
সত্যব্রত ঘোষ
উদ্বেগকে শব্দে পরিণত করতে পারছে না নচিকেতা। অন্তত এখন। কানে ঢাকের আওয়াজ বেজেই চলেছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই চোখ চলে যায় মানুষের ঢলে। এবার পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার আগে থেকেই দেবীপক্ষের আয়োজন হয়েছে। উৎসবে ফেরাতে হবেই মানুষকে। তা যেভাবেই হোক। কত হাজার কোটি টাকা যেন গড়াগড়ি খায় দেবীপক্ষে?
নচিকেতা বুঝতে পারে না তার উদ্বেগ বেশি তীব্র, না রাগ। ঘণ্টা তিনেক হল, বাবাইকে লালবাজারে নিয়ে গেছে পুলিশ। সঙ্গে ওর আট বন্ধু। কেন ধরে নিয়ে গেল পুলিশ? কারণ, বিচারের দাবি সোচ্চার করেছিল দক্ষিণ কলকাতার ভিড়াক্রান্ত এক বিখ্যাত মণ্ডপে।
গত প্রায় দুই মাস হয়ে গেল, নচিকেতা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, যখন থেকে স্বাধীনতার মধ্যরাত্রিতে মিছিলগুলিতে যোগ দিয়ে মানুষরা প্রতিবাদ করছে, এমন খবর পেয়ে। বাবাই বলছিল নচিকেতাকে। এমনকি রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বার পরও উত্তেজিত বাবাই ঘরে ঢুকে ঠেলে, দাদু, দাদু! ওঠো, দেখো কী হচ্ছে!
নচিকেতা ঘুমোচ্ছিল না। কলকাতাকে যখন মিছিলনগরী বলা হত, সেই সময়ের টুকরো ছবিগুলি ভেসে উঠছিল নচিকেতার অপলক চোখে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের সারিরা চলমান। মুখে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। খবরের কাগজে কাজ করবার সুবাদে আগাম জানা যেত, কোথায়, কখন, কী কারণে মিছিল বের হবে। হয় রাজনীতির দলগুলি থেকে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে, নয়তো লালবাজারে কর্মরত বন্ধু সুগতই জানিয়ে দিত ‘বন্দোবস্ত’ কেমনটি হবে।
গুরুত্বের তারতম্য ছিল। কোথাও জুনিয়ররা কভার করত। আবার কোনও মিছিলে হোমরাচোমরা নেতারা হাঁটলে সঙ্গে আলোকচিত্রী নিয়ে নিজেকেও যেতে হয়েছে। নেতাদের নাম আর মুখগুলি অদলাবদলি করে দেয় স্মৃতি। এক ঘটনার পিঠে অন্য ঘটনা জুড়ে যায়। অসংলগ্ন মন ইতিহাস রচতে পারে না।
নচিকেতাকে হাত ধরে বিছানা থেকে তূলে বাবাই নিয়ে যায় বসবার ঘরে। টিভি থেকে উত্তেজিত সঞ্চালিকার কথা কানে আসছিল। মেয়েটির মুখ চেনাচেনা মনে হল নচিকেতার। ইন্টারভিউ প্যানেলে মুখোমুখি বসে সপ্রতিভতার অভিনয় করছিল না? প্যানেলের পক্ষ থেকে অধীর ওকেই বোধহয় বলেছিল, লাউড হতে হবে, লাউড। মনে রেখো, এটা টিভি। খবর কাগজ নয়। আর সরকারি দূরদর্শনও নয়। ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাব দ্য অ্যাটেনশন অফ অডিয়েন্স। অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে কথাগুলি। দেখতে দেখতে নচিকেতার মনে হচ্ছিল ও সঞ্চালিকা নয়, যেন ঘটনাক্রমের এক আয়োজকই। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সংবাদদাতাকে উসকে দিচ্ছে ক্রমাগত।
তবে উসকে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। উত্তর কলকাতার হাসপাতালের সামনে থেকে প্রতিবাদকারীদের মিছিল এগিয়ে যাওয়ার পর পরেই এক দল মানুষ চড়াও হয়েছে হাসপাতালে। ভাঙচুর চালাচ্ছে। পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করছে, সঙ্গে সংবাদদাতাও। কথা বলতে বলতে হাঁপাচ্ছে সে। ঘাম ঝরে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
—এ আবার কী শুরু হল রে?
