অচেনাকে চেনার আনন্দ খুঁজে নেব বইমেলায়

স্বাতী ভট্টাচার্য

 

…তবে শেষ অবধি বইমেলায় যে আহ্লাদ, তা প্রত্যাশা পূরণের নয়, অপ্রত্যাশিতের দেখা পাওয়ার। অচেনার আনন্দ। আরে, এই বিষয় নিয়ে এমন বই বেরিয়েছে নাকি! মনে আছে বাঙালির জীবনে মেস আর হস্টেলের স্মৃতিকথার এক সঙ্কলন দেখে চমকে গিয়েছিলাম এক বছর। বঙ্গের লুপ্তপ্রায় জীবিকা, বাঙালি মেয়ের ভ্রমণ, বাংলার গাছগাছালি, এমন নানা বিষয় নিয়ে কত উপভোগ্য সঙ্কলন, কত স্মৃতিকথা হাতে এসেছে, আর অবাক বিস্ময়ে তুলে নিয়েছি হাতে। বইমেলার মাঠ থেকে সে-সব ঠাঁই নিয়েছে বালিশের পাশে। নতুন নতুন ‘শয্যাসঙ্গী’ চাইলে বইমেলা না গিয়ে উপায় কী?

বইমেলায় এবার প্রথমেই খোঁজ করব সেই বইটার, যার প্রকাশক মেলার মাঠে স্থান পায়নি। এপিডিআর সদ্য বের করেছে ‘পশ্চিমবঙ্গের চলমান পরিবেশ আন্দোলন।’ যশোর রোড থেকে দেউচা-পাঁচামি— পাহাড়, নদী, বাতাস বাঁচানোর নানা আন্দোলনের বিবরণ নাকি ধরা হয়েছে একশো ষাট পাতার বইতে। পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদ করলে কখনও ‘মাওবাদী’ তকমা জোটে, কখনও কোভিড-আইন ভঙ্গ করার দায়ে গ্রেফতার হতে হয়। এমন কত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এখন মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত সংস্থা এপিডিআর পরিবেশ আন্দোলনের বই-সহ বইমেলার ‘গেট বাহির’ হল। কেবল সেই কারণেই বইটা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে না আনিয়ে বইমেলা থেকে কিনতে চাই। স্রেফ সেন্টিমেন্টাল ভ্যালুর জন্য নয় অবশ্যই— টুকরো টুকরো করে যে-সব খবর নানা সময়ে পড়া গিয়েছে, ছবি-সহ সে-সবের বিশদ তথ্য একত্রে পাওয়া যে খুব কাজের ব্যাপার হবে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন হিরণ মিত্র। এখন নজর রাখতে হবে, বই কোথায় পাওয়া যায়। শুনছি, এপিডিআর-এর কিছু সদস্য নাকি ভ্রাম্যমাণ বইওয়ালা হয়ে ফিরি করবেন বইটা।

প্রতিবারই বইমেলায় এমন কিছু পত্রিকা কেনা হয়, যাদের প্রকাশকরা স্টল কিংবা টেবিল নেওয়ার আবেদন জমা করার কথাও ভাবতে পারেন না। তেমনই একটা কাগজ ‘বিবাদী’, চটকল শ্রমিকদের নিজস্ব পত্রিকা। পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলোর ভিতরের ছবি ঠিক কেমন, খবরের কাগজে মালিক সংগঠন কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিবৃতি পড়ে তার আধ শতাংশও বোঝা যায় না। নফরচাঁদ, অ্যাঙ্গাস চটকলে শ্রমিকদের আন্দোলনের জেরে মালিকদের দশা, শ্রমিকদের অবস্থা, চিনা তাঁত চালাতে গিয়ে শ্রমিকদের গলদঘর্ম দশা, এ-সবের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি পেতে হলে কর্তাব্যক্তিদের কাঁধের মস্ত ঝোলা থেকে পাতলা পত্রিকাখানা সংগ্রহ করতে হবে। মনে পড়ে, একবার পত্রিকা-আয়োজিত সভায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম, শ্রীরামপুরে। সেখানে অতিথি সৎকারের জন্য ছিল জলের জগ, আর পলিথিনের প্যাকেটভর্তি বাতাসা। এমন মানুষজন না হলে এমন পত্রিকা হয় না। আর একটা পত্রিকা প্রতিবার সংগ্রহ করি বইমেলা থেকে— নাগরিক মঞ্চের স্টল থেকে ‘মানুষী কথা’, সঙ্গে এক-দুটো রিপোর্ট বা বই। এবারে সেখান থেকে কিনতে হবে নাগরিক মঞ্চের প্রাণপুরুষ নব দত্তের ‘শ্রমের কথা, শ্রমিকের অধিকার’। সদ্য বেরিয়েছে। এ-বিষয়টা তাঁর মতো আর কে জানে?

