জলদূষণ এবং মহাকুম্ভ— সঙ্গতি ও অসঙ্গতির দুই রিপোর্ট

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 


প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। শুধু জলের মতো কিছু কার্য-কারণ সম্পর্ক, ধর্ম-রাজনীতি কর্তৃক বিজ্ঞান ও সর্বোচ্চ বিজ্ঞান সংস্থাগুলির কণ্ঠরোধ ও ঢোক গেলানোর ট্র্যাডিশন, ধামাচাপা দিয়ে দেশবাসীর ঐতিহ্যগত বিস্মরণের অভ্যেসকে খানিক চাগিয়ে দেওয়া ছাড়া মহাকুম্ভ ও জলদূষণের লেগ্যাসিটি আর কোনও অর্থ বহন করতে পারল না শেষমেশ। কী হারাল? সুস্বাস্থ্য, সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি অর্থাৎ সুস্থ পরিবেশ পাওয়ার নিরঙ্কুশ অধিকার। এবং আশ্চর্যের এটাই যে, শাসকের সঙ্গে এই ভিশাস সার্কেলের মারণ ট্রাজেক্টরিতে ঢুকে গেল দেশের সাধারণ মানুষের একটা বিশাল অংশ। না জেনেই। না বুঝেই। না তর্ক করেই। এই মারণখেলার শেষ নেই

 

শুরুতেই মহাকুম্ভ-পূর্ববর্তী সাম্প্রতিক ঘটনাপরম্পরাটি বলে নেওয়া প্রয়োজন। জলের স্বাস্থ্যপরিমাপক ‘ইন্ডিকেটর’ ফিকাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ২,৫০০ এমপিএন বা মোস্ট প্রোবাবল নাম্বার। গত নভেম্বরে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা সিপিসিবি-র রিপোর্টে প্রয়াগরাজের সঙ্গমে কলিফর্ম মাত্রা পাওয়া যায় ৩,৩০০ এমপিএন, যা তখনই স্বাভাবিক মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছিল। ঠিক এই অবস্থায় নিপুণ ভূষণের পক্ষ থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গঙ্গার জলদূষণে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগে ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। পিটিশন অ্যাপ্লিকেশন নম্বর ৬৭/২০২৫-এর প্রেক্ষিতে গঠিত হয় জাস্টিস প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে চেয়ারপার্সন করে এবং অন্যান্য দুই সদস্য বিশেষজ্ঞ সদস্য এ সেন্থিল ভেল ও বিচারবিভাগীয় সদস্য সুধীর আগরওয়ালকে নিয়ে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল (এনজিটি)। এই এনজিটি গত ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ একটি নির্দেশিকার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে মহাকুম্ভ চলাকালীন স্থানীয় গঙ্গার জলের বিশদ রিপোর্ট চায়। ১৭ ফেব্রুয়ারি সিপিসিবি প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষার রিপোর্ট দিলেও রিপোর্ট পেশ করতে অপারগ হয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। ফলত, এনজিটি-র থেকে ধমক এবং আরও সাত দিনের সময়সীমা দান। এবং এই ১৭ ফেব্রুয়ারি সিপিসিবি-র প্রথম পর্যায়ের রিপোর্টটি নিয়েই দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের শুরু।

 

সঙ্গমের কাছে ৫টি জায়গা এবং সঙ্গম থেকে দূরবর্তী ২টি জায়গা— মোট ৭টি জায়গার সমীক্ষা নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্যায়ের একটি বিশদ রিপোর্ট পেশ করেছিল কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। রিপোর্টের ডিটেলে আসার আগে এই সাতটি সাইট সম্পর্কে একটু ধারণা করে নিই।

সাইট ১ – সঙ্গমের ৪০ কিলোমিটার আগে শ্রীংভেরপুর ঘাটের গঙ্গা
সাইট ২ – সঙ্গমের ১১ কিলোমিটার আগে লর্ড কার্জন ব্রিজ এলাকার গঙ্গা
সাইট ৩ – সঙ্গমের ৪ কিলোমিটার আগে নাগবাসুকি মন্দিরের কাছে শাস্ত্রী ব্রিজের ঠিক আগের গঙ্গা
সাইট ৪ – মূল সঙ্গমঘাট
সাইট ৫ – সঙ্গমের ঠিক পরেই দীহা ঘাটের গঙ্গা
সাইট ৬ – সঙ্গমের পরে ৫ কিলোমিটার দূরের যমুনা
সাইট ৭ – গঙ্গায় মেশার ঠিক আগে যমুনা