—বুঝতে পারছি না, দাদু। ওদের টার্গেট যদি প্রোটেস্টাররাই হত, তাহলে কি টাইমিংয়ে গণ্ডগোল হয়েছে?
বাবাইয়ের চোয়ালটা শক্ত হতে দেখছিল নচিকেতা। সুষমা বলত, নাতি হুবহু ঠাকুরদার কার্বন কপি। ওর বয়সে যখন ছিল, চোয়াল নিশ্চয়ই শক্ত হয়েছে বারবার। কলেজের দিনগুলিতে ছাত্র পরিষদের বিষ্ণু, জগন্নাথ, কপিল, মুনতাসিররা ক্লাসে ঢুকে অধ্যাপকদের থামিয়ে ইন্দিরা গান্ধি ভারতমাতা বলে স্লোগান তূলে ক্লাস বানচাল করে দিত। ওই নামগুলিও মনে থাকত না, যদি না ওদের মারা ঘুষি আর লাথির আঘাতগুলি গুণোত্তর হয়ে এখনও ফিরে ফিরে আসত নচিকেতার শরীরে।
—ওরা কি প্লেস অফ অকারেন্সটাকেই ডেসট্রয় করতে চাইছে?
বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে নচিকেতা। মাত্র উনিশ বছর বয়সেই ‘রেপ’, ‘মার্ডার’, ‘অ্যাসল্ট’, ‘মলেস্ট’ ধরনের কথাগুলি উচ্চারণে কতটা স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে ও। টিভির দিকে চেয়ে যে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ‘প্লেস অফ অকারেন্স’ কথাটি বলল, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা এক স্রোত বয়ে গেছিল নচিকেতার। নাগরিক আধুনিকতা আর শিক্ষা অতি দ্রুত সব কিছু আত্মস্থ করে নেয়। অস্বাভাবিকত্বকেও।
—হতে পারে। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট তো সিবিআই-কে ইনভেস্টিগেট করতে বলেছে।
—এটা কিন্তু সহজে মিটবে না, দাদু। এনআরএস-এ স্টুডেন্টরা কিন্তু ফুঁসছে। উনিশে না কবে ওখানকার ডাক্তারদের মেরেছিল না পাবলিক। তখন তো সিএম অ্যাসিয়র করে, শি উড টেক কেয়ার অফ এভরিথিং।
ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। মাথাটা ক্রমশ ভার হয়ে আসছিল নচিকেতার। টিভির মেয়েটা তখন বলছিল, তার মানে স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অনুমান করছে পুলিশ। ধন্যবাদ অর্চিস্মান।
***
দূর থেকে যেন রাঙাজেঠিমার গানটি শুনতে পাচ্ছে নচিকেতা। ঢাকের আওয়াজ কানে সইছে না আর। সতীদাহ যখন হত, তখন শ্মশানে সদ্যবিধবাদের জ্বলন্ত চিতায় তুললে তাদের আর্তচিৎকার ঢাকতে নাকি সজোরে ঢাক, কাঁসর বাজানো হত। পবিত্র পরিবেশে ঢাকের অনুষঙ্গ বেমানান বলেই ধারণা নচিকেতার। গানের কথাগুলি থেকে স্মৃতিতে অনুরণন জাগে। নচিকেতার চোখে ছোটবেলার ছবি। দোতলার কোণের ঘরে জানলার শিক ধরে রাঙাজেঠিমা বাইরের দিকে চেয়ে গাইছে।
…তোমায় দিতে পূজার ডালি
বেরিয়ে পড়ে সকল কালি
পরান আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে
দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে
নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে…
আজ মহাসপ্তমী। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়েই শহরের মানুষজন বেরিয়ে পড়েছে মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে। বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজের কৈশোরে ফিরে গেছে। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত ঠাকুর দেখা। মাইলের পর মাইল হাঁটা, অন্ধ গলিগুলিতে ভুল করে ঢুকে ফিরে আসা, মণ্ডপ খোঁজা— এই উত্তেজনার রেশ কি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদেরকেও স্পর্শ করেছে? সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠাকুর দেখার উন্মাদনায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে। খাওয়ার পর্ব আর সেলফি তোলার হিড়িকে ঠাকুর দেখাটা স্পষ্টতই এখন দলগত আনন্দের উচ্ছলতার থেকে ব্যক্তিগত ইচ্ছেপূরণের সহজতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
—বাই দাদু, আজ আমরা বন্ধুরা একটা মিশনে বেরোচ্ছি।
—মানে?
