
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই গল্পের কোনও নায়ক নেই। এই গল্পের কোনও খলনায়ক নেই। তপোসুন্দরকে এই গল্পের নায়ক বলা চলে না। সে এই গল্পের চরিত্র মাত্র। কেবল বিবিধ ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে, একসময় সে মূল হয়ে ওঠে। আবার হয়ও না বোধহয়। এই গল্পের পটভূমি শহর কলকাতা। যে শহরে এখন সন্ধেরাত।
সেদিন কী কারণে জানি তপোসুন্দর পিজি হাসপাতালের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে ভবানীপুরের দিকে এগোলে সার্কাস এভিনিউ আর ক্যাথেড্রাল রোডের মোড়। সে অংশ থেকে আরও দক্ষিণে যাওয়ার উপায় হরিশ মুখার্জি রোড, সরাসরি পিজি হাসপাতালের সামনে দিয়ে সে রাস্তা চলে গিয়েছে ভবানীপুর। সচরাচর তপোসুন্দর এভাবে হাঁটে না। এক্সাইড মোড় থেকে বাস বদলে নেয়। তার বাসস্থান চারু মার্কেট ছাড়িয়ে। পূর্ণ সিনেমার আগেই। আজ কী মনে হল তার, ইচ্ছে হল বলবন্ত সিংহের ধাবায় দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা খাবে। সঙ্গে খান-দুই জিলিপি। সেই ভেবেই সে হাঁটতে শুরু করল। বাঁদিকে তাকালে সুগার অ্যান্ড স্পাইসের দোকান। ফ্যাক্টরি আউটলেট। এখন কারখানা বন্ধ। নয়তো কাজের সময় এই রাস্তা দিয়ে হাঁটলে নাকে সদ্য আভেন থেকে নামানো কেক-বিস্কুটের গন্ধ পাওয়া যায়। আগে যে গন্ধ তপোসুন্দর অনেকবার পেয়েছে। বাবার হাত ধরে তারা এই রাস্তায় বেড়াতে আসত। সে আর তার ছোটভাই অমিয়। তপোসুন্দরের বাবার নাম ধীরাজ। কেন জানি না তপোসুন্দরের নামটাই এমন বিরাট, বড়সড়, ভারিক্কি করে রেখেছিলেন ধীরাজ। মধ্যবিত্ত মফস্বল থেকে কলকাতা শহরে আসা ধীরাজ বড় ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন সফলও হয়েছে তাঁর। ধীরাজদের সময়ে যাকে সদাগরি আপিসের চাকরি বলা হত তপোসুন্দরদের সময়ে কোনওভাবে একটু ডানা-পাখনা গজালেই তাদের পরিচিতি হয় ‘কর্পোরেট’। উদয়াস্ত খাটনির পর মাস ফুরোলে মোটা টাকার হিসেব। যদিও সে টাকা খরচের সময়টুকুও মেলে না। সেই অঙ্ক কেবল পাসবইয়ের পাতা ভরানোর প্রয়োজনে। অথচ একবার সেই পাতার ভার বাড়তে শুরু করলেই ধীরাজদের সঙ্গে তপোসুন্দরদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান বাড়তে শুরু করে। সময়ের অভাবে টাকার গরমটুকুই যাবতীয় অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। তখন আর কাজের সময় সুগার অ্যান্ড স্পাইসের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও কেক-বিস্কুটের গন্ধ মেলে না। গন্ধবাহী স্নায়ুগুলোও তখন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তপোসুন্দর এই সত্যিটাকে অনুভব করে।
সে তবুও হাঁটতে চায়।
কেঁউ কেঁউউ আওয়াজেই তাকে থমকে যেতে হল। সন্ধেরাত হলেও হরিশ মুখার্জি রোড ধরে ভবানীপুরের দিকে যাওয়া গাড়িগুলোর যথেষ্টই গতিবেগ থাকে। সকলেই একমুখী চলাচলের সুযোগ তুলতে চায়। ঠিক সে-সময়েই গুরুদ্বারের সামনেটায় সিগনাল পালটে গনগনে লাল হয়ে উঠেছিল হঠাৎ। চোখে পড়ার সেই উত্তাপটুকু নজরে না আসতেই একদিকে ঘাড়ের উপর ক্যাঁচকোঁচ শব্দ আর ভারি ভারি গাড়িগুলোর ব্রেক কষার শব্দে তপোসুন্দর কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে সেই কেঁউ কেঁউ চিৎকার।
