
সোমেন বসু
পিলু বাড়িয়েছিল বলটা। ডানপাশ থেকে। ছুটতে পারে বটে। সমীর, দিশারী সঙ্ঘের লেফট ব্যাকে খেলে, তখন খেলত, এখনও খেলে, সেদিন তিন-চারবার মাটি ধরিয়ে দিয়েছিল ওকে পিলু। সমীরকেই স্পিডে বিট করে পেনাল্টি বক্সের ঠিক কোনা থেকে বলটা মাটি ঘেঁষে রেখেছিল একদম সোজাসুজি। রনোর গায়ে তখন বাপ্পাদা। দিশারী সঙ্ঘের হাট্টখাট্টা স্টপার। বাপ্পাদার খেলার ভক্ত ছিল পিলু-রনোরা অনেক আগে থেকেই। বলটা বাপ্পাদার পায়ের দিকেই যাচ্ছিল, বাঁ পাটা তুলেওছিল ও বলটা ক্লিয়ার করার জন্য। এক ঝটকায় নিজের বাঁ পাটা বাপ্পাদার পা-জোড়ার সামনে নিয়ে ফেলেছিল রনো যাতে বাপ্পাদা ক্লিয়ারটা না করতে পারে। ওই যে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ থমকাল বাপ্পাদা, ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ডান পায়ের গোড়ালির ওপর গোটা শরীরটার ভর রেখে পুরো শরীরটা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিতে পেরেছিল ও। ঠিক যেমন বৃত্ত আঁকা শিখিয়েছিল সুমিত স্যার। পেন্সিল কম্পাসের কাঁটাটার ওপর ভর রেখে পেন্সিলটাকে ঘুরিয়ে দিতে হবে কাগজের ওপর। বলটা ততক্ষণে বাপ্পাদাকে টপকে চলে এসেছে ঘুরে যাওয়া রনোর বাঁ পায়ের সামনে। পাশে ভ্যাবাচাকা বাপ্পাদা, সামনে বিপদ বুঝে দু-পা এগিয়ে আসা অলোক, দিশারী সঙ্ঘের গোলকিপার। শরীরটাকে হাল্কা ডানদিকে ঝুঁকিয়ে বাঁ পাটা তুলেছিল রনো, ওই ঝোঁকটাই বিপজ্জনক, অলোকও বাঁদিকে একটু হেলে গেছিল ওই ঝোঁকটা খেয়াল করে। আর সেই হেলে যাওয়া অবস্থাতেই শট না নিয়ে ওর ডানদিক দিয়ে বাঁ পায়ে একটা জোরালো পুশ করে রনো দেখেছিল বলটা জড়িয়ে যাচ্ছে জালে…
ছবির মতো মনে আছে রনোর গোটা ঘটনাটা এখনও। মাঝেমাঝেই ভুস করে ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ওই তো… পিলুর বাড়ানো বলটা আসছে… বাপ্পাদাকে এক ঝটকায় আড়াল করে টার্ন নিচ্ছে রনো… ওর বাঁ পায়ের পুশটা অলোকের পাশ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে গোলে… পিলু পাশ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে গো-ও-ল বলে… ও পিলুর দিকে দৌড়তে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে সিধু এসে ঝাঁপিয়ে উঠছে ওর ঘাড়ে, তারপরই রাজা… ওদের ধাক্কায় পড়ে যেতে যেতে একবার আড়চোখে বাপ্পাদার দিকে তাকাচ্ছে রনো, কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে… স-ব-টা— যখনতখন। স্কুলে তরুণ স্যারের ক্লাসের ভেতর, বাড়িতে বাবার বকুনি খাওয়ার সময়ে, পাড়ার কালীপুজোর চাঁদা তুলতে তুলতে, মাঠে বাপ্পাদার পাশে দাঁড়িয়ে ডিফেন্স করার সময়ে…
ওটাই শেষ গোল এখনও অব্দি। তারপর থেকে এই দু-বছরে রনো আর একটা গোলও দেয়নি।
—তোকে ডিফেন্সে খেলতে বলছে?
—হুঁ… সেন্ট্রাল ডিফেন্সে… বাপ্পাদার পাশে…
—কেন? বলছে কিছু সুধীনদা?
—আমাকে সরাসরি কিছু বলেনি। খালি বলল, তোকে আমি ডিফেন্সে খেলাব বুঝলি? ওইদিন আমাদের চাপের মুখে তুই নেমে এসে যেভাবে খেলছিলি… ভেরি গুড। ওটাই তোর আসল জায়গা…
—যাঃ শালা… সেদিন তাহলে তোর নেমে আসাটাই কাল হল!…
ওদের কথা হচ্ছিল ক্লাবের বাইরের বেঞ্চটায় বসে, খেলাটার তিন দিন পর। সন্ধে নেমেছিল। ক্লাবের ভেতরে ক্যারাম খেলা চলছিল, তাস পিটছিল এক কোনায় বসে এক দল, টিভিটা চলছিল গাঁক গাঁক করে। পেছনে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে দমদম-বনগাঁ রেললাইন। ওই লাইনের ধারে ধারে গাঁজা-চোলাইয়ের ছোট ছোট আসরও বসে গেছিল নিয়ম মেনে। ওদের ক্লাবের সামনে দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে পচা খালটার পাশ দিয়ে বস্তির ভেতর দিকে। ওই রাস্তাটা থেকেই ঠিক ক্লাবের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা কেটে বেরিয়ে রেললাইনের তলায় একটা ছোট টানেলের মধ্যে দিয়ে ঢুকে গেছে পূর্বসিঁথি, ওখান থেকে দিশারী সঙ্ঘের মাঠটা ঠিক তিন মিনিট দূরে। আর মূল রাস্তাটা খালটার উল্টোদিকে আরেকটু এগিয়ে একটা বাঁক নিয়ে চলে গেছে সামনে, বাঁদিকে পড়ে থাকে একটা পরিত্যক্ত রেলকোয়ার্টার, তার সামনে একটা মাঠ, যে-মাঠ বল পিটতে শিখিয়েছে রনো-পিলুদের। ডানদিকে-বাঁদিকে ঘিঞ্জি বসতি, কিছু ছোট ছোট দোকানপাট। রাস্তাটা গিয়ে একটু পর দুভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একটা ভাগ ডানদিক ঘুরে চলে যাবে মূল বেদিয়াপাড়ার ভেতর, বাঁকের মুখটায় দত্তনগর মেন্টাল হোম, জনভাষ্যে পাগলা গারদ। আর একটা ভাগ সোজা এগিয়ে যাবে আরেকটা রেললাইনকে মাথার ওপর রেখে। এ-টানেলটা অনেক বড়সড়, গাড়িঘোড়া যায়। ওপরের রেললাইনটা দমদম থেকে বেরোনো মেন লাইন আর ডানকুনি লাইন, যে দুটো ভাগ হয়ে যাবে আরেকটু পরে গিয়ে। টানেলটা পার হলেই ৩০এ বাসস্ট্যান্ড। এই দুটো রেললাইনের মধ্যের বস্তিটাই রনো-পিলুদের পাড়া।
—কিন্তু তুই যাবি না প্র্যাকটিস করতে? কথা ঘুরিয়েছিল রনো। পিলুকেও তো ডেকেছে দিশারী, সুধীনদা।
—কী করে যাব? জানিস তো অবস্থা। আমি কাজে না গেলে চলবে না। আর কাজ থেকে ওরকম বিকেলে বেরিয়ে আসা সম্ভব না। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিল— আমার ওই একটু ছুটিছাটা থাকলে কোয়ার্টারের মাঠে খেলা, এদিক-ওদিক যদি ম্যাচ-ট্যাচ থাকে… খেলা, ও-ই হবে। রেগুলার প্র্যাকটিস করে ফুটবলার হওয়া… ওসব হবে না… হেসেছিল পিলু।
রনো জানত সবই। তাও যে কেন জিজ্ঞেস করেছিল! পিলুর বাবা নেই। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। বাড়িতে একটা বোন আছে, আর ঠাকুমা। পিলু সেভেনে উঠে আর পড়েনি। কয়েক বছর হল বিটি রোডের ওখানে একটা গ্যারেজে কাজ করছে। বোনটা স্কুলে পড়ে। পিলুর পক্ষে সত্যি কাজ ছেড়ে ফুটবল খেলা সম্ভব নয়।
