়ার প্রবেশপথ করা সম্ভব নয়, কর্তৃপক্ষ গতবারই জানিয়েছিলেন। তাঁদের জন্য একটি আলাদা পরিসর করা যেত, বই হাতের কাছে রেখে, আলাদা করে প্রবেশাধিকার দিয়ে। তাও তো হয়নি। আমরা জেনে পুলকিত যে এপিডিআর-এর ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাই তাদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতা জারি রাখার একটা জানালা অনাবশ্যক বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হল, যেখানে দেওয়ালের উপরেই আকাশ। ভিন্নমতকে ভয় করার প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর নয় আর একনায়কতন্ত্রের জন্য অতি উপাদেয়।
চল্লিশ বছর আগে হাওড়া স্টেশনে দুন এক্সপ্রেস ঢোকার ঠিক আগে মনের মধ্যে যে উদ্বেল উতরোল অবস্থা হত, দূরে চলে যাওয়া, ঘরে না ফেরার আশঙ্কার টানাপোড়েনজনিত, সোশাল মিডিয়ার কালে প্রতি বার্ষিক বইমেলার আগে তেমনই অবস্থা হয় মনের। মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে বই দেখা বই কেনার দিন শেষ। এখন মাথার উপর ঘনিয়ে এসেছে বইসম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যের হিরোশিমার মেঘ। ভয় হয়, বুক দুরুদুরু করে। কোথাও বইপড়া হারিয়ে যাবে না তো সংখ্যা আর তথ্যের বন্যায়? খুঁজে পাব ভাল পাঠকের মুখে শোনা, বিজ্ঞাপনে দেখে চোখ টানা পছন্দের গুটিকয়েক বই?
কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলাকে সারা বছরের বই বেচাকেনার মূল জায়গা বলে স্বীকার করতে আমার দ্বিধা আছে। একই কারণে দুর্গাপুজোর ছেচল্লিশ হাজার কোটির ব্যবসাকে বাংলার অর্থনীতির আর্থিক প্রাণশক্তি বলে আমি মনে করি না। সম্বৎসরের খাওয়া দশ দিনে খাইয়ে দিলে সুস্থ মানুষেরও অজীর্ণ হবে। বই প্রকাশের মরশুম যদি কেবল, বা মুখ্যত বইমেলা হয়, তাতে নড়বড়ে পরিকাঠামোর উপর যে চাপ পড়ে তাতে বইশিল্পের নাভিশ্বাস ওঠে, ভাল বই তৈরির জন্য যে সময় আর অভিনিবেশ দরকার, তার জায়গা থাকে না। তবু আমি বইমেলায় আসি নতুন বই, নতুন লেখকের খোঁজে, হারিয়ে যাওয়া বইও খুঁজি। বাংলা বই-আলোচনার কাগজ করি বলে একটা চোখ সবসময় বইয়ের খোঁজে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর বইমেলায় আমি কেবল খবর নিই। বই কিনি না। আমার বই পাওয়া, কেনা, বিনিময় চলে সারা বছর ধরে।
বাতাসে পাওয়া, কাগজে ছাপা বইয়ের খবরের মধ্যে কয়েকটিতে মথের মতো মন গিয়ে বসে প্রতিবার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমি কেবল নিজের বাসনা ব্যক্ত করব, কোনও মনোনয়ন আমার সাধ্যাতীত।
গত ২৩শে শ্রাবণ থেকে প্রতিবাদ, ক্ষোভ, দুর্নীতির চক্র ভাঙার নিরন্তর আন্দোলনে মন ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। তার উপর আহত রক্তাক্ত গাজা ও তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘৃণ্য দরকষাকষি। বইয়ের কাছে নিজের হারানো কণ্ঠস্বর খুঁজতে যেতে হয়। গত বছরেরই, তবে এখনও তাজা কণিষ্ক ভট্টাচার্যের সম্পাদনা ও অনুবাদে তরুণ ফিলাস্তিনের কবিদের কবিতা। অলিভের রক্ত, আক্রান্ত ফিলাস্তিন আজকের কবিতা। প্রকাশক হাওয়াজান, অবশিষ্ট কিছু কপি আছে সৃষ্টিসুখে, পরিবেশক প্রতিক্ষণ।
‘গলায় ব্যান্ডেজ গজে ভাঙাবাড়ির দরজার চাবি অভিজ্ঞানের মতো ঝুলিয়ে, ভাঙা পাথরের পাশ দিয়ে, ছিন্ন জলপাইগাছের ডাল বাঁচিয়ে, মৃত সন্তানের দেহ দু-হাতে বহন করে হেঁটে যাওয়া পিতার মাথায় বোনা হয়ে চলেছে যে কবিতা, তাতে ত্রাস আছে, ঘৃণা আছে, তবু আছে অপেক্ষা—’ আর্ট অফ রেজিস্টেন্সের প্রসঙ্গে লিখছেন কণিষ্ক। তিন মাস ধরে ফোনে কথালাপে অনুবাদ চলেছে আর মনের মধ্যে আশঙ্কা জেগেছে, যে তরুণ কবির কবিতা তর্জমা হচ্ছে বাংলায়, তিনি থাকবেন তো? এ-বইটি পুনর্মুদ্রণ হওয়া খুব দরকার ছিল এবার।
