
রাসমুসেনের ডায়েরি
উৎসর্গ: ক্নুড রাসমুসেন— গ্রিনল্যান্ড থেকে দূর সাইবেরিয়ায় খুঁজে গিয়েছেন যিনি মানুষের কথা আর গান
পঞ্চম পুনরুদ্ধার
বরফ কুটির থেকে ভেসে আসে গান। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো সমবেত। গুরু ও গম্ভীর শব্দে বাজে কিলাউত। দিনান্তের আলো লেগে অ্যাঙ্গাককের মুখে চকচক করে ওঠে পরিশ্রম, ঘাম। গানের ধুয়ায় দোলে শিকারিসমাজ, শিকারের কাটা মাথা, হারপুন, প্রাণ, ব্রিদিং হোলের নিচে দাড়িওলা সিল, দূরে ওই কুনাক পাহাড়। উইলোর বনে বনে পাতা দুলে ওঠে। প্রাচীন আত্মারা দোলে। মৃত মানুষের তুষারে জমাট রক্ত দুলে উঠে বরফনদীর জলে কায়াকের মতো নিজেদের কবর ভাসায়…
ষষ্ঠ পুনরুদ্ধার
হারানো টুপির খোঁজে যত দূরে যাই, তারও পরে পড়ে থাকে রোদ। দিকহীন, ছায়াহীন তুন্দ্রা অঞ্চল। চোখ বুজে আসে আর বাতাসেরও গতিবিধি চেনা নয়, ক্রূর। কেবল ভাটির দিকে ছুটে যাওয়া স্লেজ বরফের খবর রাখে না। হারানো টুপিটি যদি বরফ-গলানো জলে ভাসে, তাকে দাও নৌকোর মর্যাদা। যে বরফ গলে গেছে তাকে ফের জমে যেতে বলো। অত বেশি খোঁজ নিলে সম্পর্কের সব জল বাষ্প হয়ে যাবে।
সপ্তম পুনরুদ্ধার
যে সময় চলে গেছে তা কি ফিরে আসে? যে বরফ গলে গেছে তার খোঁজে নদী দিশাহারা। ডায়েরির ছেঁড়া পাতা গল্প বলে তাকে। কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে গজিয়েছে উইলোর বন, ক্যারিবু হরিণগুলি ঘাস খেতে আসে। শিকারিসমাজ সেই গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়েছে। শমীবৃক্ষ থেকে যদি তাদের লুকোনো অস্ত্র খসে পড়ে আজ, আবার সে ডায়েরির পাতা খোলা হবে। কাগজের নৌকোগুলি ভেসে যাবে উত্তর বাতাসে…
অষ্টম পুনরুদ্ধার
সুবদির মেঠোপথে হেঁটে গেলে পোলার বিয়ার, যত না অবাক হব, তার চেয়ে বিস্ময়জনক এই জলে ঝুঁকে আসা মেঘমালা। কতদিন বৃষ্টিহীন হয়ে আছে এইসব শিরিষগাছের তলা, খালপাড়, সাঁকো। তলানিতে এসে ঠেকা মাজনা পুকুর আজও কোন জাদুবলে মেঘের আয়না হয়ে যায়? মুখ আর মুকুরের বিনিময় ঘটে যায় বিকেল বেলায়। কার জলে নামো তুমি? কার জন্য একটানা বৃষ্টি পড়ে রাতে? মেঘের স্বরূপ নিয়ে এত বেশি কথাবার্তা রটে, জলের দর্পণখানি তবুও সে মুখের কাঙাল।
নবম পুনরুদ্ধার