—মিশন সেন্সিটাইজেশন। সাতজন ডাক্তারদাদা পুজোর দিনগুলোতে এতটুকু খাবার খাচ্ছে না, আর এখানে চারপাশে… হাউ কুড দে?
—চয়েস বাবাই, প্রতিটা মানুষ নিজের চয়েস অ্যাসার্ট করতে পারে। এই স্পেসটা তো ডেমোক্রেসিতে দেওয়া হয়েছে। তোরা করবিটা কী?
—প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে মনে করিয়ে দেব, ইউ হ্যাভ মোর ইম্পরট্যান্ট থিং টু ডু নাউ। ওই দাদা-দিদিদের পাশে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি জরুরি।
—এটা তোর কাছে জরুরি, তোর বন্ধুদের কাছেও। কিন্তু সবার কাছে নয়। স্পেশালি, যেখানে স্টেট সরাসরি উৎসবটা এনডোর্স করছে। তোরা কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে যেতে চাইছিস। বি ভেরি কেয়ারফুল। রাদার আই সাজেস্ট, যাস না।
—না দাদু, উই মাস্ট। মানুষ এত ইনসেনসিটিভ নয় বাই নেচার, ওদের অসাড় করে রাখা হয়েছে। ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা…
বলতে বলতে বাবাই চলে গেল। আর তারপরে তিন ঘণ্টা পরেই ফোনটা এল। বাবাইদের নিয়ে লালবাজারে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাবাইয়ের মা দীপ্তি কাঁদতে কাঁদতে নচিকেতাকে জানাল।
—কী হবে বাবা এবার?
শুদ্ধব্রত মারা যাওয়ার পর থেকে বাবাইকে আগলে রাখতে চায় দীপ্তি। আর বাবাই বাড়িতে থাকলেই নচিকেতার কাছে অভিযোগ জানায়, দাদু ডু সামথিং, মা বাড়িটাকেও নিজের স্কুল বানিয়ে ফেলেছে। নচিকেতা নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে একই কথা বোঝায়, তুই ওর পৃথিবী, রে। ওর সঙ্গে সময় কাটা। বোঝা মাকে, তোর একটা অন্য পৃথিবীও তৈরি হয়েছে। তুই যদি তোর মাকেই না বোঝাতে পারিস, কী দেখছিস, কী ভাবছিস, তাহলে জানবি কোথাও একটা বড় ফাঁক রয়ে যাচ্ছে।
—এখন কী হবে বাবা?
দীপ্তি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জলভরা চোখে নচিকেতার থেকে উত্তর খোঁজে। অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে লালবাজারে কিছু পদাধিকারী হয়তো ওকে আজও সম্মান করে। কিন্তু একই সঙ্গে নচিকেতা এও বুঝতে পারছে, পুলিশ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ওদের ধরে নিয়ে যায়নি। কোনও নেতা, হয়তো বা যার পুজো, সেই নির্দেশ দিয়েছে, সাইলেন্স দেম।
এটা এক ধরনের বার্তা সঞ্চার বলে মনে হয় নচিকেতার। প্যান্ডেলে ভিড়ের মধ্যে ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’ বলে চিৎকার না করে খোঁয়াড়ে বন্দি ভেড়াদের মতো শান্ত হয়ে একে অন্যকে নিয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশ করে, ঠাকুর দেখে আবার খোঁয়াড়ের লাইন দিয়ে বের হয়ে আসত, নেতার জয়জয়কার বাজত দিকে দিকে। ব্যবসায়ীরা ভিড় দেখে গদগদ স্বরে এসে হাত কচলিয়ে জানিয়ে যেত, পরের বছর তাহলে কুড়িটা গেট …দা। আমার দিকটাও দেখবেন। ওটা পচিশ করুন, তারপরে দেখছি। আরও বড় হবে এরিয়াটা কিন্তু, পরেরবার। উই আর দ্য বেস্ট ইন দ্য সিটি, মনে রাখবেন।
—আপনি কিছু একটা করুন, বাবা! জেলে একরাত থাকলে তো কেরিয়ারেও দাগ পড়ে যাবে ওর।
দীপ্তির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল নচিকেতা। দীপ্তিকে আশ্বাস দেওয়ার জন্যেই বলল, কিচ্ছু হবে না ওর।
কথাটার প্রতি ভরসা বাড়াতেই ও অধীরের ছোটভাই সুধীরকে ফোন করল। অধীর কর্মস্থলে গুলি খেয়ে মারা গেছে আজ বারো বছর হল। ভাঙরে স্পেশাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ হওয়ার পর ক্রসফায়ারে ওর জীবন যায়। ভাই সুধীর চৌধুরী এখন হাইকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর।
—হ্যালো সুধীর, বাবাইকে লালবাজারে ধরে নিয়ে গেছে, তুমি একটু ব্যাপারটা দেখবে?