রনোদেরও অবস্থা কমবেশি একইরকম। তফাত শুধু ওই— রনোর বাবা আছে। সংসারের ঝড়ঝাপটা আপাতত সেই লোকটাই সামলে যাচ্ছে। ইলেকট্রিকের কাজ করে দীনবন্ধু, রনোর বাবা। বাপের সঙ্গে মিলিয়েই ওর নাম রণবন্ধু। মানেটা রনো জেনেছে স্কুলে গিয়ে, বাংলার সুমন স্যারের কাছে— যুদ্ধের বন্ধু! কোনও মানে হয়! ডাকনামটাও মেলানো— দিনো আর রনো। যাই হোক, দীনবন্ধুর কনট্রাক্ট নিয়ে কাজ। রনোকেও কখনও-সখনও নিয়ে যায় স্কুল ছুটিছাটা থাকলে, কিছু কিছু কাজ ও শিখেও গেছে। রনোর মাও মেশিনে ব্লাউজ সেলাই করে। এই দুয়ে মিলিয়ে তিনজনের সংসার চলে যায় মন্দ না। দিদি ছিল রনোর একটা। বিয়ে দিয়ে দেওয়া গেছে তাকে। নিশ্চিন্ত, অতএব।
কিন্তু সমস্যা সে সব নয়। সমস্যা হচ্ছে গোল। সমস্যা হচ্ছে চোখের সামনে ভুকুত-ভাকাত ভেসে ওঠা ওর ওই শেষ গোলটার ছায়াছবি। এই যে এখন সকাল নটা বেজে চল্লিশ মিনিট, সূর্যটা খাঙ্গার হয়ে জ্বলছে মাথার ওপর— দিশারী সঙ্ঘের রোজ সকালের প্র্যাকটিস শেষ করে সুধীনদা, তারপর দেবাদার ভাষণ শুনে, কলা-ডিম খেয়ে, বাপ্পাদার সঙ্গে গল্প করতে করতে ওদের টানেলের মুখটা অব্দি আসার পর বাপ্পাদাকে ছেড়ে দিয়ে ও সেঁধিয়ে গেল টানেলের নিচে বাড়ি যাওয়ার জন্য, আর সঙ্গে সঙ্গে চলে এল সেই সিনেমাটা। সিনেমাই তো— রনোর মনে হয় এখন। বাস্তবে বোধহয় ঘটেনি কোনওদিনও।
সামনে একটা বড় খেলা আছে দিশারীর। সুধীনদা বলল আজ। তারপর দেবাদাও। রনোর ওপর নাকি অনেক দায়িত্ব। ওর আর বাপ্পাদার ওপর। গোল খাওয়া চলবে না। বাপ্পাদা আর রনোই তো দিশারীর স্টপার জুড়ি দু-বছর ধরে। টানেল পেরিয়ে সেই খাঙ্গার সূর্যটার সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাওয়ার সময় রনোর মনে পড়ল গোলটার পর দু-বছর কেটে গেল।
—সুধীনবুড়োর ভীমরতি ধরেছে…
দিশারীতে দ্বিতীয়দিন প্র্যাকটিস সেরে ফেরার পথে বাপ্পাদা বাইক নিয়ে ওর পাশে এসে স্লো করেছিল। বলেছিল, উঠে আয়… নামিয়ে দেব।
—আরে ধুর… এ কয়টুকু আর রাস্তা…
—সেটা ঠিক… আচ্ছা ঠিক আছে, আজ তো আয়। কাল থেকে নয় সাইকেল নিয়ে আসব। বাইক হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে বেশ কষ্ট… হেসেছিল বাপ্পাদা।
একটু থতমত খেয়ে বাইকে চাপতে চাপতে রনো জিজ্ঞেস করেছিল—
—সাইকেল আনবে! কেন?
—তাহলে এই টানেল অব্দি তোর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যাবে। তারপর আমি সাইকেল চালিয়ে চলে যাব…
রনো তখনও বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর সঙ্গে এইটুকু হাঁটাটা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ যে বাপ্পাদা বাইকে না বাড়ি গিয়ে পুরো রাস্তাটা সাইকেলে প্যাডেল মারার কষ্ট করবে! ও জানে বাপ্পাদার বাড়ি মধুগড়ের ভেতরে। পূর্বসিঁথির যে-প্রান্তে দিশারীর মাঠ, মধুগড়-ঘোষপাড়া-খালপাড় এসব জায়গাগুলো তার উল্টো প্রান্তে। খুব দূর না হলেও সাইকেলে মিনিট কুড়ি তো লাগবেই। প্র্যাকটিসে খাটান দেওয়ার পর রোদের মধ্যে আবার এতটা কষ্ট করবে কেন লোকটা! আর শুধু ফেরা-ই তো না, বাপ্পাদাকে আসতেও হবে তো সাইকেল চালিয়ে।
ততক্ষণে ওরা চলে এসেছিল টানেলের মুখের বস্তিটার সামনে। বাপ্পাদা বাইক থামাতে নেমে এসেছিল রনো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁধে ডানহাতটা রেখে বাপ্পাদা হেসে বলেছিল—
—শুনলি না তুই আর আমি এখন পার্টনার? পার্টনারশিপ শুধু প্র্যাকটিসে হয় না বস। কথা বলতে হয়, একে অন্যের মনের খোঁজখবর রাখতে হয়। তবেই না মাঠে আমি একটু পেছনে গেলেই তুই বুঝে যাবি যে তোকে একটু সামনে যেতে হবে!
এরকম কথা কখনও শোনেনি রনো। ওর তখনই মনে হয়েছিল পিলুর সঙ্গে ওর এই যে মাঠে এত জমে, ঠিকই, সেটা ওরা দুজন দুজনকে হাতের তালুর মতো চেনে বলেই। এরকম বলেকয়ে তৈরি হয়নি সে-চেনা, জন্ম থেকে হয়ে গেছে, কিন্তু চেনাই তো। বাপ্পাদা যাকে বলছে মনের খবর রাখা।
বাপ্পাদা আবার বলেছিল—
—ভালই হল। বাইকটা কেনার পর থেকে কোথাও যেতে গেলেই বাইকই বের করা হয়। রোজ এটুকু সাইকেল চালালে কিছুটা ব্যায়ামও হয়ে যাবে…
আর তারপরই বলেছিল ওই কথাটা—
—সুধীনবুড়োর ভীমরতি ধরেছে…। নইলে তোর এইরকম টার্ন, বডিফেইন্ট, দুপায়ে শট, হেড… এইরকম জাত-স্ট্রাইকারকে কেউ স্টপারে খেলায়!
স্বগতোক্তির ঢঙেই কথাগুলো বলে তারপর আবার যেন ঘোর ভেঙে রনোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল—
—যাকগে, সেসব ভেবে আর এখন লাভ নেই। এখন তুমি-আমি পার্টনার। চল… যাই… কাল দেখা হচ্ছে…
বাপ্পাদার বাইক ঘোরানো অব্দি ওখানেই দাঁড়িয়েছিল রনো। স্টার্ট দিয়ে বাইক ঘুরিয়ে বাপ্পাদা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে—
—আসিস কিন্তু। দিশারী ছাড়িস না…
ছাড়ার কথা ভেবেছিল রনো। বেশ গভীরভাবেই ভেবেছিল। সুধীনদা যে ওকে স্টপারেই খেলাবে সেটা বুঝে গেছিল রনো। আর স্টপার থেকে ও গোল করবে কীভাবে! হয় না, তা নয়— কিন্তু সেটা স্টপারের কাজ নয়। স্টপারের কাজ— গোল বাঁচানো— গোল হতে না-দেওয়া। কিন্তু ওর যে গোল করতেই আনন্দ। বলটা যখন ওর পা বা মাথা থেকে ছিটকে বেরিয়ে জালের মধ্যে জড়িয়ে যায়— যেমনটা, ও দেখেছে দুপুরবেলা ওদের বাড়ির পেছনের ঝিলপাড়ে হাঁসগুলো ঘাড় বেঁকিয়ে ডানার মধ্যে মুখটা ডুবিয়ে দেয় কী আরামে, ঠিক সেরকম— তখন ওর সারা গা যেন শিউরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অদ্ভুত একটা তৃপ্তি হয়… উত্তেজনা হয়। সেই অনুভূতিটা আর কখনও আসবে না ওর জীবনে?