কী কী মাপা হয়েছিল? জলের অম্লত্ব বা পিএইচ, জলের রং (কালার হ্যাজেন ইন্ডেক্স), ডিজলভড অক্সিজেন (মিলিগ্রাম প্রতি লিটার), জলের তাপমাত্রা, টার্বিডিটি (এনটিইউ), কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড বা সিওডি (মিলিগ্রাম প্রতি লিটার), বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড বা বিওডি (মিলিগ্রাম প্রতি লিটার) এবং ফিকাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়া, যা মানুষ ও পশুদের রেচন-বর্জ্য পদার্থ থেকে জলে মেশে। সিপিসিবি-র রিপোর্টে আসার আগে এই সমস্ত উপাদানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটির সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য পরিমাপ বা ‘ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল লেভেল’-গুলিতে চোখ বোলানো যাক। জলের পিএইচ ৬.৫-৮.৫, ডিজলভড অক্সিজেনের লেভেল অন্তত ৩ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার, বিওডি সর্বাধিক ৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এবং রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর উপাদান ফিকাল কলিফর্মের ‘ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল লেভেল’ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ২,৫০০ এমপিএন ও ‘ডিজায়ার্ড লেভেল’ ৫০০ এমপিএন প্রতি ১০০ মিলিলিটার।

১২ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারির ২৪ দিনের মধ্যে ১৩ দিনের ডেটা আছে সিপিসিবি-র প্রথম পর্যায়ের রিপোর্টে। ১২ জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি দিনে একবার করে প্রতিদিন, এবং তার পরে ১৯, ২০, ২৪, ২৮, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি এবং ২, ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি— সিপিসিবি-র প্রথম রিপোর্টে সমীক্ষার ফ্রিকুয়েন্সি মোটামুটি এরকম। প্রসঙ্গত এই ১৩ দিনের মধ্যে ৪টি স্নানের দিন পড়ছে— ১৩ জানুয়ারি (পৌষ পূর্ণিমা), ১৪ জানুয়ারি (মকর সংক্রান্তি), ২৯ জানুয়ারি (মৌনী অমাবস্যা) এবং ৩ ফেব্রুয়ারি (বসন্ত পঞ্চমী)।

৫৫ কোটি মানুষের স্নানের জল গায়ে মাখা সেই প্রথম পর্যায়ের রিপোর্ট কী বলছে? সঙ্গমঘাটে অধিকাংশ দিন পিএইচ বা অম্লত্বের পরিমাণ ৬.৫ থেকে ৮.৫ এবং ডিজলভড অক্সিজেনের পরিমাণ লিটার প্রতি ৫ মিলিগ্রামের বেশি হলেও অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রা ধরা পড়ছে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ও ফিকাল কলিফর্মের পরিমাপে। ১৩ জানুয়ারি বিওডি সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ১৪ জানুয়ারি ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১১,০০০ এমপিএন বা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪.৪ গুণ বেশি। ২০ জানুয়ারি যা ৪৯,০০০ এমপিএন, অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে ১৯.৬ গুণ বেশি।

সিপিসিবি-র প্রথম রিপোর্টে সঙ্গমে ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণের লেখচিত্র (একক এমপিএন প্রতি ১০০ মিলিলিটার)

