ক্লাসিক পুরনো হয় না, কিন্তু তার অনুবাদ সময়ের সঙ্গে মরচে ধরে যায়

পরিমল ভট্টাচার্য

 

 

…কাঁচা বয়সে পড়া ক্লাসিক সাহিত্য দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পাঠে শুধু সেটা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোয় নতুন করে দীপ্যমান হয়ে ওঠে তাই নয়, তার মধ্যে কখনও কখনও নিজের সেই পুরনো আমিটার ছায়াও খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা বিশেষ প্রাপ্তি। এরকম ক্লাসিক আমি অনুবাদে ফিরে পড়ি…

 

কলেজে পড়ার সময়ে না জেনেবুঝে ফ্রান্সিস বেকনের একটি উক্তি অনেকের মতো আমিও মুখস্থ করেছি— Some books are to be tasted, others to be swallowed, and some few to be chewed and digested. উক্তিটি মুখস্থ করেছি, অনুসরণ বা অনুধাবন করেছি কি? বলা বাহুল্য, সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রাক-মুঠোফোন যুগে সবকিছুই গোগ্রাসে পড়তাম, পাঠ্যবই ছাড়া। সেকালে আমাদের পাঠরুচি ছিল দামোদর শেঠের রসনার মতো, হাতে সময়ও ছিল ষষ্ঠীচরণের উদরের মতো। সেকাল গিয়াছে। বর্তমানে হাতে সময় এবং বই নিয়ে আগ্রহ শরৎচন্দ্রের সেই একাদশী বৈরাগীর মতো— ক্ষীণতনু, শীর্ণকায়, ক্ষুধামান্দ্যে দীর্ণ। এখন সারা বছরে অসংখ্য বই কেবল taste করি। বয়স বাড়ায় অভিজ্ঞতার সুবাদে একটি বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে taste করার তরিকা অনেকের মতোই আমারও রপ্ত হয়েছে, এ-ব্যাপারে প্রযুক্তিও অনুকূল (যেমন Kindle-এ বইয়ের Free sample)। তার মধ্যে কিছু কিছু বই swallow করি। সেসব মূলত তথ্যভিত্তিক বই, লেখার প্রয়োজনে যেগুলো পড়তে হয়। কখনও পড়ানোর প্রয়োজনেও পড়তে হয়।

তার বাইরে রইল তৃতীয় গোত্রের বই, যেগুলো to be chewed and digested. স্বাভাবিকভাবেই, বেকন সাহেবের নির্দেশ মেনে সেটা some few. যত বয়স বাড়ছে, হাতে সময় যত কমছে, ততই few, fewer, fewest. এ-ব্যাপারে রসনা রুচিও ক্রমশ দামোদর শেঠের থেকেও শৌখিন, শৌখিনতর… চিনেবাজারের কাঁকড়ার ডিম, বোয়ালের পেট, ঝরিয়ার জিলিপি তো চাইই, সেইসঙ্গে দার্জিলিং সেকেন্ড ফ্লাশ, ইথিওপিয়ান কফি, নতুবা সিঙ্গল মল্ট না হলে গলা দিয়ে নামে না। অগত্যা…

কিন্তু রোজ রোজ এসব আর কোথায়ই বা মেলে। তাছাড়া বোয়ালের পেট বলে বাসার ফিলেও তো বাজারে কম চলে না আজকাল। ফলে আমি বেশ কিছুকাল বেকন সাহেবের উক্তির সঙ্গে গরুর পাকস্থলির মেলবন্ধন ঘটিয়েছি। এবং গরু যেভাবে সামনের পাকস্থলি থেকে অর্ধভুক্ত খাদ্য মুখে তুলে জাবর কাটে, সেভাবেই আগে-পড়া ক্লাসিক বই ফিরে পড়ি।

কাঁচা বয়সে পড়া ক্লাসিক সাহিত্য দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পাঠে শুধু সেটা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোয় নতুন করে দীপ্যমান হয়ে ওঠে তাই নয়, তার মধ্যে কখনও কখনও নিজের সেই পুরনো আমিটার ছায়াও খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা বিশেষ প্রাপ্তি। এরকম ক্লাসিক আমি অনুবাদে ফিরে পড়ি।