গলির ভিতর থেকে ল্যাজ গুটিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে একটি ঘেয়ো রাস্তার কুকুর। ল্যাজ গুটিয়ে পেটের তলায় তার। গাড়ির মতোই যেন ব্রেক কষে হেলে পড়তে পড়তে সে তপোসুন্দরের ঠিক সামনেটায় স্থির হয়ে পাথরের মতো দাঁড়াল। তারই পিছনে ধাওয়া করে এসেছে তুলনায় তাগড়াই আরেক সারমেয়পুঙ্গব। ঘাড়ের কাছটা রাগে গরগর করছে। ধারালো দু-জোড়া কোণের দাঁত-সমেত সবকটা দাঁত তার হাঁ মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চেহারায় রাগ ফেটে পড়ছে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তার। কিন্তু সে চিৎকার করছে না। তাড়া খাওয়া কুকুরটাই বরং কেঁউ কেঁউ করে আওয়াজ করল। তাড়া করা সারমেয়টি আরেক ধাপ এগোয়। বড্ড হিংস্র দেখাচ্ছে। তপোসুন্দর নড়বে কি নড়বে না বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তাড়া খাওয়া কুকুরটা স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে উঠে তপোসুন্দরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। গরগর শব্দে আক্রমণকারী জন্তুটা এবার আবারও দাঁত বের করে এগিয়ে আসে। তপোসুন্দর হাতের ব্যাগটা খুব অল্প করে তুলে খসখসে শুকনো গলায় যাঃ যাঃ-এর মতো একটা আওয়াজ করতে চেষ্টা করে। ঠিক সে-সময়েই বীভৎস একটা শিসের শব্দে লড়াকু দুজনই লড়াই ভুলে অবাক হয়ে তাকায়। ফুটপাথের দিক থেকেই আওয়াজটা এসেছে।
লোকটার দিকে তাকালে যে কেউই তাকে পাগল বা আধ-পাগল বলে মনে করবে। মলিন, ধূলিধূসরিত চেহারা। জামাকাপড় ছেঁড়া, তাপ্পি-দেওয়া। গালে বেশ কয়েক সপ্তাহের না কামানো দাড়ি। বিড়ি ফুঁকছিল। তপোসুন্দরকে বেকায়দায় পড়তে দেখে লড়াকু দুজনকেই কেমন শিস দিয়ে থামিয়ে রেখেছে। মনে মনে তপোসুন্দরের সম্ভ্রম জাগে। আবারও একটা শিস। এবারে অন্য শব্দ। দুটো কুকুরই দুদিকে মুখ তুলে ছুট দেয় হঠাৎ। পথচলতি মানুষেরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। সিগনাল আবারও লাল থেকে সবুজ হয়। শোঁ শোঁ শব্দে বড়লোকি গাড়িগুলো স্টার্ট দিতে শুরু করে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া তপোসুন্দরকে সেই পাগলাটে লোকটাই হাত ধরে টেনে রাস্তার একপাশে সরিয়ে আনে। তার সম্বিৎ ফেরে এবার।
লোকটার গা গরম। ওইটুকু স্পর্শতেই টের পাওয়া যায়। লোকটার শরীরে দারিদ্র্য যেমন আছে, তেমনই শক্তিও রয়েছে। তপোসুন্দর অনুভব করে। দাড়িটা অপরিষ্কার। তাকাতে ইচ্ছে করে না। লোকটার উপর একই সঙ্গে মায়ায়, কৃতজ্ঞতায় তপোসুন্দর একটা টান অনুভব করে। দান করে দানশীল বড়লোক হয়ে উঠতে চাওয়ার টান। এই টান মধ্যবিত্তের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সবসময় সেই টান কুলিয়ে ওঠা যায় না। তবুও মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হয়ে উঠতে চাওয়া একেকজন কখনও সেই টান অনুভব করে। তপোসুন্দর পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে আনে। বাড়িয়ে দেয়। লোকটা আগুনচোখে তার দিকে তাকায়। নোটটা তপোসুন্দরের হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়েই সে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তার উপর। থুক করে থুথু ফেলে। তারপর হেঁটে বেরিয়ে যায়। পাশের চা-দোকানের প্রৌঢ় ভদ্রলোক তপোসুন্দরকে উদ্দেশ্য করে টিপ্পনি কাটেন, বাবা! বাসুকিকে আবার ভিক্ষে দেওয়ার শখ হয়েছিল! লোকটার নাম তাহলে বাসুকি। এমন অদ্ভুত নাম। তপোসুন্দর ধাতস্থ হয় খানিক। তারপর রাস্তা পেরিয়ে বলবন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটাকে আর সে কোথাও দেখতে পায় না। সে চায়ের অর্ডার দেয়।