আমাদের রঙ্গতামাশা থেকে এসব সমুদ্রতীর নিজেকে গুটিয়ে নেয় যদি। পাহাড়ের অন্য পারে সরে পড়ে বিকেলের রোদ, সিন্ধুঘোটকগুলি ফিরে যায় জলে। হুল্লোড় থামিয়ে দিয়ে আমরাও ফিরে যাব খাঁড়িপথে, আমাদের নিচু গ্রামদেশে। যেখানে লন্ঠন জ্বেলে মাটির কুটিরগুলি অপেক্ষায় আছে। অভাবের থালা থেকে উপচানো অন্ধকারে ততক্ষণে রান্নাঘর ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের হাঁকডাকে আবার জাগবে সব মাটি। এসব সমুদ্রতীর যদি কোনও দিন ফিরে আসে, বোলো, শামুকের খোলে ভরে বালির গভীরে রাখা আমাদের গান। হাসি ও তামাশাগুলি বাতাসে যাতে না উড়ে যায়, পাথর চাপিয়ে রাখা, বুকে…
দশম পুনরুদ্ধার
এসব ডায়েরির পাতা জলে মিশে জল হয় যদি। কিংবা ধরো, জলই যদি হয়ে ওঠে তোমার লেখার খাতা? তুমি তো নদীর জলে কলম ডুবিয়ে লিখবে জীবন? তোমাকে নিবেদন করা প্রশংসার স্তোত্রগুলি, ছেঁড়া ফুল, বেলপাতা, বাতাসের টানে আবর্জনার মতো পাড়ে জমা হবে। সেদিনের স্তব-স্তুতি আজকের জলে ভেসে দুর্গন্ধ ছড়াবে। জলের তলায় শুধু থেকে যাবে ভারি হয়ে ওঠা কাঠামোর খড় বাঁশ, আলকাতরার মতো লেপে দেওয়া অপবাদগুলি। উদ্ধারকারীর দল কুড়িয়ে আনতে পারে কেবল বাঁশের ফ্রেম, পচা খড়, রং-চটা সাজ। কীভাবে ফেরাবে তারা তোমার জীবন? যে জীবন জলে লেখা, জলে মিশে ঘাট থেকে অন্য ঘাটে স্রোতে বয়ে যাবে…
একাদশতম পুনরুদ্ধার
যখন সমুদ্র লিখি, তখন আমারও বুকে ধাক্কা মারে সমুদ্রের ঢেউ। নিজের লেখায় নিজে খড়কুটো হয়ে ভেসে যাই। উভাভনুকের গান মনে পড়ে। এই তবে মহান সাগর? এরই ঢেউ আছড়ে পড়ে কুনাক পাহাড়ে? লেখাকে আঁকড়ে ধরে পাহাড়ের কোলে এসে নামি। লেখাই আমার ঢেউ, লেখাই তরণী। নাহলে কবেই এই পাহাড়ের বুকে মাথা ঠুকে চুরমার হয়ে যেত করোটির হাড়। বরং পাহাড় লিখি। পাহাড় অশান্ত নয়, প্রতিবাদ করবে না, চোদ্দটি পংক্তির মধ্যে বন্ধ করে দিলে ওর সীমা। লিখি আর শব্দগুলি কঠিন পাথর হয়ে চেপে বসে বুকে। তবে কি সাত্দলাজ, আমিও তোমার মতো বোবা হয়ে যাব? আমরা তো নগণ্য মানুষ। পাহাড়েরা সমুদ্রেরা বিপুল, বিশাল। তবু এসো, সাত্দলাজ, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। কিলাউত বাজাও তুমিও, আমিও কলমটাকে গাঁইতি করে ধরি। দেখি আজ পাথর ফাটাতে পারি কি না। আমরা দুজনে মিলে সত্যি করে যেতে পারি কি না আনারুলুঙ্গুয়াকের সেই কথা— প্রকৃতি মহান, কিন্তু তারও চেয়ে মহান মানুষ!
ব্যবহৃত কিছু শব্দ
অ্যাঙ্গাকক: এস্কিমো শাম্যান বা ওঝা; আনারুলুঙ্গুয়াক: এস্কিমোদেশে রাসমুসেনের সহকারিণী; কিলাউত: এস্কিমো বাদ্যযন্ত্র, ড্রামের মতো; উভাভনুক: প্রখ্যাত এস্কিমো মৌখিক কবি, দ্য গ্রেট সি-এর রচয়িতা; সাত্দলাজ: রাসমুসেন-কথিত এক এস্কিমো চরিত্র।