
দেবজিৎ ভট্টাচার্য
“খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে মেয়েদের ভোট, তা যত স্পষ্ট হচ্ছে, ততই মেয়েদের টার্গেট করছে সরকারি প্রকল্প। সারা দেশে খোঁজ পড়েছে, কিসে খুশি হয় মেয়েরা।” এই দুটি বাক্য অনেকটা স্পষ্ট করে বর্তমান শাসকের রাজনৈতিক অর্থনীতির খুঁটিনাটি। এটি লেখা হয়েছে, লেখিকা স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘মেয়েদের ভোট’ বইটির প্রচ্ছদের ও-পারে। লেখিকা তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘মেয়েদের ভোট’-এ লিখছেন, “গরিব মেয়েকে ‘পাইয়ে দেওয়া’-র চারটি প্রকল্প মাঠে নামিয়ে দিলেই মেয়েরা দলে দলে গিয়ে ভোট দেয়, এই কথা এত সহজে বলা যায়, কারণ গরিবকে, মেয়েকে, অপমান করা শহুরে শিক্ষিতদের চিরকালের অভ্যাস।” এ কথা একদমই সত্য, তুলে ধরে এ সমাজের অকেজো বস্তাপচা মতাদর্শের চরিত্র। এইটুকু রাজনৈতিক বোধ নেই রাজনৈতিক দলগুলিরও। তাই ভোটের পাশ-ফেলের অঙ্কে শহরের ‘শিক্ষিত’ বিরোধীদের কাছে শ্রমজীবী মেয়েরা হয় ‘হাজার টাকার খদ্দের’। আর শহরের উচ্চবর্ণের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও শ্রমজীবী মেয়ের বিচার চাওয়া আত্মহত্যার সমতুল্য। ধারাবাহিকতায় এমনই ছবি দেখছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।
মোট ২৪টি প্রবন্ধ-সঙ্কলিত এই বইটিতে লেখিকার অক্লান্ত সাংবাদিক জীবনের ছাপ ফুটে উঠেছে, কলমের কালিতে শ্রমজীবী মেয়েদের সংগ্রামী ইতিহাস ও বর্তমান জীবনযাপন জীবন্ত করে তোলবার মধ্যে দিয়ে। সেই শ্রমজীবী মেয়েদের সংগ্রাম যতটা ব্যক্তিগত তার চেয়ে অধিক রাজনৈতিক। তাই লেখিকার প্রতিটি শব্দ, বাক্যও অত্যন্ত পরিমাণে রাজনৈতিক। অসম্ভব সুন্দরভাবে তিনি দেখিয়েছেন, বাগদার মীন ধরা, চটকল, ইটভাটায় কাজ করা শ্রমজীবী মেয়েদের দাবিগুলি আসলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষারই লক্ষণ। কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী মেয়েদের যৌন হেনস্থা নিয়ে সমাজের ভুরু কুঁচকানো, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ এ-সমাজের উচ্চবর্ণীয় অভিজাতশ্রেণির সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। তাই “অপমানের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়ে, অপমানকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া মেয়ে, অপমানকে বুকে চেপে গুমরোতে থাকা মেয়ে” দেখতে দেখতে সাংবাদিকতার সুদীর্ঘ সময়ের জীবন কাটিয়েছেন লেখিকা।
মেয়েরা যে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ, পিতৃতন্ত্রের শিকল ভেঙে বেরোতে চাইছেন স্বাধীনতার পূর্বতর সময় থেকে তাও তিনি দেখিয়েছেন। তবে তাঁর লেখার সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে দর্শনে, বিকল্প রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে। তাই তাঁর এই বইটি পড়ে দারিদ্র্য নিরসন, নারী-পুরুষের অসাম্য নিবৃত্তির প্রশ্নগুলি আবেগতাড়িত করলেও চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছতে দেয়নি। কারণ, তিনি নিজেই আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক বোধে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বইটির শেষ প্রবন্ধ, ‘তিন স্টেশনের পারে’-তে তিনি লিখেছেন, “প্রথম স্টেশন, ‘বৌঠাকুরাণীর খামার।’ ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়েছিল বটে। তবে ‘লাঙল যার জমি তার’ এই যদি হয় নীতি তাহলে অন্তত সত্তর শতাংশ জমি আজ থাকার কথা মেয়েদের নামে, কারণ তারাই কৃষি-শ্রমিকদের সত্তর শতাংশ।” তাঁর এই দর্শনগত ভাবনা রাজনৈতিকভাবে ভুল। এই স্লোগানের অর্থ বোঝায় যে, লাঙল নেই যার, জমিও নেই তার। আবার জমিও নেই যার, লাঙলও নেই তার। অর্থাৎ সত্তর শতাংশ কৃষিশ্রমিক মেয়েরা হলেও লাঙল অধিকাংশেরই থাকবার কথা নয়। লাঙল কিনতে যে পয়সা লাগে সে পয়সা একজন জমিহীন-কৃষিশ্রমিকের পক্ষে জোগাড় করা কষ্টসাধ্য। ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ প্রবাদবাক্যের সমান। ফলে যে জমিতে সে চাষ করে সেই জমির মালিকানা নেই তাঁর। এই স্লোগানটি যে রাজনৈতিকভাবে দারিদ্র্য নিরসন, নারী-পুরুষের অসাম্য নিবৃত্তির ক্ষেত্রে সঠিক নয়, তা বলা বাহুল্য। এর পরিবর্তে বিকল্প যুক্তিযুক্ত স্লোগান, চাষ যার জমি তাঁর, চাষ যার লাঙল তাঁর— এটি হতে পারে।
লেখিকার সংগ্রাম প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে, তাই তাঁর ভারতের বর্ণসংগ্রামে ইতিহাস অনুসারের অবিচ্ছেদ্য-পিতৃতন্ত্রের চরিত্রের চালচিত্রকে উৎক্ষেপণ করা আশু কর্তব্য। বর্তমান সমাজের শ্রমজীবী মেয়েদের সংগ্রাম যেহেতু ব্রাহ্মণ্যবাদ, ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র, লগ্নি পুঁজির একচেটিয়া একাধিপত্য ও ভোগবাদের চওড়া পিতৃতান্ত্রিক নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে; তাই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের উৎস সন্ধানে ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’র উৎপত্তি-বিষয়ক একটি প্রবন্ধ যোগ করা উচিত ছিল। এটি প্রকাশিত হলে পাঠকের কাছে সমাধানের পথটিও অনেকখানি সাদামাটা, সহজসরল হত। শেষ প্রবন্ধে লেখিকারও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ‘আন্দাজ’ হত না যে, “বিবাহ-বর্জনের চাইতে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়বে বেশি, কারণ বেনারসি, গোড়ের মালা, সানাই ফিশফ্রাই ঘিরে বাঙালি মেয়ের আবেগ সহজে যাওয়ার নয়।” বরং, এসবের সমাধান তাঁর কাছেও আরও পরিষ্কার হত, যা তাঁর লেখার মধ্যেকার রাজনীতির ভেতর থেকে ফুটে উঠত। বইটির রাজনৈতিক ভিত্তি, পরিপক্বতা সাধারণ সমাজকে নতুন রূপে বিকল্পের সন্ধান দিত। যেটি শ্রমজীবী মেয়েদের লড়াইয়ে দিক নির্দেশ ও আত্মরক্ষার্থে ধারালো অস্ত্রের স্বরূপ হয়ে দাঁড়াত, সমাজকে সাম্যময় করবার লক্ষ্যে সমানভাবে ঘরে-বাইরে লড়াইয়ে রাজনৈতিক সাহসের জোগান দিত পারত। বোঝাতে পারত, আসল সমস্যা সমাজের কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে, পিতৃতন্ত্র অবসানে। তবে এ কথা স্পষ্ট, যে, শ্রমজীবী মেয়েরা রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রকল্পের আশায় বেঁচে নেই, তাঁরাও পুরুষের সমান কিংবা পুরুষের চেয়েও বেশি শ্রম দিয়ে সমাজ, সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাষ্ট্র আজ আইনিভাবে মেয়েদের শ্রমশক্তি কিনতে বাধ্য হচ্ছে; যা আবার পুরনো ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থার বুকে আগামীর নতুন গণতান্ত্রিক সমাজকে ক্রমশ বিকশিত (বিবর্তিত) করছে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের অংশগ্রহণ বাড়াতে সক্ষম ভূমিকা নিয়ে চলেছে।