কিন্তু ছাড়া হয়নি। আসলে ও দিশারীতে চান্স পেয়েছে খবরটা যেন ওদের গোটা পাড়ার জন্যই একটা সুখবর। এমন একটা খবর— যেটা ওদের পাড়ার গোঁত্তা খাওয়া মানুষগুলোর জীবনে একদমই স্বাভাবিক নয়। রনোর বয়সি একটা ছেলে কী করবে সাধারণভাবে? পড়াশোনাটা ছাড়বে— স্কুলে যাওয়া বন্ধ করবে, তারপর কোথাও কোনও কাজকামে ঢুকবে, বা মদগাঁজা ধরবে— সেই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকবে নিত্যদিন, বা এলাকার কোনও মস্তানের কাছে নাড়া বাঁধবে— মারামারি, পিটোপিটি, একে চমকানো, ওকে চমকানো, আর নয়তো খুব জোর হলে কোনও মেয়েকে নিয়ে ভাগবে— কোনও মন্দিরে বিয়েটিয়ে করে ছ-মাস কি এক বছর পর বৌ নিয়ে ফিরে আসবে বাড়িতে অপরাধীর মতো। ব্যতিক্রম হলে কী হবে?— পড়াশোনাটা ছাড়বে না। স্কুলে পাশ-টাশ দিয়ে কলেজেও যাবে হয়তো। যেমন অজিতদা যায় ওদের পাড়ার। খাতিরও পায় পাড়ায় ভালই। কিন্তু একটা ছেলে ফুটবল খেলছে, তাও আবার দিশারীতে, বেদিয়াপাড়ার রেলবস্তিতে এটা একটা খবর বইকি! সন্ধের পর কোয়ার্টারের পাশের রাস্তার ধারে পাড়ার বয়স্ক লোকেরা যে দাবার বোর্ড সাজিয়ে বসে, দীনবন্ধু সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে প্রতিদিন অন্তত গড়ে তিন-চারজন তো তার কাছ থেকে রনোর খেলার খোঁজ নেবে। বলবে— ছেলেটার খেলা ছাড়াস না যেন দিনো। খেলতে দে… কিছু দরকার লাগলে বলিস। রনো যখনই পাড়ার কোনও কাকা-জ্যাঠার সামনে পড়ে যাবে, সে ওর খেলার খোঁজ নেবেই নেবে। বলবে, মন দিয়ে প্র্যাকটিস কর বাবা। দিশারীতে গেছিস, ওখান থেকে অনেক প্লেয়ার উঠেছে। রনো খেয়াল করে দেখেছে, আগে খেলতে-টেলতে গিয়ে সন্ধে পার করে বাড়ি ফিরলে বাবা চেঁচামেচি করত। কিন্তু দিশারীতে যাওয়ার পর থেকে খেলা নিয়ে আর কোনও শব্দই করে না। এমনকি, পিলুও একদিন বলছিল, তুই খেললেই আমার খেলা। তুই কিন্তু খেলাটা চালিয়ে যা রনো। এইরকম একটা অবস্থায় দিশারীতে যাওয়া বন্ধ করা যায়!
কিন্তু ওই একটাই ঝামেলা— গোলটার কী হবে?
বাপ্পাদাকে রনো জিজ্ঞেস করেছিল একদিন। ততদিনে বাপ্পাদার সাইকেল নিয়ে আসা আর প্র্যাকটিসের পর দুজনে মিলে আটভাট গ্যাজাতে গ্যাজাতে টানেলের মুখ অব্দি আসাটা অভ্যেস হয়ে গেছে। সেদিন নিজের কথা বলছিল বাপ্পাদা। বাবা কাজ করত জেশপে। বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কখনও রঙের কাজ, কখনও বাজারে মাছ বিক্রি, এসব করে ওদের বড় করেছে। ওদের মানে বাপ্পাদা আর বাপ্পাদার দিদি। বাপ্পাদা হায়ার সেকেন্ডারির পর মতিঝিল কমার্স কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পর আর যায়নি। আসলে দিদির বিয়ে দিতে বাবার পুঁজিপাটা বেলেঘাটা হয়ে গেছিল। তারপর আর বাপ্পাদাকে পড়ানোর খরচ টানতে পারত না। বাপ্পাদা পারত, কিছু টিউশন-ফিউশন করে পড়ার খরচটা চালিয়ে নিতে। ফুটবলটা তো ভালই খেলে। তাতে খেপ খেলে টুকটাক রোজগার খারাপ হত না, এখনও হয় না। কিন্তু ছেলে পড়াতে বাপ্পাদার ভাল লাগে না। খুব যে পড়াশোনায় ভাল ছিল তাও তো নয়। তাই পড়েনি আর। তবে দিদির বিয়েটা ভাল হয়েছে। জামাইবাবু প্রোমোটিং করে। প্রেম করেই বিয়ে, তাও একটা মেয়ের বিয়েতে খরচ তো হয়। বাপ্পাদাকে এখন ওর জামাইবাবুই নিজের সঙ্গে কাজে টেনে নিয়েছে। সাইটে দেখাশোনা করে, পয়সাকড়িও দেয় ভালই। বাইকটাও জামাইবাবুই কিনে দিয়েছে। আমার শালা হয়ে সাইটে যাবি দেখভাল করতে, সাইকেল নিয়ে গেলে লেবাররা পাত্তা দেবে না— বলেছিল। এইসবই বলছিল বাপ্পাদা।
তখনই জিজ্ঞেস করেছিল রনো— হুট করেই— বাপ্পাদার আত্মসংলাপের ফ্লো-টাকে একটু থমকে দিয়েই যেন—
—আমাকে স্টপারে খেলাচ্ছে কেন… জানো তুমি কিছু?
থমকেইছিল একটু বাপ্পাদা। সময় নিয়েছিল অল্প। তাকিয়েছিল চারদিকে একবার। খালপাড় বস্তিতে তখন জীবনের তুমুল স্রোত। বস্তির একটাই টিউবওয়েলপাড় মহিলা-পুরুষে জমজমাট। কেউ চান করছে, কেউ মাছ, কেউ আলু ধুচ্ছে, রাস্তাটার মধ্যে কলকল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কটা বাচ্চা, দুটো চ্যাংড়া খালের ওপরের কালভার্টে বসে মোবাইল ঘাঁটছে আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। বাপ্পাদা এসব দেখেনি মনে হয়। চোখটা বুলিয়েছিল খালি।
—দ্যাখ… আমাকে তো ওরকম বলে না কিছু… তবে হ্যাঁ, তোর কথাটা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম… আসলে একটা চান্স পেয়ে গেছিলাম জিজ্ঞেস করার…
একটু থেমে বাপ্পাদা দেখেছিল রনো জ্বলজ্বলে মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। উইং যখন হা হা করে বল নিয়ে দৌড়য় তখন স্ট্রাইকার বক্সের ভেতর জায়গা নিতে নিতে যেরকম মুখে বলটার দিকে তাকিয়ে থাকে, রনোর মুখটা অবিকল সেইরকম লাগছে তখন। গল্পটা শুনতে চায় ও।
—সুধীনদা সেদিন টিম করে খেলার সময় আমাকে তুলে নিয়ে কথা বলছিল, খেয়াল করেছিস বোধহয় তুই। তোকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। আমাকে বলছিল, তোকে একটু গড়েপিটে নিতে ভাল করে, তোর সঙ্গে জুটিটা ভাল করে তৈরি করতে… এইসব। তা তখনই আমি জিগালাম, আচ্ছা রনোকে হঠাৎ স্টপার বানাতে চাইছেন কেন আপনি? ও তো জাত-স্ট্রাইকার…। তা সুধীনদা একটু তাকিয়ে থেকে একটা অদ্ভুত কথা বলল, জানিস! বলে, ও তুই বুঝবি না। আমাদের দেশে গরিব ঘরের ছেলেদের ডিফেন্স করাটা ইনস্টিঙ্কট। ওটা আপনা থেকেই আসে। রনো একদিন অনেক বড় ডিফেন্ডার হবে, আমার কথা মিলিয়ে নিস…
অদ্ভুত মানে!! আগামাথা কিছুই বোঝে না রনো।
—গরিব বলে ডিফেন্সে খেলব!