***
হেলমেটের অবস্থা দেখেই সে মনে মনে প্রমাদ গুণেছিল। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় আর উপায়ও ছিল না। কাল ছোটভাই অমিয়ের জন্মদিন। একদিকে বাড়িতে সে কথা দিয়ে এসেছে একেবারে যদুবাবুর বাজারের কানাইয়ের দোকান থেকে ভাল পেটির মাছ কাটিয়ে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে। এদিকে কানাইয়ের দোকান সাড়ে আটটায় বন্ধ হয়। রানিহাটি থেকে তাই উবের-বাইকে চড়া ভিন্ন তপোসুন্দরের আর কোনও বিকল্প ছিল না। আজকেই তার মার্কেট সার্ভের দিন পড়তে হল। সে মনে মনে গজগজ করে। চাইলে হয়তো সে ট্যাক্সিও নিতে পারত। কিন্তু বাইকে আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে। বিশেষত সামনে যখন হুগলি পেরোনোর ট্র্যাফিক। কিন্তু হেলমেট দেখেই আবারও থমকাল তপোসুন্দর। একে আবার হেলমেট বলে নাকি! নিজের মাথায় দিব্যি স্টাডসের মার্কামারা শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে বাইকের ছেলেটি তপোসুন্দরের দিকে হলুদরঙা যে বস্তুটি বাড়িয়ে ধরেছে সেটি আর কিছুই নয়, সিভিলের কাজ করা এঞ্জিনিয়রদের তদারকিতে যাওয়ার সময় মাথায় যেমন ফিনফিনে হলুদরঙা প্লাস্টিকের টুপি পরতে হয়, সেই এক জিনিস। তর্ক করতে গিয়েও আর কথা বাড়াল না তপোসুন্দর। অনেকটা সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু বাইকে চাপতেই সে টের পেল হেলমেট বলে কী জিনিস তার মাথায় চড়েছে।
গঙ্গার হু হু হাওয়ায় রীতিমতো ঠান্ডা লাগছিল। হাওয়ার বেগ মাথা ফুঁড়ে যাচ্ছিল। ওই হেলমেট দেখেও হুগলির ট্রাফিক পুলিশ যে বাইক আটকে কৈফিয়ৎ চায়নি এই রক্ষে। তপোসুন্দরের ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু বাইকের পিছনে বসে এভাবে ঘুম— মন থেকে সে চিন্তাটা তাড়াতে চাইল। কিন্তু গেলে তো।
দ্বিতীয় হুগলি সেতুর উপর কলকাতামুখী রাস্তা যেখানে দুটি লেনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দে তপোসুন্দরের বাইক সেই বিভাজিকা পেরিয়ে এল। বাইক নামছে। সামনেই হেস্টিংসের মোড়। বাঁ হাতে রেসকোর্স, ময়দান। তপোসুন্দরের চোখ জুড়িয়ে আসে। ফুরফুরে হাওয়ার সুখ। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে তার। এক মুহূর্তের ঝাঁকুনিতে তপোসুন্দর চোখ খোলে। বাঁদিকে আলোকোজ্জ্বল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। বেশ তাড়াতাড়ি ছুটছে তো বাইকটা। একটা ছোট ম্যানহোলের গাড্ডায় পড়ে বাইক অল্প লাফিয়ে ওঠে। মুহূর্তে চোখ খুলেই আবারও ঘুমে তলিয়ে যায় তপোসুন্দর। বড় ক্লান্তি। হুঁশ থাকে না তার। প্রচণ্ড জোর একটা আওয়াজ হয়। তার শরীরটা যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে।
