নারী সশক্তিকরণ ও ডঃ লক্ষ্মী গৌতমের কথা

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

বৈষ্ণব তীর্থ বৃন্দাবন। ধর্মানুসারীদের বিশ্বাস অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি। ধর্মীয় মাহাত্ম্যে উজ্জ্বল এক সুপ্রাচীন জনপদ। এমন সুপরিচিতির আড়ালেই ঢাকা পড়ে আছে এক ঘন বিষন্নতা, নিরাপত্তাহীন একদল মানুষীর হৃদয়ের সুগভীর শূন্যতাবোধ থেকে উৎসারিত হাহাকার। বৈষ্ণবতীর্থ বৃন্দাবনের আরও এক পরিচয় – বৃন্দাবন হল সংসার-পরিত্যক্তা অসহায় বিধবা মহিলাদের আস্তানা, যাঁদের সিংহভাগই হলেন একদা আমার আপনার বাংলার‌ই আবাসিক। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিচিত মানুষদের মাঝে যাঁদের ঠাঁই হয়নি, মেলেনি উপযুক্ত সম্মান , নিরাপত্তা ঘরছাড়া প্রবাসী জীবনে তাঁদের সবকিছু মিলবে এমনটা আশা করাই যখন দুঃস্বপ্নের মতো, তখনই তাঁদের উদ্দেশ্যে ভালবাসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এক মরমী অধ্যাপিকা ডঃ লক্ষ্মী গৌতম।

এদেশের তীর্থস্থানগুলোতে বহুসংখ্যক মুমুক্ষু মানুষের ভিড় লেগে থাকে সারাবছর ধরে। এমনটা শুধু একালের প্রবণতা নয়, বহুকালের। সাধারণ তীর্থযাত্রীদের সেই লাগাতার মিছিলে আত্মপরিচয় গোপন করেই মিশে থাকে বহু অশক্ত মানুষ, পরিত্যক্ত অনাথেরা এবং অতি অবশ্যই পতিহারা বিধবা মহিলারা, যাঁরা এই সময়ের সমাজে এক অর্থে ঘোষিত বোঝা। এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই ২০১৩ সালে লক্ষ্মী দেবী তৈরি করেন কনক ধারা নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। উদ্দেশ্য একটাই – ঐ সব মৌন ম্লান মূক মুখে ভাষা জোগানো, বুকে বেঁচে থাকার আশা জোগানো। এবং বয়সকালে ইহলোকের পাট সাঙ্গ করে যখন তাঁরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁদের পূর্ণ মর্যাদায়, প্রয়াতের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী শাস্ত্রীয় বিধি নিয়ম অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করা।

কীভাবে এমন একটি কঠিন কর্মযজ্ঞে সামিল হবার প্রেরণা পেলেন লক্ষ্মী দেবী? তখন তিনি ১০ বছরের এক কিশোরী। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি ঐ বয়সেই ছিল তাঁর গভীর নজর। বাবা ছিলেন এক নামী পণ্ডিত। তাই তাঁদের বাড়িতে সবসময় বহু মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। লক্ষ্মী দেখতেন বহু মহিলা বাবার কাছে আসছেন নানান ধরনের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। তাঁদের অধিকাংশই হলেন বাংলা থেকে যাওয়া ধবধবে সাদা শাড়ি পরা মহিলা। “বাবা! এই মহিলারা কেন এমন করে দলে দলে তোমার কাছে আসেন?” – কিশোরী লক্ষ্মী বাবাকে প্রশ্ন করে। “এসব জটিল বিষয় মা। তুমি এখনও এনিয়ে বোঝার বয়সে পৌঁছোওনি। বড় হ‌ও। সব জানতে, বুঝতে পারবে।” গম্ভীর গলায় বাবা উত্তর দেন।

এতেই ছেড়ে দেবার মেয়ে নন লক্ষ্মী। তিনি মনে করেন তাঁদের এক বাঙালি পারিবারিক বন্ধুর পিসিমার কথা। সাদা কাপড় পড়া অথচ হাসিখুশি পিসিমার সঙ্গে সাদা থান কাপড়ের কোথায় যেন একটা বড় রকমের বিরোধ আছে! মাত্র নয় বছর বয়সে পিসিমার বিয়ে হয় তাঁর থেকে অনেকটাই বেশি বয়সের এক মানুষের সঙ্গে। প্রবাসী মানুষটির সঙ্গে সংসার সামলাতে অভ্যস্ত হবার আগেই একদিন খবর এল তিনি প্রয়াত হয়েছেন ভিনদেশে। রঙিন ডুরে শাড়ি পরা ছোট্ট কিশোরীটি সবকিছু বুঝে ওঠার‌ও সময় পেল না। সধবা থেকে নিমেষেই এক বিধবা হিসেবে তাঁকে দেগে দিল সভ্য সমাজ। সেই পিসিমার কাছেই লক্ষ্মী বৈধব্য দশায় বদলে যাওয়া অন্ধকার জীবনের কথা প্রথম জানতে পারে। মাথাভর্তি লম্বা কালো চুল কেটে ফেলা হল, বন্ধ হল তাঁর বাইরে বেড়ানো, আমিষ খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল সঙ্গে সঙ্গেই। এক স্বপ্নদেখা কিশোরী মেয়ের চোখ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো ভাবী জীবনের সমস্ত রঙিন স্বপ্ন।

