যে বই পড়বই— পড়বই মানে, পড়বই

দেবাশিস্ভট্টাচার্য

 

…কিন্তু, কী জিনিস এটা? কী হয়, এই দিয়ে? এক কথায় জিনিসটা হচ্ছে, সত্যি বা মিথ্যে হতে পারে এইরকম বাক্যের ওপরে অঙ্কের মতো করে যুক্তি খাটিয়ে অন্যান্য কিছু সত্য ‘কষে’ বার করবার বিদ্যা। কথাবার্তায় তো আমরা সব সময়েই নানা যুক্তিতর্ক করছি, এবং নানা সিদ্ধান্তেও পৌঁছচ্ছি— ম্যাথমেটিক্যাল লজিক-এ সেটাকেই অঙ্কের মতো করে কষে বার করা যায়। তার সুবিধেটা হচ্ছে, প্রক্রিয়াটি অঙ্কের মতো সুনির্দিষ্ট ও যান্ত্রিক, ফলে সিদ্ধান্তে ভুল হওয়ার সুযোগ কম, এবং যে-সব কথার ওপরে যুক্তি খাটানো হচ্ছে সেগুলো মিথ্যে হলে ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।…

 

বসে বসে মাঝেমাঝেই গালে হাত দিয়ে ভাবি, ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়ে ফেলতে পারলে বেশ হত! কিন্তু, এ সব বাসনার কথা খুলে বলবার আবার পব্লেম আছে, জানেন্তো! ফিচেল পাব্লিক শুনলেই বলবে, বেশি কেত মেরো না গো কাকা, নিউটন সায়েবের ওই সাঙ্ঘাতিক বইয়ের কথা সারা পিত্থিমির লোক জানে! একে তো সেই সতেরো শতকের ভয়ঙ্কর ল্যাটিন ভাষায় লেখা, আর ল্যাটিন ভাষায় তুমি মহাপণ্ডিত ঢ্যাঁড়শাচার্য, আর তার ওপরে আবার ওই বই হচ্ছে এক খুনখারাপি ব্র্যান্ডের কঠিন ক্যাইস, লেখক নিউটন সায়েব নিজে আর সমসাময়িক অল্প কয়েকটা আধপাগলা ছাড়া আর কেউ ওসব বুঝত না।

তবে কিনা, এসব কথার কাটান-ছাড়ান আছে। প্রথমত, সেই কবে ১৭২৯ সালেই ও-বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হয়ে গেছে, এখন সব জায়গায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, ওইসব বিজ্ঞান ওই সময়ে খুব কঠিন ছিল, কিন্তু এই প্রায় সাড়ে তিনশো বছর বাদে এখন ওসব জিনিস ইশকুলের ছেলেরা পড়ে। কাজেই, ওটা কথা না। আসল কথাটা হচ্ছে, আমি তো ওই বইটার কথা বলছিলাম না! সত্যি বলতে কী, ওই বইটার নামটা আসলে আরও অনেক বড়, ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা ফিলোজফিয়া ন্যাচুরালিস’, আমরা ছোট করে বলি।

আমি বলছিলাম বিশ শতকের গোড়ার দিকের আরেকটা বইয়ের কথা, ওই একই নামের (এবং ওটাই গোটা নাম)। সেটা লিখেছিলেন দুই জাঁদরেল ইংরেজ দার্শনিক, বার্ট্র্যান্ড রাসেল এবং আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড। তিন খণ্ডের বই, এবং প্রতিটি খণ্ডই আকারে মহাভারতোপম। আরেক প্রবাদপ্রতিম ইংরেজ, গণিতজ্ঞ জিএইচ হার্ডি— যিনি ভারতীয় গণিতজ্ঞ রামানুজনকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন সেই লোক— এই বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, যদিও প্রত্যেক গণিতজ্ঞের এই বইটি পড়া উচিত, কিন্তু আসলে গোটা ব্রিটেনে নাকি ওটা বড়জোর কুড়িটা লোক পড়বে! কী লেভেলের কড়া মাল, বুঝতেই পারছেন! সত্যি বলতে কী, বইয়ের যে কোনও পাতা খুললেই আপনি যে অপার্থিব অঙ্কগুলো ঠাসা রয়েছে দেখতে পাবেন, বেশিরভাগ পেশাদার গণিতজ্ঞও আলাদাভাবে চর্চা না করলে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবেন না। আর, আপনার-আমার মতো লোক একটানা সেদিকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে বুঝি উচ্চমার্গের কোনও ভিনগ্রহী প্রাণীর হাতে তৈরি পাঠ্যবস্তু, সায়েন্স ফিকশন সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা। এই আশ্চর্য বস্তুটির নাম হচ্ছে, ‘ম্যাথমেটিক্যাল লজিক’। সারা পৃথিবীতে খুব অল্প কিছু লোকজন এই নিয়ে কাজ করে (অবশ্য, এ জিনিস তথ্যপ্রযুক্তিতে যেটুকু কাজে লাগে সেইখানে কাজের লোক কম নয়)।