—আরে আমিও তো ভেবলে গেছিলাম শুনে। পাশে দেবাদা বসেছিল। হেসে বলল, ওরে ওসব বুঝবি না। তোদের সুধীনদা ফুটবল কোচ হলেও রাজনীতিও করত তো। ওটুকুই। দেবাদাকে এমনি তো জানিস। খেলা নিয়ে সুধীনদার কাজে নাক গলাবে না…
—কিন্তু… ঘোর থেকে তখনও বেরোতে পারেনি রনো।
—পরে ভাবছিলাম রনো, জানিস। আমিও তো গরিব ঘরেরই ছেলে। তোর আগে লাল্টু স্টপারে খেলত আমার সঙ্গে, ও-ও তাই। আসত লালবাগান থেকে। সুধীনদার বোধহয় এটাই স্টাইল।
—হুঁ… আর অনি, শুভ্র ওদের সবারই অবস্থা ভাল… ঠিক বাপ্পাদাকে না, আনমনেই বলেছিল রনো।
ঘোরটা এখনও কাটেনি রনোর। এই এতদিন— প্রায় দু-বছর পরেও। ও বুঝেই উঠতে পারে না গরিব হওয়ার সঙ্গে ডিফেন্সে খেলার কী সম্পর্ক। ফুটবলেরই বা কী সম্পর্ক। হ্যাঁ, খেলার জন্য জার্সি বুট এসব কেনাকাটির খরচ আছে, সেই হিসেবে একটা সম্পর্ক আছে বটে। যে-কারণে পিলুটা খেলতে পারছে না সেভাবে। কিন্তু সে তো মাঠে নামার আগে। মাঠে নেমে পড়ার পর তো তোমরাও এগারোজন, আমরাও এগারো। তোমারও দুটো ঠ্যাং, আমারও। সেখানে কে গরিব, কে বড়লোক— তা দিয়ে কী হবে! এই যে ওদের দিশারীর টিমের আপফ্রন্টে খেলে অনি, শুভ্র… ওদের সঙ্গে রনোর যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক। বাপ্পাদার মতো হয়তো নয়, কিন্তু বেশ ভাল। মাঝেমধ্যে ফোনাফুনিও হয়। পুজোর সময়ে ওরা আসে একদিন এদিকে, রনোকে ডেকে নেয়, একসঙ্গে ঘোরাঘুরিও হয়। অবশ্য রনো নিজে কোনওদিন উদ্যোগ নেয়নি সত্যি। মানে নিজের থেকে ফোন করা, বা ওদের ওদিকে কখনও গেলে ওদের ডাকা— এইসব। এগুলো শুভ্ররাই করে। ওর একটু জড়তা কাজ করে নিজের থেকে এগুলো করতে। হ্যাঁ, সেটার কারণ— রনো বোঝে— ওদের আর্থিক অবস্থার ফারাকের কারণেই। কিন্তু কথাটা হচ্ছে এগুলো সবই তো— ওই— মাঠের বাইরের ব্যাপার। মাঠে কে গরিব, কে বড়লোক, তারও ওপরে গরিব বলে ডিফেন্ডার, আর পয়সা থাকলে অ্যাটাকার— এ কেমন হিসেব! তার ওপর দেবাদা ওই যে বলেছিল— সুধীনদা রাজনীতি করে— এর সঙ্গে আবার রাজনীতিরও যোগ আছে? মাথা ভোঁ ভোঁ করে রনোর।
রনোর বাবা— দীনবন্ধু— রাজনীতি করত। মানে, এখনও করে। আসলে দীনবন্ধুদের দল আগে ক্ষমতায় ছিল। তাই তখন রাজনীতির কাজে দীনবন্ধুর দৌড়াদৌড়িও ছিল বিস্তর। এখন সেসব অনেক কম। তাই, প্রথম ধাক্কায় মুখ দিয়ে রাজনীতি করত-টাই বেরিয়ে পড়ে অজান্তে। এখনও কোনও ভোটের আগে দীনবন্ধু পাড়ায় ঘোরে, পোস্টার লাগায়, পার্টির কোনও মিছিল-মিটিং থাকলে যায়। কিন্তু সঙ্গে থাকে হাতেগোনা কটা লোক। সেই জহরকাকা, বুলুকাকা… ওই। আর যেদিন ভোটের রেজাল্ট বেরোয়, দীনবন্ধু ঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে সারাদিন। পাড়ায় যারা উল্টো দল করে— আগে থেকেই করত, বা জমানা বদলানোর পর ভিড়েছে— এরকম সবাই জানে, ওদিন দীনবন্ধু ঘর থেকে বেরোবে না। এমনিতে সমস্যা কিছু হয় না। দীনবন্ধুর সঙ্গে যাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তারা কখনও হয়তো তার এই রাজনীতি করা নিয়ে একটু হাসিঠাট্টা করে, কিন্তু মোটের ওপর সবাই একটা শ্রদ্ধাই করে লোকটাকে। বোঝে রনো। ওদের এলাকার এখনকার যে কাউন্সিলর সে মাঝেসাঝে চেষ্টা করেছে রনোকে নিজেদের দিকে ভেড়াবার। কিন্তু ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এক তো দীনবন্ধুর ওরকম গোঁড়া ইমেজ, আর দুই ফুটবল। বিশেষ করে, দিশারী। দিশারীতে চান্স পাওয়ার পর থেকেই সবাই ওকে মন দিয়ে খেলতে দিতে চায়। সবাই যেন বলতে চায়— বাবা, এটাই তোমার কাজ।
রনো অনেকবার ভেবেছে বাবাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবে নাকি। রাজনীতির ব্যাপার যখন— বাবা জানতেও পারে। কিন্তু করেনি। এমনিতে বাবার সঙ্গে খেলা-টেলা নিয়ে কখনওই কথা হয়নি। আবার তার ওপর এমন একটা ব্যাপার যে কী জিজ্ঞেস করবে সেটাই ও ভাল করে জানে না। আর করেই বা কী হবে? সুধীনদা তো সুধীনদার মতোই চলবে। রনো ওর বাবার থেকে কথাটার মানে বুঝে নিয়েছে বলে তো আর ওকে স্ট্রাইকারে খেলাতে শুরু করবে না।
সুধীনদা ঘাউড়া লোক। টিমের ব্যাপারে যা ঠিক করবে, সেটাই করবে। দিশারীতে এ নিয়ে কেউ কিছু ঘাঁটায় না। আড়ালে আবডালে কিছু ফিসফাস, কিছু বিষোদ্গার, কিছু হাসিঠাট্টা সবই হয়, কিন্তু এগুলো সবই গ্যালারির দর্শকদের মতো। মাঠে ঢুকতে পারে না। মাঠে ওই টাকমাথা কাঁচাপাকা ঝোলা দাড়িওয়ালা সুধীনবুড়োই শেষ কথা।
—সুধীনদাকে আরও কেউ ঘাঁটায় না দেবাদার জন্য। বলছিল একদিন বাপ্পাদা। আসলে দেবাদাদের দল ক্ষমতায় আসার পর সবাই ভেবেছিল দিশারীতে এবার সুধীনদার জমানা শেষ হল। কিন্তু দেবাদা অদ্ভুতভাবে সেসব দিকেই যায়নি। দেখিস তো এখনও… মাঠে আসে, প্র্যাকটিস দেখে, টিমের ব্যাপারে আছেও পুরো… কিন্তু ফুটবল টিমের টেকনিকাল ব্যাপার নিয়ে সুধীনদাকে ফুল হ্যান্ড দিয়ে রেখেছে…
—দেবাদাও তো বোধহয় সুধীনদার কাছে খেলেছে, না?
—হ্যাঁ… দেবাদা রাজনীতি-মাজনীতি করলেও খেলাধূলা ভালবাসে। খেলতও একসময় আগে। শুনেছি ভালই খেলত। তবে দেবাদার সঙ্গে পলিটিক্স হয়েছিল শুনেছি। এই দিশারীতেই। দেবাদা আসলে ইয়ং বয়স থেকেই রাজনীতি করে। সুধীনদাদের বিরোধী পার্টি। আর সুধীনদাদের জমানা তখন। দেবাদা নাকি তখন খেলার সময় ভালই আওয়াজ-ফাওয়াজ খেত। আরও কিছু কিছু ব্যাপার হয়ে থাকবে, আমি অত ভাল জানি না। সেজন্যই সবাই ভেবেছিল পাওয়ারে আসার পর দেবাদা দিশারীর কন্ট্রোল তো নেবেই, সঙ্গে সুধীনদাদের সবাইকে তাড়াবে। শুধু যে দেবাদাদের দল পাওয়ারে এসেছে তাই তো নয়, দেবাদা নিজেও তো কাউন্সিলর। কিন্তু দেবাদা সেসব করল না। দিশারীর কন্ট্রোল নিল, কিন্তু ফুটবল টিমকে ডিস্টার্ব করল না, সুধীনদাকেও না। পলিটিক্সটা ভালই বোঝে দেবাদা…
বাপ্পা যেটা জানে না, বা জানলেও অত ভেঙে বলেনি রনোর কাছে, সেটা হল দেবাকে দিশারী থেকে একসময় প্রায় তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছিল বলা যায়। দেবা তখন খেলে, ভালই খেলে, দিশারীর ফার্স্ট টিমের সেন্ট্রাল মিডিও, ছোটখাটো চেহারা নিয়ে পুরো খেলা কন্ট্রোল করতে পারত। তখন বাংলায় সুধীনদের পার্টির একচেটিয়া জমানা। সুধীনের নিজের ভাই পূর্বসিঁথি এলাকার তো বটেই, দক্ষিণ দমদমেরও দাপুটে নেতা, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা কমিটিরও মেম্বার ছিল। দিশারী তখন সুধীনের একরকম জায়গিরদারি। তবে লোকটা ফুটবলের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না। ওই সময়ে তো পার্টির কল্যাণে সুধীনের সল্টলেক স্টেডিয়ামেও অবাধ গতি, ফ্রেন্ডস অফ দ্য স্টেডিয়ামের মেম্বার হিসেবে স্টেডিয়ামে একটা ঘরও ছিল ওর। তা দেবা করত উল্টো পার্টি, ছোট থেকেই, বোধহয় বংশগত সূত্রে পাওয়া। আর বেশ সক্রিয়ভাবেই করত। সে নিয়ে পাড়াতেও যেমন টুকটাক আওয়াজ খেত, দিশারীতেও। আওয়াজই, তার বেশি, মানে ধমকচমক নয়। হয়তো ভোট-টোটের আগে কেউ বলল বেশি লাফালাফি করিস না— ওটুকুই। আসলে ওদের তখন শক্তি এতটাই কম যে ক্ষমতায় থাকা দল এদের বেশি পাত্তা দিতেই চাইত না। তা একদিন প্র্যাকটিসের পর বেরোচ্ছে দেবা, দিশারীর মূল ক্লাবঘরটা, যেটা দেবারা ক্ষমতায় আসার পর এখন বড় বিল্ডিং হয়েছে, জিম-টিম করা হয়েছে ভেতরে, তার সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল পাড়ার কিছু ছেলে। এরা অবধারিতই শাসক পার্টির ছেলেপুলে বা লোকজন, এখনও দেয়, এখন দেবাদের পার্টির ছেলেপুলে বা লোকজন। মজাটা হচ্ছে, এদের মধ্যে দু-একটা মুখ কিন্তু পাল্টায়নি। আনুগত্য বদলে নিলে মুখ বদলানোর দরকার হয় না। তো সেই আড্ডার মধ্যেই একজন দেবাকে যেতে দেখে বলে উঠেছিল, ওই দ্যাখ নেতা যাচ্ছে, উঠে স্যালুট কর রে সবাই। দেবা না তাকিয়েই বলেছিল, হ্যাঁ প্র্যাকটিস করে রাখো। একদিন না একদিন তো করতেই হবে। এতটা ঔদ্ধত্য সহ্য হয়নি ওদের। একজন চেয়ার থেকে উঠে এসে ওর সামনে এসে ঠান্ডা গলায় বলেছিল—
—যে যা বলবে মাথা নিচু করে শুনে চলে যাবি। মুখের ওপর কথা যেন এখানে আর না শুনি…
দেবা ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে শুনেছিল পুরো বাক্যটা। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল মাঠের ধারে বেঞ্চে বসে থাকা সুধীনদার দিকে একবার, আর দিশারীর মাঠটার দিকে একবার। তারপর আবার ওর চোখে চোখ রেখে বলেছিল—
—যদি সেটা না পারি, তাহলে? এখানে আসতে বারণ করছ?