—আরে দাদা, আমার কানে সব এসেছে। পুলিশগুলোও তেমন। আর ওই শেয়ালদার এজিএম। আমি ট্র্যাক রাখছি সব। তবে আজ রাতটায় কিচ্ছু করতে পারব না। কালই কেসটা হাইকোর্টে উঠবে।
—মানে বাবাই আজ সারারাত কাস্টডিতেই থাকবে?
—কিচ্ছু করবার নেই। এরা পাবলিককে একটা উল্টো মেসেজ দিতে চাইছে। কিন্তু এই কেস দাঁড়াবে না। কালই বাবাই বাড়ি আসবে। ওর বন্ধুরাও সস্মমানে বাড়ি ফিরে যাবে দেখবেন।
—কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সহজ। স্টেট ওদের ছেড়ে দেবে?
—ছাড়তে বাধ্য, দাদা। গোটা শহরটায় এখন মন্থন চলছে। অমৃত উঠে আসার আগে কিছুটা গরল তো উগরোবেই। দ্য স্টেট উইল বি ইন আ টাইট স্পট, আমি লিখে দিতে পারি।
—আমাকে কী করতে হবে বল? ওর মা…
—দীপ্তিকে ফোনটা দিন। আমি কথা বলছি।
নচিকেতা ফোনটা দীপ্তির হাতে দেয়। দীপ্তির হাতটা কাঁপছে। পুজোর দিনে এতজনের মা-রা কি এভাবেই চোখের জল ফেলাবে। বাবাই আজ বলছিল, সোদপুরে ওই দিদিটার বাবা-মা বাড়ির বাইরে ধর্নায় বসে আছে পুজোর শুরু থেকে। ধর্মতলায় যে দাদা-দিদিরা অনশন করছে, তাদের মা-বাবারা সবাই ধর্নামঞ্চে এসে ওদের কাছে বসে রয়েছে চোখের জল মুছে, মুখে গর্বের হাসি নিয়ে। গর্ব তো হবেই। শিরদাঁড়া সোজা রেখে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই চরম পথে প্রতিবাদ জানানোর সাহস বাঙালির স্মৃতি থেকেও যে মুছে গেছে। নচিকেতা অন্তত তাই জানে। নেত্রীর একদা অনশনের বিজ্ঞাপন যতই উজ্জ্বল আলোকিত হোক না কেন, এই সমবেত প্রতিবাদের তুলনায় সেই অনশন থেকে ব্যক্তিস্বার্থের গন্ধ তো মুছে ফেলা যায় না।
দীপ্তি ফোন কেটে নচিকেতার হাতে দেয়। চোখের জল মোছে, নাইটির উপর জড়ানো ওড়নার হাতায়।
—চিন্তা করতে বারণ করল অধীরদা।
—তোমাকে কি বাবাই বলেছে দীপ্তি, আজ ধর্মতলায় ওই যারা হাঙ্গার স্ট্রাইক করছে, তাদের বাবা-মায়েরা সেখানে গেছিলেন।
—ওরা তো রোজই যায়। বিদিশা আমাদেরই স্কুলে পড়ায়। প্রতিদিনই ওয়াটসঅ্যাপে ছেলের সঙ্গে ওখানে তোলা সেলফি পাঠায়। দেখি, আর ভাবি, যে দেশে মায়েরা এমন ছবি তুলে ছেলেমেয়ের গর্বে শরিক হয়, সেখানে শাসক ভয় তো পাবেই। বিশেষ করে শাসক যদি অন্যায় চাপা দেয়।
—বাবাই রোলমডেল খুঁজে পেয়েছে দীপ্তি। বারবার বলত, কে আছে বলবে যিনি আমাদের সাহস দেবেন, উৎসাহ জোগাবেন। মিডিওক্রিটিই যেখানে থাম্ব রুল, সেখানে ব্রেনড্রেন হবেই, আটকাতে পারবে না। আজকাল যারা নেতাদের হয়ে সামনে এসে থ্রেট দেয়, তাদেরকে দেখেছ? চেহারায়, হাবেভাবে এক-একটা লুম্পেন। অ্যারোগেন্স আছে, আর আছে নেতাদের আশীর্বাদ— কিচ্ছু হবে না তোদের। শুধু পুলিশ কেস থেকে বাঁচবি। হয়ে গেলেও নো পবলেম। কিন্তু সবার কাছে একটা কথা যেন পরিষ্কার হয়— নো ট্যাঁ ফো, চুপচাপ আমাদের কথা শুনে কাজ করতে হবে। দেখছি তো কলেজের ইউনিয়নে। ফ্রেশারদের কারা আঙুল দেখিয়ে কথা বলে। কলেজ কেন, স্কুলের চৌকাঠ মাড়িয়েছে কিনা সন্দেহ।