ক্লাসিক পুরনো হয় না, কিন্তু তার অনুবাদ সময়ের সঙ্গে মরচে ধরে যায়। সেজন্য ক্লাসিক সাহিত্যগ্রন্থ বারে বারে অনুবাদ হয়ে চলে। ফ্লোব্যেরের মাদাম বোভারি উপন্যাস বিগত দেড় শতাধিক বছর বোধহয় ১৯-২০ বার ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। এই নিয়ে ঔপন্যাসিক Julian Barnes-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও আছে। মার্সেল প্রুস্তের বিখ্যাত ‘হারানো সময়ের সন্ধানে’ বহুকাল Scott Moncrieff-এর অনুবাদে ইংরেজি দুনিয়ায় পরিচিত ছিল। কিছুকাল আগে সেই মহাগ্রন্থের ছটি খণ্ড ছজন অনুবাদকের হাতে অনুবাদ হয়েছে। প্রথম খণ্ড, Swann-এর পথ অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক Lydia Davis (তিনি সম্প্রতি মাদাম বোভারিও অনুবাদ করেছেন)। দুটি অনুবাদ পাশাপাশি রেখে পড়লে টের পাওয়া যায় Moncrieff সাহেব কতখানি খোদা প্রুস্তের ওপর খোদকারি করেছেন। একই দুর্ভাগ্য কাফকার ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো আগে Margaret Sayers Peden-এর অনুবাদে পড়েছি, গত বছর পড়লাম Douglas Weatherford-এর অনুবাদে। সঙ্গে উপরি পাওনা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ভূমিকা। সেই সঙ্গে নেটফ্লিক্সে নতুন পেদ্রো পারামো ছবি আসায় এক্কেবারে জমে ক্ষীর!

এই বছর পড়তে শুরু করেছি দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, Michael R Katz-এর নতুন অনুবাদে। এবং পড়তে গিয়ে টের পাচ্ছি প্রথম যৌবনে প্রোগ্রেস (নাকি রাদুগা?)-র ইংরেজি অনুবাদে পড়া দস্তয়েভস্কি আমায় কেন সেভাবে টানেনি। গোলমালটা ছিল অনুবাদে। এটা শেষ করে এ-বছর হয়তো ব্রাদার্স কারমাজভের নতুন অনুবাদ খুঁজব, চাখব, পছন্দ হলে চিবোব।

এছাড়া বছরের শুরুতে আমার পড়ার টেবিলে এসেছে একটি নতুন বিচিত্র বই— Iconic Trees of India, লেখক S. Natesh। সাত বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ৭৫টি বিখ্যাত প্রাচীন ইতিহাসবিজড়িত গাছেদের কথা লিখেছেন লেখক। অতীব সুমুদ্রিত এই বই হাতে নিলে মন ভরে যায়, বোঝা যায় ছাপা বই কেন থাকবে আরও বহু বহু কাল। তার একটা বড় কারণ বইটির পাতায় পাতায় অপূর্ব অলঙ্করণ, শিল্পী সাগর ভৌমিক। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সাগর ভৌমিক কলকাতাতেই থাকেন, এখানে বসে চুপচাপ বিশ্বমানের কাজ করেন। কিন্তু তাঁর কাজের হদিশ কলকাতা নামক এই কুয়োবিশ্বে ছাপাখানা জগতে বিশেষ কেউ রাখে বলে মনে হয় না।

আরেকজন তরুণ শিল্পী অর্ঘ্য মান্না। বিশ্বমানের কাজ করেন শুধু নয়, MIT, Oslo University থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রোজেক্টে কাজ করেন। এককালে এই শহরেরই একটি সংবাদ সংস্থায় ছিলেন, বর্তমানে আইআইটি গান্ধিনগরে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট। তাঁকেও কলকাতা প্রাপ্য স্বীকৃতি দেয়নি। ঘটনাচক্রে তিনি আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু। ঘাস নিয়ে আঁকা তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ছবির বই I Am the Grass: I Cover All আসছে, আর দিন কয়েকের মধ্যেই আমার টেবিল সেজে উঠবে। বছর দুই আগে আইআইটি গান্ধিনগর ক্যাম্পাসের বিস্তীর্ণ সবুজে প্রাতঃভ্রমণে অর্ঘ্যর সঙ্গী হয়ে চারপাশের প্রকৃতি কীভাবে ওঁর স্কেচখাতায় ফুটে ওঠে চাক্ষুষ করেছি। ফলে বইটি হাতে পাওয়ার অধীর অপেক্ষায় আছি।

সুন্দর ছাপা, ছবিতে ভরা বই ঘরে সাজিয়ে রাখার খুব সাধ ছিল এককালে, কিন্তু সাধ্য ছিল না। এখন কিছুটা অন্তত পারি। সামনের মাসে Mapin Publishing থেকে প্রকাশিত হচ্ছে একটি কফি টেবিল বই Textiles of Bengal। বইটির প্রিভিউ যেটুকু যা দেখা যাচ্ছে Mapin-এর ওয়েবসাইটে, তাতে মনে হচ্ছে দারুণ হবে। দামটাও দারুণ, প্রায় পঞ্চ সহস্র টঙ্কা। তবু মনে হয় লোভ সামলাতে পারব না। তার একটা কারণ, বছর খানেক ধরে একটি সুদীর্ঘ উপন্যাস লিখতে গিয়ে বাংলার তাঁত নিয়ে এরকম একটি বই আমি হাতে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।

সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা লিখতে গিয়ে গত এক বছর সত্যি বলতে নিছক ভাল-লাগার ভালবাসার পড়া আমি বিশেষ করতে পারিনি। ২০২৫-এ সেটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব। এ-বছর যে-কয়েকটি বইয়ের জন্য অপেক্ষা করব, সেই তালিকায় ওপরদিকে থাকবে মা মেরি রায়কে নিয়ে অরুন্ধতী রায়ের বই Mother Mary Comes to Me. এর আগে তাঁর Ministry of Utmost Happiness উপন্যাসে নায়িকা তিলোত্তমার মায়ের চরিত্র তিনি এঁকেছেন। খুব তীব্র, দগদগে সেই চিত্রণ। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে হয়তো এর মধ্যে লেখকের নিজের মায়ের সঙ্গে জটিল সম্পর্কের ছায়া হয়তো আছে। সেটা আছে কী না দেখব। না থাকলেও এই বইটা যে খুব তীব্র মনোযোগের দাবি নিয়ে আসবে সেটা আশা করছি।

চা আর কফি, কিংবা হুইস্কি আর ওয়াইন যেমন একসঙ্গে পান করা যায় না, তেমনই খুব ডিমান্ডিং কোনও লেখা লিখতে লিখতে খুব ডিমান্ডিং কোনও বইও পড়া যায় না। গত একবছর আমি তাই পেটের ভাত জোটানোর জন্য যেটুকু না পড়লেই নয় তার বাইরে প্রায় কোনও গুরুপাক লেখা পড়িনি। প্রচুর পডকাস্ট শুনেছি, Audible-এ বই শুনেছি (প্রুস্তের মহাগ্রন্থের একটি অসাধারণ নাট্যরূপ শুনেছি ঘন্টা পাঁচেকের), আর নটি প্রজন্ম ধরে একটি অঞ্চলের জটিল কাহিনির প্লট থেকে মাথাটাকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রেলের টাইমটেবিল আর ম্যাপ দেখে গিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা।

রেলগাড়ি, রেলের ইঞ্জিন, রেলভ্রমণের সবরকম খুঁটিনাটি নিয়ে ছেলেবেলা থেকেই আমার বিচিত্র মোহ, এই বয়সেও সেটা এতটুকু মরেনি। সেসব আমার লেখায় এসেছে— ড্যাঞ্চিনামায়, দার্জিলিং-এও। আমার এই নতুন উপন্যাসের নায়ক বাপ্পাদিত্য ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মার্টিন্স কোম্পানির ছোট রেলগাড়ি চেপে মামারবাড়ি যায়।

বার্লিন থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপ ছুঁয়ে দক্ষিণ বরাবর ট্রেনে ট্রেনে মাসাধিক কাল ধরে আটটা দেশ আর বারোটা শহর ঘুরে রোম হয়ে ফেরার এক দীর্ঘ বিচিত্র রেলভ্রমণের ছক কষেছি আমি এই পুরো লেখাটা লেখার সময়ে। ইউরোপে ট্রেনে ভ্রমণ যেহেতু তূলনামূলকভাবে খরচসাপেক্ষ, আর অন্তত মাস ছয়েক আগে টিকিট কাটলে অনেকটা সস্তা হয়, তাই লেখাটা শেষ করার জন্য নিজেই নিজেকে একটা ডেডলাইন দিয়েছিলাম। সেটা করে আসার পর রেলভ্রমণ নিয়ে ভাল ভ্রমণসাহিত্য পড়ার আগ্রহ জেগেছে আমার। আপাতত পড়ছি একটা পুরনো বই, The Great Railway Bazaar, লেখক Paul Theroux। এরপর পড়ব Around India in 80 Trains, মনীষা রাজেশের লেখা। তারপর খুঁজব বাংলায় রেলভ্রমণ নিয়ে কোথায় কী ভাল লেখা আছে যা আমি আগে পড়িনি। যদি তেমন কোনও সঙ্কলন গ্রন্থ খুঁজে পাই, বা কেউ করেন, তাহলে অবশ্যই পড়ব। আর আবার ফিরে পড়ব ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। গত এক বছরে তাঁর সাহিত্যকীর্তির কথা আমার বারে বারে মনে পড়েছে। একদিন ভোররাতে তাঁকে স্বপ্নে দেখেওছি। আমার ভাটপাড়ার বাড়ির কাছেই শ্যামনগর-রাহুতায় তাঁর বাস্তুভিটে থেকে লুঙ্গি পরে লাঠি ঠুকঠুক করে সদর দরজায় এসে ডাকছেন— ‘পরিমল, সোঁদরবনের কুমির-গেলা বেগুন খেয়েছ নাকি কখনও? ইলিশের মাথা দিয়ে কষে রাঁধলে সে যা সোয়াদ!’

ইলিশের কাঁটা দিয়ে কুমির-গেলা বেগুনের স্বাদ কেমন হবে জানি না, কিন্তু ফিরে পড়ায় ত্রৈলোক্যনাথ যে জম্পেশ হবে সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...