—হ্যাঁ, বারণ করছি। আসবি না। তোর মতো প্লেয়ার দিশারীতে অনেক এসেছে, আরও আসবে। কিন্তু আমাদের মুখের ওপর কথা বলা যাবে না, এটা মানতে হবে।
ওই ছেলেটা বলেনি এটা। দেবার কথা শুনে সে কথা বলবে, না একটা চড় মারবে, সে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছিল সম্ভবত। মুখটা লাল হয়ে উঠছেল অস্বাভাবিক, কিন্তু কথা আসছিল না। যে ছেলেটা প্রথম আওয়াজটা দিয়েছিল সে উঠে এসে কথাগুলো বলেছিল তখন দেবার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে তখন পূর্বসিঁথির পার্টির যুব সংগঠনের সেক্রেটারি।
—আচ্ছা বেশ। দেবা আরেকবার ঘুরে তাকিয়েছিল সুধীনদার দিকে। সুধীনদা তখন দেবাদের পরে যে বাচ্চাগুলো আসে প্র্যাকটিস করতে তাদের দিকে উঠে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকায়নি এদিকে।
দেবা বেরিয়ে গেছিল দিশারী থেকে। ঢুকেছিল একেবারে কাউন্সিলর হয়ে।
সেদিনের ঘটনাটায় শোনা যায় পার্টি বিরক্ত হয়েছিল। লোকাল পার্টি। রথীনের ভাই সেই যুব-সেক্রেটারি ছেলেটাকে কিছু বকাবকিও করেছিল নাকি। কিন্তু বিষয়টা এতটাই খুচরো ছিল, যে তার বেশি আর কিছু হওয়ার ছিল না, হয়ওনি।
হয়েছিল পরে। মানে দেবারা ক্ষমতায় আসার পর। সেই যুব সেক্রেটারি ছেলেটার বডি পাওয়া গেছিল একদিন বাগজোলা খালে। পুলিশ বলেছিল, অ্যাক্সিডেন্ট। আর তার দোসর সেদিনের সেই ছেলেটা, যে এখন মধ্যবয়সি লোক একটা, সন্ধের পর এই দিশারীতেই বসে এসে। দেবাদের পার্টির টুকটাক কাজকর্ম করে।
টানেল দিয়ে বেরিয়ে গলির বাঁকটা ঘুরে ক্লাবের সামনে এসে পিলুকে দেখতে পেল রনো।
—কি রে, ছুটি নাকি আজ?
—উঁউহ্… ছুটি! বেঞ্চ থেকে নামতে নামতে মুখটা বিকৃত করে বলল পিলু। যাইনি আজ… বলে রনোর পাশে হাঁটতে শুরু করল।
—কেন? শরীর-টরির খারাপ নাকি?
—না রে… একটু থেমে মুখটাতে আলগোছে একটু হাত বুলিয়ে পিলু বলল— বড্ড খিস্তি করে শালা মালিকটা। ভাল্লাগেনা। মটকা গরম হয়ে যায় মাঝেমাঝেই। কাল রাতে একটু আগে ছুটি করতে চাইতে এমন বিচ্ছিরি গালাগাল দিল মেজাজটা খিঁচড়ে গেল একেবারে…
—কিছু বলিস না কেন?
—কী বলব! বললে পালটা খিস্তি করতে হয়। সে করলে তো কাজটা যাবে…
—আরে কোনও সময় তো নর্মাল মুডে থাকে নিশ্চয়ই। তখন বলবি, আপনি এত মুখখারাপ করবেন না…
—তুই চিনিস না। ওসব বললে আরও বেশি করে খিস্তোবে। একমাত্র রাস্তা হল গায়ে না লাগানো। অন্য মেকানিকরাও এটাই বলে আমাকে। আর কাজটাও তো শিখতে হবে। চেষ্টা করি… কিন্তু মাঝেমাঝে মাথা-ফাতা ঝাঁ ঝাঁ করে। একেক সময়ে তো মনে হয় মালটার বাইকের ব্রেকের তারটা কেটে দেব লুকিয়ে লুকিয়ে। মরুক ফেরার সময়…
—অ্যাই এসব করিস না! রনো যেন একটু আঁতকেই ওঠে। সত্যিই মরে যাবে তো…
—আরে না না… হাসে পিলু। মনে হয়, তা বলে সত্যি সত্যি করব নাকি! বাপ-মার কাছে ক্যালান খাওয়ার সময়ে মনে হত না, দিই একটা পালটা চালিয়ে? সেরকমই। দিতাম না তো…
আবার হাসে পিলু। রনোও। এসব ওদের ছেলেবেলার কমন অনুভূতি। ওদের বাড়ির পেছনের ঝিলটার পাড়ে বসে, বা কোয়ার্টারের মাঠের কোনায় বসে একসময় কত এসব অনুভূতি ভাগাভাগি হয়েছে দুজনের।
—যাকগে, আমার কথা বাদ দে, পিলু বলল, তোর খেলা কেমন চলছে বল…
রনোদের বাড়ির গলির মুখে চলে এসেছিল ততক্ষণে ওরা। ডানদিকে পাগলা গারদের উঁচু পাঁচিল। সামনে বড় টানেল, তার ওপরে শিয়ালদা মেন আর ডানকুনি লাইন। একটা ট্রেন চলে গেল এই সময়েই মেন লাইন দিয়ে সিটি দিতে দিতে। রনোর মনে হল আজ কি স্কুলটা কামাই করবে? পিলুও কাজে যায়নি। অনেকদিন ওর সঙ্গে গল্প করা হয় না।
—এক কাজ কর… আমার সঙ্গে বাড়ি চ… আমি এগুলো ছেড়ে-টেরে নিই, নিজের গায়ের ঘামে ভেজা জার্সির দিকে দেখায় রনো— তারপর বসে আড্ডা মারি…
—স্কুল যাবি না?