কিন্তু, কী জিনিস এটা? কী হয়, এই দিয়ে? এক কথায় জিনিসটা হচ্ছে, সত্যি বা মিথ্যে হতে পারে এইরকম বাক্যের ওপরে অঙ্কের মতো করে যুক্তি খাটিয়ে অন্যান্য কিছু সত্য ‘কষে’ বার করবার বিদ্যা। কথাবার্তায় তো আমরা সব সময়েই নানা যুক্তিতর্ক করছি, এবং নানা সিদ্ধান্তেও পৌঁছচ্ছি— ম্যাথমেটিক্যাল লজিক-এ সেটাকেই অঙ্কের মতো করে কষে বার করা যায়। তার সুবিধেটা হচ্ছে, প্রক্রিয়াটি অঙ্কের মতো সুনির্দিষ্ট ও যান্ত্রিক, ফলে সিদ্ধান্তে ভুল হওয়ার সুযোগ কম, এবং যে-সব কথার ওপরে যুক্তি খাটানো হচ্ছে সেগুলো মিথ্যে হলে ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।

কিন্তু, দুই সায়েব রাসেল আর হোয়াইটহেড মিলে ওই বইতে এই জিনিস নিয়ে করলেনটা কী? সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। অঙ্কের বিজ্ঞানীরা সাধারণত গবেষণা করতে করতে আরও বড়, আরও জটিল জিনিসের দিকে যেতে থাকেন। এক থেকে দশ অবধি আঙুল গোনা থেকে শুরু করে আরও বড় বড় সংখ্যা, সেখান থেকে পাটিগণিত— মানে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ, সেখান থেকে বীজগণিত, ক্যালকুলাস— আরও কত কী! কিন্তু এই দুই সায়েব গেলেন উল্টোদিকে। মানে, আরও সরলের দিকে, আরও মূলের দিকে। মানে, কাকে বলে সংখ্যা, কাকে বলে যোগ বিয়োগ, সেগুলোকে স্রেফ ‘লজিক’ বা যুক্তিশাস্ত্রের ‘হয়’, ‘নয়’, ‘এবং’, ‘অথবা’ জাতীয় ধারণা দিয়ে প্রকাশ করা যায় কিনা— এইসব। মানে, দুয়ে দুয়ে চার হয়, এইখান থেকে অন্য গণিতজ্ঞরা যদি আরও মস্ত ও জটিল একটা অঙ্ক বানাতে চান, তাহলে এই দুই সায়েব বলবেন, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, ‘দুই’ মানে কী, আর ‘যোগ’ মানেই বা কী, আর তা থেকে শুধু চারই হতে হবে কেন, কেন পাঁচ বা তিন নয়?

লোকে বলে, সংখ্যা আর চিহ্ন নিয়ে বিস্তর ধস্তাধস্তির পরে ওই বইয়ের তিনশো ঊনআশি পাতায় এসে নাকি তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন, এক আর এক যোগ করে দুই হয়। অবশ্য, বইটা যাঁরা পড়েননি তাঁদের মধ্যে তিনশো ঊনআশি পাতা না তিনশো বাষট্টি— এই নিয়ে জোর ধন্ধ আছে। যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যেও ধন্ধ আছে কিনা, জানি না— আমাকে ওইসব ফালতু কোশ্চেইন অ্যাকদম জিজ্ঞেস কোর্বেন্নাকো!

মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, বইটা আমি পড়বই। মানে, পড়বই। এই বলে দিলুম, হ্যাঁ!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...