সঙ্গমের থেকে ৪ কিলোমিটার আগে নাগবাসুকি মন্দিরের কাছে শাস্ত্রী ব্রিজ এলাকায় ফিকাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ ১৩ দিনের ভেতর ৫ দিনই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। ১৫ জানুয়ারি এবং ৪ ফেব্রুয়ারি এর পরিমাণ যথাক্রমে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১৩,০০০ এমপিএন (স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি) ও ১১,০০০ এমপিএন (স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ গুণ বেশি)। সঙ্গমের ১১ কিলোমিটার আগে লর্ড কার্জন ব্রিজের কাছে ১৩ দিনের ভেতর ৪ দিন ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা গেছে। ১৩ জানুয়ারি এই এলাকার বিওডি ৪.২, স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি। সঙ্গমঘাটের ঠিক আগে খোদ যমুনার জলে পরীক্ষায় দেখা গেছে ১৩ দিনের ভেতর ৯ দিনই ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি, বিশেষ করে ১৪ জানুয়ারি এই সংখ্যা ৩৩,০০০ এমপিএন যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। ওল্ড নৈনি ব্রিজ এলাকায় ১৩ জানুয়ারি, ১৪ জানুয়ারি ও ২০ জানুয়ারি ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১১,০০০, ৩৩,০০০ ও ২৩,০০০ এমপিএন— সামগ্রিকভাবে ১৩ দিনের ভেতর ৯ দিনই রিপোর্ট অসম্ভব খারাপ। সঙ্গমঘাটের ঠিক পরে দীহা ঘাটের কাছে পরীক্ষায় দেখা গেছে ১৩ দিনের ভেতর ১০ দিনই জল ফিকাল কলিফর্ম ও বিওডি-র নিরিখে যথেষ্ট খারাপ— ১৩ জানুয়ারি, ১৪ জানুয়ারি ও ২০ জানুয়ারি ফিকাল কলিফর্ম যথাক্রমে ৩৩,০০০ এমপিএন, ১৭,০০০ এমপিএন ও ৭,৮০০ এমপিএন। সঙ্গমের ৩.৮ কিলোমিটার আগে শ্রীংভেরপুরা ঘাটের কাছে ১৩ দিনের ভেতর ৫ দিন ফিকাল কলিফর্ম রিপোর্টে অত্যধিক বেশি মাত্রা পাওয়া গেছে।

সিপিসিবি-র প্রথম রিপোর্টে ওল্ড নৈনি ব্রিজ এলাকায় ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণের লেখচিত্র (একক এমপিএন প্রতি ১০০ মিলিলিটার)

এবং এর পাশাপাশি এসে পড়ে মহাকুম্ভর আশেপাশে ড্রেনগুলির পরীক্ষার রিপোর্ট। জোন্ধোয়াল ড্রেন ও শিবকুটি ড্রেন এবং সাসুর খাদেরি ড্রেনে মহাকুম্ভচলাকালীন বিওডির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৭.৯১, ২৭.৭২ ও ২৭.১৪ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। ১৮ জানুয়ারি জোন্ধোয়াল ড্রেনে ও ১৯ জানুয়ারি সাসুর খাদেরি নদীতে ফিকাল কলিফর্ম ছিল আশঙ্কাজনক ৯.২ X ১০ এমপিএন করে, যা সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য মাত্রা থেকে ৪,০০০ গুণ বেশি। পাশাপাশি ১৮ জানুয়ারি শিবকুটি ড্রেন ও ১৯ জানুয়ারি সাসুর খাদেরির ডিজলভড অক্সিজেনের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ২ ও ১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। যেখানে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য ডিজলভড অক্সিজেন প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৪ মিলিগ্রাম হতেই হবে, সেখানে, এই দুটি ভ্যালু, আরেকবার লিখছি, ১ ও ২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। ভয়ের— রীতিমতো ভয়ের।

সিপিসিবি-র প্রথম রিপোর্টে দীহা ঘাট এলাকায় ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণের লেখচিত্র (একক এমপিএন প্রতি ১০০ মিলিলিটার)

ঠিক এই ধাপেই চাঞ্চল্য। গ্রিন ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে ভর্ৎসনা, পর্ষদের রিপোর্টকে ‘ভুয়ো’ বলে দাগিয়ে দিয়ে মহাকুম্ভের জল স্নান তো বটেই এমনকি পান করার পক্ষেও নিরাপদ বলে দাবি করা যোগী আদিত্যনাথের বাইট।