আবারও সেই একই জায়গা। সেই সুগার অ্যান্ড স্পাইস। হইহই করে লোক ছুটে এসেছে। ছুটে চলা গাড়িগুলোকে উপেক্ষা করে বাইকওয়ালাও অদ্ভুত কায়দায় গতির মুখে কাউকে কাটাতে গিয়েছিল। তার কাছে তো আর ঘুমন্ত সওয়ারির খবর ছিল না। ভারসাম্য নড়ে গিয়ে বাইকটা কাত হয়ে পড়েছে। চোখ খুলতেই আবারও চোখে অন্ধকার দেখে তপোসুন্দর। তারপর উজ্জ্বল কিছু আলোর বিন্দু। ঝাপসা থেকে ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়। ভিড়ের কথা কানে আসছে। সে বুঝতে পারে মাথার হেলমেটটা ফেটেছে। কানের উপর যন্ত্রণা চটচট করছে। রক্ত? কিন্তু শরীরটা নাড়াতে যেতেই যন্ত্রণায় সে প্রায় চিৎকার করে ওঠে। ডান পায়ের গোড়ালির উপর আস্ত মোটরবাইকের চাপ। হাড় ভাঙার শব্দটাও কি শুনতে পাওয়া গিয়েছিল? তপোসুন্দর অসহ্য যন্ত্রণায় আবারও ঘুমিয়ে পড়তে চায়। লোকজন জোরে জোরেই বলছে, সে শুনতে পায়, এইরকম একটা হেলমেট পরে বাইকে উঠেছিল! শ্লা বাপের ভাগ্যি ভাল… এরই মধ্যে কতগুলো লোক ভিড়ের বাইরে থেকে ভিতরে ছুটে এসেছে সে আন্দাজ করে। পিজি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। আকাশি নীল ইউনিফর্ম। কিন্তু যে মুখটা সবার প্রথম তপোসুন্দরের মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে, তাকে চেনা কঠিন নয়। দাড়িটা এখনও ময়লা একইরকম। চোখদুটিও তাই। জল শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাওয়া নদীচরের পাথরের মতো। তবুও সে-চোখেই চকমকি আগুন দেখা যায়। তপোসুন্দর সেই নাম উচ্চারণ করতে চায়। পারে না। বাসুকি একা হাতে তার গোড়ালির উপর চেপে বসা বাইকটাকে আলতো করে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। লোকজনও এগিয়ে এসে হাত লাগায়। তপোসুন্দরের আর কিছুই মনে নেই তখন। সে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। রাস্তাতেই।
***
অমিয়র পিছন পিছন ধীরাজকে ঢুকতে দেখে খাটের উপর তপোসুন্দর টান হয়ে বসতে চেষ্টা করে। পারে না। ডাক্তার স্পষ্টই বলেছেন, মরতে মরতে সে কোনওমতে বেঁচে ফিরে এসেছে। কানের চোট এ-যাত্রায় একেবারেই গুরুত্বহীন। তবে ভাঙা হেলমেটের টুকরো আরও ভিতরে ঢুকলে মস্তিষ্কে চিরস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা থাকত। প্রধান সমস্যা গোড়ালিতেই। এ-জীবনের মতো বাইকে চড়া ছাড়তে হবে বোধহয়। গোড়ালিতে প্লেট বসানো হয়েছে। এখনও নাড়তে গেলে যন্ত্রণা হয়। ছুটি পেতে পেতে এখনও কয়েক দিন।
এতদিনে এই প্রথম ধীরাজ হাসপাতালে এলেন। প্রথমদিন বেডে জ্ঞান ফিরতেই অমিয়কে দেখতে পেয়ে তার হাত ধরে বাবাকে কিছু না জানাতে বলেছিল তপোসুন্দর। কিন্তু সেও জানত বাবা জানবেনই। এই আঘাত লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। সে বলেছিল আপাতত বাবাকে হাসপাতালে না আনতে। অপারেশনের দিনও একলাটি অমিয়ই এসে সব ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আজ ধীরাজ এসেছেন। তপোসুন্দরের কেমন যেন আড়ষ্ট বোধ হয়। নতুন এই চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই কোথায় যেন তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ধীরাজের সঙ্গে তপোসুন্দরের। তপোসুন্দর তার বাবার দিকে তাকায়।
—সামান্য পেটির মাছের জন্য অমন তাড়াহুড়ো করতে গিয়েছিলে সেদিন? পরের দিন সকালে গিয়ে নাহয় আমিই নিয়ে আসতাম।