শ্রমিকদের জীবনের যে-দিকটা সবে লেখালেখির আলোতে আসছে, তা হল তাদের প্রবাসজীবন। দুটো বাড়তি রোজগারের আশায় এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশযাত্রা, প্রাণান্তকর পরিশ্রম, অমানবিক পরিবেশে বাস, এবং প্রায়ই প্রতারিত, ঋণগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফেরা, এমনকি নিখোঁজ বা মৃত্যু, এ-সবই নিতান্ত সাধারণ ঘটনা। গত বছর গুরুচণ্ডালী প্রকাশনা বার করেছিল মুহাম্মদ সাদেকুজ্জামান শরীফের বই, ‘বাঙালির রোমানিয়া গমন’। বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে কাজ করতে-যাওয়া এক শ্রমিকের সরস, করুণ স্মৃতিকথন। এ-বছর সেই প্রকাশনা থেকেই বেরোল মঞ্জীরা সাহার ‘লেবারের বিদেশযাত্রা’। মঞ্জীরা এর আগে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের ভিনরাজ্যে যাত্রার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন। অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি গিয়ে, তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, তাঁদের জীবনযাত্রা ও জীবিকা নিয়ে মঞ্জীরার ধারাবাহিকভাবে লিখছেন। ইরানের চাবাহার কিংবা দুবাই গিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের কী হাল হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তিনি তুলে ধরেছেন। অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যের বহু রসদ মিলবে এ-সব বয়ান থেকে।

আর যে-সব বইয়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছি, তার মধ্যে রয়েছে পরিমল ভট্টাচার্যের ‘সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা’ (অবভাস)। বৃহৎ এই উপন্যাসের দু-একটা টুকরো ইতিমধ্যে বেরিয়েছে সাময়িক পত্রিকায়, সেগুলো পড়ে থেকে সম্পূর্ণ উপন্যাসটা পড়ার জন্য মনটা উন্মুখ হয়ে আছে। সময়-পলির স্তরে স্তরে লেখক দেখাচ্ছেন এক প্রাচীন জনপদ আর সাত প্রজন্মের মানুষের বিচিত্র ইতিহাস। পরিমল ভট্টাচার্যের গদ্য জাদুময়, কাহিনিও এগোয় তরতর করে। বহুদিন পরে একটি বৃহৎ আকারের উপন্যাস পড়ার জন্য এমন আগ্রহ অনুভব করছি।

পড়ব, পড়ব করে পড়া হয়নি অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘লবণাক্ত’ (দে’জ) উপন্যাসটিও। কচ্ছের রণের লবণ তৈরি করেন যাঁরা, তাঁদের কঠিন জীবনযাত্রা নানা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল মহাত্মা গান্ধির ডান্ডি পদযাত্রার নব্বই বছর পূর্তিতে। এর আগে মহারাষ্ট্রের আখের ক্ষেতে কাজ করা মেয়েদের জীবন নিয়ে অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘কাস্তে’ উপন্যাসটি পড়ে বিশদে জানা গিয়েছিল, মরাঠাওয়াড়ার চিনি সমবায়ের নেতা-চাষিরা আখ-কাটা শ্রমিককে কীভাবে দাস-শ্রমিকে পরিণত করছে। কেমন করে ব্যাঙ্ক তুলোচাষিকে ঋণশোধের সুযোগ না দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে দড়ির ফাঁসের দিকে। এ-সব অজানা জীবনযাত্রা জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কলমে। লবণাক্ত না পড়লে কচ্ছ এলাকা তেমনই ছায়াচ্ছন্ন থেকে যাবে। এ বার বইমেলায় কিনতে হবে।

প্রতিবারই ‘কোরক’ কোনও একজন ব্যক্তি বা একটি বিষয় নিয়ে সংখ্যা তৈরি করে। গত বছর প্রচ্ছদে ছিলেন দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এ-বছরের সংখ্যা বাংলার উদ্যোগপতিদের নিয়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো পরিচিত নামের পাশাপাশি দ্বারকিন হারমোনিয়ম, র‌্যালে সাইকেলের মালিক, হোসিয়ারি বা সার্কাস ব্যবসায়ে নিরত বাঙালিরাও রয়েছেন। এমন সঙ্কলন ছাড়া যায় না।

তবে শেষ অবধি বইমেলায় যে আহ্লাদ, তা প্রত্যাশা পূরণের নয়, অপ্রত্যাশিতের দেখা পাওয়ার। অচেনার আনন্দ। আরে, এই বিষয় নিয়ে এমন বই বেরিয়েছে নাকি! মনে আছে বাঙালির জীবনে মেস আর হস্টেলের স্মৃতিকথার এক সঙ্কলন দেখে চমকে গিয়েছিলাম এক বছর। বঙ্গের লুপ্তপ্রায় জীবিকা (প্রতিক্ষণ), বাঙালি মেয়ের ভ্রমণ (লা স্ত্রাদা), বাংলার মিষ্টি (খসড়া খাতা) – এমন নানা বিষয় নিয়ে কত উপভোগ্য সঙ্কলন, কত স্মৃতিকথা হাতে এসেছে, আর অবাক বিস্ময়ে তুলে নিয়েছি হাতে। বইমেলার মাঠ থেকে সে-সব ঠাঁই নিয়েছে বালিশের পাশে। নতুন নতুন ‘শয্যাসঙ্গী’ চাইলে বইমেলা না গিয়ে উপায় কী?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...