মাত্র দশ বছরের লক্ষ্মী এসব বেনিয়মের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার প্রতিজ্ঞা সেদিনই করে ফেললেন। বাল্যবিধবাদের অনেকেই মৃত স্বামীর সংসারে ঠাঁই পায় না। বাপের বাড়ি ফিরে এলেও যোগ্য সম্মান আর ফিরে পাওয়ার প্রশ্ন‌ই নেই। সেখানে

সকলেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। অসহায় এই মানুষগুলো উপায়ান্তর না দেখে গোবিন্দর চরণে ঠাঁই নিতে কষ্টেসৃষ্টে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বৃন্দাবনে এসে হাজির হন। এ এক অনিশ্চিত জীবন। বৃন্দাবনে মঠ মন্দির আশ্রমের তো কোনও অভাব নেই। তাদের কোনও একটিতে আশ্রয় জুটে যায় বটে কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। পরিচিত পরিজনদের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকলেও লোকলজ্জায় সেখানে আর ফিরে যাওয়া হয় না। নিদারুণ গ্লানিকর এক জীবন অতিবাহনের পর আসে সেই অন্তিম ক্ষণ। ইহজীবনের অন্তিম প্রহর। যে মঠ বা মিশনের আশ্রয়ে একরকম ভিক্ষাজীবি হয়ে এতগুলো দিন কাটালেন, বৃদ্ধার মৃত্যুর পর তাঁরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। অন্তত একজনের দায় কমল। এইসব অসহায় মহিলাদের খবর নেওয়ার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে না। সুতরাং চলে যাবার খবরটুকুও কার‌ও ঠিকানা খুঁজে পায় না।

ডঃ লক্ষ্মী গৌতমের কাজ শুরু হয় এখান থেকেই। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি এসেছিলেন বৃন্দাবন সন্দর্শনে। এই অসহায় বিধবাদের নিদারুণ আর্থসামাজিক অবস্থার কথা তাঁর নজরে আসায় বিধবা মহিলাদের এই সমস্যা থেকে কীভাবে খানিকটা রেহাই দেওয়া যায় তা নিয়ে সরকারি প্রয়াসের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। প্রচারমাধ্যমে দিন কয়েকের জন্য হইচই হলেও বৃন্দাবনের অসহায় বিধবাদের নদীর তীরে প্রয়োপবেশনে কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবুও সুপ্রিম কোর্টের সদিচ্ছার জন্যই প্রথম অসহায় বিধবাদের জন্য কিছু সদর্থক ভাবনা চিন্তা শুরু হল। এক নির্দেশনামা মারফত সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে এই সমস্ত বিধবা মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, পুষ্টিকর খাবার ও সুচিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সেইসব পরামর্শের প্রতি সামান্যতম সম্মান প্রদর্শনের সদিচ্ছা সরকারের তরফ থেকে দেখান হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মথুরার সিভিল হাসপাতালের চিফ্ মেডিক্যাল অফিসারকে বলা হয়েছিল হাসপাতালে মৃত দাবিদারহীন মহিলাদের শেষকৃত্য যেন যথাযথভাবে করা হয়। কিন্তু এখানেও গড়িমসি। জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছেও এক‌ই দাবি পেশ করা হয়েছিল যাতে জীবনের অন্তে একটু সমব্যথী ভাবনার প্রকাশ ঘটে সহনাগরিকদের পক্ষ থেকে, তাও জোটেনি।