অ্যাক্সিডেন্টের আগে হলে হয়তো পালটা জবাব পেতেন ধীরাজ। হয়তো তপোসুন্দর বলে উঠত, না আনলে তো বলবে সংসারে আমি কিছুই দায়দায়িত্ব নিচ্ছি না! ইত্যাদি। আসলে, নতুন চাকরিতে মাইনে যেমন বেড়েছে— তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাজের চাপ। সময়। যাতায়াতের ধকল বেড়েছে। তারই মধ্যে বাড়িতে নানান বিষয়ে আত্মীয়স্বজন-মহলের কোন্দল। ধীরাজকে এখনও মফস্বলের বাড়িতে থাকা অকর্মণ্য দুই ভাইয়ের হাতখরচ জোগাতে হয়। মফস্বলের বাড়িটা যদি বিক্রি করে দেওয়া হয় তাহলে প্রোমোটিংয়ের সময় কেমন ভাগাভাগি হবে? বিয়ে হয়ে অন্য সংসারে চলে যাওয়া পিসিদেরও কেনই বা সেই ভাগে জায়গা দেওয়া হবে, সেই নিয়ে তপোসুন্দরের দুই জ্যাঠা-কাকার ভিন্নমত। দিনশেষে এই কূটকচালির গল্প শুনতে তার ভাল লাগত না। অধৈর্য হয়ে উঠে তাই কোনও কোনও দিন ধীরাজকেই পালটা শুনিয়ে দিত তপোসুন্দর। যতই আত্মীয় হোক অকর্মণ্য লোকের দায়িত্ব কেনই বা নিতে হবে, এই যুক্তিতেই সে ধীরাজকে বিঁধতে চাইত বারংবার। তিনি বলতেন, কিছু কিছু বিষয় তুমি এখনও বোঝো না। কাজেই সেই ব্যাপারে আমাকেই ভাবতে দাও। এরই মধ্যে একদিন ভুল করে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নিজের মাইনের দেমাক দেখিয়ে ফেলেছিল তপোসুন্দর। চিৎকার করে বলে ফেলেছিল, আমার কষ্টার্জিত পয়সায় আমি সারা জগৎকে পুষতে পারি না। সেই ক্ষমতা আমার নেই! আর সেদিনই বোধহয় বাড়ির জন্য নতুন কিনে আনা চায়ের বাক্সটারও দাম উল্লেখ করে গরম দেখিয়ে বলেছিল, এই চা তোমাদের জন্যই আনি। গুষ্টিশুদ্ধ সকলকে আমি এই ভালবাসা দেখাতে পারব না!
সেদিন বড় গুমোট করে এসেছিল। সেদিন ধীরাজ নীরব হয়ে বসেছিলেন। বড় কষ্টে কলকাতার এই ফ্ল্যাটটুকু গড়ে তুলেছিলেন ধীরাজ। একা হাতের প্রচেষ্টায়। তার জন্য তাঁকে চাকুরিজীবী ছেলের কাছে হাত পাততে হয়নি।
ধীরাজ জলের গন্ধ পান। আশির দশকে সোদপুর। নাটাগড়ের দু-কামরার বাসস্থান। দুই ছেলে, বউ, কোনও কাজ না করা দাদা আর ভাইকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালিয়েছেন, তাঁর মনে পড়ে। সেখান থেকেই তপোসুন্দরের উঠে আসা। তপোর কি সত্যিই মনে পড়ে না সেসব? পড়ে বোধহয়। তপোসুন্দরও বাবার দিকে তাকায়। দাওয়ায় বসে মার মুড়ি বেছে রাখার দৃশ্যপট। ঘরের খাটে একপাশে কাঁথায় পড়ে থাকা অমিয়। ঘুমে কাদা হয়ে রয়েছে, ঘাম-ঘাম গন্ধ পাওয়া যায়। বাবা তখনও অফিস থেকে ফেরেননি বোধহয়। বারান্দায় মাথার উপর ভিড় করে এসেছে মশার দল। তপোসুন্দর টিউশনি পড়ে ফিরেছে। খিদের মুখে তখন জল-বাতাসাই বরাদ্দ কেবল। বাড়ির পিছনে এঁদো পুকুরঘাট। মশা তো হবেই— চাপড় মেরে মশা মারতে মারতে তপোসুন্দরের মা স্বগতোক্তি করেন। চৈত্রের শেষ। মুড়ি মাখতে গেলে একটুখানি আমতেলের আবদার। সেই ছোটবেলায় একটা গন্ধ লেগে থাকত। তপোসুন্দরের ক্লাস সেভেন তখন। প্রথমবারের জন্য কলকাতায় ভাড়া উঠে এলেন ধীরাজ। স্ত্রীপুত্র-সমেত চারজনের পরিবার। দেড়খানি বরাদ্দ ঘর। অফিসের মাইনে থেকে বাড়িভাড়া গুণেও বাড়িতে আলাদা করে টাকা পাঠাতেন ধীরাজ। সেইসব দিন গেছে কোথায়। এখন, তপোসুন্দরের কাছ থেকেই টাকার হিসেবের কথা শুনতে হয়। যদিও আজকে তা হল না। তপোসুন্দরের মধ্যে ধীরাজ একটা শান্ত ভাব দেখেন। বাইরে থেকে হঠাৎ একটা হইহইয়ের শব্দ শোনা যায়।