তবুও প্রয়াস প্রকাশ করেছেন পিকে পারাক্কাদাভুর নির্বাচিত মলয়ালম অণুগল্প, তৃষ্ণা বসাক-কৃত ভাষান্তরে। গল্পগুলিতে আছে নৈঃশব্দের বিস্ফোরণ। অনন্ত জীবনের সম্ভাবনাময় বীজ আছে পারাক্কাদাভুর লেখায়। সাবলীল অনুবাদে নির্বাচিত গল্পগুলি বাঙালি পাঠকের কাছে খুলে দেবে তির্যক ব্যঙ্গ, নির্জনতা, ঈশ্বর, প্রকৃতি, ভালবাসা আর মৃত্যুচেতনার অনাস্বাদিত জগৎ।
কদাচিৎ ভাল বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়, কোথাও দু-দণ্ড বসতে পারি না বলে, কিন্তু আব্দুল কাফির সেই অবিস্মরণীয় ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতা’টি কাছে বসে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেটিই এবার উল্লেখপঞ্জি ও টীকা-সহ প্রকাশ করেছে মার্কসবাদী পথ। ‘মৃত্যুকে ডাক জীবনপানে। ধূমকেতু রক্তকরবী লাঙল’ এই বইটি প্রবলভাবে সংগ্রহযোগ্য।
দশম খণ্ড প্রকাশিত হল শুদ্ধস্বত্ব ঘোষের মহাভারতের। সমগ্র মহাভারতের বিনির্মাণ ও নির্মাণ নিয়ে এই পর্যায়ের কাজ আর বাংলায় নেই। সাধারণ পাঠকের ঔৎসুক্যকে আড়াল করে রাখে গুণীজনের নীরবতা। দীর্ঘপাঠের অভিনিবেশের অভাব ছাড়া আর কী কারণ আছে? মহাভারতের কয়েকটি খণ্ড পাঠ আরম্ভ করা যাক।
স্মৃতির আখ্যান টানে যদি তার গভীরে থাকে লেখকের নিজস্ব দর্শন। বিষাণ বসুর টুকরো স্মৃতি ছেঁড়া শোক, অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামীর এক যে ছিল গ্রাম, বিশ্বেশ্বরী পঞ্চাধ্যায়ীর মা মেয়ের ঘর, সুযোগ হলে এখন নেব কিংবা কিছু পরে, কিন্তু পড়ব অবশ্যই এ-বছর। কেবল ইনস্টিঙ্কট থেকে উপন্যাস বাছতে হলে বলব ভগীরথ মিশ্রর পালা পুরাণ, অমিত কুমার বিশ্বাসের ঙ বৃত্তান্ত, পরিমল ভট্টাচার্যর সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণ্ডগ্রামের গল্পের পাশে রাখব অর্পিতা কুণ্ডুর কবিতার বই পুড়েছে নাম ময়ূর আহরণে। কলকাতার রুদ্ধ বাতাস থেকে দূরে পুরুলিয়া মেদিনীপুরে রাতপ্রদীপ জ্বেলে কাজ করে চলেছেন ভাবুক মেধাবী মানুষজন।
কেউ কেউ বলেন বইমেলায় বই কিনব না। ছাড় মাত্র দশ। বইয়ে সারা বছর যে মহাছাড় আর বিকট ছাড় চলে আমি তার ঘোর বিরোধী। মেধা শ্রম চিন্তার এক অমূল্য জিনিসের অবমূল্যায়ন মনে হয়। বই বেশি কিনবেন কেন, বেছে কিনুন। জনসংখ্যায় তো আমরা কয়েক কোটি, তার মধ্যে দশমিকের পর শূন্য শূন্য শূন্য শতাংশ পাঠক। আমরা কেরালা নই। সাক্ষরকে পাঠকে বিবর্তিত করা আমাদের খুব পরিশ্রমের কাজ মনে হয়। একই সঙ্গে সবকিছু বিনা পয়সায় চরম সস্তায় নেওয়ার স্বভাব তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে জেনেবুঝেই। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়বে না, কারণ তাতে ভোটের অঙ্কে গোলমাল হবে। কাজেই আমরা সারা বছর অটো আর টোটোর মাস্তানি সইব। বইমেলার প্রবেশমূল্য মাফ করে কার কী লাভ হল? আবার সেই ভিক্ষেদাতা সরকার। পাঠক বা ক্রেতা তো ভিক্ষুক নয়, তার একটা যোগদান তো থাকা দরকার ছিল। বরং প্রবেশমূল্য জারি করে গিল্ডকে বলা যেত ছোট প্রকাশক ও লিটল ম্যাগাজিনদের পরিকাঠামো খরচ কমাতে। তাতে তাদের মেরুদণ্ডের জোর বাড়ত।
এবারের বইমেলা অনেকটা বদলেছে। এবং সে বদল ভালর দিকে নয়। মুক্তমঞ্চ নেই। প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইলচেয়ার প্রবেশপথ করা সম্ভব নয়, কর্তৃপক্ষ গতবারই জানিয়েছিলেন। তাঁদের জন্য একটি আলাদা পরিসর করা যেত, বই হাতের কাছে রেখে, আলাদা করে প্রবেশাধিকার দিয়ে। তাও তো হয়নি। আমরা জেনে পুলকিত যে এপিডিআর-এর ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাই তাদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতা জারি রাখার একটা জানালা অনাবশ্যক বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হল, যেখানে দেওয়ালের উপরেই আকাশ। ভিন্নমতকে ভয় করার প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর নয় আর একনায়কতন্ত্রের জন্য অতি উপাদেয়।