অতঃপর সিপিসিবি-র দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট। এবং এখানেই টুইস্ট। অবশ্য সেই প্লট টুইস্ট আজকের ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে খুব চেনা, প্রেডিক্টেবল। গ্রিন ট্রাইবুনালকে দেওয়া সিপিসিবি-র ২৮ ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট এনজিটির ওয়েবসাইটে আসে ৭ মার্চ। আশ্চর্যরকম পাল্টে যাওয়া সিপিসিবি-র ভাষা বলছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপোর্টে ফিকাল কলিফর্মের ‘মিডিয়ান ভ্যালু’-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্বের রিপোর্টে মহাকুম্ভর জলকে ‘আনফিট ফর বাথিং’ বলে উল্লেখ করলেও দ্বিতীয় পর্বে সেই জল হয়ে গেল ‘ফিট ফর বাথিং’। এ-ব্যাপারে সিপিসিবি-র যুক্তি কী বলছে? ১২ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি একাধিক সাইটে ফিকাল কলিফর্ম ও বিওডি অস্বাভাবিক বেশি হলেও, সেই বৃদ্ধি গঙ্গার জলের সামগ্রিক চেহারা নয়। দিনের বিভিন্ন সময়ে একই জায়গার রিপোর্ট এবং একই দিনে বিভিন্ন জায়গার রিপোর্টে ভিন্নতা আসায় এই প্রথম পর্যায়ের রিপোর্টে জলের সামগ্রিক চেহারার ছবি ধরা পড়েনি। এই ভিন্নতা জলের স্রোতের ফ্লো-রেট ও মিক্সিং, স্যাম্পল নেওয়ার গভীরতা ও সময়, আপস্ট্রিম হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি— এইসব একাধিক ভেক্টরের ফলে হতে পারে। জলের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক চেহারা একমাত্র ‘মিডিয়ান ভ্যালু’-তেই বোঝা যায়। সিপিসিবি-র দাবি, ফিকাল কলিফর্মের এই ‘মিডিয়ান ভ্যালু’ নেওয়া হয়েছে ১২ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারির ভেতর দশটি শাহিস্নানের সাইটে সপ্তাহে দুবার করে মোট কুড়ি রাউন্ড পরীক্ষা এবং পরবর্তী ‘পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ’-এর পর‌। কী বলছে সেই ‘পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ’? মিডিয়ান‌ ভ্যালু বেরিয়েছে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১,৭০০ এমপিএন, যা ‘ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল লেভেল’ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ২,৫০০ এমপিএন-এর চেয়ে কম, যদিও ‘ডিজায়ার্ড লেভেল’ অর্থাৎ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৫০০ এমপিএন-এর চেয়ে বেশি, যেটুকু বৃদ্ধি ভারতবর্ষের মতো ধর্মীয় উৎসবপ্রধান ও জনঘনত্বপূর্ণ দেশে মেনে নেওয়া যেতে পারে। ডিজলভড অক্সিজেন ও বিওডির এই মিডিয়ান ভ্যালু এসেছে যথাক্রমে ৮.৭ ও ২.৫৬ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার, যা স্বাভাবিক মাত্রায় চেয়ে দৃশ্যতই বেশি এবং কম।

 

যদিও এই আপাত নিরীহ যুক্তির পরেও দ্বিতীয় পরীক্ষার প্যাটার্ন এবং পরিণতিতে থেকে যাচ্ছে অসঙ্গতির পর অসঙ্গতি। এক এক করে আসি:

অসঙ্গতি ১ – কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপোর্টের ফ্রিকুয়েন্সি ফেব্রুয়ারির ৮, ১২, ১৩, ১৭, ২১ ও ২২। অর্থাৎ প্রথমভাগে ২৪ দিনের ভেতর ১৩ দিন সমীক্ষা নেওয়া হলেও পরের ধাপের ২২ দিনে পরীক্ষা করা হল ৬ দিন। দুই পর্যায়ের ভেতর এতটা পার্থক্য কেন?

অসঙ্গতি ২ – প্রথম পর্বে মূল স্নানের দিনগুলির অব্যবহিত পরেই রিপোর্ট নেওয়া হলেও দ্বিতীয় পর্বে ১২ ফেব্রুয়ারি (মাঘী পূর্ণিমা)-র রিপোর্ট থাকলেও ২২ ফেব্রুয়ারির পরের রিপোর্ট নেই, অর্থাৎ আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত ২৬ ফেব্রুয়ারি মহাশিবরাত্রির স্নানের পরের রিপোর্ট। কেন?

অসঙ্গতি ৩ – ৪ ফেব্রুয়ারি নাগবাসুকি মন্দিরের কাছে এবং সঙ্গমে ফিকাল কলিফর্ম যথাক্রমে আশঙ্কাজনক ১১,০০০ ও ৭,৯০০ এমপিএন মাত্র চারদিনের মধ্যে ৮ তারিখ পরীক্ষায় হয়ে গেল যথাক্রমে ২০০ ও ৭৮০ এমপিএন। অর্থাৎ, নাগবাসুকি মন্দিরের কাছে মাত্র চার দিনে প্রবলতম ভিড়ে, স্নানে, আচার অনুষ্ঠানের পর ফিকাল কলিফর্ম বাড়ার বদলে কমে গেল এবং তাও অস্বাভাবিক পাঁচ গুণ! সঙ্গমঘাটে সেই সংখ্যাটি কমে দ্বিগুণ। খুব স্বাভাবিক কি?