***
চাকরি নিয়ে ছেলে বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকেই বাসুকির জীবনের প্রতি আগ্রহ কমেছে। নয়তো শখ করে কেউ নেশাড়ু অপবাদ নিয়ে সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়ের চাকরি খোওয়ায়? ইচ্ছে করেই সে চাকরির মাথায় লাথি মেরেছিল। চুলোয় যাক রোজগার আর পেনশনের হিসেব। প্রথমে অসুখে গেল বউ, আর তারপর দেমাকে গেল ছেলে। সে মনে মনে গালাগালি দিয়ে ওঠে। এর-ওর ফাইফরমাশ খেটে দিয়ে দুবেলা দুমুঠো অন্নের জোগাড় তো হয়েই যায়। তাছাড়া জমানো টাকার সবটুকুই তো আর নেমকহারাম ছেলের পিছনে সে ঢেলে দেয়নি। বাসুকির নামে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে এখনও আসল খাতা খোলা রয়েছে। কজন জানে সেসব? বাসুকি তাই মোড়ের চায়ের দোকানে এসে বসে থাকে। খুব হল্লাগুল্লা করে একেকদিন। কখনও হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের, আরএমও-দের টুকরো-টাকরা কাজ করে দেয়। কিন্তু এমআর-দের কেউ তাকে দিয়ে কিছু করাতে গেলেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। এদিকে খুব গুমোর আছে তার। সে ডাক্তারদের কাজ করতে পারে। মায় নার্সদেরও এক-আধটা হুকুম সয়ে নিতে পারে। কিন্তু এমআর-দের সঙ্গে রীতিমতো তাঁব রেখে কথা বলে বাসুকি। ছেলেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে সে মানুষ করেছিল। কিন্তু চাকরি পেতে না পেতেই একদিন খুব মুখ করে ছেলে উধাও হয়ে যায়। তার গরম দেখে সেদিন চুপটি করে অনেকক্ষণ আদিগঙ্গার পাড়-বরাবর ঘাটের উপর নিজেদের এক কামরার দরমা-ঘেরা ঘরের, ঘরের চেয়েও ছোট একচিলতে উঠোনে বাসুকি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসেছিল। কিসের জন্য সে তবে এত কষ্ট করে ছেলে-মানুষ করেছিল? এতগুলো বছর? বউ মরে যাওয়ার বছরে, সেই ঘটনার এক সপ্তাহের ভিতর ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল। ছুটি নিয়ে, রাত জেগে ছেলের শিয়রে বসে থাকত বাসুকি। ফিসফিস করে বলত, এই তো সোনা ছেলে আমার। পরীক্ষা দিলেই যে তুই জলপানি পাবি রে বাপ! তা জলপানি সে পেয়েছিল বটে। এমনই জলপানির বহর, সেই থেকে শেষ অবধি কোনও দিন আর বাসুকিকে ছেলের পড়ার খরচ নিয়ে ভাবতে হয়নি। কিন্তু সেই জন্যই কি চাকরি পেতে না পেতেই সে অতখানি বদলে গেল?
তার ঘুম ভাঙছে না। সকাল থেকেই শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। এক-কামরার ঘর। বার-দুয়ারে এক চিলতে রোদ। পা ছড়িয়ে একটু আরাম করতে ইচ্ছে করছিল। সে পা ছড়িয়ে বসেছিল। হঠাৎ যেন শ্বাসকষ্টের মতো মনে হল। মাথার উপর যেন ভারি একটা কিছু চেপে বসেছে। কি ভাগ্যি তখনই জুনিয়র ওয়ার্ডবয় গোপাল ওর ঘরের পাশ দিয়ে চকিত পায়ে ডিউটিতে যাচ্ছিল। বাসুকির গোঙানির শব্দ সে বাইরে থেকে শুনতে পায়। ততক্ষণে বাসুকি শানবাঁধানো উঠোনের উপর টসকিয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে তার।
চোখ খুলতে বাসুকি দেখল দুখানি চোখ। শান্ত দৃষ্টি। নদীর জলের মতোই তিরতিরে গভীর। সে চোখ বুঝে ফেলল।
দীর্ঘ শুষ্কতা বুঝি এতখানি আর্দ্রতাও চট করে নিতে পারে না। এমন অসময়ে তো আরওই নয়। ধীরাজকে অমিয় বলে বলে নিয়ে এসেছিল, কেমনভাবে বাসুকি তপোসুন্দরের অপারেশনের দিন অবধি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত কাজে সাহায্য করেছিল। অমিয়কে কোনও কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই বাসুকি সেদিন। তার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু মুখ ঝুঁকিয়ে যখন ধীরাজ ‘বাসুকি’র দিকে তাকান, তারপর তাঁর খেই হারিয়ে যায়। নামটা শুনে তাঁর আগে থেকেই মনে খটকা লেগেছিল। বাইরে হইচইয়ের শব্দে ওয়ার্ড থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে যখন লোকজনের কাঁধে চড়ে অবসন্ন অবয়বটাকে এমার্জেন্সির ভিতরে ঢুকে যেতে দেখেন, তখনও খটকা লেগেছিল। কিন্তু সবটুকু মন মানতে পারেনি। এখন আর অস্বীকার করা চলে না। বাসুকি চোখ নাড়িয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করে। মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ হয়। অস্ফুটে সে কোনও মতে উচ্চারণ করে, ম-ম্মম, সে আবারও চোখ বুজে ফেলে। ধীরাজ তার কপাল ছুঁয়ে থাকেন। বাসুকির চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