—ডুব মারি আজ… তুইও আছিস… একটু হাসে রনো।
পিলুও হাসে। তারপর একটু ভেবে বলে, তাহলে চ তোর বাড়ি যাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নে… তারপর ঝিলপাড়ে আমাদের জায়গাটায় যাই। অনেকদিন যাওয়া হয় না ওখানে…
আজ ওদের খেলা। যুগীপাড়া ইউনাইটেড ক্লাবের সঙ্গে। শূরের মাঠে যে নতুন স্টেডিয়ামটা বানানো হয়েছে, অমল দত্ত ক্রীড়াঙ্গন, সেইখানে। এই খেলাটার কথাই সেদিন প্র্যাকটিসের পর বলেছিল সুধীনদা আর দেবাদা। দিশারী আসলে অনেকদিনের ক্লাব। মানে ক্লাব বললেই এখন যেরকম চোখের সামনে একটা ঘর, তাতে গাঁ গাঁ করে একটা টিভি চলছে, কিছু তাস-ক্যারাম খেলা হচ্ছে, আর কতগুলো ছেলে বসে গুলতানি মারছে যারা আবার জাঁকিয়ে এবং কাঁপিয়ে দুর্গাপুজো কি কালীপুজো করবে— সেরকম একটা ছবি ভেসে ওঠে, দিশারী সেই গোত্রের নয়। দিশারী সঙ্ঘ আক্ষরিক অর্থেই ফুটবলের ক্লাব। সুন্দর বড় মাঠ। বহুদিন ধরেই সেখানে ফুটবল চর্চা হয়। মাঠের পাশে ক্রিকেট প্র্যাকটিসের জন্য দুটো নেট লাগিয়ে কংক্রিটের পিচ করা রয়েছে বটে, কিছু বাচ্চাকাচ্চা ক্রিকেট শেখে, একজন কোচও রয়েছে— কিন্তু ক্রিকেটের স্ট্যাটাসটা দিশারীতে দুয়োরানিরই। তাস-ক্যারাম-টিভি-পুজোপাঠে দিশারী নেই। কোনওদিনই ছিল না। জমানা বদলের পর এখন যেমন উৎসবের আবহ গোটা রাজ্যেই আছড়ে পড়েছে, দমদমে তো বটেই, তখন অনেকেই ভেবেছিল দিশারীতেও নিশ্চয়ই এবার সেসব শুরু হবে। কিন্তু মূলত বোধহয় দেবার জন্যই দিশারী ফুটবলের বাইরে বেরোয়নি। বহু ফুটবলার বেরিয়েছে দিশারী থেকে। কলকাতা ময়দান তো বটেই, তাদের অনেকেই জাতীয় দলেও দাপিয়ে খেলেছে, জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেছে। উত্তর চব্বিশ পরগণা থেকে শুরু করে উত্তর-মধ্য কলকাতা অব্দি যেসব টুর্নামেন্ট-শিল্ড-কাপ ইত্যাদি হয়, দিশারীর অফিসঘরে সে-সবই সাজানো রয়েছে একাধিক করে। কিন্তু এত উজ্জ্বল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও দিশারী কলকাতা লিগে খেলেনি কখনও। দিশারীর সঙ্গে জড়িত মানুষজনের বুকে এই কাঁটাটা একটা ক্ষতের মতোই— পুরনো ক্ষত।
রনোর গোলের ক্ষতটাও ওরকম পুরনো ক্ষত হয়ে যাবে? নাকি হয়েই গেছে অ্যাদ্দিনে? পুরনো ক্ষত কি মানুষ ভালবাসে অবচেতনে? বাঁচিয়ে রাখতে চায়? প্রেমে বিরহের স্মৃতির মতো? নইলে এই যে দু-বছর ও একটাও গোল করেনি, করতে কি পারত না ইচ্ছে থাকলে? এই সময়টাতে দিশারী যতগুলো ম্যাচ খেলেছে টুর্নামেন্ট-প্র্যাকটিস ম্যাচ সব মিলিয়ে সব কটাতেই স্টপার জুড়ি ছিল বাপ্পাদা আর ও। আর সেই ম্যাচগুলোতে বাপ্পাদা অন্তত সাত-আটটা গোল করেছে কর্নার বা ফ্রিকিকের সময়ে উঠে গিয়ে। ফিল্ড মুভের সময়েও উঠে গেছে অনেকবার। যেগুলোর মধ্যে— রনোর বিশ্বাস— চার-পাঁচটা জায়গায় তো বাপ্পাদার জায়গায় ও থাকলে গোল করে আসত। আসলে বাপ্পাদার সেরকম ফিনিশ নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ও কখনওই যায়নি। না ডেডবল সিচুয়েশনে, না কোনও মুভে। এমনকি এই নিয়ে সুধীনদার অবাধ্যও হয়েছে রনো। যেটা একদিন তো সিরিয়াস হয়ে গেছিল প্রায়।
সুধীনদা ওকে মাঝেমধ্যেই উঠতে বলে। বলে মানে, বলত। ওই দিনটার পর থেকে আর বলেনি খেয়াল করেছে রনো। আগে যখন বলত তখন কোনওদিনই ওঠেনি রনো। বাপ্পাদাকে এগিয়ে দিয়েছে। বাপ্পাদা ওর মেজাজটা বোঝে। উঠতে বললে নিষ্পলক একটু তাকিয়ে উঠে যায়। তা সেদিন সেটাই করতে হঠাৎ খেলা থামিয়ে দিয়েছিল সুধীনদা। খেলা মানে নিজেদের মধ্যে দল করে খেলা, রোজ প্র্যাকটিসের পর যেমন হয়। না তুই না বাপ্পা, দাঁড়া… অ্যাই রনো যা— কড়াভাবে বলেছিল সাইডলাইন থেকে। না আমি যাব না— রনোও গোঁয়াড়ের মতো বলে ঘাড় গোঁজ করে হাঁটা দিয়েছিল নিজেদের গোলের দিকে। ঘটনাটা অভাবিত। দিশারীর মাঠের মধ্যে, প্র্যাকটিসের মধ্যে, এভাবে সুধীনদার অবাধ্য হতে কোনও প্লেয়ারকে শেষ কবে দেখা গেছে ক্লাবের পুরনো মেম্বাররাও মনে করতে পারবে না বোধহয়। উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল সুধীনদা। হাওয়া বুঝে মাঠ থেকে দৌড়ে সুধীনদার দিকে এগিয়ে গেছিল বাপ্পাদা, পেছন পেছন অনি। আড়চোখে দেখেছিল ক্লাবঘরের সামনে যে চেয়ারে বসে প্র্যাকটিস দেখে দেবাদা সেখান থেকে তড়িঘড়ি উঠে এগিয়ে আসছে সাইডলাইনে সুধীনদার দিকে। কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছিল। ওকে কেউ কিছু বলেনি। সেটা ভাল লেগেছিল রনোর।
কিন্তু রনো যায় না। একবারের জন্যও ওঠে না গোল করতে। ওর ভাল্লাগেনা। বাপ্পাদা এ-নিয়ে কখনও জিজ্ঞেস করেনি ওকে। বোঝে মনে হয়। মাঠে তো বোঝেই। যখনই কর্নার বা ফ্রিকিক পায় দিশারী অপোনেন্ট বক্সের কাছাকাছি রনো একটা শান্ত চোখে তাকায় বাপ্পাদার দিকে। বাপ্পাদা সেই চোখটা দেখে নিয়ে উঠে যায় চুপচাপ। একদিন খালি ওই ফেরার সময়ে বলেছিল—
—এ-বছর আমি যতগুলো গোল করেছি, দিশারীতে এত বছর খেলে টোটাল এত গোল করেছি কি না সন্দেহ। ভালই লাগে গোল করতে… যাই বলিস…
বলেই অন্য কথা শুরু করেছিল। রনোর কোনও উত্তরের প্রত্যাশা করেনি।
ধরল পিলু। ওই সেদিন, ঝিলপাড়ে বসে আড্ডা মারতে মারতে।
—আচ্ছা ডিফেন্সে খেললে গোল যে একদম করাই যাবে না, তা তো নয়। সেসবও কি বারণ করেছে নাকি সুধীনদা তোকে?