—আপনার কি মনে হয়, জাস্টিস পাবে ছেলেমেয়েগুলো? দীপ্তি প্রশ্ন করে একদা-সাংবাদিক শ্বশুরকে।
নচিকেতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেমেয়েগুলি রাজনৈতিক রংকে দূরে রেখে ন্যায্য কাজই করেছে বলে মনে করে নচিকেতা। এমন অরাজনৈতিক আন্দোলনকে আমাদের দেশের চলতি রাজনীতি গ্রাস করে নেয় একসময়। আন্না হাজারে অনশন করেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু তখন কারা যেন ক্ষমতায় ছিল— কংগ্রেস— তাদেরকে সরিয়ে দক্ষিণপন্থীরা দেশটার দখল নেয় পরের নির্বাচনেই। অঙ্কগুলি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে ক্রমশ।
—জাস্টিস পাবে কিনা জানি না দীপ্তি। তবে ওদের ঐক্যবোধটা একদিন-না-একদিন মানুষের বিবেকবোধ জাগাবেই। ওরা নিজেদের জন্যে তো লড়ছে না এই লড়াই। লড়ছে একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে, কোরাপ্ট একটা পচে গলে যাওয়া সিস্টেমের বিরুদ্ধে। যা থেকে পরজীবীর মতো নিজেদের রসদ সংগ্রহ করছে এই রুলিং ডিসপেনসেশন। এত সহজে প্যারাসাইটরা কি নিজেদের এন্টাইটেলমেন্ট ছেড়ে দেবে?
—পুলিশকে আজকাল বড় অসহায় লাগে। ওদের উপর কে ভরসা করবে বলুন?
—পুলিশ, বিশেষ করে নিচুতলার পুলিশ বেশ ক্ষুব্ধ। হতেই হবে। কারণ আনসারাবিলিটি ওদেরই বেশি। পরিবারের কাছে, সমাজে কাছে। ইনফ্যাক্ট, ওরাই সফট টার্গেট এখন। স্যান্ডউইচও। উপর থেকে চাপ আসছে, করতেই হবে! দেয়ার ইজ নো রুলবুক অ্যাট অল। কী ঘটছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। লেট মি অ্যাডমিট দিস।
—ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক, আর কিছু চাই না।
—ঘরটাও যেন দেশটার মতো তাসের ঘর না হয়ে ধসে পড়ে, সেদিকটাও তো দেখতে হবে।
দীপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা থেকে সরে নিজের ঘরে যায়। বৃহৎ শক্তির সঙ্গে লড়ার আগে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা তো লড়ে নিতেই হবে প্রত্যেককে।
***
আজ অষ্টমীর সন্ধ্যা। বাবাই ঘরে ফিরে এসেছে। এসেই স্নান করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। কিচ্ছু খায়নি। দীপ্তিও জোর করেনি। ওর দাদা-দিদিগুলির মা-বাবা তো এসে নিজের সন্তানদের মুখে অন্ন-জল তুলে দিচ্ছেন না। একজন অনশনকারী আজ হাসপাতালে ভর্তি হল। নচিকেতা হাত জোড় করে মা দুর্গার কাছে ভিক্ষা চাইছে, ওদের মন যতটা দৃঢ়, ওদের শরীরগুলিকেও দৃঢ় কর মা গো।