বাবার মুখে তপোসুন্দর এই গল্প শুনেছে। নাকি বিশেষ করে এই ‘বাসুকি’র গল্পই শোনেনি বোধহয়। কিন্তু শুনেছে ওপার থেকে আসা মানুষদের গায়ে গায়ে বেড়ে ওঠার কথা। এঁদো পুকুরের ধারে ধারেই ঘেঁষে ঘেঁষে বেড়ে ওঠা বাসস্থান। তখনও তপোসুন্দরের জন্ম হয়নি। নাটাগড়ের বাড়িগুলোও ঘেঁষাঘেঁষি করে সবে একটু উঠে দাঁড়িয়েছে। ধীরাজের বাবা তখনও বেঁচে আছেন। ঘোর বর্ষার রাত। নটবরের বউ তারাসুন্দরীর প্রসববেদনা উঠেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। টানা বৃষ্টিতে পথ-পুকুর একাকার হয়ে রয়েছে। দরমার ঘরখানি ঘিরে এলাকার ছেলে-বউরা উপস্থিত। কেউ বা ভিজছে, কেউ বা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। ঘরের ভিতরে একখানি তক্তপোষের উপর নটবরের বউ আছাড়ি-পিছাড়ি করে মরছে। তার হাত দুটো চেপে ধরে আছে পাড়ার জনদুই বয়স্কা স্ত্রীলোক। দরজায় পর্দা দিয়ে দেওয়া হল। ধীরাজের বাবা স্কুলমাস্টার, এলাকার মাথা বলে সুনাম রয়েছে। ধীরাজকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, এখনও তো এল না নটবর? ধীরাজ অসহায়ভাবে মাথা নাড়ে। রক্ত বন্ধের ওষুধ, আরও কিছু জরুরি ওষুধ আনতে সেই জলভাঙা রাত্তিরেই সাত কিলোমিটার দূরের হেলথ সেন্টারে ছুটেছে নটবর। সাইকেল নিয়ে বেরোবার সময় হাঁক পেড়ে বলে গিয়েছিল, এই গেলাম আর এলাম রে বউ, এট্টুস দাঁত চেপে রাখিস! ধীরাজকে তার বাবা ইঙ্গিত করেন। একটু এগিয়ে দেখা উচিত এবার। ঝরঝর করে জল পড়ে চলেছে। মানিক, স্বপন, আরও দু-চারজন ছিল বোধহয়। জল ভেঙে তারা এগিয়ে দেখতে যায়। ছপছপ শব্দ হয়। জোরালো টর্চের আলো ফেলে তারা এগিয়ে চলেছে। এই সন্ধেয় জলভাঙা পথ, সাপের উপদ্রব। দূর থেকেই রাস্তার উপর সাইকেল আর তার পাশেই মানুষের অবয়বটাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছুটতে ছুটতে তারা অবয়বটাকে ঘিরে দাঁড়ায়।
কপাল। যে কেউ শুনলে এই কথাই বলবে। সাইকেলের চেন খুলে যাওয়ায় গোড়ালিজলে নেমে চেন পালটাতে যাওয়া কোনও মানুষ যদি সর্পাঘাতে দষ্ট হয়, নিয়তি ছাড়া তাকে আর কিই বা বলা চলে? জলের উপরেই পলিথিনের প্যাকেটে মোড়া কাগজের খামে ওষুধগুলো পড়েছিল। বৃষ্টিতেও কোনও ক্ষতি হয়নি তার। ধীরাজের বাবাই আগত পুত্রসন্তানের নাম দিয়েছিলেন ‘বাসুকি’। হয়তো পিতৃহন্তার হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে একদিন সেই ছেলেই পরশুরাম হয়ে দাঁড়াবে, অবচেতনের এই বাসনা থেকেই নাম এমন। তারাসুন্দরী শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। তার কেমন যেন জড়বুদ্ধির দোষ দেখা দিল। একটু বড় হতেই বাসুকিও তাই বেশিদিন আর কলোনিতে থাকেনি। খুব ছোটবেলায় ধীরাজের বাবা তাকে ধরে এনে নিজেদের দাওয়ায় বসিয়ে দিতেন। ধীরাজের তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ার। তারপর বাসুকি বড় হল। পড়তে