—না না। কর্নার-টর্নার পেলে তো উঠতে বলত আমাকে। একদিন তো সে-নিয়ে… বলে সেদিনের কথাটা বলেছিল ওকে রনো।
—তা তুই যাস না কেন? গোল করতে এত ভালবাসিস… বুঝছি না তো কেসটা…
একটু চুপ করে ছিল রনো। ওদের পায়ের কাছে ঝিলের জলে সে-সময়েই একটা বড় মাছ হঠাৎ ঘাই মেরে গেছিল।
—গোল করা মানে তো ফিনিশ পিলু। কিন্তু ফিনিশের আগে তো একটা গোটা কাজ থাকে। বলের জন্য ছোঁকছোঁক করা, ডিফেন্ডারদের হাঁপিয়ে দেওয়া, গোলকিপারকে বোকা বানানো… আমি এই পুরো থ্রিলটাই মিস করি। আর ওগুলো কিছু না করে টুক করে কর্নারে উঠে একটা হেড বা ভলি মেরে গোল করে দেওয়াটা কীরকম ফাঁকিবাজি মনে হয়। মনে হয় অন্যের ভাগের জিনিস আমি হাতিয়ে নিচ্ছি…
পিলু কিছু বলেনি। বুঝেছিল বোধহয়। বা হয়তো বোঝেনি পুরোটা। কিন্তু এটুকু বুঝেছিল এখানে ওর কিছু বলার নেই।
ঠিক সময়েই স্টেডিয়ামে পৌঁছে গেল রনো। বেশ জমজমাট পরিবেশ। গ্যালারি ভর্তি প্রায়। এই ম্যাচটা নিয়ে দেবাদাদের পুরবোর্ড বেশ প্রচার চালিয়েছে দমদমে কয়েকদিন ধরে। টিকিটের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি, ফলে মাঠ ভরবেই। অনেক প্রাক্তন ফুটবলার আসবে, আইএফএ-র প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিও আসবে। এগুলো রনোরা আগে থেকেই শুনেছে। এই ম্যাচটার আসলে আয়োজন করা হয়েছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে। বড় উদ্দেশ্যেও বলা যায়। উদ্যোগ দেবাদার। ম্যাচটার না, যে-প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে এই ম্যাচটা, সেই প্রক্রিয়াটার। দিশারীকে এবার কলকাতা লিগে খেলানোর জন্য কোমর বেঁধে নেমেছে দেবাদা। ডায়রেক্ট থার্ড ডিভিশনে খেলবে। আগেকার জমানায় আইএফএ-র এসব নিয়ে অনেক নিয়মকানুন ছিল। শুরু করতে হবে ফিফথ ডিভিশন থেকে, ময়দানে টেন্ট থাকতে হবে… ইত্যাদি ইত্যাদি। সুধীনদাদের পার্টি একটু উদ্যোগ নিলে সেসবের কিছু এদিকসেদিক করে দিশারীকে যে লিগে খেলানোর ব্যবস্থা করতে পারত না এমন নয়— কিন্তু কোনওভাবে এই ইস্যুটা উপর অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে হারিয়ে যেত। জমানা বদলের পর আইএফএ-র নিয়মকানুনেও অনেক শিথিলতা এসেছে, এখন টাকা দিলে সব হয়, সরকারি চাকরি হয়— তো এটা আর কী এমন বড় ব্যাপার। আর টাকারও চিন্তা নেই— সেসব দেবাদা বুঝে নেবে। দমদমে বছরে একবার করে দেবাদা যে গানমেলার আয়োজন করে, তার বাজেট তো ছেড়েই দাও, যে-কটা দুর্গাপুজো-কালীপুজোর দেবাদা পৃষ্ঠপোষক তার দুটো পুজোর বাজেটের টাকাও পুরোপুরি লাগবে না বোধহয় এতে। কিন্তু সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়। দেবাদা এই উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই বেলঘড়িয়া-আগরপাড়া-সোদপুর বা ওদিকে বাগুইহাটি-কেষ্টপুর-লেকটাউনের দিককার আরও কিছু কাউন্সিলরও তাদের এলাকার ক্লাবকে কলকাতা লিগে খেলানোর জন্য নেমে পড়েছিল। টাকার জোর তাদেরও কম নেই। এই জমানায় কোনও নেতাকেই কেউ সেই অপবাদ দিতে পারবে না। আইএফএ পড়েছিল ফ্যাঁসাদে। এতগুলো নতুন ক্লাবকে একসঙ্গে থার্ড ডিভিশনে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় নাকি! এবার এনারা তো কেউ কারও কাছে হারতে রাজি নন। সবাই নিজের নিজের পাড়ার ক্লাবকে কথা দিয়ে বসে আছে। আইএফএ অগত্যা ক্রীড়ামন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়। তিনিই নাকি রফাসূত্র বাতলে দিয়েছেন। বছরে একটা করে ক্লাব ঢুকবে। আর সেটা কে হবে, সেটা ঠিক হবে একটা টুর্নামেন্টের মাধ্যমে। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হও, টাকা দাও— যেখানে যেখানে যা যা দেওয়ার, লিগে খেলো। দেবাদা তো এক কথায় রাজি, কিন্তু মজাটা হয় এবার অন্যদের নিয়ে। দেখা যায় যারা এতদিন লাফাচ্ছিল তাদের পাড়ার ক্লাবকে লিগে খেলাবে বলে, তাদের অনেক ক্লাবেরই ফুটবলের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। কারও কারও আছে, তাও সে কোনও টুর্নামেন্ট হলে এদিক-ওদিক থেকে টাকাপয়সা দিয়ে ছেলে নিয়ে এসে খেলায়, নিয়ম করে প্র্যাকটিস-ম্যাকটিস ওসব কিছুই হয় না। মাঠও নেই বেশিরভাগেরই। শেষমেশ লড়াইটা এসে দাঁড়ায় দুটো ক্লাবের মধ্যে— দিশারী আর যুগীপাড়া ইউনাইটেড। ঠিক হয়, দুটো দলের তো আর টুর্নামেন্ট হয় না, একটা ম্যাচই হোক। যারা জিতবে, লিগে খেলবে। অবশ্যই ওই মাঝের ধাপটা পূরণ করে। সেই ম্যাচটাই আজ।
ফার্স্ট হাফটা নিরুপদ্রবে কাটল বলা যাচ্ছে না। উপদ্রবের হেতু যুগীপাড়া নয়। খেলা প্রায় পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রণ করছে দিশারী। তফাতটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। একটা নিয়মিত প্র্যাকটিস করা টিমের সঙ্গে একটা অগোছালো টিমের যেমন তফাত হয়। যুগীপাড়া এই ম্যাচটার জন্য ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা তিনটে প্লেয়ারকেও নিয়ে এসেছে পয়সা দিয়ে। কিন্তু হলে কী হবে। তারা তো মারাদোনা নয় যে টিমে নামলে সেই টিমটাকে বলা হবে সে একা আর বাকি দশজন। সুধীনদার ছেলেরা একসঙ্গে ঘাম ঝরায় বছরের প্রায় সব কটা দিন, তার দাম আলাদা, ওটা পয়সা দিয়ে আনা যায় না। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে বাপ্পা আর রনো দুর্ভেদ্য। ওদের টপকানোর কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে এখন ওই তিনজনের একজন— স্ট্রাইকার ছেলেটা— মিডল থার্ড থেকে ঘুপঘাপ শট নেওয়ার দিকে মন দিয়েছে। দুটো শট নিয়েওছে ওরকম। অলোকের অসুবিধা হয়নি। ওর এরকম ধান্দা দেখে শুভ একটু নেমে এসেছে। সেকেন্ড হাফে মিডল থার্ডেও আর জায়গা পাবে না খুব একটা। ওপরেও অনি-শুভ-সুদীপরা খেলছে তেল দেওয়া মেশিনের মতো। ওদের এই ত্রিভুজ থেকেই গোল করেছে অনি। অনির ওই গোলেই ফার্স্ট হাফে এগিয়ে আছে দিশারী। সুধীনদা বলে দিয়েছিল মেপে খেলতে। ওদের খেলা দেখে, ম্যান-টু-ম্যান মার্ক করে, বেশি খুল্লমখুল্লা না উঠে খেলতে। সেইজন্যই বেশি চাপ দেয়নি দিশারী। এক গোলেই সন্তুষ্ট আছে।
কিন্তু উপদ্রবটা হয়েছে রনোর। হঠাতই— আর অভাবিতভাবে। অনির গোলটা হয়নি তখনও। যুগীপাড়ার ওই ভাড়া করা একটা ছেলেই স্প্রিন্ট টেনে ঢুকে আসতে যাচ্ছিল রনোদের বক্সে। পাশে সাপোর্টে নিঃশব্দে উঠে আসছিল আর একজন। আড়চোখে রনো দেখল বাপ্পাদা সেই মক্কেলকে কভার করছে, তাহলে এই দৌড়বীরকে ওকেই বুঝে নিতে হবে। সামনে গেল রনো, তারপর খুব স্পিডে একটা ট্যাকেলের ভান করল, কিন্তু কমিট করল না। এই চুক্কিটাই খেয়ে গেল ছেলেটা, দুম করে ইনসাইড মেরে দিল, আর ওর সেই টাচে বলটা টুক করে চলে এল রনোর কমিট-না-করা ডান পায়ে। তারপরই একটা ছোট্ট টার্ন, আর বল আর সেই দৌড়বীরের মাঝে রনোর অলঙ্ঘ্য শরীরটার নিশ্চিত উপস্থিতি। ছেলেটা এখন কিছুক্ষণ ওর পিঠের ওপর ধস্তাধস্তি করবে— জানে রনো— এরকমই করে সবাই। ওসবে পাত্তা না দিয়ে ওর এখন কাজ বলটাকে নিজের পোষা বেড়ালটার মতো দুই পায়ের মধ্যে আগলে রাখা। সবই হচ্ছিল এই নিয়ম মেনেই, তখনই একটু ঘাড়টা তুলে সামনে আর আশপাশটা দেখল রনো, আর তখনই ঘটল ঘটনাটা। প্রথমে তাকাল বাপ্পাদার দিকে, বাপ্পাদার পেছনে ওদের উঠে আসা ছেলেটা তখন গা ছেড়ে দিয়েছে। চোখমুখে হতাশা। তারপর দেখল অলোককে, ওর আর রনোর দিকে নজর নেই তখন, নিজের জায়গা একটু ছেড়ে সামনে অন্য প্লেয়ারদের দেখছে, রনো যদি ব্যাকপাস করে তবে কাউকে বাড়ানো যায় নাকি উড়িয়ে দেবে, সেটাই ভাবছে নিশ্চয়ই। আর অলোকের পাশেই— রনোর মাথার ভেতর যেন ইলেকট্রিকের শক মারল সেই বাবার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একবার যেমন খেয়েছিল— একটা লোহার পোস্ট, পেছনে হলুদ রঙের জাল, অপেক্ষা করে রয়েছে একটা বলকে কোলে নেবে বলে। এখন যদি ব্যাকপাস দেওয়ার মতো করে ওখান দিয়ে একটা জোরে পুশ করে রনো অলোক কিছুতেই ধরতে পারবে না। কেন এরকম অদ্ভুতুড়ে ভাবনাটা মাথায় এল— ভাবতে ভাবতেই রনোর দুম করে মনে পড়ল পিলুর কথা। মালিকের বাইকের ব্রেকের তারটা চুপিচুপি কেটে দিতে ইচ্ছে করে পিলুর। গরিব বলে ওদের ডিফেন্ড করতে হবে, বড়লোকরা অ্যাটাক করে যাবে, ওদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সেসব সামলে যেতে খালি, কিন্তু অন্তর্ঘাত তো করাই যায়… না?!…
—রনো অ্যালার্ট…!