ডঃ লক্ষ্মী গৌতমের যুদ্ধ ও দ্রোহের সূচনা এই অমানবিকতার অন্ধকারের বিরুদ্ধে নতুন সম্মান আদায়ের – মৃত্যুর পর সমস্ত বিধবা মহিলাদের যথাযথ মর্যাদায় শাস্ত্রীয় রীতিপ্রকরণ মেনে সৎকারের ব্যবস্থা করা। কনকধারা সংগঠনের কাজে পাশে পেলেন তাঁর স্বামী বিজয় গৌতমকে আর তাঁকে ছায়ার মতো আগলে রাখা শিক্ষিকা শাশুড়ি মা, যিনি লক্ষ্মীকে দিয়েছিলেন – স্বামীর পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে না গিয়ে নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করার উপদেশ। এভাবেই নারীত্বের পূর্ণ জাগরণ হোক। শাশুড়ি মায়ের প্রেরণাতেই লক্ষ্মীর পি এইচ ডি পাওয়া, কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করা।

একদিকে ঘরসংসার, আর অন্যদিকে নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুরূহ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। দশভূজা দুর্গা হয়ে একার হাতে সবকিছু সামলে নেওয়া। গলায় ঝোলানো নামজপের ঝুলিতে রাখা তাঁর ফোন ক্লান্তিহীন ভাবে বেজে চলে অসহায় , অনাদৃত মানুষের মৃত্যুর খবর জানিয়ে । খবরটা পৌঁছতে যা দেরি, লক্ষ্মী সটান ছুটে যান অকুস্থলে, উপযুক্তভাবে সৎকারের ব্যবস্থা করেন, সরকারি নথিতে বেওয়ারিশ আখ্যা পাওয়া সেইসব মানুষের। মৃত মানুষটি এর ফলে কতটা শান্তি পাবেন তা লক্ষ্মীর জানা নেই, তবে তিনি অশেষ তৃপ্তি পান এই কাজের মধ্যে। এ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ মৃতদেহের সৎকার করেছেন তিনি কনক ধারার মাধ্যমে। বৃন্দাবনে যে সমস্ত গেরুয়া বসনধারী সাধু আছেন তাঁদের মৃতদেহের কোনও ওয়ারিশ না থাকলে তাঁদের সৎকারের জন্য হাজির কনকধারা।।কোবিডকালীন অতিমারির সময় টানা ৭২ দিন ধরে রান্না করে খাইয়েছেন মথুরার কয়েক শত শিশুদের। মহিলা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি কনকধারার মাধ্যমে। কয়েক শত নাবালিকাকে উদ্ধার করে আবার পরিবারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে এ পর্যন্ত। শুধু নিজে নয় সবাইকে নিয়ে বাঁচার কথাই ভাবতে ভালোবাসেন লক্ষ্মী। আর তাই শেষকৃত্য সম্পন্ন করার মতো দুরূহ দায়িত্ব পালনেও পিছিয়ে যাননি তিনি।

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বিবাহসূত্রে গৌতম পরিবারের বধূ হয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মী। মুখ থেকে ঠিকঠাক কথাও ফুটত না তখন। সংসারের জটিল ঘোর প্যাঁচ সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা ছিল না তাঁর । সেই লক্ষ্মী আজ এক সাড়া জাগানো প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন অসহায় বিধবা তথা নিপীড়িত মহিলাদের জন্য লড়াইয়ের আঙিনায়। সম্পূর্ণ একা এক দ্রোহ লড়ছেন তিনি। বৃন্দাবনের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে আদর করে ডাকে অ্যাঞ্জেল অফ বৃন্দাবন নামে। তাঁর এই অসাধারণ কাজের জন্য মিলেছে সরকারি স্বীকৃতি, পেয়েছেন নারী সশক্তিকরণের কাজে অতুলনীয় অবদানের জন্য নারী শক্তি পুরস্কার।  পুরস্কার প্রাপ্তির পর তাঁর পথ চলা শেষ হয়ে গেছে এমনটা কখনওই মনে করেন না বৃন্দাবনের দি ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল ফিলোসফির এই শিক্ষিকা। তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞে অবিচল থাকতে চান এক নিভৃত পথচারীর মতো। ভারতীয় দর্শন যে তাঁকে শিখিয়েছে এগিয়ে চলার শাশ্বত মন্ত্র — চরৈবেতি, চরৈবেতি। আলোর পথযাত্রী তুমি এখন‌ই থেমো না, এখন‌ই থে মো না, এ খ ন  ই  থে……।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. লক্ষ্মী গৌতম আমাদের চারপাশের মানুষদের থেকে অনেক অনেক স্বতন্ত্র। রোজা আম্মা , লক্ষ্মী দেবী — এরা সত্যিই নমস্য ব্যতিক্রমী । বৃন্দাবনের বাঙালি বিধবাদের এই কৃচ্ছসাধনা বহু দিনের। আরো আরো লক্ষ্মী দেবীর প্রয়োজন। যথার্থই সশক্তিকরণ।

আপনার মতামত...