অসঙ্গতি ৪ – ১২ ফেব্রুয়ারি গঙ্গায় যমুনা মেশার ঠিক আগে ৩,৩০০ এমপিএন ছাড়া দ্বিতীয় পর্বের রিপোর্টের ছ-দিনে একবারও ফিকাল কলিফর্ম ২,৫০০ এমপিএন পেরোল না। আশ্চর্য নয়?

অসঙ্গতি ৫ – একমাত্র ‘মিডিয়ান ভ্যালু’-ই নদীর জলের সামগ্রিক চেহারা দেয়, এটি প্রথম পর্বে বোঝা গেল না কেন? তখন কেন জলকে ‘আনফিট’ বলা হল? নাকি শাসকের থেকে ধমক খাওয়ার পর বিজ্ঞানের দিকনির্দেশও পাল্টে গেল!

অসঙ্গতি ৬ – দ্বিতীয় পর্বের রিপোর্টে কোনও সাইটেই ফিকাল কলিফর্ম ২,৫০০ এমপিএন পেরোল না। কেন? মিডিয়ান ভ্যালুর এই অতি-তাৎপর্যের সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগসূত্র নেই তো? বিক্ষিপ্তভাবে জলে ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ যখন জলের সামগ্রিক চেহারার কথা বলে না বলে সিপিসিবি-র তত্ত্ব বলছে, তখন স্নানের পিকটাইমে একটিও সাইটে ফিকাল কলিফর্ম লেভেল ২,৫০০ ছাড়ালেই বা কী সমস্যা ছিল? তাহলে কি দ্বিতীয় পর্বের রিপোর্ট পেশ করার সময় কোনওরকম ঝুঁকিই নিতে চায়নি পর্ষদ? ‘মিডিয়ান’ তত্ত্ব আনার সঙ্গে সঙ্গে একক পরীক্ষার রিপোর্টগুলিতেও চালানো হয়েছে চূড়ান্ত তথ্যবিকৃতি বা বিজ্ঞান-গবেষণার পরিভাষায় ‘ইনভেসিভ ম্যানিপুলেশন’?

অথচ খরচাবহুল ওয়েস্টওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো তো কম হয়নি প্রয়াগরাজে। ‘ডাউন টু আর্থ’ পত্রিকার একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে সম্ভাব্য জনবহুল এলাকাগুলি চিহ্নিত করে সেখানে হাইব্রিড গ্র্যানুলার সিকুয়েন্সিং ব্যাচ রিয়্যাক্টর ও টেম্পোরারি সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হলেও লাভ হল না সেরকম। অস্থায়ী সেটলমেন্টগুলিতে বসানো হয়েছিল ডিসেন্ট্রালাইজড ওয়েস্টওয়াটার ট্রিটমেন্ট সিস্টেম এবং ২০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ জলনিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করে উৎসতেই ওয়েস্টওয়াটার কন্ট্রোল টেকনোলজি আয়ত্ত করার চেষ্টা করা হলেও মহাকুম্ভে কাজে দেয়নি এর কোনওটিই। রিয়েল টাইম মনিটরিং সিস্টেম শুরু করা গেলেও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে ধসে পড়ছে বিজ্ঞান। পাশাপাশি বায়োমেডিকেল ও ফিকাল পদার্থগুলিকে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের তৈরি গামা রেডিয়েশন স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি মহাকুম্ভের মতো বিশালাকার মেলায় তেমনভাবে দাগ কাটতে পারেনি মূলত স্কেল-আপ করার ব্যর্থতার জন্য। প্রায় ১ লক্ষ ৪৫ হাজার সংখ্যক টয়লেটের ব্যবস্থা-সহ ১৬০০ কোটি টাকা খরচা করা মহাকুম্ভের স্যানিটেশন ব্যবস্থা অদক্ষ পরিচালন ব্যবস্থা ও অনুপযুক্ত পরিকাঠামোয় সফলতার থেকে অনেকটাই দূরে থেকে গেল। অথচ, যে প্রশ্নগুলি করা হল না, সেগুলি? সঙ্গম-পরবর্তী ডাউনস্ট্রিম শহরাঞ্চলগুলির ফিকাল কলিফর্মের পরিণতি কী হয়েছিল? স্যানিটেশন ব্যবস্থাগুলি কোটি কোটি টাকা খরচার পর বসানো তো হল, তার আগে ফিসিবিলিটি স্টাডি আদৌ করা হয়েছিল কি? স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও নদীর জলের স্বাস্থ্যের যুগপৎ নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা আদৌ কতদূর হয়েছিল সঙ্গমে? ফিকাল কলিফর্ম থেকে দীর্ঘকালীন এবং তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসঙ্কটগুলি কী কী হতে পারে? স্থানীয় জনবসতিকে কি স্যানিটেশন ও জলের স্বাস্থ্য রক্ষা বজায় রাখার ব্যাপারে সজাগ করা হয়েছিল?