বাপ্পাদার চিৎকারটায় চটক ভেঙেছিল যেন ওর। ও একটু বেশি টাইম নিচ্ছে দেখে পেছনের ছেলেটা টুক করে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলটার দিকে, বাপ্পাদা সেটা নজর করেই চেঁচিয়েছে। বেশি টাইম মানে কতই বা! এক মিনিটও হয়েছে কি? উল্টোদিকে ফিরে বলটা নিয়ে একটু বাঁদিকে সরে গেছিল রনো। ছেলেটা এবার হাল ছেড়ে দিল। সুদীপ নেমে এসেছিল, বলটা দিয়ে দিয়েছিল রনো ওকে।
হাফটাইম শেষ হয়ে এল। নামতে হবে আবার। ড্রেসিংরুমের একটা কোনায় বসেছিল রনো এতক্ষণ, চুপচাপই। সুধীনদা গেমপ্ল্যান বলে দিল। এবার শুরুতেই ওরা একটা ঝটকা দেবে। দশ মিনিট। দুটো হলে তো ভালই হয়, অন্তত একটা গোল তুলে নিতেই হবে এই সময়টায়। তারপর আবার নর্মাল খেলা। যেমনটা খেলেছে ওরা ফার্স্ট হাফে। শুনেছে রনো, শোনেওনি আবার। ওর আর কী! ঝটকার সময়েও তো ও আর উঠবে না। বাপ্পাদা উঠবে হয়তো একটু বেশি, ওকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে, ঠিক আছে। লাইন দিয়ে যখন ওরা এগিয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে, পেছন থেকে বাপ্পাদা ওর কাঁধে হাত রাখল।
—তোর কি কিছু হয়েছে?
—কতদিন গোল করি না বাপ্পাদা…
বলে ফেলল রনো। পাশ না কাটিয়ে, এড়িয়ে না গিয়ে। মুখ থেকে বেরিয়েই এল যেন ওর খানিকটা অজান্তেই।
কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে ওর হাতটা ধরল বাপ্পাদা শক্ত করে। কয়েক লহমা থেমে হাতটা ছাড়িয়ে পিঠে একটা ছোট চাপড় মেরে বলল— আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট… চ, মেরে আসি… তারপর কথা হবে…
সুধীনদার ছক অনুযায়ীই নিখুঁতভাবে হচ্ছে সব কিছু। খেলা শেষ হতে আর মিনিট পাঁচেক। সেকেন্ড হাফের শুরুর ওই দশ মিনিটের ঝটকায় দুটো গোল তুলে নিয়েছে দিশারী। অনি আরও একটা গোল দিয়েছে, আর একটা গোল বাপ্পাদার। যুগীপাড়ার বক্সের ডান কোনার দিকে ফ্রিকিক পেয়েছিল দিশারী। সুদীপ নিখুঁত একটা ইনসুইং রেখেছিল সেকেন্ড পোস্টে। বাপ্পাদাকে খেয়াল করেনি যুগীপাড়ার ডিফেন্ডাররা। চুপিচুপি উঠে গিয়ে বলটা যখন বক্সের জটলার ওপর দিয়ে সেকেন্ড পোস্ট ঘেঁষে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটু ডিপ করল, তখনই স্পট দিয়ে কানেক্ট করল বাপ্পাদা। এই ডেডবলও নিয়মিত প্র্যাকটিস করে ওরা। যুগীপাড়া সেটাই টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। ওই সময়ে শুভর একটা শট বারে না লাগলে এখন দিশারী চার গোলে এগিয়ে থাকে।
সেই ছেলেটা। ফার্স্ট হাফে যুগীপাড়ার যে ভাড়া করা ছেলেটা ঢুকে আসতে গেছিল ওদের বক্সে। আসছে আবার হঠাৎ। এবার বাঁদিক দিয়ে। প্রদীপকে কাটিয়ে নিল দেখল রনো। বাপ্পাদাও। অলোকও। প্রদীপ ওদের রাইট ব্যাক। চোখে চোখে কথা হল রনো আর বাপ্পাদার। ডানদিক থেকে যে আর একটা ছেলেও এগিয়ে আসছে জায়গা নিতে নজর হল সেটাও। বাপ্পাদা নিঃসাড়ে সরে গেল সেদিকে। রনো এগোল দৌড়বীরের মহড়া নিতে। ছেলেটার পায়ে শট আছে ভাল। বক্সে ঢুকতে পারছে না দেখে দূর থেকে শট নিয়েছিল কয়েকটা। সেকেন্ড হাফে অবশ্য শুভ আর সেরকম জায়গা দেয়নি ওকে। কিন্তু এখন কী করবে? রনো আসছে দেখে আর না এগিয়ে ওখান থেকেই শট মারবে, নাকি রনোকে কাটানোর চেষ্টা করবে, নাকি ওই ছেলেটাকে বাড়াবে? মজাটা হল এই সময়েই। রনোর প্রশ্নগুলো অবধারিতভাবে ভাবল ছেলেটাও, ভাবতে গিয়ে বলের ওপর থেকে ফোকাস নষ্ট করল সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য, যে-ভগ্নাংশটা পার হওয়ার পর অমল দত্ত ক্রীড়াঙ্গনের সবাই দেখল বল রনোর পায়ে। আবার রনোর নিজেদের গোলের দিকে ঘুরে যাওয়া, আবার বডি-শিল্ডিং, আবার ছেলেটার রনোর পিঠের ওপর কিছু ব্যর্থ ধস্তাধস্তি। আর তারপরই…! আবারও সেই ফার্স্ট হাফের রিপ্লে। রনোর চোখের সামনে ভেসে উঠল অলোকের নিশ্চিন্ততা, ফাঁকা ফার্স্ট পোস্ট, পেছনের বলের জন্য অপেক্ষারত হলুদ জাল, সুধীনদা বলছে ও গরিব… ডিফেন্সই ওর জায়গা, পিলু বলছে শালা মালিকটার বাইকের ব্রেকের তার দেব কেটে, রনোর বাবা বলছে সবটাই রাজনীতি… গরিবদের ডিফেন্স করাও রাজনীতি… তাদের অন্তর্ঘাত করাটাও রাজনীতি, রনো বলছে— আমি কতদিন গোল করি না বাপ্পাদা…
লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মকে ধন্যবাদ এমন গল্প পড়ানোর জন্য।
চমৎকার গল্প। অন্তর্কথন ও সংলাপের দক্ষ জাক্সটাপোজিশন বিশেষ করে চোখে পড়ল। লেখককে অভিনন্দন এমন ভালো একটা গল্প লেখার জন্য।
দুর্দান্ত…
ভালো লাগল। লেখনী সচল থাক।🙏