শিখল। কলোনিরই স্কুলে তাকে ভর্তি করা হল। তখনও সে ধীরাজদের বাড়িতে এসেছে। ধীরাজ তখন নতুন সংসারী হয়েছে। ধীরাজের বাবাই তাকে একটুআধটু পড়া দেখিয়ে দিতেন। অঙ্ক কষাতেন। বাসুকি খানিক পড়ত। খানিক পর উঠে যেত। ধীরাজের বাবা বিরক্ত হতেন। এমনি করেই বাসুকি চোদ্দ-পনেরো বছরের যখন, ধীরাজের কোলেও সন্তান এসে গিয়েছে বছর পাঁচ— একদিন জড়বুদ্ধি তারাসুন্দরীও শেষমেশ চোখ বুজল। তার মাস কয়েকের মধ্যেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসুকিও এলাকা ছাড়ল। বদনেশা বা আর কোনও বদনাম তার ছিল না। কিন্তু উড়নচণ্ডী বাসুকির হারিয়ে যাওয়াতে কলোনির বিশেষ ভাবান্তর হল না। কেউ একজন খোঁজ নিয়ে এসে জানাল আসানসোলের কোলিয়ারিতে কোথাও সে কয়লা কাটতে গিয়েছে।
মাঝখান দিয়ে পার হয়ে গেল এতগুলো বছর। সরকারি হাসপাতালের বড় বড় খোলা জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তপোসুন্দর এসবই ভাবছিল। খানিক আগে অমিয় আর ধীরাজ চলে গেছেন। বাসুকি ভাল আছে এখন। তবে এখনও তার বাকশক্তি ফেরেনি। বাহাত্তর ঘণ্টা অন্তত না কাটলে স্ট্রোকের প্রভাব কতটা সেই বিষয়ে কিছু বলা চলে না। ডাক্তার তবু আশ্বস্ত করেছেন, হয়তো ততটাও কিছু ভয়ের কারণ নেই। বাইরে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। ধীরাজ বুঝেছেন তপোসুন্দরের এই কয় মাসের আচরণের কারণ। তপোসুন্দরও ধীরাজকে বুঝেছে। কেবল খবর পাঠালেও বাসুকির ছেলে তার বাপকে দেখতে আসার ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। এলেই যদি পয়সা গুণতে হয়।
জানালার ঠিক বাইরে একখানি কৃষ্ণচূড়া গাছ। হাওয়ায় ফুলগুলি দুলছে। ধোঁয়ার গন্ধ, জলের গন্ধ ভেসে আসে কোথাও। মেট্রন ঘরে ধূপ জ্বেলে দিয়েছেন। তার গন্ধ মিষ্টি। তপোসুন্দর নিচে পা ঝুলিয়ে বসেছে। অফিসের বড়কর্তারা বিকেলে দেখা করতে এসেছিলেন। মেডিক্লেমের সুবিধে থাকা সত্ত্বেও কেন তপোসুন্দর কোনও প্রাইভেট নার্সিংহোমে গিয়ে চিকিৎসা করাল না সেই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অবশ্য অ্যাক্সিডেন্টের আকস্মিকতায় অন্য কোথাও যে তখন তাকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না সে-কথাও স্বীকার করেছেন। বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে সে বসতে পারবে না। তপোসুন্দর পা তুলে নিয়ে বিছানার উপর টান করে দেয়। অনেক দূর থেকে যেন বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে। বড় চেনা বলে মনে হয়। বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ওয়ার্ডবয়কে নিজের সন্দেহের বিষয়ে সে জিজ্ঞেস করে বসে। আশ্চর্য যে ওয়ার্ডবয়টিও ঠিক চিনতে পারে বাঁশুরিয়াকে। তপোসুন্দর অবাক হয়ে যায়। এখানে কি সবাই সবাইয়ের পরিচয় মনে রাখে? নাকি, সবটাই তপোসুন্দরের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
কানু চৌরাসিয়া বাঁশি বাজিয়ে যায়। অনেক রাত্তিরেও, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস অথবা নন্দন চত্বরের ফুটপাথের কোথাও যে কেউ গিয়ে থাকলে, কানুর বাঁশি শুনেছেন। অনেকবার। অনেক রাত্তিরেও শহরের নিস্তব্ধতা ভেঙে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে সেই বাঁশির সুর। কানু বোধহয় হাসপাতালের পাশ দিয়েই রবীন্দ্র সদনের দিকে চলে যাচ্ছে। তার গল্পই শোনাব পরেরবার।