 

প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। শুধু জলের মতো কিছু কার্য-কারণ সম্পর্ক, ধর্ম-রাজনীতি কর্তৃক বিজ্ঞান ও সর্বোচ্চ বিজ্ঞান সংস্থাগুলির কণ্ঠরোধ ও ঢোক গেলানোর ট্র্যাডিশন, ধামাচাপা দিয়ে দেশবাসীর ঐতিহ্যগত বিস্মরণের অভ্যেসকে খানিক চাগিয়ে দেওয়া ছাড়া মহাকুম্ভ ও জলদূষণের লেগ্যাসিটি আর কোনও অর্থ বহন করতে পারল না শেষমেশ। কী হারাল? সুস্বাস্থ্য, সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি অর্থাৎ সুস্থ পরিবেশ পাওয়ার নিরঙ্কুশ অধিকার। এবং আশ্চর্যের এটাই যে, শাসকের সঙ্গে এই ভিশাস সার্কেলের মারণ ট্রাজেক্টরিতে ঢুকে গেল দেশের সাধারণ মানুষের একটা বিশাল অংশ। না জেনেই। না বুঝেই। না তর্ক করেই। এই মারণখেলার শেষ নেই। পাশাপাশি প্রশ্ন করার দিকটিও যেন শেষ না হয়। রোমিলা থাপারের ‘ভয়েসেস অফ ডিসেন্ট’ বই থেকে উদ্ধৃত করলে দাঁড়ায়—

If we are to survive into a future that is worth waiting for, then the provision and maintenance of basic human rights will be the first requirement. …. Among the trajectories from the past as recorded in history is the one pointing to the voice of the citizen gradually becoming more audible. When citizens have spoken up, as in recent history, and expressed dissent, the state has often been unable to silence them and has had to hear what they have to say.

ধর্ম-রাজনীতির যৌথ ক্রেনে ক্রমশ উপড়ে যাওয়া দেশের সুস্থ ও বহুমতের সংস্কৃতির মেলবন্ধনের শাশ্বত লেগ্যাসির ক্রাইসিসে, দূষণের মারণ সময়ে, এই প্রশ্নগুলি, এই অসঙ্গতিগুলি তুলে ধরার কণ্ঠস্বরগুলি যেন বেঁচে থাকে…

 

তথ্যসূত্র:

  1. High levels of microbes from human, animal excreta found in river water at Maha Kumbh: report. The Hindu. February 19, 2025.
  2. Improved river water quality post-monitoring, but faecal contamination persists during Maha Kumbh Mela: CPCB report to NGT. ANI. February 18, 2025.
  3. Mishra, Vivek. Maha Kumbh 2025: Rivers’ natural flow is what keeps them clean — but is it enough for Ganga to self-purify? Down To Earth. February 25, 2025.
  4. Mukul, Sushim. How big a health hazard is Sangam water with high level of faecal coliform. India Today. February 19, 2025.
  5. Now, CPCB tells green tribunal Maha Kumbh water fit for bathing. The Hindu. March 8, 2025.
  6. Parsad, Jyoti & Singhal, Sumita. Maha Kumbh 2025: Ganga & Yamuna’s long-term sustainability depends on continuous monitoring, improved wastewater treatment, and public cooperation. Down To Earth. February 21, 2025.
  7. Saigal, Gaurav. Maha Kumbh water quality: NGT raps, UPPCB apologises, submits action taken report. Hindustan Times. February 19, 2025.
  8. Sayantani. Maha Kumbh water was safe to bathe? CPCB’s new report takes U-turn, cites ’variability in data’. Mint. March 9, 2025.
  9. Water Quality at Maha Kumbh 2025. CPCB.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...